জঙ্গলের এক গোপন সত্য
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/15/shojaru.png)
প্রত্যেক শিকারির জীবনের অনেকটা সময় কাটে ঝোপ-জঙ্গলের নিবিড় আলিঙ্গনে বসে থেকে। শিকারের উদ্দেশ্যে তাকে এভাবে বসে থাকতে হয় বিভিন্ন স্থানে। কখনো গাছের ডালে মাচার ওপর, কখনো গুহার মুখে, কখনো ঝোপের ভেতর, আবার কখনো নালার ঢালে।
ঝলমলে দুপুর, আলো-আঁধারময় সন্ধ্যা, মসীকৃষ্ণ কিংবা জোনাক জ্বলা রাত অথবা যেকোনো সময় ওত পেতে বসে থাকা শিকারির মাথায় একটা চিন্তা জোরালোভাবে কাজ করে। সেটা হলো নিজের অবস্থানকে আশপাশের সমস্ত প্রাণীর চোখ থেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করে সে। সম্পূর্ণভাবে মিশে যেতে চায় প্রকৃতির সাথে। কারণ, এই ওত পেতে বসে থাকার মধ্যে অনেকাংশে নির্ভর করে শিকারির সফলতা।
ঝোপ-জঙ্গলে ওত পেতে বসে থাকা শিকারিদের সামনে মাঝে মাঝে ঘটে যায় প্রাণিজগতের বিচিত্র সব ঘটনা। পরবর্তী জীবনে স্মৃতি রোমন্থনের সময় শিকারিদের কাছে এসব ঘটনার তাৎপর্য অনেক বেড়ে যায়। তবে যেকোনো শিকারির জীবনে এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা থাকে খুব কম। তাই তারা এসব ঘটনার স্মৃতিগুলোকে বুকের গহিন কোণে আলাদাভাবে যত্ন করে রেখে দেয়। আর এসব ঘটনার দর্শক হতে পারায় সৌভাগ্যবান মনে করে নিজেকে।
এই ক্ষুদ্র পরিধির শিকারিজীবনে ঝোপ-জঙ্গলে শিকারের সন্ধানে ওত পেতে বসে থাকতে গিয়ে প্রাণিজগতের কিছু দুর্লভ আর বৈচিত্র্যময় ঘটনা দেখার সুযোগ পেয়েছি আমি। এসব ঘটনা থেকে বাছাই করা একটি ঘটনা তুলে ধরাই হচ্ছে এই লেখার মূল উদ্দেশ্য।
বসে আছি অনেকটা ছাতার মতো আকৃতির একটা ল্যানটানা ঝোপের ভেতর। এই ঝোপগুলোর ভেতরে ঢুকে শিকারি খুব সহজেই ঝোপের ক্যামোফ্লাজের সুযোগ নিতে পারেন। শুধু বন্দুকের নলের কিছু অংশ ছাড়া আমার দেহের অন্যান্য অংশ সম্পূর্ণভাবে মিশে গেছে ঝোপের দেহের সঙ্গে। আমার অবস্থানের পেছন দিকে ঘন গজারিবন, বাঁ দিকজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা টিলা, ডান দিকে ছোট একটা বিল। বুকসমান উঁচু ঘাসে ছাওয়া একটা বাইদের কিছু অংশ এগিয়ে এসেছে টিলার গোড়া পর্যন্ত।
বাইদের শেষ অংশ থেকে ঘন গজারিবনের দিকে চলে গেছে সরু একটা পথ। না, এ পথ মানুষের চলাচলের পথ নয়। বাইদ আর গজারিবনের ভেতর বসবাসকারী জীবজন্তুরা এই পথ দিয়ে চলাচল করে। আমি ল্যানটানা ঝোপের ভেতর এসে বসেছি দুপুরের একটু পরে। দৃষ্টি রাখছি বন্য জন্তুদের চলাচলের পথের ওপর।
এই পথের ওপর মায়া হরিণের পায়ের অনেক ছাপ আমার চোখে পড়েছে। এদিকের জঙ্গলে মায়া হরিণগুলো দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে এই বিশাল বাইদের উঁচু ঘাসের ভেতর। ঠিক গোধূলিলগ্নে আবার কখনো বা শেষ বিকেলে হরিণগুলো বাইদ ছেড়ে জঙ্গলের উদ্দেশে রওনা দেয়। সারা রাত জঙ্গলে ঘুরে প্রাতঃকালে আবার একই রাস্তা ধরে বাইদের ভেতর প্রবেশ করে। ওত পেতে বসে থাকা শিকারিদের সময়গুলো যেভাবে কাটে, আমার সময়গুলোও ঠিক সেভাবে কেটে যেতে লাগল।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/15/sjaarur_lej_yen_anekgulo_chott_oyaain_glaas_upr_kre_raakhaa_hyeche_chbi_sngrhiit_2.jpg)
চারদিকের সমস্ত প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। বাইদের ঘাসগুলোর মাথায় একধরনের সাদা লম্বা ফুল ফুটে আছে, দেখতে অনেকটা কাশফুলের মতো। বহু জাতের নাম না জানা বুনোফুল ফুটে আছে চারদিকে। বেশির ভাগ ফুলের নামই আমার অজানা।
আসলে এই পথিবীর জ্ঞানের ভান্ডার যত বড়, মানুষের জানার পরিধি ঠিক ততটাই ছোট। বিলের দিকে ডেকে চলেছে কয়েকটা জলপিপি। তীব্র স্বরে ডেকে সমস্ত বিকেলটাকে উপভোগ করার জন্যে যেন নিজেদের প্রস্তুত করে নিচ্ছে পাখিগুলো। বাইদের ঘাসের জঙ্গলের ভেতর থেকে হঠাৎ বাইরে বেরিয়ে এল একঝাঁক বটের (কোয়েল)।
বটেরগুলো ধীরে ধীরে এগিয়ে এল আমার সামনের খোলা জমিনের দিকে। সবাই পোকা খোঁজায় ব্যস্ত। বটেরগুলো আমাকে অবাক করে দিল; কারণ, এ ধরনের রঙের বটের এর আগে কখনো আমার চোখে পড়েনি। সাধারণ বটের আর রঙিলা বটের এদিকের জঙ্গলে প্রচুর আছে। কিন্তু এই বটেরগুলোর দেহের একটা বিশেষ রং আমাকে যেন মোহিত করে ফেলল। বটেরগুলোর বুকে যেন নীল আগুন জ্বলে রয়েছে। কিছু কিছু পাখির বুকের নীল রং আবার বেশ গাঢ়, এরা হচ্ছে পুরুষ। একটু চিন্তা করার পর আমি দুর্লভ নীল বটেরগুলোকে চিনতে পারলাম।
হঠাৎ তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে সব কটি পাখি দৌড়ে চলে গেল বাইদের ঘাসের ভেতর। খোলা আকাশে দুর্দান্ত শিকারি পেরিগ্রিন ফ্যালকনকে চক্কর খেতে দেখে বুঝতে পারলাম নীল বটেরগুলোর হঠাৎ পালিয়ে যাওয়ার কারণ।
বাঁ পাশের টিলার গায়ের চাকুয়া কড়ইগাছের ডালে লাফালাফি করে গান গেয়ে চলেছে একটা দুধরাজ পাখি। কয়েক ইঞ্চি লম্বা দেহের সঙ্গে জুড়ে থাকা প্রায় এক ফুট লেজ দেখেই বোঝা যায় এটা পুরুষ দুধরাজ। টিলার গাজুড়ে রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় গর্ত। গর্তগুলো হঠাৎ দেখলে মনে হবে অতিকায় সাইজের কোনো ইঁদুরের গর্ত। আসলে এগুলো হচ্ছে শজারুর গর্ত। শজারুরা ঘন ঘন গর্ত পরিবর্তন করে। তাই এক জায়গায় অনেক গর্ত দেখা গেলেও সব গর্তে শজারু থাকে না।
টিলার গায়ের একটা জারুলগাছের গোড়ার নিচে বেশ বড় আকারের একটা গর্ত দেখতে পেলাম। গর্তটার দূরত্ব আমার অবস্থান থেকে তিরিশ ফুট দূরে। গর্তের আশপাশের পরিষ্কার অবস্থা দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, ভেতরে একাধিক শজারু রয়েছে। কিছুক্ষণ গর্তটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলাম শজারুর চিন্তা। সমস্ত বনভূমি আর বাইদের লম্বা ঘাসের ডগাগুলো ঝলমল করছে বিকেলের সোনা রোদে।
কিছুক্ষণের মধ্যে বাইদ ছেড়ে জঙ্গলের দিকে রওনা হয়ে যাবে হরিণের দল। তাদের চলাচলের পথের ওপর থেকে একমুহূর্তের জন্যও দৃষ্টি সরালাম না। বন্দুকটাকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে জন্মেছি। আমার সজাগ দুই কান হঠাৎ শুনতে পেল ঝুম ঝুম শব্দ। শব্দটা ভেসে আসছে আমার বাঁ দিক থেকে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই বড় আকারের শজারুটাকে দেখতে পেলাম। ঝুম ঝুম শব্দটা এসেছিল তার দেহ থেকে। এদের লেজের অগ্রভাগ দেখতে মেয়েদের কানের ঝুমকার মতো। এরা যখন চলাফেরা করে, তখন এদের লেজ ঝুম ঝুম শব্দে বেজে ওঠে।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/15/shojaru-1.jpg)
বিকেলের আলো পড়ে ঝকঝক করছে শজারুর দেহের কাঁটার সাদা অগ্রভাগগুলো। এই মুহূর্তে শজারুর উপস্থিতি আমাকে ভীষণ অবাক করে দিল। কারণ, শজারুর আচরণের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বহুদিনের। একসময় গাজীপুর জেলার কৃষকদের আনারসখেত রক্ষার জন্যে আমাকে প্রচুর শজারু মারতে হয়েছে। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন আমি এদের পেছনে ঘুরে বেড়িয়েছি। তাই এদের ব্যবহার ও আচরণ সম্পর্কে আমার মোটামুটি একটা ভালো ধারণা আছে। দীর্ঘদিন শজারুর পেছনে লেগে থেকে আমি দেখেছি, দিনের আলোয় কখনোই এরা গর্তের বাইরে আসে না। অবশ্য শিকারিরা মাঝে মাঝে গর্তে ধোঁয়া দিয়ে এদের দিনের আলোয় গর্তের বাইরে আসতে বাধ্য করে। কিন্তু সেটা ভিন্ন কথা।
স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী সূর্য ডোবার অনেকক্ষণ পর চারদিকে গাঢ় অন্ধকার নেমে এলে শজারুরা গর্তের বাইরে বেরিয়ে আসে। কিন্তু এই অদ্ভুত শজারুটা বিকেলের আলোয় হঠাৎ গর্তের বাইরে বেরিয়ে এসে আমার অনেক দিনের একটা বিশ্বাসকে মুহূর্তের মধ্যে গুঁড়িয়ে দিল। শজারুর এই অদ্ভুত আচরণে হরিণ শিকারের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে তাকিয়ে রইলাম প্রাণীটার দিকে। টিলার গায়ের যেকোনো একটা গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে সে। শজারুটা সোজা এগিয়ে এল আমার ঝোপের দিকে। নিজেকে যথাসম্ভব স্থির করে রাখলাম। আমার দেহের প্রায় দশ ফুট দূরত্বের মধ্যে চলে এল সে। এরপর সোজা এগিয়ে গেল বিলের পানির মধ্যে।
এবার আমি ভাবলাম, কোনো কারণে হঠাৎ ভীষণ তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ার ফলে শজারুটা দিনের আলোয় গর্তের বাইরে বেরিয়ে এসেছে। ল্যানটানা ঝোপের ফাঁক গলে আমার দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করে চলল। খুব স্বাভাবিক একটা দৃশ্য দেখার জন্যে প্রস্তুত রাখলাম দুই চোখকে। শজারুটা ধীরে ধীরে পানির কাছে গিয়ে মুখ নামিয়ে চুক চুক শব্দে নিজের তৃষ্ণা নিবারণ করবে, এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আমাকে দেখতে হলো সম্পূর্ণ অন্য রকম একটা দৃশ্য। পানির কাছে পৌঁছে শজারুটা হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে নিজের দেহের পেছন দিকটা পানির খুব কাছে নিয়ে এল। এরপর পেছন দিক ফিরে পানিতে নামতে শুরু করল সে। তার দেহের পেছনের অংশ একসময় হারিয়ে গেল বিলের পানির নিচে। পরক্ষণেই আবার সে বিলের পানি থেকে পেছন দিকটা উঠিয়ে টিলার দিকে রওনা দিল। এই অদ্ভুত ঘটনার তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া তো দূরের কথা, আমার মনে হলো নিজের দুই চোখই আমার সঙ্গে কোনো কারণে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
বেজি, বনবিড়াল, মেছো বাঘ, বাগডাস, এই জাতীয় কিছু কিছু প্রাণী বিষ্ঠা ত্যাগ করার পর নিজের দেহের পেছনের অংশ মাটির খুব কাছাকাছি নামিয়ে ঘষে ঘষে মলদ্বারে লেগে থাকা অবশিষ্ট বিষ্ঠা পরিষ্কার করে, এটা অনেকেই জানে। কোনো শজারু নিজের স্বজাতীয় নিয়ম ভঙ্গ করে দিনের আলোয় গর্ত থেকে বেরিয়ে নিজের পেছন দিক পানিতে নামিয়ে মলদ্বারের অবশিষ্ট বিষ্ঠা পরিষ্কার করবে, এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না আমি। এই অদ্ভুত ঘটনা আমার ওপর এতটা প্রভাব ফেলল যে নিজেকে আমার পাগল মনে হলো। নিজের মনে কেন এ রকম অদ্ভুত ধারণার সৃষ্টি হলো, সেটা আমার জানা নেই। তবে নিজের চোখে দেখা ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজে না পাওয়ার পর স্বাভাবিক কারণেই বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠল মনটা। অবশেষে সবকিছু ছেড়ে দিলাম সময়ের ওপর। সময় হচ্ছে সবচেয়ে বড় শিক্ষক। পানি থেকে উঠে শজারুটা আমার দেহের সামনে দিয়ে টিলার দিকে এগিয়ে গেল। আশ্চর্য, অজানা কোনো কারণে শজারুর লেজ থেকে ঝুম ঝুম শব্দ বের হচ্ছে না। এ কী করে সম্ভব? সত্যি সত্যি পাগলের মতো বন্দুক তুলে শজারুটাকে গুলি করতে গেলাম। কিন্তু সাথে সাথে আমার অবচেতন মন নিজকে শান্ত রাখার নির্দেশ দিল। হাত থেকে বন্দুক নামিয়ে নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলাম অদ্ভুত শজারুর গমনপথের দিকে। টিলার গা বেয়ে সে এগিয়ে গেল জারুলগাছের গোড়ার দিকে। আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল কিছুক্ষণ আগে দেখা জারুলগাছের গোড়ার সেই বড় আকারের গর্তের কথা। বিদ্যুতের গতিতে চোখ তুলে তাকালাম গর্তটার দিকে। গর্তের মুখজুড়ে নাড়াচাড়া করছে কালো রঙের কয়েকটা মূর্তি। শজারুটা এগিয়ে এল গর্তের দিকে। গর্তের খুব কাছে পৌঁছে হঠাৎ সে দেহ ঘুরিয়ে নিজের পেছন দিকটা নামিয়ে দিল গর্তের দিকে। যে ভঙ্গিতে বনবিড়াল, মেছো বাঘ আর বাগডাস মলদ্বার পরিষ্কার করার সময় দেহের পেছন দিকটা মাটিতে নামিয়ে আনে, ভঙ্গিটা হুবহু সে রকম।
কয়েক মিনিট এভাবে থাকার পর দেহ সোজা করে আবার এগিয়ে এল বিলের দিকে। গর্তের দিকে তাকিয়ে দেখলাম কালো মূর্তিগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল নতুন একটা চিন্তা, মনে হয় সময় নামক শিক্ষক আমাকে সাহায্য করতে শুরু করেছে। ঝুম ঝুম শব্দ তুলে শজারুটা আমার সামনে দিয়ে চলে গেল বিলের পানির কাছে। কিছুক্ষণের মধ্যে শব্দহীনভাবে আমার সামনে দিয়ে সে চলে গেল গর্তের কাছে। কিছুক্ষণ গর্তের মুখে পেছন দিকটা নামিয়ে রেখে আবার এগিয়ে এল বিলের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলল তার এই নাটকীয় আসা-যাওয়া। ইতিমধ্যে তার আচরণে আরও একটা ব্যতিক্রম আমার চোখে পড়ল।
গর্ত থেকে বিলের দিকে যাওয়ার সময় তার যে গতি থাকে, বিল থেকে গর্তের দিকে যাওয়ার সময় সেই গতি অর্ধেক হয়ে যায়। একসময় বন্ধ হয়ে গেল শজারুর এই অদ্ভুত আসা-যাওয়া। শেষবার গর্তের কাছে নিজের পেছন দিকটা কিছুক্ষণ নিচু করে রাখার পর দেহ ঘুরিয়ে নিজের মাথাটা নিয়ে এল গর্তের কাছাকাছি। সাথে সাথে তিনটি শজারুর বাচ্চা ব্যাকুল আদরের স্পর্শ পাওয়ার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল মায়ের মুখের ওপর। বাচ্চাসহ শজারুটা একসময় গর্তের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল।
ব্যাপারটা নিয়ে ধীরলয়ে ভাবতে গিয়ে আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল বৃদ্ধ সাঁওতাল শিকারি রঙলালের কথা। এক অদ্ভুত কায়দায় শজারু শিকার করত সে। সাধারণ শিকারিদের মতো গর্ত খুঁড়ে বা গর্তের ভেতর ধোঁয়া দিয়ে সে শজারু শিকার করত না। সে তার নিজস্ব একটা কৌশলের আশ্রয় নিত। দিনের বেলা জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে শজারুর গর্ত খুঁজে বেড়াত সে। নিশ্চিত শজারু আছে, এমন একটা গর্ত খুঁজে পাওয়ার পর সে গ্রামে ফিরে যেত।
রঙলালের শজারু শিকারের অস্ত্র ছিল কলাগাছের নরম কাণ্ড। ছোট ছোট কলাগাছ কেটে সেগুলোকে আকৃতিতে ছোট (এক থেকে দেড় ফুট) করে একটা চটের ব্যাগের ভেতর ভরে সন্ধ্যার একটু আগে শজারুর গর্তের কাছে হাজির হয়ে যেত। সুবিধাজনক আলো ঝোপের ভেতর ওত পেতে বসে থেকে শজারুর বাইরে বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় থাকত। সন্ধ্যার পর শজারু খাবারের খোঁজে গর্তের বাইরে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রঙলাল মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ সৃষ্টি করত। ভয় পেয়ে দেহের কাঁটাগুলোকে খাড়া করে দাঁড়িয়ে যেত শজারু, এই সুযোগে রঙলাল কলাগাছের কাণ্ড ছুড়ে দিত শজারুর দেহ লক্ষ্য করে। শজারুর দেহের খাড়া হয়ে থাকা কাঁটায় শক্তভাবে আটকে যেত কলাগাছের কাণ্ড। সাথে সাথে ঝোপের ভেতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসত রঙলাল। নিজের দেহের কাঁটায় আটকে যাওয়া দুই-তিন সের ওজনের কলাগাছের কাণ্ড নিয়ে শজারু খুব বেশি একটা নড়াচড়া করতে পারত না। আর এই সুযোগে কোমর থেকে ভোজালি খুলে এক কোপে শজারুর মাথাটাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলত সে।
এই ধুরন্ধর শিকারি একবার আমাকে একটা গল্প শুনিয়েছিল। বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের কাল থেকে তারা এই কাহিনি বিশ্বাস করে এসেছে। সে বলেছিল, শজারু তার লেজ দিয়ে আশপাশের জলাশয় থেকে পানি বহন করে এনে বাচ্চাদের খাওয়ায়। তার মতে, শজারুর লেজ সত্যিই এক আশ্চর্য জিনিস। খুব কাছ থেকে এদের লেজ দেখলে মনে হবে যেন অনেকগুলো ছোট ছোট গ্লাস এক জায়গায় উপুড় করে রাখা হয়েছে। রঙলালের কথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখের সামনে একে একে পরিষ্কার হয়ে গেল দিনের আলোয় গর্তের বাইরে বেরিয়ে আসা শজারুর অদ্ভুত আচরণের ব্যাখ্যা।
গর্ত থেকে বেরিয়ে বিলের কাছে গিয়ে নিজের পেছন দিকটা পানিতে নামিয়ে লেজ খাড়া করে দিয়ে বাচ্চাদের জন্যে পানি সংগ্রহ করেছিল শজারু। পানিতে নেমে লেজের অগ্রভাগ খাড়া করে দেওয়ার ফলে উপুড় হয়ে থাকা গ্লাসের আকৃতির ছোট পাত্রগুলো পানিতে ভরে যায়। এরপর লেজ খাড়া অবস্থায় গর্তের কাছে এসে নিজের পেছন দিক নিচু করে পানিভর্তি লেজ উপুড় করে দিয়েছিল বাচ্চাদের মুখের ওপর। এবার আরও দুটো প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেলাম আমি। বিলের দিক থেকে গর্তের দিকে যাওয়ার সময় শজারুর লেজের ঝুম ঝুম শব্দ শুনতে না পাওয়ার কারণ হলো, তখন শজারুর লেজ ছিল খাড়া অবস্থায় এবং পানিতে ভরা। আর একটা প্রশ্নের উত্তর বাকি থাকে, বিল থেকে গর্তের দিকে যাওয়ার সময় তার দেহের গতি কেন অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল? উত্তরটা খুবই সোজা, লেজভর্তি পানি নিয়ে খুব সাবধানে তাকে এগিয়ে যেতে হচ্ছিল গর্তের দিকে। গোটা ব্যাপারটা পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর শেষ একটা প্রশ্ন আমার মনে উঁকি দিল। দিনের আলোয় কেন সে গর্তের বাইরে বেরিয়ে এসেছিল? নিজের মনই আমাকে প্রশ্নের উত্তরটা বের করে দিয়েছিল। উত্তরটা হলো, বাচ্চার ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে মায়ের কাছে দিন-রাতের পার্থক্য তেমন কোনো জরুরি বিষয় নয়। শজারুর অদ্ভুত আচরণের রহস্য দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর এমন একটা বিরল দৃশ্য দেখার সুযোগ পাওয়ায় নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হলো।