অবসরে যাওয়া উড়োজাহাজের দ্বিতীয় জীবন: যেভাবে বৈশ্বিক এভিয়েশন শিল্পকে সচল রাখছে
২০২৪ সালের এপ্রিলের কোনো এক সুন্দর সকালে মুম্বাই বিমানবন্দর থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার ৭৪৭-৪০০ মডেলের আগ্রা নামের বিমানটি উড়ে যায়। বিমানটি যখন মাটি ছেড়ে ঘন জনবহুল শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল তখন কিছুটা ভীতিকর পরিস্থিতি হয়। মহামারির কারণে বিমানটি দীর্ঘ তিন একজায়গায় স্থবির পড়েছিল। দীর্ঘ তিন বছর পর যখন এটি চলা শুরু করে এর বিশাল ডানা বিপজ্জনকভাবে একবার ডান দিকে এবং একবার বাম দিকে হেলে পড়ছিল। পরে অবশ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং স্বাভাবিকভাবেই বিমানটি আরব সাগরের উপর দিয়ে উড়ে গিয়েছিল।
বিমানে আরোহীদের জন্য মুহূর্তটি ছিল একইসঙ্গে মনোমুগ্ধকর ও দুঃখের। কারণ সেদিন বিমানটির উইং ওয়েভের দিন। অর্থাৎ যাত্রী নিয়ে বিমানটির এটিই শেষ উড়াল। প্রায় এক শতাব্দীর চারভাগের এক ভাগ অর্থাৎ প্রায় ২৫ বছর আগ্রা বিভিন্ন পরিবারকে তার আপনজনদের কাছে, ছাত্রদের নতুন জীবনের পথে এবং উদ্যোক্তাদের নতুন বিনিয়োগের সন্ধানে নিয়ে গেছে। এছাড়া বিমানটি প্রধানমন্ত্রীদের শীর্ষ সম্মেলনে, হাজীদের মক্কায় এবং মহামারির সময়ে বিপদে পড়া নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে এটি ১৩,০০০ এরও বেশি ফ্লাইট সম্পন্ন করেছে এবং আকাশে ৬৩ হাজার ১২০ ঘণ্টা কাটিয়েছে। তার শেষ গন্তব্য আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমের মরুভূমি, নিউ মেক্সিকোর রোসওয়েলে। তবে বিমানটির আগ্রা হিসেবে যাত্রা শেষ হলেও, তার একটি পরবর্তী জীবন রয়েছে। তার এ জীবন বৈশ্বিক বিমান চলাচলকে সচল রাখার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
একটি বোয়িং ৭৪৭-এ প্রায় ছয় মিলিয়ন যন্ত্রাংশ রয়েছে, যেগুলো পুনঃব্যবহারযোগ্য। যদিও যন্ত্রাংশগুলোকে সার্টিফাইড হতে হয় এবং তাদের পূর্ণাঙ্গ রক্ষণাবেক্ষণ ইতিহাস থাকতে হয়, অন্যথায় তাদের উৎস সন্দেহজনক হলে তাদের দাম পড়ে যায়।
মজবুত দেখানো বাইরের আবরণ আসলে এক মিলিমিটারের পাতলা অ্যালুমিনিয়ামের অ্যালোয়ে দিয়ে তৈরি পাতলা ধাতব কাঠামো যা আসলে বিমানের চামড়া। এর ভেতর ফোম দিয়ে একে নিরোধক করা হয়েছে। এ পাতলা ধাতব কাঠামোটি সংগ্রহ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান হলো প্লেন ট্যাগস। তারা এ ধাতব কাঠামো সংগ্রহ করে চাবির জন্য চেইন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের স্মারক আইটেম তৈরি করে থাকে।
বিমানের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ হল ইঞ্জিন, যা সাধারণত প্রথমে সংগ্রহ করা হয়। ডেলটা এয়ারলাইন্সের মাইক ম্যাকব্রাইড এ বিষয়ে বলেন, "যখন একটি বিমান অবসর নিতে শুরু করে, তখন আপনি ইঞ্জিনের জীবনের মেয়াদ বাড়াতে এর সঙ্গে আরও অনেক জিনিস একত্রিত করতে পারেন।"
আবার ককপিটের যন্ত্রপাতিও একইভাবে পুনঃব্যবহার করা যেতে পারে। কখনও কখনও পুরো ককপিটটিকে পাইলট প্রশিক্ষণের জন্য একটি সিমুলেটর হিসেবে পুনরায় ব্যবহৃত করা হয়।
এছাড়া বিমানের সিট ও কার্পেট প্রতি আট-দশ বছরে পরিবর্তন করা হয়। ফার্স্ট-ক্লাসের সিটগুলো অন্য এয়ারলাইন্সগুলো কাছে বিক্রি করা হয়। আবার কেউ শখের বসেও এসব সিট কিনে নেন। তবে বিমানের ইকোনোমি সিটগুলো আকাশে যেমন কম চাহিদা সম্পন্ন ঠিক তেমনি মাটিতেও এর চাহিদা কম।
এয়ারলাইন্সগুলো নিয়মিতভাবেই পুরোনো বিমানগুলো সরিয়ে নতুন বিমান সংগ্রহের চেষ্টা করে। তবে এর পেছনের কারণ বিমান উড্ডয়নযোগ্যতার সঙ্গে খুব কমই সম্পর্কিত। একটি বোয়িং ৭৪৭-৪০০ বিমানগুলো তাদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে দ্বিগুণ ঘণ্টা বা প্রায় তিনগুণ বেশি সফর করতে পারে, যেমন- আগ্রা উড়েছে। তবে এটি এমন একটি শিল্প যা অত্যন্ত ক্ষুদ্র মার্জিনে কাজ করে এবং পরিবেশগতভাবে টেকসই না হওয়ার জন্য প্রায়ই অভিযুক্ত হয়। বিমানের জীবন এবং মৃত্যু কঠোর ব্যবসায়িক হিসাবের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।
একটি নির্দিষ্ট ধরনের বিমান অপারেশন বন্ধ করার সবচেয়ে বড় কারণগুলো হলো গ্রাহকের প্রত্যাশা, খরচ এবং হিসাবনিকাশ। অবাক করার মতো হলেও সংকুচিত সিট স্পেস এবং ব্যাগ রাখার সম্মতি কিংবা যাত্রীদের সুস্থতা এসব এয়ারলাইনগুলোর অগ্রাধিকার তালিকায় একদম শেষে রয়েছে। এরপরও বিমানে চলাচল করা আগে থেকে অনেক আরামদায়ক হয়েছে এবং অনেকের জন্য গুরুত্বপূর্ণও।
দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার জন্য তৈরি নতুন প্রজন্মের বিমান বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার এবং এয়ারবাস এ৩৫০ এর শব্দ অনেক কম এবং এটি টার্বুলেন্সের মধ্যেও অন্যগুলোর তুলনায় বেশ ভালো স্থির থাকে। এই নতুন বিমানগুলো আর্দ্রতা স্তর পরিমাপ করতে সক্ষম, যা যাত্রীদের ডিহাইড্রেশন হওয়ার সম্ভাবনা কমায় এবং কেবিনের প্রেসারও ভূপৃষ্ঠের মতোই অনুভূত হয়। এয়ার ইন্ডিয়ার নতুন ফ্ল্যাগশিপ বিমান এ৩৫০-এ সাধারণ শ্রেণির যাত্রী ৭৪৭-এর মেনুতে থাকা সুপ্রিম ডে পুলেট আ লা ইম্পেরিয়াল, পমস আ লা সাভোইয়ার্ড এবং হ্যারিকট ভের্স অ আ বাটার উপভোগ না করতে পারলেও, গন্তব্যে পৌঁছানোর পর তিনি তাজা অনুভব করবেন।
নতুন প্রজন্মের বিমানগুলো আরও বেশি দক্ষ। যেকোনো এয়ারলাইন্সের জন্য জ্বালানি হলো সবচেয়ে বড় খরচ। ইঞ্জিন ও বিমানের ওজনই নির্ধারণ করে যে বিমানটির কতটুকু জ্বালানি প্রয়োজন। আধুনিক বড় বিমানগুলো মধ্যে বোয়িং ৭৪৭ অথবা বিশাল এয়ারবাস এ৩৮০ ডাবল-ডেকারের চারটি ইঞ্জিনের পরিবর্তে দুটি ইঞ্জিন রয়েছে, এবং অনেকাংশে বিমানের কাঠামো হালকা কম্পোজিট উপাদান যেমন কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি, যা ভারী অ্যালুমিনিয়াম অ্যালোই-এর পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়। এয়ারবাস দাবি করে যে, এ৩৫০ পূর্বসূরিদের তুলনায় প্রতি আসনে ২৫ শতাংশ কম জ্বালানি খরচ করে।
তারপর রয়েছে এয়ারলাইনের হিসাবরক্ষকদের রহস্যময় কার্যক্রম, যারা পাইলটদের মতো পদার্থবিদ্যার নিয়মের দ্বারা আবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ) নামে একটি শিল্প সংস্থা জানিয়েছে, বিমান অধিগ্রহণ এবং অবমূল্যায়নের হিসাব 'জটিল' এবং এয়ারলাইন বিষয়ক বিচারবুদ্ধির প্রয়োজন। সরলীকৃত সংস্করণ হল যে, একটি বিমানের পৃথক অংশগুলি শেষমেশ তাদের সমষ্টির চেয়ে বেশি মূল্যবান হতে পারে। অথবা সবচেয়ে ব্যাপক বাধ্যতামূলক রক্ষণাবেক্ষণ চেকগুলোর খরচ একটি বিমানের বুক মূল্যকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাই তখন বিক্রি করা ভালো।
বাহ্যিক কারণগুলোও বিমানের জীবনচক্রে প্রভাব ফেলতে পারে। বর্তমানে বাণিজ্যিক বিমান চালনা শিল্পে চাহিদার বিস্ফোরণ হয়েছে। কিন্তু আগের অর্ডারের নতুন বিমান তৈরি করতেই প্রস্তুতকারকদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। এদিকে অনেক বিমানের ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা যাচ্ছে। তাই কিছু এয়ারলাইন্স পুরোনো জেটগুলোই দীর্ঘ সময় উড়াচ্ছে অথবা বাদ দেওয়া বিমানগুলোই পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে আসছেন। বিপরীতে মহামারির সময়ও অনেক বিমানকে অবসরে পাঠাতে হয়েছে। যেমন- ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ তার ৩১টি বোয়িং ৭৪৭ বিমানের ফ্লাইট এ বছর পর্যন্ত চালানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু কিন্তু জুলাই ২০২০ সালে তারা বিমানগুলো বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতের এয়ার ইন্ডিয়া এয়ারলাইন্সের ৭৪৭ মডেলের বিমান আগ্রা ২০২১ সালের মার্চে শেষ ফ্লাইট পরিচালনা করে।
আকাশে ওড়ার কাজ থেকে অবসর পাওয়া বিমানগুলোর পরবর্তী কর্মজীবন বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। কিছু বিমান ব্যবহার করে আতিথেয়তায়। স্টকহোমের আরলান্ডা বিমানবন্দরের বাইরে পার্ক করা জাম্বো স্টে হোটেল হলো একটি ৭৪৭ মডেলের বিমান। এ হোটেলটিতে অতিথিরা ককপিটে ঘুমাতে পারেন। এদিকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ৭৪৭ মডেলের বিমানটি কোটসওল্ডে একটি পার্টি ভেন্যুতে রূপান্তরিত হয়েছে।
অন্য বিমানগুলো এভাবেও বিভিন্ন সেবা দিচ্ছে। একটি ৭৪৭ মডেলের বিমান দুই দশক ধরে যাত্রী পরিবহণ করেছে। পরবর্তীতে একে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নাসা) একটি উড়ন্ত মহাকাশ পর্যবেক্ষণ যন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। মেক্সিকো সিটির ইস্তাপালাপা এলাকায় একটি ৭৩৭ বিমানকে গ্রন্থাগারে পরিণত করা হয়েছে। ২০১২ সালে আমেরিকার ডিসকভারি চ্যানেল এবং ব্রিটেনের চ্যানেল ৮ একটি ৭২৭ বিমানকে সেনোরা মরুভূমিতে ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করা হয়। এর মাধ্যমে যাত্রীরা কোথায় সবচেয়ে নিরাপদ তা দেখাতেই মূলত এ কাজ করা হয়েছিল। এখানে পরবর্তীতে দেখা যায় ইকোনোমি ক্লাসেই যাত্রী সবচেয়ে নিরাপদ। কিছু ভাগ্যবান বিমানকে শেষ পর্যন্ত বিমান জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে।
বেশিরভাগ অচল বিমানগুলোকে আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যেমন- আগ্রাকেও সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমেরিকার এ অঞ্চলটি মুম্বাইয়ের ঠিক বিপরীত। এখানে জমির দাম কম এবং জনসংখ্যা প্রায় নেই। আর সূর্য প্রায় ৩০০ দিন ধরে উজ্জ্বল থাকে। এখানে আর্দ্রতার পরিমাণও কম। এখানকার শুকনো মাটি 'ক্যালিচি' নামে পরিচিত। এ ধরনের পরিবেশ বিমান সংরক্ষণের জন্য আদর্শ।
ম্যানুয়ালকরণ থেকে পুনরায় বিক্রিযোগ্য বিমানের দরজা
বাণিজ্যিক বিমানগুলো আমেরিকার টুসন থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পিনাল কাউন্টি এয়ারপার্কের মতো একটি স্থানে চলে যায়। সেখানে বেসরকারি কিছু কোম্পানি বিমান সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ, রূপান্তর এবং বিচ্ছিন্নের কাজ করে থাকে। কেউ যখন এ অঞ্চলে মহাসড়ক দিয়ে মরুভূমির দিকে যেতে থাকবে, তখন দেখতে পাবেন মরুভূমির মাঝে শতশত বিমান পেছনের পাখা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পিনাল এয়ারপার্কে প্রায় ২০০-৩০০টি বিমান থাকে। বিমানগুলো এখানে শুধু সংরক্ষণের জন্যই আনা হয় না। পরবর্তীতে কী ঘটবে তা মালিকের ব্যবসা, বিমানটির ধরন এবং বাজার পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। তবে প্রতিটি পথই বিমানের পূর্ণ বা আংশিকভাবে উড়ে থাকার সুযোগ থাকে।
আকাশে ফিরে যাওয়ার একটি পথ হল অধিগ্রহণ। ধনী দেশগুলোর বিমান সংস্থাগুলো জ্বালানি এবং গ্রাহকের প্রত্যাশার কারণে সাধারণত নতুন বিমানই কেনে। তবে, গরীব দেশে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো পুরানো মডেলগুলোতেও সন্তুষ্ট থাকে। ১৫ বছরের পুরানো বোয়িং ৭৩৭ বা এয়ারবাস এ৩২০ আফ্রিকার মধ্যে যাত্রী পরিবহনের কাজ করতে ফিরতে পারে। এসব বিমানকে কার্গো বিমানেও পরিণত করা হয়। এর ফলে তার জীবনে উড়ার জন্য আরও ১০ থেকে ২০ বছর যুক্ত হতে পারে। উচ্চ অপারেটিং খরচ সত্ত্বেও সেকেন্ড হ্যান্ড বিমানগুলো পণ্য পরিবহণে দামি বিমানগুলোর তুলনায় আরও ভালো কাজ করে থাকে। কারণ মালবাহী বিমানগুলো যাত্রীবাহী বিমানগুলোর তুলনায় কম উড়ানো হয়।
আকাশে ফিরে যাওয়ার বিকল্প পথটি আরও জটিল তবে তা অহরহই করা হয়। প্রতিটি বিমান সংস্থায় সব বিমানই নিয়মিত চেকআপের ওপর রাখা হয়। আর যত বয়স বাড়তে থাকে তার চেকআপও ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এসব চেকআপের ধরনও রয়েছে। মাসে একবার চেকআপকে 'এ চেক' বলা হয়। এ চেকআপে সেসব যন্ত্রাংশগুলো বেশি দেখা হয় যেগুলো বেশি ব্যবহৃত হয়। চেকআপের আরেকটি ধরণ হলো 'ডি চেক'। এ চেকআপে পুরো বিমানটিই খুলে ফেলা হয়। কয়েক বছরে একবার এ চেকআপটি করা হয়। এটি মূলত সমস্যা চিহ্নিত ও সেগুলো ঠিক করতে করা হয়ে বলে জানান আসেন্ট এভিয়েশন সার্ভিসেসের একজন কর্মী স্কট বাটলার।
একটি বিমান সংস্থা যার শত শত বিমান রয়েছে, তারা প্রতিদিন চেকআপ পরিচালনা করবে। এসব চেকআপে পুরোনো বা ক্ষতিগ্রস্ত উপাদানগুলো প্রতিস্থাপন করা হয়। ডেলটা এয়ারলাইনসের রক্ষণাবেক্ষণ অপারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক ম্যাকব্রাইড বলেন, "আপনি যতবার এর চেকআপ করবেন এর অর্থ হলো আমি জীবনে দুই তিনবার সেসব বিমান পুনর্নির্মাণ করছেন।"
একটি অপারেশনের পরিসর উপলব্ধি করতে বোয়িং ৭৭৭ সম্পর্কে ভাবা যেতে পারে। এর ১৩২,৫০০টি অংশ এবং মোট প্রায় ৩০ লক্ষ উপাদান রয়েছে, যার মধ্যে বল্ট, রিভেট এবং অন্যান্য ছোট উপাদানও অন্তর্ভুক্ত। যাত্রী কেবিনের নরম, গোলাকার পৃষ্ঠের নিচে রয়েছে আরও জটিল যন্ত্রাংশ। যেমন- সেন্সর, রাডার, পাম্প, পিস্টন, সিলিন্ডার এবং ড্রাম। এগুলো হাজার হাজার তারের মাধ্যমে অ্যাভিওনিক্স ককপিটের সাথে সংযুক্ত থাকে। হাইড্রোলিক সিস্টেমগুলো রাডার, উইং ফ্ল্যাপ বা ব্রেকগুলো সরাতে কাজ করে। বিমান সংস্থাগুলোর জন্য এইসব উপাদান এবং অংশের একটি নির্ভরযোগ্য সরবরাহ প্রয়োজন। এই উপাদানগুলোর অভাবে বৈশ্বিক বিমান চলাচল একেবারে থমকে যেতে পারে।
এই শিল্পের এসব অংশের চাহিদা পূরণ হয় এ বিমানগুলো থেকে। পিনাল অঞ্চলে পার্ক করা কিছু বিমান এমনভাবে রাখা হয়েছে যেন সেগুলো কাঠের রেলওয়ে স্লিপারের উপরে দাঁড়িয়ে আছে, আর তাদের ল্যান্ডিং গিয়ার অনেক আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিছু বিমান ফ্লাইট ডেক বা ফিউজেলেজের কিছু অংশ হারিয়ে ফেলেছে, যা বিমানটির অন্তর্বর্তী অংশগুলোকে উন্মুক্ত করে, যেন একটি ভয়ংকর বাস্তব জীবনের কাটা ডায়াগ্রামের মতো। অনেক অংশ হয়ত অন্য বিমানগুলোতে ব্যবহৃত হচ্ছে বা স্টোরেজে রয়েছে যা অন্য বিমানের ব্যবহারের জন্য রাখা হয়েছে। কাছাকাছি ফিনিক্স নামে এমন একটি সংরক্ষণাগার রয়েছে। এর নামকরণ করা হয়েছে সেই পৌরাণিক পাখির নামে যা ভস্ম থেকে নতুন জীবন লাভ করে। এগুলো অ্যামাজনের ফুলফিলমেন্ট সেন্টারের মতোই দেখায়।
যখন একটি বিমান অ্যারিজোনায় পৌঁছায় তখন প্রথমে এর ইঞ্জিন সরানো হয়। তারপর সরানো হয় ল্যান্ডিং গিয়ার। পরে বিমান থেকে অ্যাভিওনিক্স, যন্ত্রপাতি, হাইড্রোলিক এবং অন্যান্য উপাদানগুলো সংগ্রহ করা হয় এবং প্রয়োজন অনুসারে সেগুলো পরে সরিয়ে নেওয়া হয়। ককপিট কখনও কখনও সরিয়ে নেওয়া হয় এবং পাইলট প্রশিক্ষণের জন্য ফ্লাইট সিমুলেটরে রূপান্তরিত করা হয়। বিমানের সামনের বিলাসবহুল সিটগুলি নতুন গন্তব্যে পৌঁছায়। হয়ত সেগুলো দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের কোনো বিমান সংস্থায় চলে যায় কিংবা শৌখিন মানুষের কাছে চলে যায়।
বিমানের সবচেয়ে কম চাহিদার অংশ হলো ইকোনোমি ক্লাসের সিটগুলো। এগুলো কেউ চায় না। এবং এগুলো সহজে পুনঃব্যবহারযোগ্যও নয়। একটি বিমানের সিটে ২০ বা ৩০টি আলাদা উপাদান থাকে, বলে জানিয়েছেন, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড বাটলার। এগুলো শেডার বা ল্যান্ডফিলের মধ্যে চলে যায়।
তবে কিছু বিমান সংস্থা বর্জ্য কমানোর চেষ্টা করেছে। যখন ২০১৪ সালে আমেরিকান ক্যারিয়ার সাউথওয়েস্ট ৭১,৭৮৬টি সিটের কভার পরিবর্তন করেছিল। এর ফলে ৪৩ একর চামড়া লেগেছিল, যার ওজন ছিল ৬৩৫ টন। তারপর থেকে তারা এই চামড়া দান করছে বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায়। পরে এ চামড়া দিয়ে ফুটবল, জুতা ও ব্যাগ বানানো হয়েছিল।
দুবাইয়ের সবচেয়ে বড় বিমান সংস্থা এমিরেটস তাদের নিজস্ব বিমান পুনর্নির্মাণ ব্যবস্থা রয়েছে। এয়ারলাইন্সের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান আহমেদ সাফা বলেন, একটি এ৩৮০ মডেলের বিমান ৮০০ থেকে ৯০০ কেজি নরম আসবাবপত্র ব্যবহার করতে পারে। এমিরেটসে ১৪ জন দর্জি আছে তারা কেবিনের উপকরণ থেকে শুরু করে ব্যাগ, ওয়ালেট এবং স্যুটকেস তৈরি করেন। যা বিক্রির জন্য বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায় দেওয়া হয়। এয়ারলাইন্সটি এ শিল্পকে আরও বাড়ানোর কথা ভাবছে, তারা এস্কেপ স্লাইড থেকে ছাতা তৈরির কথা ভাবছে। এ বিষয়ে সাফা বলেন, "এটি আমাদের জন্য আসলে খরচ সাপেক্ষ।"
বিমানগুলোর বিভিন্ন অংশ পুনঃব্যবহার করার ধারণাটি মজার। কিছু বিমানপ্রেমী এ৩৫০ মডেলের বিমানের সিটের জন্য সাত হাজার পাউন্ড খরচ করতেও রাজি হবেন। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি আর্থিকভাবে লাভজনক বা স্কেলযোগ্য নয়, শুধু কিছু অদ্ভুত পণ্য ছাড়া। একটি উদাহরণ হলো- একটি ক্যালিফোর্নিয়া-ভিত্তিক সংস্থা প্লেন ট্যাগস একটি বিমানের এয়ারফ্রেমের বাইরের পাত সংগ্রহ করে এবং খোদাই করা চাবির রিং তৈরি করে ৪০ ডলারে বিক্রি করে ভালোই মুনাফা করে।
কিছু অংশ একই ও কিছু অংশ আলাদা
অধিকাংশ ক্ষেত্রে, বিমানের বাইরের স্কিনটি অন্যান্য অংশের মতোই ভাগ্য বরণ করে। একবার সবকিছু, যেমন- ইঞ্জিন, উপকরণ, ভিতরের যন্ত্রাংশ বের করে ফেলা হলে, কেবল মেটাল স্ট্রাকচারই বাকি থাকে। উচ্চমানের অ্যালুমিনিয়াম অ্যালায় দিয়ে তৈরি এই কাঠামো স্ক্র্যাপে প্রিমিয়াম দামে বিক্রি হয়। এয়ারবাস এবং বোয়িং উভয়ই বিমানের ৯০ শতাংশ অ্যালুমিনিয়াম স্ক্র্যাপ হিসেবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য। তবে নতুন বিমানগুলোর এসব উপাদান মেটালের মতো পুনরায় ব্যবহার যোগ্য নয়। তবে এখনও এক দশক সময় আছে। বিমানগুলো বাতিলের খাতায় যাওয়ার আগেই এর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
এটাই সম্ভবত এয়ার ইন্ডিয়ার আগ্রার শেষ পরিণতি। এর ভৌত রূপ পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেলেও, এটি অন্যান্য বিমানগুলোর একটি ছোট অংশ হিসেবে আকাশে ভ্রমণ করতে থাকবে। পাঁচটি বিমান সংস্থা- এয়ার চায়না, কোরিয়ান এয়ার, লুফথানসা, মাহান এয়ার এবং রোসিয়া এয়ারলাইন্স এখনও ৭৪৭ মডেলটি যাত্রী পরিবহনের জন্য ব্যবহার করছে। তবে মডেলটি এখন বেশি জনপ্রিয় বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহণের জন্য। ১৯৬৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত উৎপাদিত এক হাজার ৫৭৪টি বিমানের মধ্যে এখনও প্রায় এক চতুর্থাংশ বিমান আকাশে উড়ছে। তবে তার বেশিরভাগই মালামাল পরিবহণ করছে।
এয়ার ইন্ডিয়ার আগ্রা, ব্রিটিশ এয়ারওয়ে এবং অন্যান্য যেসব এয়ারলাইন্স এখনও ৭৪৭ ব্যবহার করেছে। নতুন বিমানের প্রযুক্তি এবং কেবিন আরও উন্নত ও আরামদায়ক হওয়া সত্ত্বেও ৭৪৭-এর মতো জনপ্রিয় বা সুন্দর কোনো বিমানই হয়নি। এটি পৃথিবীকে জেট যুগে প্রবেশ করিয়েছিল। যখন আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ধীরে ধীরে ধনী শ্রেণীর বাইরে বিস্তৃত হচ্ছিল, তখন এটি আন্তর্জাতিক যাত্রার জন্য একটি যুগান্তকারী বিমান ছিল। এটি সেই বিমান, যার উপর অনেক পাঠক প্রথম বিদেশি সফর করেছিলেন। এটি কিংবদন্তি হিসেবে বেঁচে থাকবে।