আজ ২৪ সেপ্টেম্বর, বীরকন্যা প্রীতিলতার আত্মাহুতির দিন
আজ ২৪ সেপ্টেম্বর, চট্টগ্রামের বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আত্মাহুতির দিন। একইসাথে অত্যাচারী ইংরেজদের মুখে চপেটাঘাতের দিনও এটি। যদিও সেই দিনটি ছিল ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, তবুও প্রীতিলতার আত্মাহুতি দিবস হিসেবে ২৪ সেপ্টেম্বরকেই ধরা হয়।
সেদিন পাহাড়তলী ক্লাব আক্রমণের পর কলকাতার ইংরেজদের সর্বপ্রধান সাপ্তাহিক 'ইংলিশম্যান' পত্রিকায় এই অভিযানের বিবরণ প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়েছিল, প্রায় ৫৩ জন ইংরেজ নরনারী ঐ আক্রমণে হতাহত হয়েছিল। পত্রিকার সংবাদদাতা প্রীতিলতার শৌর্যবীর্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তার নামের পূর্বে 'অসম সাহসিকা', 'বীর নারী' ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করেছিলেন। তবে, কলকাতার ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের প্রবল প্রতিবাদের কারণে পরবর্তী সংখ্যায় দুঃখ প্রকাশ করে বিশেষণগুলো প্রত্যাহার করা হয়।
বারংবার ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণ
চট্টগ্রামে দুটি ইউরোপিয়ান ক্লাব ছিল। একটি শহরের কেন্দ্রে পল্টন ময়দানের পাশে, যেখানে চব্বিশ ঘণ্টা কড়া সামরিক ও পুলিশ পাহারা থাকত। অন্যটি একটু বাইরের দিকে পাহাড়তলিতে। চট্টগ্রাম শহরের সামান্য দূরে উত্তর-পশ্চিমের পাহাড়গুলোর কোলে ছিল পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব। এখানেও প্রায় সমান পুলিশী সতর্কতা ছিল।
বিপ্লবীদের প্রথম লক্ষ্য ছিল পল্টন ময়দানের ইউরোপিয়ান ক্লাবটি, যা বর্তমানে চট্টগ্রাম ক্লাব নামে পরিচিত। ক্লাবটি আক্রমণ করা হয় ১৮ এপ্রিল ১৯৩০ তারিখে। কিন্তু সেদিন খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় উৎসব গুড ফ্রাইডে থাকায় অভিযান ব্যর্থ হয়। আক্রমণ ব্যর্থ হলেও ইংরেজরা প্রাণভয়ে বেশ কিছুদিনের জন্য নৈশ আনন্দ স্থগিত রাখে। এর কয়েক মাস পর শুরু হয় রেলওয়ে কর্মচারীদের জন্য নির্দিষ্ট থাকা পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবকে শহরের সকল ইংরেজ নরনারীর ক্লাব হিসেবে ব্যবহার করা।
যতক্ষণ ক্লাবটি খোলা থাকতো, ইংরেজ নরনারীরা নৃত্য ও অন্যান্য খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকতেন। সশস্ত্র পুলিশ ক্লাবটিকে চারদিক থেকে পাহারা দিত। প্রতি শনিবার চট্টগ্রামের প্রায় সকল উচ্চপদস্থ শ্বেতাঙ্গ কর্মচারীরা এখানে এসে সমবেত হওয়া শুরু করেন। রেলের সাহেবরা আসতেন, অন্যান্য সাহেবরাও এই ক্লাবকে নিরাপদ ভেবে বিনোদনের জন্য এখানে নাচ-গান করতেন। শাসক শ্রেণির বাঘা বাঘা শ্বেতাঙ্গরাও মাঝে মাঝে পাহাড়তলীতে এসে যোগ দিতেন। সেখানে খানাপিনা, নাচ, গান আর বিপ্লবী আন্দোলন দমনের ষড়যন্ত্র হতো।
দেশীয় কোনো মানুষের পক্ষে সেই ক্লাবের সীমানার কাছাকাছি যাওয়ারও সাধ্য ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই, বিপ্লবীদের পরবর্তী লক্ষ্য হয় পাহাড়তলী ক্লাব।
পাহাড়তলী ক্লাব আক্রমণ
তরুণ বিপ্লবী শৈলশ্বর দে'র নেতৃত্বে ১০ আগস্ট ১৯৩২ তারিখে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণ হয়। কিন্তু সময়মতো সংকেত না আসায় ঐ অভিযান ব্যর্থ হয়। ব্যর্থতার আঘাত সহ্য করতে না পেরে বিপ্লবী শৈলশ্বর দে শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করেন।
কয়েকদিনের মধ্যেই খবর আসে, ২৩ সেপ্টেম্বর পাহাড়তলী ক্লাবে আবার জমজমাট জলসা বসবে। যুদ্ধ জাহাজের বড় সাহেবরা এবং জেলাশাসক এ. এস. হ্যান্ডস উপস্থিত থাকবেন। ফলে বিপ্লবীদের প্রধান নেতা মাস্টারদা সূর্য সেন নতুন একটি দলের ওপর এই দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মেয়েরা অনেকদিন ধরে এসব অভিযানে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে আসছিল। তাই তিনি তাদের যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন।
মাস্টারদা এবং তার দল পরিকল্পনা নিতে থাকেন। এরই মাঝে ১৯৩২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর কল্পনা দত্ত পুরুষের পোশাক পরে মাস্টারদার কাছে আসার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। সে সময় মাস্টারদা এবং প্রীতিলতা কাট্টলীর একটি বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন। কল্পনা দত্ত গ্রেপ্তার হওয়ার পরও অভিযানের পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়নি।
২৩ সেপ্টেম্বর ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দিন নির্ধারিত হয়। প্রীতিলতা অভিযানের নেতৃত্ব দেন। তার সাথে ছিলেন শান্তি চক্রবর্তী, কালী দে, প্রফুল্ল দাস, সুশীল দে, মহেন্দ্র চৌধুরী, বীরেশ্বর রায় এবং পান্না সেন।
অভিযানের আগে কয়েকদিন ধরে রাত্রে কাট্টলীর সাগরতীরে তাদের অস্ত্রশিক্ষা চলতে থাকে।
অভিযানে অন্যতম সহায়তাকারী ছিলেন ইউরোপিয়ান ক্লাবের একজন মুসলিম বাবুর্চি, যিনি নিকটস্থ গ্রামের এক চাষির ছেলে। ক্লাবের দরজা-জানালার সংখ্যা, প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণ পথ, নাচগানে লিপ্ত থেকে কখন ইংরেজ অফিসাররা পানোন্মত্ত হয়ে কিছুটা অসতর্ক হবেন এবং ক্লাব পাহারায় নিযুক্ত সশস্ত্র পুলিশ বা সৈনিকের সংখ্যা কত—এ সমস্ত তথ্য বিপ্লবীদের সঠিকভাবে জানিয়ে সাহায্য করেন তিনি। তাছাড়া, আক্রমণের দিন রান্নাঘরের ছোট জানালা থেকে টর্চের আলো দিয়ে বিপ্লবীদের কীভাবে আক্রমণ শুরু করার সংকেত দেবেন, তাও তিনি বলে দিয়েছিলেন।
তবে এ বিষয়ে বইপুস্তকে কিছু দ্বিমত রয়েছে। পূর্ণেন্দু দস্তিদারের 'বীরকন্যা প্রীতিলতা' বইতে মুসলিম বাবুর্চির কথা উল্লেখ থাকলেও, শংকর ঘোষ সম্পাদিত 'প্রীতিলতা' বইতে অভিযানের অন্যান্য বিপ্লবীদের স্মৃতিচারণায় পাওয়া যায় অন্য এক সাহায্যকারীর নাম। তিনি ছিলেন যোগেশ মজুমদার (বিপ্লবীদের দেওয়া তার গোপন নাম ছিল জয়দ্রথ)। তিনিও ছিলেন ক্লাবের কর্মচারী।
যেভাবে হয়েছিল অভিযান
দিন গুণতে গুণতে চলে আসে চূড়ান্ত দিন—১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, শনিবার। যথারীতি সব ইউরোপিয়ান মেম-সাহেবরা প্রমোদভবনে এসে জড়ো হন আনন্দ ফূর্তিতে। আনুমানিক ৪০ জন তখন ক্লাবঘরে উপস্থিত ছিলেন। ক্লাবের মধ্যে ছিল একটি বড় নাচের হলঘর আর একটি বিলিয়ার্ড খেলার ঘর। শান্তি সেন তার 'প্রীতিলতা' বইতে লিখেছেন, 'সেদিন হলঘরটিতে পিয়ানো, স্যাক্সোফোন ও ড্রামের মিলিত আনন্দ সংগীত চলছিল। একজন শ্বেতাঙ্গ হুইস্কির গ্লাস নিয়ে নাচের ভঙ্গিতে ঘরময় ঘুরে চলেছেন। চার-পাঁচ জোড়া শ্বেতাঙ্গ নারী-পুরুষ অন্যমনস্কভাবে নেচে চলেছে। মদ্যপানের জন্য উঁচু টুলে বসা কয়েকজন সাহেব বোধহয় টহলদারী ফৌজের বুটের আওয়াজ শোনার চেষ্টা করছিলেন। বিপ্লবী সাথী যোগেশ তখন অভ্যর্থনা অঙ্গনে বসেছিলেন।'
এদিকে বিপ্লবীরা সবাই প্রস্তুত। প্রীতিলতার পরনে ছিল পুরুষদের মতো করে মালকোচা দেওয়া ধুতি, মাথায় গৈরিক পাগড়ি, গায়ে লাল ব্যাজ লাগানো শার্ট। পায়ে ছিল মোজা ও বাদামি রঙের ক্যানভাসের রাবার সোলের জুতো। দীর্ঘ কেশরাশিকে সুসংবদ্ধ করে সামরিক কায়দায় পাগড়ি বাঁধা হয়েছিল। ইউরোপিয়ান ক্লাবের পাশ দিয়ে যেতে হবে বলেই তাকে পাঞ্জাবী ছেলেদের মতো পোশাক পরানো হয়।
অভিযানে অংশ নেওয়া কালীকিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস ও শান্তি চক্রবর্তীর পোশাক ছিল ধুতি আর শার্ট। মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে এবং পান্না সেন পরেছিলেন লুঙ্গি আর শার্ট। সকলের পায়ে ছিল রবার সোলের কাপড়ের জুতো। খাকি সামরিক পোশাকে সজ্জিত প্রীতিলতার কোমরে চামড়ার কটিবন্ধে ছিল গুলিভরা রিভলভার ও চামড়ার খাপে রাখা গোর্খা ভোজালি। অন্যান্য বিপ্লবীর হাতে ছিল অস্ত্রাগার থেকে দখল করা রাইফেল, কোমরে রিভলভার ও ভোজালি, কাঁধে ঝোলানো বোমা।
সর্বাধিনায়ক সূর্য সেনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এই অভিযাত্রীদল পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের জন্য যাত্রা করল। প্রীতিলতা সবার শেষে তাকে প্রণাম করে বিদায় নেন, তারপর সাথীদের নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যান।
রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫। পরের দিনের পত্রিকায় রাত এগারোটার কথাই লেখা হয়েছিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাবের কাছাকাছি পূর্বনির্ধারিত স্থানে এসে দলটি অবস্থান নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিলিয়ার্ড হলের দিকে অবস্থান নেন বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস ও পান্না সেন। ক্লাবঘরের হলঘরের সামনে থাকেন প্রীতিলতা, কালীকিংকর দে ও শান্তি চক্রবর্তী। সামনের দিকের দরজা-জানালা আগলে রাখেন সুশীল দে ও মহেন্দ্র চৌধুরী।
নিজ নিজ অবস্থান বুঝে নিয়ে তারা যোগেশের টর্চলাইট সংকেতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। পরিকল্পনা ছিল, ক্লাবঘর থেকে তিনবার টর্চের আলো জ্বলবে এবং নিভবে। তিনবারের পরেই আক্রমণ শুরু হবে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেখা গেল সেই সংকেত। নিশানা দেখানোর সাথে সাথেই তিনদিক থেকে শুরু হয়ে গেল ক্লাব আক্রমণ।
হঠাৎ উচ্চ বিস্ফোরক পিকরিক অ্যাসিডে ভরা একটি বোমা বজ্রের মতো ভয়ংকর শব্দে হলঘরে ফেটে পড়ে। প্রীতিলতা, চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অভিজ্ঞ অংশীদার কালি দে এবং শান্তি চক্রবর্তী ওয়েবলি রিভলভার, বোমা ও তরবারি নিয়ে হলঘরের সামনে দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। বীরেশ্বর রায়ের হাতে ছিল ৯ ঘোড়া পিস্তল, আর প্রফুল্ল দাস ও পান্না সেনের হাতে ছিল রাইফেল ও হাতবোমা। তারা বিলিয়ার্ড ঘর অবরোধ করে দাঁড়ান। ওয়েবলি রিভলভার হাতে মহেন্দ্র চৌধুরী এবং সুশীল দে আরেকটি দরজার মুখে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন।
অদম্য যোগেশ ঘরের ভেতর থেকেই তার শক্তিশালী বাহু দিয়ে সাহেবদের মাথায় মুগুরের মতো আঘাত করতে থাকেন। মদ্যপ সাহেব-মেমদের আর্তচিৎকারে প্রমোদক্লাব সে রাতে এক বিভীষিকাময় দক্ষযজ্ঞে পরিণত হয়। এর মধ্যেই বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে যায়, এবং ঘন অন্ধকারে পালানোর চেষ্টা করা কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ বেয়নেট ও তরবারির মুখোমুখি পড়েন। কমান্ডোরা ক্লাব ছেড়ে যাওয়ার আগে সেখানে বিলম্বে বিস্ফোরিত হওয়ার জন্য তিনটি বোমা রেখে যান (শান্তি সেন, প্রীতিলতা, পৃ. ১৪৬)।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ক্লাব থেকে কিছু দূরে নিরাপদ স্থানে ইস্তাহার বিতরণকারীরা অপেক্ষা করছিলেন। আক্রমণের শব্দ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা শহরে ছুটে গিয়ে চার ধরনের ইস্তাহার বিলি করেন (কালীকিংকর দে, ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ, পৃ. ১৩৭)।
পটাসিয়াম সায়ানাইড খাওয়াই ছিল তার মৃত্যুর কারণ
কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রীতিলতা তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্ন করে হুইসেল বাজিয়ে সবাইকে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন। সামরিক নিয়ম অনুযায়ী, আক্রমণের সময় নেতা সবার আগে থাকবেন এবং ফিরে আসার সময় সাথীদের আগে নিরাপদে পাঠিয়ে নেতা পেছনে আসবেন। এই নিয়মে, সাথীদের এগিয়ে দিয়ে বিজয়িনীর গর্বে প্রীতিলতা ক্লাবের সামনে রেলের বড় সড়কে উঠে আসেন।
আক্রমণের সময় ক্লাবে উপস্থিত অফিসাররা বিভিন্ন দরজা দিয়ে পালিয়ে যান। এক ইংরেজ যুবক ক্লাবের পাশের নালার মধ্যে লম্বা হয়ে শুয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হন। তিনি লক্ষ্য করেন, বিপ্লবীরা তাদের কাজ শেষ করে ফিরে যাচ্ছেন।
সবার পেছনে পাগড়ি মাথায় সামরিক পোশাকে প্রীতিলতা একা একা রাস্তা পার হয়ে প্রায় পৌঁছে যান পাহাড়তলী রেলওয়ে কারখানার উত্তরদিকে পায়ে হাঁটার পথে। সেখান থেকে কাট্টলী গ্রামে পৌঁছানো সময়সাপেক্ষ ছিল না। প্রীতিলতার সাথী সাতজন বিপ্লবী ঐ পথ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, গোপন আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে তাদের সাফল্যের সংবাদ দেবেন প্রধান নেতাকে।
এমন সময় নালার মধ্যে থেকে একটি গুলি এসে প্রীতিলতার বুকে আঘাত হানে, এবং তার রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সাথীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়ে নিজেও প্রায় পাঁচশত গজ এগিয়ে এসেছিলেন। শেষ মুহূর্তে তিনি পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সাথী কালীকিংকর দে'র হাতে নিজের আগ্নেয়াস্ত্রটি দিয়ে বললেন, 'কালীদা, আপনার সায়ানাইডটুকু আমাকে দিন, আমারটুকু আমি খেয়েছি।' এ কথা বলেই তিনি লুটিয়ে পড়েন। সাথী কালীকিংকর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাকে সায়ানাইড খাইয়ে দেন। এরপর সকলে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে চলে যান। ফিরে আসেননি একমাত্র প্রীতিলতা (প্রীতিলতা, পৃ. ১৪২)।
পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে বিপ্লবীরা শ্রদ্ধা জানিয়ে স্থান ত্যাগ করেন। পরদিন পুলিশ ক্লাব থেকে ১০০ গজ দূরে তার মরদেহ খুঁজে পায় এবং পরবর্তীতে তাকে সনাক্ত করে। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা মরদেহটির পুরুষের মতো পোশাক দেখে তারা ধারণা করতে পারেনি যে এটি কোনো নারীর দেহ। মাথার পাগড়ি খোলার পর তার দীর্ঘ কেশরাশি দেখে তারা বুঝতে পারে।
মরদেহ তল্লাশি করে বিপ্লবী লিফলেট, অপারেশনের পরিকল্পনা, রিভলভারের গুলি, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি এবং একটি হুইসেল পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তে জানা যায় যে গুলির আঘাত তেমন গুরুতর ছিল না; বরং পটাসিয়াম সায়ানাইড খাওয়াই ছিল তার মৃত্যুর কারণ।
যখন বিপ্লবীদের এমন কোনো অভিযানে পাঠানো হতো, তখন তাদের সঙ্গে অনেক সময় তীব্র বিষ 'পটাসিয়াম সায়ানাইড' এর ছোট মোড়ক দেওয়া হতো। গুরুতর আহত অবস্থায় শত্রুপক্ষের হাতে পড়ে যদি লাঞ্ছনা বা নির্যাতনের ভয়ে কোনো বিপ্লবীর মনে দূর্বলতার উদয় হতো, এবং ভুলক্রমে দলের কোনো গোপন তথ্য প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকত, তখন নিজ হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আত্মহত্যা করতে হতো। যদি সেটা সম্ভব না হতো, তখন ঐ প্রাণঘাতী বিষ খেয়ে মৃত্যুবরণ করতে হতো। এ বিষ খেলে কয়েক সেকেন্ডেই মৃত্যু নিশ্চিত। বিশেষ করে, নারী বিপ্লবীদের এই নির্দেশনা বিশেষভাবে দেওয়া হতো, যাতে তারা কোনো নৃশংস অত্যাচারের শিকার না হন।
আট বিপ্লবী ওই অভিযানে অংশ নিয়ে ৫৩ জন ইংরেজকে হতাহত করেছিলেন বলে অনেক জায়গায় উল্লেখ আছে। তবে অন্যত্র বলা হয়েছে, সে রাতে ক্লাবে প্রায় ৪০ জনের মতো ইংরেজ ছিলেন। ১৯৩২ সালের ২৭ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকার একটি লেখায় বলা হয়েছিল, ৮ জন পুরুষ ও মহিলার মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা গুরুতর ছিল। আবার কোনো কোনো সূত্রে ১৪ জন হতাহতের কথা বলা হয়েছে। এই তথ্যগুলো নিয়ে বেশ গোলযোগ রয়েছে। তবে অধিকাংশ জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, পাহাড়তলী আক্রমণে জনৈক ৬০ বছর বয়সী ইউরোপীয় মহিলা, মিসেস সুলিভান, ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এছাড়া ইন্সপেক্টর ম্যাকডোনাল্ড, সার্জেন্ট উইলিস, এবং বন্দরের এক জাহাজ কর্মী মি. চ্যাপম্যান আহত হন। আহতদের অধিকাংশই রেল কর্মচারী ছিলেন। আহত ও নিহতদের পরিবারবর্গের সাহায্যার্থে ইউরোপীয় অ্যাসোসিয়েশন সে সময়ে একটি রিলিফ ফান্ডও খুলেছিল। সরকারও শাস্তিমূলক কর বসিয়ে জনগণের কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা সংগ্রহ করেছিল।
আজও শুরু হয়নি সংরক্ষণের কাজ
ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে চলে যাওয়ার পর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সেমিপাকা ঘরটি রেলওয়েকে হস্তান্তর করে। বর্তমানে রেলের পূর্বাঞ্চলের একটি বিভাগের এক প্রকৌশলীর দপ্তর হিসেবে পুরোনো ইউরোপিয়ান ক্লাবটি ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও ক্লাবের মূল ভবনটি তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। ভাঙা কাচের জানালা দিয়ে দেখে বোঝা যায়, ভবনটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
ক্লাবের পেছনের দিকে যে ঘন জঙ্গলঘেরা পাহাড় ছিল, সেটি এখন আর অবশিষ্ট নেই। পাহাড়তলীর মূল রাস্তার ওপর দিয়ে সিএনজি, অটোরিকশা, দূরপাল্লার বাসসহ মানুষের অবাধ যাতায়াত চলছে। এই ব্যস্ত রাস্তার মাঝেই নিশ্চুপ ও স্থির হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ইউরোপিয়ান ক্লাবটি। রাস্তায় খুব কাছাকাছি হলেও, ভবনটি ভেতরের দিকে হওয়ায় খেয়াল না করলে একতলা লাল ইটের এই ভবনটি চোখে পড়ে না। বিশেষ করে, রাতের বেলায় পুরো জায়গাটি অন্ধকারে ঢেকে থাকে। ক্লাবটির উপরে নিভুনিভু একটি বাতির আলোয় ইংরেজি অক্ষরে লেখা 'ইউরোপিয়ান ক্লাব, চট্টগ্রাম' নামটিও চোখে না পড়ার মতো।
ভাবতে অবাক লাগে, ৯২ বছর আগে যে ঘরটির গায়ে লেখা ছিল 'ডগস অ্যান্ড ইন্ডিয়ানস আর প্রহিবিটেড', সেই ঘরটি আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে পড়ে আছে। পাশের ব্যস্ত সড়ক দিয়ে অসংখ্য মানুষের আনাগোনা, অথচ তাদের কাছেও এটি কেবল একটি পুরোনো ধ্বংসাবশেষ।
২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে 'বীরকন্যা প্রীতিলতা' ভাস্কর্য উন্মোচন করা হয়। ব্রোঞ্জের তৈরি এ ভাস্কর্যের নকশা প্রণয়ন করেন ভারতের বিখ্যাত ভাস্কর অধ্যাপক গৌতম পাল। চট্টগ্রামবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অর্থায়নে ক্লাবের সামনের সড়কদ্বীপে এ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। তবে এ ছাড়া ক্লাবটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
২০১৮ সালে ক্লাবটি 'বীরকন্যা প্রীতিলতা জাদুঘর' নামে পরিচিতি পেলেও, সেখানে কিছুই সংরক্ষিত নেই। ২০২০ সালে সরকারি অনুদানে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস 'ভালোবাসা প্রীতিলতা' অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রের শুটিংও ক্লাবটিতে হয়েছে। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন প্রদীপ ঘোষ। গণমাধ্যমেও প্রীতিলতা ও এই ক্লাব নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বীরকন্যা প্রীতিলতা ট্রাস্টের সভাপতি পঙ্কজ চক্রবর্তীসহ অনেকে দীর্ঘদিন ধরে ক্লাবটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। রেল মন্ত্রণালয়ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে, তবে তা এখনো কার্যকর হয়নি।