ঢাকাবাসী সাহেবের ঢাকাই মসলিন: ঢাকার তুলাশিল্প—বিস্ময় এবং বেদনা
ঢাকার তুলাশিল্প একসময়ে অত্যন্ত মূল্যবান ছিল। এই তুলা স্থানীয় ও ইউরোপবাসী অনেকেরই জীবিকার উৎস ছিল। তুলাশিল্পে স্থানীয়রা কাজ করতেন। আর এ শিল্পপণ্যের ব্যবসা করতেন ইউরোপীয়রা। প্রাচীন ঢাকার তুলাশিল্পের হালচাল নিয়ে ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত জন মোরটিমারের বইয়ে এমন সব চিত্তাকর্ষক তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। 'ডেসক্রিপটিভ অ্যান্ড হিস্টোরিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব দ্য কটন ম্যানুফ্যাকচার অব ঢাকা ইন বেঙ্গল' নামের এ বইয়ে লেখকের নামের আগে লেখা হয়েছে 'সাবেক ঢাকাবাসী'। ঔপনিবেশিক ঢাকার তুলাশিল্পের পতনের কারণ হিসেবে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে এ বইয়ে।
বইতে বলা হয়েছে, ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ঢাকার তুলাশিল্পের পতন শুরু হয়। পতনের কারণ, ইংল্যান্ডে 'খচ্চর-কাটা' সুতার প্রচলন। ১৮ শতকের শেষ দিকে স্যামুয়েল ক্রম্পটন সুতা কাটার যন্ত্র বের করেন। তার এ যন্ত্র 'স্পিনিং মুল' বা 'সুতা কাটার খচ্চর' নামে পরিচিতি পায়। সাবেক ঢাকাবাসী সাহেবের বইটি থেকে জানতে পারি, ১৭৯৯ নাগাদ ঢাকায় অনেক তাঁতি কাজ বন্ধ করে দেয়। বাজারে চাহিদা নেই, কাজে আয় নেই। তাই বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো গতি তাদের ছিল না। কর্মহীন হয়ে পড়ার আবশ্যিক শর্ত হিসেবে এসব তাঁতি জীবনে অমাবস্যার ঘন অন্ধকারের মতো দারিদ্র্য নেমে আসে। কেউ কেউ দক্ষ তাঁতি জীবনের ইতি টেনে পেটের জ্বালায় অন্য পেশায় নেমে পড়তে বাধ্য হন। ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তাঁতশিল্প আগের তুলনায় এক-পঞ্চমাংশের তলানিতে এসে ঠেকে।
এখানেই থেমে থাকেনি পতনের ধারা। তাঁতিদের কপাল পুড়তেই থাকে। ১৮০০ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ তুলা উৎপাদনে নতুন নতুন যন্ত্র এবং বাষ্পশক্তি যোগ হতে থাকে। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্পের জগতে ধ্বংসের দানব হয়ে দেখা দেয় এসব যন্ত্র। যন্ত্রোৎপাদিত পণ্য দামে সস্তা, ক্রেতাও অনেক। পতনের এ ধারায় ইউরোপীয় বাজার থেকে ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার তুলাপণ্য পুরোই বাদ দেওয়া হয়।
ঢাকার তুলাপণ্যের বাণিজ্যিক পতন ঠেকানো যায়নি। কিন্তু মানের গুণে ক্রেতার কাছে ঢাকা মসলিনকে সমাদৃত পণ্য করেই রেখেছিল। মিহি বস্ত্র হিসেবে ঢাকাই মসলিন মানের শিখরে বিরাজ করেছে। স্কটিশ চিকিৎসক, রসায়নবিদ এবং শিল্পায়ানের প্রবক্তাদের অগ্রদূতদের অন্যতম অ্যান্ড্রু উরে ১৮৩০-এ লিখেছিলেন, ইউরোপীয় প্রযুক্তিতে তৈরি তুলাপণ্য ঢাকাই সুতা এবং মসলিনের সাথে তুলনার যোগ্যই ছিল না। হাতে কী করে এমন মিহি সুতা কাটা বা তৈরি করা সম্ভব, তা বুঝতে পুরোই অক্ষম ছিলেন ইউরোপের অনেক বিশেষজ্ঞ। কোমলতা, সূক্ষ্মতা এবং টেকসইয়ের বিচারে ঢাকার মসলিন এখনো অন্যান্য (ইউরোপীয়) দেশের বস্ত্রের তুলনায় উন্নত। মসলিনের শত শত বছরের দীর্ঘস্থায়ী খ্যাতি এক অনন্য ঐতিহাসিক তাৎপর্যে বয়ে এনেছে গৌরবগাথা। ভারতবর্ষের অন্য কোনো শাখার শিল্পকারখানাজাত পণ্য কলা বা শিল্প হিসেবে যুগ যুগ ধরে সুনামের এমন সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেনি।
জন মোরটিমার বইটি লেখার জন্য ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ এবং দাপ্তরিক নথিপত্র উভয়ের ওপর নির্ভর করেছেন। ঢাকায় বসবাসের সময় এসব নথিপত্র দেখার সুযোগ পান তিনি। এ ছাড়া বইয়ের কিছু কিছু ঐতিহাসিক তথ্য তৎকালীন ভারতবর্ষ এবং তুলাশিল্প নিয়ে লেখা বইপত্র থেকেও সংগ্রহ করেছেন।
তৎকালীন এক লেখকের বয়ানে বলা হয়েছে, ভারতবর্ষের বয়নশিল্প-সংক্রান্ত বর্ণনায় প্রায়ই ব্যবহারিক অন্তর্দৃষ্টির অভাব দেখা যায়। এসব বর্ণনায় বয়নপ্রক্রিয়া-সংক্রান্ত প্রাথমিক বিবরণ দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁতিদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এবং তাদের দক্ষতাসম্পর্কিত প্রধান প্রধান বিষয়গুলো যেমন সুতা এবং মাকুর ধরন-সম্পর্কিত তথ্য ঘাটতি থাকে। তাঁত স্থাপনের বিষয়েও তেমন কোনো তথ্য থাকে না। এসব ঘাটতি মোরটিমারের নজর এড়ায়নি। সুতা বানানো এবং বয়নপ্রক্রিয়ার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন তিনি। তার বর্ণনায় তুলা প্রস্তুতকরণ থেকে চূড়ান্ত পণ্য অর্থাৎ বস্ত্র উৎপাদনের পর্যায়গুলো ছবির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। ছবিগুলো আঁকাও হয়েছে স্থানীয় শিল্পীদের দিয়েই।
সেকালের ঢাকায় বয়নশিল্পে সরল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে গুণে-মানে এবং সৌন্দর্যে অসাধারণ এবং চোখজুড়ানো বস্ত্র তৈরি করা হয়েছে। এসব ঢাকাই বা ভারতবর্ষের বস্ত্র তৎকালের উন্নত যন্ত্রপাতিতে তৈরি ইউরোপীয় বস্ত্রকে টেক্কা দিয়েছে। নির্মাণপ্রক্রিয়া প্রাথমিক পর্যায়ের হওয়ার পরও বয়ন দক্ষতা ছিল উল্লেখযোগ্য। ইউরোপীয় বস্ত্র নির্মাতারা ঢাকা এবং ভারতবর্ষের বয়নপ্রক্রিয়া ভালোভাবে দেখে এবং শিখে তাদের নিজস্ব বস্ত্র উৎপাদনের গুণমান, দক্ষতা এবং শৈল্পিক নৈপুণ্য বাড়ানোর পথ খুঁজে পেতে পারে। এমন ধারণা ব্যক্ত করেছেন লেখক।
আগে তুলাশিল্পের প্রাচীন অঞ্চল হিন্দুস্তান। বস্ত্রশিল্পের শাখা হিন্দুস্তান থেকেই পারস্য, মিসর হয়ে ইউরোপে গেছে। ইতিহাসের উষাকাল থেকেই তুলা থেকে সুতা বানানো এবং বয়নের চল ছিল এ অঞ্চলে। বয়নশিল্প বাংলা অঞ্চলে দক্ষতার হিমাদ্রি শিখর ছুঁয়েছিল। এমনটি আর কোথাও ঘটেনি। ১৬ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে মোরটিমারের বই লেখার সময়কাল পর্যন্ত এত মিহি, মোলায়েম বস্ত্র বুনেছেন বাংলার তাঁতি যে এক ইউরোপীয় লেখক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, কোনো কোনো বস্ত্র দেখে মনে হয়, এ কোনোভাবেই রক্ত-মাংসের মানুষের হাতের কাজ নয়। পরীরা বুনেছে, না হয় বয়নকর্মে দক্ষ কোনো কীট বা পতঙ্গ বানিয়েছে এমন বস্ত্র।
তুলার জন্য পূর্ব বাংলার ঢাকা জেলা সবচেয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিল। বইয়ে ঢাকা জেলার আয়তন ১৯৬০ বর্গমাইল উল্লেখ করা হয়েছে। এই এলাকায় গঙ্গা (পদ্মা হবে?), ব্রক্ষ্মপুত্র এবং মেঘনা নদী মিলিত হয়েছে।
ঢাকার মৃত্তিকাকে প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। একটি অঞ্চল আশেপাশের নদীগুলোর তুলনায় উঁচু। এখানকার মাটি কাদামাটি, কঙ্কর এবং খনিজসমৃদ্ধ। ৭০ মাইল বিস্তৃত এই অঞ্চলটি ময়মনসিংহ জেলাকে স্পর্শ করেছে। পুরো এলাকাটাই ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ।
ঢাকা জেলার অন্য অংশটি রয়েছে অর্ধেকের বেশি জুড়ে। বৃহত্তর এ অংশটি পলল সমভূমি। উর্বরা এ অঞ্চল দিয়ে বয়ে গেছে একাধিক শাখানদী। এখানকার নিম্ন অঞ্চল প্রতিবছর তিন মাসের জন্য দুই থেকে ১২ ফুট পর্যন্ত পানির তলে ডুবে যায়। অতি নিচু অঞ্চলজুড়ে রয়েছে বড় বড় ঝিল। এ ছাড়া বাকি অঞ্চল উর্বর কৃষিজমি। এখানে ধান, সরিষা, তিল, চিনি, নীল, তুলা, হলুদ, আদা এবং পানের চাষ হয়।
ঢাকার জলবায়ুর কথা বলতে গিয়ে জানানো হয়েছে, পশ্চিম বাংলার তুলনায় সামান্য শীতল। বছরের সবচেয়ে উষ্ণ মাস এপ্রিল এবং সেপ্টেম্বর দশ বছর পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে মোট গড় তাপমাত্রা যথাক্রমে ৮৭.৩৯ (৩০.৭৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ফারেনহাইট এবং ৮৮.৩৪ (৩১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ফারেনহাইট। ঢাকার জলবায়ু জলীয় বাষ্পে ভরপুর। অন্যদিকে আট বছর পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৭০.৩ ইঞ্চি। এ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে ৯৩.৯ ইঞ্চি। অন্যদিকে একই সময়ে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হলো ৪৬.৮ ইঞ্চি।
১৮৩৭-এর হিসাব অনুযায়ী, সমসংখ্যক হিন্দু এবং মুসলমান নিয়ে ঢাকা জেলার তৎকালীন জনসংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ৩০ হাজার। স্থানীয় ঐহিত্য অনুযায়ী ঢাকা জেলায় কয়েকটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানও রয়েছে। এদের অন্যতম একটি স্থানের নাম বিক্রমপুর। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী বঙ্গজ বা বঙ্গ-দেশের সাম্রাজ্যের রাজধানী বিক্রমপুর। বিক্রমপুরে রাজা আদিসুর এবং বল্লাল সেনের আবাসিক প্রাসাদ ছিল। রামপালের কাছেই তাদের প্রাসাদ ছিল বলে দাবি করা হয়। বাংলার ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে কেবল এই দুই হিন্দু রাজার কথা স্থানীয় মানুষ এখনো মনে রেখেছে। সময়ের সাথে সাথে অন্যান্য রাজার নাম, ধাম, গাথা বা কাহিনি ইতিহাসের বাঁকে হারিয়ে গেছে।
ঢাকা জেলায় সাভার এবং কাপাসিয়া নামে আরও দুটি পৃথক প্রাচীন জনপদ রয়েছে। এই দুই জনপদই ঢাকার জঙ্গলপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত। দুই জায়গার রাজ ছিলেন যথাক্রমে হরিশ্চন্দ্র এবং শিশু পাল। হিন্দিতে কাপাস বলতে তুলাকে বোঝানো হয়। এখান থেকেই এ নামের উৎপত্তি। কাপাসিয়া অঞ্চলটি প্রাচীন কালে মসলিনের কেন্দ্র ছিল, এমনটিই বলেছেন লেখক।
বয়ন ব্যবসা কমবেশি এ জেলার প্রায় সব গ্রামেই চলে। মসলিন তৈরির প্রধান প্রধান কেন্দ্র বা আড়ং (ধঁমঁহমং) হলো ঢাকা, সোনারগাঁ, ধামরাই, তিতবাড়ি (ঞববঃনধফব), জঙ্গলবাড়ি এবং বাজিতপুর। ১৮৩৮-এর হিসাব অনুযায়ী, সেকালের ঢাকা নগরীর লোকসংখ্যা ৬৮ হাজার। জনসংখ্যার বেশির ভাগই ছিল হিন্দু ও মুসলমান। এ ছাড়া ইংরেজ, আর্মেনীয়, গ্রিক এবং পর্তুগিজদের বংশজাত কিছু মানুষও ছিল।
ঢাকায় দালানকোঠা, মসজিদ, মন্দির, গির্জার বিবরণ দেওয়ার পাশাপাশি উল্লেখ করা হয় যে সাড়ে সাত শ ঘর তাঁতিও ছিল।
আজকের ঢাকাকে অগোছালো মহানগরী মনে করা হয়। সেকালের ঢাকা প্রসঙ্গে একই কথা বলা হয়েছে। লেখক বলেছেন, বেশির ভাগ স্থানীয় অধিবাসীদের শহরগুলোর মতোই ঢাকাও খুবই অগোছালোভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। রাস্তা এবং গলিগুলো লম্বা এবং সংকীর্ণ। দুই পাশে বাড়িঘর বানানো হয়েছে। ইটের ঘর বা খড়ের ঘর পাশাপাশি বানানো হয়েছে। কোনো কোনো বাড়ি দোতলা বা তিনতলাও ছিল। কোনোটার সাথে কোনোটার মিল ছিল না। স্থাপত্যশৈলী ছিল অনন্য।
তিন বা চারতলা উঁচু হলেও সামনের অংশ মাত্র আট থেকে দশ ফুট হতো। পাশের দেয়াল ৬০ বা ৭০ ফুট প্রসারিত হলেও কোনো জানালার বালাই ছিল না। দালানগুলোর শেষের দিকে ছাদ থাকত। মধ্যভাগে খোলা চত্বর বা উঠান থাকত।
কেবল ইউরোপীয়দের আবাসিক এলাকাগুলো বেশ বড়সড়ো এবং সুন্দরভাবে তৈরি। বাড়ির সামনে বাগান ছিল এবং তাদের বেশির ভাগ বাড়িই বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে ছিল। বন্যা হলে সামনের দেয়াল পানিতে ডুবে যেত। শহরটি দক্ষিণ থেকে দেখলে বেশ দৃষ্টিনন্দন মনে হতো।
ঢাকা শহরে একটি ইউরোপীয়দের এবং একটি স্থানীয় অধিবাসীদের জন্যÑএই দুটো পৌর কমিটি ছিল সেকালে। স্থানীয়দের শিক্ষাদানের জন্য কলেজ ছিল। ইংরেজ প্রোটেস্ট্যান্ট, রোমান ক্যাথলিক, আর্মেনীয় খ্রিষ্টান, গ্রিক এবং ব্যাপটিস্টদের পৃথক পৃথক গির্জা ছিল। মুসলমানদের ১৮০টি মসজিদ, মাজার এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের স্থান ছিল। হিন্দুদের বিভিন্ন জাতের জন্য ১১৯টি মন্দির বা উপাসনা কেন্দ্র ছিল। শিখ বা বৌদ্ধদের কথা উল্লেখ করা হয়নি গ্রন্থে।
ঢাকার কোনো কোনো বাজার নির্দিষ্ট জাতের দখলে ছিল। যেমন তাঁতি, স্বর্ণকার এবং শাখা নির্মাণকারী।
সেকালের ঢাকায় একটা খাড়ির ওপর লোহার ঝুলন্ত সেতুসহ ১০টি সেতু ছিল। ১৩টি ঘাট ছিল। খাদ্যসামগ্রী কেনাবেচা করার ১২টি বাজার ছিল। একটা গণচত্বর বা মার্কেট প্লেস ছিল। সাতটি থানা, কারাগার, ডাকঘর, পাগলাগারদ ইত্যাদি ছিল। মোগল সুবেদারের প্রাসাদ লালবাগ তখনো ভগ্নদশায় দেখতে পেয়েছেন লেখক। এর তিনটি ভবনকে সরাইখানা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। একটি ঈদগা ছিল। হোসেনি দালানের কথাও উল্লখ করা হয়েছে বইতে। মহররম মাসে শোক অনুষ্ঠান পালন করা হতো এ দালানে।
১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহল থেকে বাংলার রাজধানী ঢাকায় সরিয়ে আনা হয় এবং সে সময় ঢাকার নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীরনগর। ১৭০৪ পর্যন্ত এ মর্যাদার মুকুট ছিল ঢাকার কবজায়। পরে এখান থেকে রাজধানী সরিয়ে নেওয়া হয় মুর্শিদাবাদে। সকল কালেই বাংলায় তুলা উৎপাদনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা। ঢাকাকে ১৭ শতকের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য শহর হিসেবে উল্লেখ করেছেন ফরাসি রত্ন ব্যবসায়ী এবং পর্যটক জ্যাঁ-ব্যাপটিস্ট তাভার্নিয়ের (১৬০৫-১৬৮৯)। তিনি এশিয়া বিশেষ করে পারস্য, ভারতবর্ষ এবং উসমানিয়া সাম্রাজ্য ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছেন। তিনি রত্ন বিশেষ করে হীরার ব্যবসাও করেছেন। এ ছাড়া ঢাকার কথা উল্লেখ করেন ১৭ শতকের পর্তুগিজ ক্যাথলিক খ্রিষ্টান মিশনারি এবং পর্যটক সেবাস্তিয়াও মানরিক। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেন তিনি। এ দুই পর্যটক তাদের বিবরণে ঢাকাকে মহা বাণিজ্যিক শহর হিসেবে উল্লেখ করেন।
১৮ শতকে জন মুরির প্রতিষ্ঠিত খ্যাতনামা ব্রিটিশ প্রকাশনী সংস্থার 'মুরিস ডিসকভারিস ইন ইন্ডিয়া'য় ঢাকা সম্পর্কে বলা হয়, এমন এক বিপণন কেন্দ্র, যেখানে সব দেশের মানুষের যাতায়াত ছিল। ইউরোপে মসলিন রপ্তানির লক্ষ্যে ইংলিশ, ডাচ এবং ফরাসিদের কারখানা ছিল এখানে। মোরটিমার লিখেছেন, গত শতাব্দী থেকে বস্ত্রবয়ন এবং সূচিকর্মে ভাটা পড়েছে। তারপরও এসবের চর্চা এখনো চলছে এবং ঢাকা অঞ্চলের প্রধান শিল্প হিসেবেও এগুলো বিরাজ করছে। বইটি লেখার সময় ঢাকায় সাড়ে সাত শ ঘর তাঁতি টিকে ছিল।
সোনারগাঁ বা পানাম নগরীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে বইতে। বিক্রমপুরের অংশ সোনারগাঁ ঢাকা থেকে ১৩ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। বঙ্গদেশের সাবেক রাজধানী, সেকালে এ নগরীর প্রায় ৫ হাজার অধিবাসীর বেশির ভাগই ছিল মুসলমান। শেরশাহের আমলে বানানো দু-একটা সেতু তখনো টিকে ছিল। ছিল কয়েকটা মাজার এবং মসজিদও।
সোনারগাঁয়ের কথা আবুল ফজল এবং পর্যটক রালফ ফিচ উল্লেখ করেছেন। ১৬ শতকের শেষে উৎকৃষ্ট সুতি কাপড় তৈরি করা হতো, তারা বলেছেন। এ ছাড়া মিহি মসলিন এবং ফুলতোলা বস্ত্রের জন্যও বিখ্যাত ছিল। এসব বস্ত্র প্রাথমিকভাবে সোনারগাঁ এবং এর আশেপাশের মুসলমান তাঁতিরা তৈরি করতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বস্ত্র ব্যবসায় করত, তখন সেখানে তাদের কাপড়ের গুদাম ছিল। প্রায় ১৩০০ থেকে ১৪০০ তাঁতি নিবন্ধিত ছিল। কিন্তু বইটি লেখার সময় তাদের মধ্যে মাত্র ৩০ ঘর তাঁতি টিকে ছিলÑউল্লেখ করেছেন মোরটিমার।