ভালোবাসার ‘মিনতি’ আমার
একদিকে ভাওয়াল গড়, অন্যদিকে প্রত্যন্ত এক গ্রামীণ জনপদ, মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে শীতলক্ষ্যা নদী। এ ধরনের অঞ্চলেই আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। শিশু বয়স থেকেই নানা জাতের বন্য প্রাণী প্রত্যক্ষণের সুযোগ হয়েছে। যাদের খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছি, মূলত তাদের নিয়েই লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। নদী, গজারি বন আর গ্রামীণ জঙ্গল, সকলই ছিল জীববৈচিত্র্যে ভরপুর।
নানাভাবে বন্য প্রাণীরা আমার সংস্পর্শে এসেছে, নানা কৌশলে আমি ওদের কাছাকাছি গিয়েছি। বন্যতার আহ্বান; এর এক অমোঘ আকর্ষণ রয়েছে। একবার যারা এই আকর্ষণের সংস্পর্শে এসেছে, তাদের অনেককেই সারা জীবন এই দুর্দান্ত নেশা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কখনো কখনো স্মৃতি হয়ে ওরা এসে ধরা দেয়। যেমন ইদানীং প্রায়ই আমার মনে পড়ে তেমন কিছু বন্য প্রাণীর কথা, যাদের সঙ্গে আমার সখ্য ছিল, ভালোবাসা ছিল। মাঝেমধ্যে নিজেকে ভাবতে গিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ি। যেই আমি ওদের রক্ত ঝরিয়েছি, সেই আমার কাছেই ওরা ছিল প্রাণের চেয়েও প্রিয়; বড় আজব এই মানবজীবন!
আমাদের এলাকায় বসবাসকারী চৌহান আর রবিদাস সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে শজারু শিকার ছিল ঐতিহ্যের অংশ। অবসর পেলেই তারা দলবেঁধে নদী পেরিয়ে ভাওয়ালের গজারি বনে চলে যেত। শজারু গর্তজীবী নিশাচর স্তন্যপায়ী প্রাণী। দিনের বেলায় ওরা টিলার গর্তে আত্মগোপন করে থাকত। শিকারিরা কখনো গর্ত খুঁড়ে কখনো গর্তের মুখে ধোঁয়া দিয়ে ওদের বাইরে বের করে আনত। মাঝেমধ্যে শজারুর গর্তে বাচ্চাও পাওয়া যেত। ওরা সেইসব বাচ্চা বাড়ি নিয়ে এসে পুষে বড় করত। তারপর কোনো এক অনুষ্ঠানে সেটাকে শিরচ্ছেদ করে উদরপূর্তি করত।
একবার বাদল চৌহানের নেতৃত্বে এক দল শিকারির শজারু শিকার হয়ে গেল। গভীর রাতে তারা দুটো মৃত শজারু আর একটি বাচ্চাকে নিয়ে গ্রামে ফিরে এল। খবর পেয়ে পরদিন সকালে বাদলের বাড়ি গিয়ে বাচ্চাটি দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাচ্চাটার কিছু ছবি তুলে বাদলকে বললাম, 'একে কিন্তু মারবে না; আমি নিয়মিত খোঁজখবর রাখব।' একবার ইচ্ছে করছিল বাচ্চাটাকে নিজের কাছে এনে রাখি। কিন্তু তখন আমাকে লেখাপড়ার কাজে প্রায়ই ঢাকা যাতায়াত করতে হতো।
বাদলই তার নাম রেখেছিল 'মিনতি'। নামটা আমারও বেশ পছন্দ হয়েছিল। তুলতুলে কাঁটার ছোট্ট মিনতি আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠতে লাগল। তাকে দেখতে প্রায়ই চৌহানপাড়ায় যাওয়া পড়ত। বাদলও মাঝেমধ্যে মিনতিকে নিয়ে আমার কাছে চলে আসত। ওকে বাগানবাড়িতে ছেড়ে দিলে সে ঝোপের দিকে চলে যেত। ওখানে কচু আর শাকসবজিসহ নানা খাবার খেয়ে আবার ফিরে আসত আমাদের কাছে। কচুর মূল তার খুবই প্রিয় খাদ্য ছিল।
সাধারণত নিরীহ প্রাণী হলেও তীক্ষ্ণ কাঁটার কারণে বনের বাঘ পর্যন্ত এদের ভয় পায়। অথচ মিনতি চুপটি করে আমার কোলে ঘুমিয়ে থাকত। কখনো একটি কাঁটার আঘাত আমার গায়ে লাগেনি। মিনতিকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
সময়ের পরিক্রমায় মিনতি একসময় পরিণত হয় নাদুসনুদুস শজারুতে। এর মধ্যে আমি একদিন বাড়িতে এলে বাদল এসে হাজির হয় মলিন মুখে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তার সোজা উত্তর, 'মিনতিরে খাইয়া ফালাইছি।' আমি তখন রীতিমতো স্তম্ভিত, হাসব না কাঁদব নাকি বাদলকে থাপড়াব, কিছুই বুঝতে পারলাম না! শুধু জিজ্ঞেস করলাম, 'কেন এই কাজ করেছ?' সে কাচুমাচু গলায় বলল, 'স্যার, অসুখ করছিল; চার পা-ই ফুইলা গেছিল, হাঁটতে পারত না, এমনিতেই মারা যাইত।' আমি তাকে আর কিছুই বললাম না, বলতে ইচ্ছে করল না। তার ভালোবাসায় খাদ ছিল, তাই পরাজিত হয়েছিল জাতিগত লালসার কাছে।
বহুকাল পেরিয়ে গেছে। তবু আজও বাদলের বলা সেই কথাগুলো কানের মধ্যে তীক্ষè হয়ে বেজে ওঠে, 'স্যার, মিনতি রে খাইয়া ফালাইছি।'