সেকালের আরেক ঢাকা
রাজধানী ঢাকায় বাইজি সংস্কৃতির প্রথম বিস্তার ঘটে মোগল আমলে। বাইজিদের দরবারি নৃত্যের ঐতিহ্য প্রবর্তন করেন ঢাকার সুবাদার ইসলাম খাঁ। সৈয়দ মুহম্মদ তৈফুরের ঢাকাবিষয়ক আকর গ্রন্থ 'Glimpses of Old Dhaka' থেকে এ তথ্যের সত্যতা মেলে। তিনি লিখেছেন, 'Islam Khan had a luxurious court in Dhaka. For the entertainment of the court, he maintained a number of "lulis", "kanchanis", "horkanis" and "domnis" (all dancing girls) at a cost of eighty thousand rupees per month.' ইসলাম খাঁর দরবারি নৃত্য বিষয়ে আরও চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায় অজিত কৃষ্ণ বসুর 'ঢাকার স্মৃতি' নিবন্ধে।
তিনি লিখেছেন, 'তাঁর দরবারে ছিল বহুসংখ্যক নৃত্যগীতে সুদক্ষ সুন্দরী নর্তকী। ...কিন্তু ইসলাম খাঁ নিজে কোনো আসরে হাজির থাকতেন না। তাই দেখে তাঁর এক বন্ধু তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি নিজে যদি এই নাচ-গান উপভোগ না করেন, তাহলে এত খরচ করে এত গায়িকা-নর্তকী পুষবার দরকার কী? ...ইসলাম খাঁ বলেছিলেন, শহরের যত দুশ্চরিত্র লোক এই নাচগানের আকর্ষণে এসে এই মজলিসে সন্ধ্যা আর রাত কাটায় তার ফলে শহরে চুরি-ডাকাতি কম হয়। নৃত্য ও সংগীতকে উপজীব্য করে ইসলাম খাঁর কাঞ্চনীদের ("kanchanis") উত্তরসূরি বাইজিরা পরবর্তীকালে নওয়াব, জমিদার ও বিত্তশালী সম্প্রদায়ের বিনোদনের উপাদান জুগিয়েছেন। বাইজিরা ঘরোয়া মজলিশে, রংমহলে, বাগানবাড়িতে বা বজরায় নাচ-গান করতেন। ঢাকার নওয়াব নুসরাত জঙ্গ, নওয়াব শামসুদ্দৌলা, নওয়াব কমরদ্দৌলা, নওয়াব আবদুল গনি ও নওয়াব আহসানুল্লাহর সময় বাইজিদের নৃত্যগীতের চর্চা ছিল। যার ফলে কলকাতা ও ভারতের উত্তরাঞ্চল থেকে আসা বাইজিদের অনেকে ঢাকায় থাকতে শুরু করেন। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে ঢাকার স্থানীয় বাইজিরাও বেড়ে ওঠে, ফলে এখানে বাইজিবাড়ি ও বাইজিপাড়া গড়ে ওঠে। তারা শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করতেন মূলত গান ও নাচের মধ্য দিয়ে। খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পাজাতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত ও গজল গাইতেন।
বাইজি ও বাবু সংস্কৃতি
ঢাকায় বাইজিদের অভ্যুদয়ের আরেকটি বিশেষ কারণ ছিল সমকালীন বাবু সংস্কৃতি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে আঠারো শতকের শেষ ভাগে ঢাকায় এক নব্য ধনিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এই বিত্তশালীরা আখ্যায়িত হতে শুরু করেন 'বাবু' নামে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুসলমান জমিদারের স্থলাভিষিক্ত হন তারই হিন্দু গোমস্তা। নব্য জমিদার সম্প্রদায়ের অভ্যুদয় ঘটে।
এই বিত্তশালীদের কথা বলতে গিয়ে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, 'রাজনীতিক পরিবর্তনে পুরোনো অবস্থাপন্ন মুসলমান পরিবারগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যায়। পুরোনো যারা ছিল, দে ফেইল্ড টু একোমোডেট দেমসেলভস উইথ দি নিউ চেঞ্জেস। ফলে যার যা ছিল সব বিক্রি হয়ে যায়।' মুদ্রা বাজার ও মুদ্রা ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং রাজস্ব আইনে আরোপিত বিভিন্ন সংস্কার এই বাবুদের উত্থান তরান্বিত করে। তারা প্রাদেশিক রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করতেন। দেশজুড়ে হুন্ডির ব্যবসা, টাকা বিনিময়, অর্থ লগ্নি (সুদে টাকা খাটানোর ব্যবসা), সামরিক বাহিনীর বেতন প্রদান এবং অভিজাত মোগল কর্মকর্তা, রাজকীয় পরিবারের সদস্য ও সওদাগরদের ব্যবসা করার জন্য তারা প্রয়োজনীয় পুঁজিও সরবরাহ করতেন। বাবুদের মুদ্রা বাণিজ্য ও দালালি ব্যবসার মারপ্যাঁচের কাছে সমসাময়িক অন্যান্য ব্যবসায়ীরা হার মানতে বাধ্য হয়।
ঢাকা জেলা কালেক্টরেটের ১৭৮৭ সালের জরিপ অনুযায়ী ঢাকার বাজারে তখন প্রচলিত ছিল মোট ৭ ধরনের মুদ্রা। তবে এর মধ্যে আর্কট মুদ্রার প্রাধান্য ছিল সবচেয়ে বেশি। পরবর্তী অবস্থানে ছিল 'সিক্কা' মুদ্রা। সরকারি রাজস্ব পরিশোধ করা হতো সিক্কায়। আর ব্যবসায়িক লেনদেন হতো আর্কটে। নানা ধরনের মুদ্রার বিনিময় প্রথার এ কৌশলকে কাজে লাগিয়ে শ্রফ, শেঠ ও পোদ্দাররা ঢাকায় বিকশিত হয়। মুদ্রা বিনিময় আর অর্থলগ্নি ব্যবসার লাভ দিয়ে পরবর্তী সময়ে জমিদারি কিনেছিলেন মথুরানাথ পোদ্দার। ব্যবসার শুরুতে আনুমানিক ১৮২০-এর দশকে বাংলাবাজারের রাস্তার ওপর চট পেতে তিনি কড়ি, পাই, আনা, রুপি সাজিয়ে রাখতেন। এক রুপি ভাঙানোর জন্য বাট্টা নিতেন এক পাই। সে সময় পাইয়ের চেয়েও ক্ষুদ্রতম একক ছিল কড়ি (১ রুপি=১৬ আনা=৬৪ পয়সা=১৯২ পাই, ১ পাই=২০ কড়ি)। এক রুপি ঋণের জন্য প্রতিদিন এক পয়সা সুদ নেওয়া হতো। যার অর্থ এক শ রুপি ধার দিলে এক বছরে সুদ পাওয়া যেত পাঁচ শ সত্তর রুপি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীতি-বাবুদের সৃষ্ট নৈরাজ্যকে আরও বেগবান করেছিল। বাবুরা কোম্পানি থেকে আভিজাত্যের উপাধি স্বরূপ পেয়েছেন বিভিন্ন উপাধি। বাবু সংস্কৃতির নিগঢ়ে শুধু হিন্দু বাবুরাই মোহাবিষ্ট হননি, আহসান মঞ্জিলের অনেক নওয়াবও এ সংস্কৃতির সাধক ছিলেন। ঢাকার সামাজিক পরিবেশে আচার-আচরণের প্রথাগত বিধিনিষেধের গণ্ডি ছিল তাদের অপছন্দ। বাবুদের পৃষ্ঠপোষকতায় আত্মপ্রকাশ করেছিল রক্ষিতা পোষণ, বাইজি নৃত্য, খেমটা নাচ, বেশ্যাগমন, ঘোড়দৌড়ের বাজি, পাশা খেলা, আফিম খাওয়া প্রভৃতি। সাহেবদের খুশি করার জন্য সুদূর লক্ষ্ণৌ থেকে বাইজি আনা হতো আসরে।
১৮৮৮ সালে লর্ড ডাফরিনের ঢাকা সফরের সময় নাচের আয়োজন করতে গিয়ে বিপত্তি বাধে স্থান নির্বাচনে। প্রতিদ্ব›দ্বী ছিল আহসান মঞ্জিল ও রূপলাল হাউস। ইউরোপীয় ক্লাবে অনুষ্ঠিত সভ্যদের ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতে রূপলাল হাউস। লর্ড ডাফরিনকে নাচ দেখাবার জন্য ইংরেজ কোম্পানি দুই দিনের জন্য ২০০ টাকায় ভাড়া নিয়েছিল রূপলাল হাউস। কিন্তু এই বাড়িটি সাজাতে রূপলাল পরিবারের খরচ হয়েছিল ৪৫ হাজার টাকা!
বাইজি শ্রেণিভাগ, এজেন্ট ও বাদ্যযন্ত্রী
বাইজি শব্দের বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনীতে। তিনি লিখেছেন, বাইজিদের চারটি শ্রেণি ছিল। যার নামের সঙ্গে শুধু 'বাঈ' শব্দটি ব্যবহৃত হতো, তিনি শুধু গান করতেন। যার নামের সঙ্গে 'জান' শব্দটি ব্যবহৃত হতো, তিনি নাচ ও গান দুটিই করতেন। তৃতীয় জনকে 'কানীজ' বলা হতো, যিনি অতিথিদের আপ্যায়ন করতেন এবং মদ পরিবেশ করতেন। আর চতুর্থ জনকে 'খানাগী' বলা হতো, যিনি বেশ্যাবৃত্তি করতেন। হিন্দুস্তানি 'জি' যোগ করা হতো, সম্ভ্রম জানানোর উদ্দেশ্যে। বিভিন্নজনের স্মৃতিচারণায় বাইজির সমার্থক হিসাবে 'তওয়ায়েফ' শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে। সত্যেন সেনের তথ্যমতে, বাইজিরা গানের ভাব প্রকাশ করতেন নাচের মুদ্রায়; হাত, মুখ, চোখ, নাক ও ওষ্ঠের সূক্ষ্ণ কম্পনে। নাচ-গানের সঙ্গে ব্যবহার করা হতো দুটি করে বেনারসি সারেঙ্গি, বেনারসি তবলা ও বেনারসি মন্দিরা। পেশওয়াজ, চুড়িদার পাজামা, ওড়না ও পায়ে চিকন ঘুঙুর পরার প্রচলন ছিল বাইজিদের মাঝে। আর তাদের দেখাশোনা করা, বাজনা বাজানো এবং নতুন গ্রাহক জোগাড় করার জন্য থাকত নিজস্ব লোক। বাইজি পরিভাষায় তাদের বলা হত 'সফরদার'। তাদের ওপর বাইজিরা অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল। সফরদারের পোশাক ছিল পাঞ্জাবি, ভেলভেটের ওয়েস্ট কোট এবং মাথায় ভেলভেটের কিশতি টুপি।
নওয়াববাড়ির বাইজিরা
আবদুল গনীর নওয়াবি খেতাবপ্রাপ্তি তথা ১৮৭৫ সাল থেকে সে শতকের শেষ অবধি প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে নর্তক-নর্তকী ও গায়ক-গায়িকারা শাহবাগে (বর্তমান শাহবাগ, মধুর ক্যান্টিন, দোয়েল চত্বরসহ সড়ক ভবন অংশ) নাচ-গান করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করতেন। বাইজিদের এক সুদীর্ঘ তালিকা ছিল। তাদের নওয়াব এস্টেট থেকেই মাসিক বেতন দেওয়া হতো।
১৮৭৫ থেকে ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকার ৭০ বছরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে লেখা 'ঢাকা পাচাশ বারাস পাহলে' গ্রন্থে হেকিম হাবিবুর রহমান স্মৃতিচারণা করেছেন, 'নওয়াব স্যার আব্দুল গণির ওখানে সকালবেলা শহরের রইসগণ টেবিলে জমা হতেন আর চা পান করতেন।...এই টেবিলে শহরের নামকরা তওয়ায়েফগণও জমা হতেন। ...তার মধ্যে দুই-চারজনের নাম আমার স্মরণে আছে, তা এখন পেশ করছি। আন্নু, গান্নু ও নওয়াবীন এরা তিন বোন ছিল। নওয়াবীন অনেক নাম করেছিল এবং সেই সবচেয়ে অল্পবয়স্কা ছিল। ...যা হোক সেই তওয়ায়েফদের বদৌলতে ঢাকায় সংগীতচর্চা সমাদৃত হতে লাগল।'
এ গ্রন্থ থেকে পান্না বাইয়ের বিষয়েও তথ্য পাওয়া যায়, যিনি গজল গেয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। এ ছাড়া আচ্ছি বাইয়ের বিষয়ে বলা হয়েছে। যাকে হেকিম হাবিবুর রহমান নৃত্যপটিয়সী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রেবা মুহুরীর 'বাইজি ও ঠুমরি' গ্রন্থ হতে বাইজিসংশ্লিষ্ট একটি চমকপ্রদ তথ্য জানা যায়, 'কীভাবে লোকের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে চলতে হয়, কীভাবে বসতে হয়, কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত, কোন সময় হাসা যায়, কোন সময় হাসা উচিত নয়– এই সমস্ত জিনিস বাইজিদের খুব ভালোভাবে শিখতে হতো।' সমাজের উঁচুতলার মানুষদের মনোরঞ্জনের জন্য এভাবেই নিজেদের প্রস্তুত করতে হতো সেকালের বাইজিদের।
'জিন্দাবাহার'-এর 'সুন্নৎ বাঈ'
চিত্রশিল্পী পরিতোষ সেন ছিলেন ঢাকার সন্তান। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে জিন্দাবাহারের বৈচিত্র্যময় পরিবেশে। সুন্নৎ বাঈসহ এলাকার নানাবিধ সামাজিক বিষয়াদি তুলে ধরেছেন তাঁর আত্মজীবনী 'জিন্দাবাহার'-এ। বাইয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেনে, 'ছোটবেলায় আমাদের দাই জামিলার মার কাছে তখনকার ঢাকার সবচেয়ে নামকরা বাইজি সুন্নৎ বাঈর আশ্চর্য নাচের গল্প শুনেছি।...শরীরটাকে যেমন খুশি বাঁকাতে পারত।...একই আসরে দুজনকে নাচবার দাওয়াত দেওয়া হলো। সুন্নৎ বাঈ কিছুতেই রাজি হয় না, নানা রকম নখরাবাজি করে। তারপর যখন নাচের আসরে কুর্নিশ করতে করতে ঢুকল, পায়ে রাশি রাশি ঘুঙুর-পরা সত্ত্বেও একটা ঘুঙুরের আওয়াজ শোনা গেল না। যেন হাওয়ার ওপরে পা ফেলছে...।'
গওহরজান
বাইজিরা নৃত্যগীতের আসর জমাতেন কখনো নিজস্ব আঙিনায় আবার কখনো সম্মানীদাতার পছন্দশীল পরিবেশে। তাদের এই আসর পরিচিত ছিল 'মেহফিল' বা 'মুজরো' নামে। ভারত থেকে ঢাকায় 'মুজরো' করতে আসা বাইজিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গহরজান, নুরজাহান, মালকাজান, সিদ্ধেশরী, জানকী বাঈ (ছাপপান ছুরি), জরদান বাই (সিনেমার নার্গিসের মা), কোহিনূর ও ইন্দুবালা।
সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুরের লেখা থেকে জানা যায়, ১৮৯০-এর দশকে (১৮৯৬ সালে) ঢাকার কাজীবাড়ির এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গওহরজান নাচ-গান করে গেছেন এবং তৈফুর তা দেখেছেন। কাজী জালাল উদ্দীন ও রাজিউদ্দীনের পরিবারের এক বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল এটি। গওহরজানের মা মালকাজান। উর্দু, ফারসি আর হিন্দিতে প্রায় সমান দখল ছিল মালকার। তাঁর লেখা ১০৮ পাতার কাব্যগ্রন্থে গজল ছিল ১০৬টি। এ প্রসঙ্গে গবেষক সোমনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন, 'মুজরোর নেশার ঘোর লাগিয়ে দেওয়ার মন্ত্র মালকাজানের হাতের মুঠোয় ছিল এবং সেই বিদ্যা তিনি গোপন রাখেননি আদরের মেয়ে গওহরজানের কাছে। বিদ্যেধারীদের ছলাকলার সবটুকু বিদ্যে উজাড় করে শিখিয়েছিলেন মেয়েকে।'
একই মুজরায়, একটি বা দুটি নাচের ফাঁকে ফাঁকে পোশাক বদলে নিতেন গহর– যা সেই যুগের রেওয়াজের পক্ষে ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। তাঁর অলংকারও ছিল অভিনব। বলা যায়, গহরের অর্ডার দেওয়া পোশাক থেকেই শুরু হতো কলকাতার ফ্যাশনের অ-আ-ক-খ। সাদা-কালো পোস্ট কার্ড সাইজে রমরমা করে বিক্রি হতো তাঁর ছবি এক আনায়। রঙিন হলে ওই ছবির দাম হতো দুই আনা। ১৯০২ সালে প্রথম গওহরের গান রেকর্ড হয় গ্রামোফোন রেকর্ডে। বাইজিরা সাধারণত বাংলা গান করত না। ব্যতিক্রম ছিলেন তিনি।
গ্রামোফোন রেকর্ডের লেবেলে খুঁজে পাওয়া যায় 'sung by Gauharjan, 1st Dancing Girl', এর ওপরে লেখা 'পরকে দিয়া প্রাণ'। বাংলা ছাড়া হিন্দি, উর্দু, ফারসি, মারাঠি, পাঞ্জাবি ও ইংরেজি ভাষায় গান তার সঞ্চয়ে থাকত। শুনিয়ে দিতেন ফরমায়েশ কিংবা দরকারমাফিক। ভূপালি রাগের ত্রিতাল ছন্দে গাওয়া তার অন্যতম গান 'কাঁচা চাইয়্যে দাইয়্যা, বলহার করে দাইয়্যা, আনজান বানে বাইয়্যা.....' এতগুলো বছর পরেও শ্রোতাদের হৃদয়ে সুরের অনুরণন তোলে মুহুর্মুহু। কী এক অদ্ভূত মায়া ছিল গওহরের গলায়!
প্রতিভা বসুর স্মৃতিকথায় বাইজির নৃত্যগীত
হিন্দুদের ঝুলন উৎসবের সময় ধনী বণিকদের বাড়িতে বাইজিদের নিয়ে নিয়মিত মেহফিলের আয়োজন হতো। এর মধ্যে লালমোহন সাহার ঠাকুরবাড়ি ছিল বিখ্যাত। ঠাকুরবাড়ির মেহফিলে উপস্থিত হতো ঢাকাই ধুতি আর ধবধবে সাদা বিলিতি আদ্দির গিলে করা পাঞ্জাবি পরা সব বাবুরা। যাদের গা থেকে ভুর ভুর করে বেরোত আতরের গন্ধ। তাদের আয়োজনে থাকত রুপোর থালাভর্তি তবক মোড়া পান আর এলাচ লবঙ্গ। ঠাকুরবাড়ির এই মেহফিলে বসে বাইজির নৃত্যগীত দেখার সুযোগ হয়েছিল লেখিকা প্রতিভা বসুর। তাঁর স্মৃতিকথা 'জীবনের জলছবি'তে যা ফুটে উঠেছে এভাবে, 'এই আসরে বয়স্ক মহিলা একজনই আর সব ছুকরি।...গান ধরল বাই "সামো ঝুলামেভি রাধেকা না ঝুলাতে হ্যাঁয়, বাকি সখিয়ো আপন গালে লাগাতো হ্যা–"... ফুলবাবুরা আতরের গন্ধ ছড়িয়ে ফুল কোঁচা নেড়ে কখনো হায় হায় কখনো মারদিস এইসব বুলি আওড়ে নিজেদের খুশি জানাচ্ছে। গান শেষ করে বসে পড়ল বাই, এবার ছুকরিরা নাচে-গানে ঘুঙুরের শব্দে, রইস রইস বাবুদের ঘাঘরার আঘাতে কাত করতে লাগল আর বাবুরা ছুড়ে ছুড়ে টাকা দিতে লাগল।'
বাইজিবাড়ি 'গঙ্গাজলি'
ব্রিটিশ আমলে জিন্দাবাহার ছিল বাইজি-বারাঙ্গনাদের চারণভূমি। নৃত্যগীত নিপুণা ও বিলাস ব্যসন সংযুক্ত নানা কৃষ্টিসম্পন্ন গণিকা ছিল সে আমলে। তারা অধিকাংশই ছিলেন সুন্দরী নর্তকী ও গায়িকা। এদের সংস্পর্শে এসে ঢাকার ধনী ও অভিজাত শ্রেণির লোকেরা জীবনটাকে ভোগ করতেন ঠিক ইন্দ্রপুরীর মতো। নাট্যকার সাঈদ আহমদ তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'জীবনের সাতরং'-এ বর্ণনা করেছেন গঙ্গাজলির কাহিনি। পাটুয়াটুলী থেকে বেরিয়ে সোজা জনসন রোডে যাওয়ার প্রবেশমুখেই পড়ত গঙ্গাজলি, পাশে কালীবাড়ি।
সাঈদ আহমদের লেখনীতে ফুটে উঠেছে এখানকার বাইজিদের দেহসৌষ্ঠবের আদি-রসাত্মক বর্ণনা, 'বাড়িটির নাম গঙ্গাজলি।...বাইজিরা গঙ্গাজলিতে আসতেন, কিছুদিন অবস্থান করে যে যার মুল্লুকে ফিরে যেতেন। কোনো কোনো বাইজি ওই বাড়িতেই থেকে যেতেন। আমরা নিচে দাঁড়িয়ে ওদের গানের রেওয়াজ শুনতাম। সন্ধ্যা ঘনালেই গানবাজনা শুরু হতো। ঠুমরি আর দাদরায় গঙ্গাজলি গুলজার করত। আর দিনের বেলায় রেওয়াজ চলত। ...সূর্যোদয়ের আগে প্রায় সব বাইজিই ওয়াইজ ঘাটে স্নান করতে যেত। ...নদীর পানিতে ডুব দিত পবিত্র হওয়ার জন্য। সারিবদ্ধভাবে গামছা পেঁচিয়ে ঘরে ফিরে যেত। ভেজা কাপড়ে উন্মুখ হয়ে ফুটে উঠত তাদের সুডৌল দুটি স্তন। সেই স্তন দুলিয়ে তাদের পথ চলার দিকে আমি আর আমার বন্ধুরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকতাম।'
বর্তমানে সেই গঙ্গাজলি নেই, নেই কালীমন্দিরও। সেকালের বাইজিরা স্থান করে নিয়েছিল সমকালীন কবিদের রচনায়ও। সৈয়দ শামসুল হক 'আমার শহর' কাব্যগ্রন্থে ব্যক্ত করেছেন এই উদ্দাম স্তনওয়ালী বাইজিদের কথা– 'আমি ছাড়া আর কে এখনো হাঁটে পোস্তগোলায়/ এবং ব্যাকুল হয়ে খোঁজে সেই দুধ নারীদের/ যারা ভোরে স্নান করে নদীর ধারায়/ যাদের পায়ের শব্দ বহুদূর থেকে শোনা যায়।'
চিরায়ত কৌলিন্য প্রথা
সুদীর্ঘ এই সাংস্কৃতিক অভিযোজনের পাশাপাশি ঢাকা শহরের মানুষ অনেকগুলো দৈব দুর্বিপাক তথা ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো ও দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছে। আর এই দৈব দুর্বিপাকের সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে নারী। বাস্তুচ্যুত নারীকে, স্বজনহীন হয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে আবির্ভাব ঘটেছিল ভারতীয় উপমহাদেশের চিরায়ত কৌলিন্য প্রথার; যা তখনকার কুলীন সমাজে বহুবিবাহের ব্যাপক প্রসার ঘটায়।
বিবাহের ক্ষেত্রে কুলীন পুরুষের বয়স কোনো বাধা হিসেবে বিবেচিত হতো না। এ প্রসঙ্গে শ্রী কেদারনাথ মজুমদার তাঁর 'ঢাকার বিবরণ ও ঢাকা সহচর'-এ উল্লেখ করেছেন, 'দশ বৎসরের বালক ৩৫ বৎসরের কুমারীকে এবং ৮০ বৎসরের বৃদ্ধ ১২ বৎসরের বালিকাকে বিবাহ করিতে লাগিলেন। কারণ অন্যত্র পর্যায় মিলিতেছে না। ক্রমে বহুবিবাহ জঘন্য ব্যবসায় পরিণত হইয়া গেল। কুলীন জামাতা অর্থ পাইয়া এক রাতে এক স্থানে বসিয়া বিভিন্ন পরিবারের ২০-২৫টি বালিকা, কুমারী ও বৃদ্ধার পানি পীড়ন করিয়া উপায়হীন কন্যাদাতাগণের দায় ও কুল উদ্ধার করিতে লাগিলেন এবং পরদিন প্রত্যুষে উঠিয়া সেই ধর্মপত্মীদিগকে তাঁহাদিগের পূর্ব প্রতিপালকের হস্তে জন্মের মতো পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন।'
বারাঙ্গনা আকীর্ণ নগরী ঢাকা
সম্ভবত এসব পরিত্যক্ত নারীদের শেষ আশ্রয়স্থল ছিল গণিকালয়। এ ছাড়া সে সময় চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল বারাঙ্গনাদের এ পেশায় যাওয়ার অন্যতম কারণ। স্যার চার্লস ডয়লির ১৮২৪ সালের 'Antiquities of Dacca' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সেকালে চকবাজারে ক্রীতদাস বেচাকেনার ব্যবস্থা ছিল। বাংলায় ক্রীতদাসীদের দাম খুব কম ছিল। অল্প বয়সের ক্রীতদাসীরা সাধারণত বারবনিতা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে ঢাকা ছিল বারাঙ্গনা আকীর্ণ নগরী।
পতিতাপল্লি-বাইজিবাড়ির মাঝে চোখে পড়ত সাইনবোর্ড: 'গৃহস্থ বাড়ি'। ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট Henry Walters-এর ২৫ মার্চ ১৮৭৯ সালের 'Census of the City of Dacca এবং Municipal Proc.'-এর তথ্য মোতাবেক ১৮৩০ সালে ঢাকায় বারবনিতার সংখ্যা ছিল ২৩৪ জন, ১৮৭০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৭৮৩ জন। ১৯০১ সালে ৯০,৫৪২ জন শহরবাসীর মধ্যে বারাঙ্গনার সংখ্যা ছিল ২১৬৪ জন।
বেসরকারি মতে, এদের সংখ্যা ছিল আরও বেশি। ১৮৬৪ সালের সাপ্তাহিক 'ঢাকা প্রকাশ' পত্রিকায় সেকালে গণিকাবৃত্তির ব্যাপকতার প্রমাণ মেলে–'...ঢাকায় ক্রমে ক্রমে বেশ্যার সংখ্যা অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিয়াছে। বিগত ১০ বৎসর পূর্বে এখানে যে পরিমাণ বেশ্যা ছিল, এক্ষণে তাহার চতুর্গুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে বলিয়া অত্যুক্তি হয় না। সদর রাস্তার উভয় পার্শ্বের উত্তম উত্তম যে সকল একতালা ও দোতালা দালান আছে, তাহার সমুদয়ই প্রায় বেশ্যাপূর্ণ হইয়াছে। বেশ্যাবাস সংস্রব নাই, রাজপথের উভয় পার্শ্বে এরূপ উৎকৃষ্ট দালানই নাই বলিলে হয়...।'
সে সময় সংবাদপত্রে প্রায়ই বারাঙ্গনাদের খবর ছাপা হতো। তাদের শহরের বাইরে স্থানান্তরের পরামর্শ দেওয়া হতো। গণিকাবৃত্তি এমন একপর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে ১৮৬৯ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনারদের এক সভায় শহরের পতিতাদের মধ্যে সিফিলিস রোগ দমনের জন্য একটি যৌনব্যাধি নিরাময় চিকিৎসালয় (Lock Hospital) স্থাপন করার জন্য ঢাকার আর্মেনীয় জমিদার জে জি এন পোগোজ প্রস্তাব করেছিলেন। জেমস টেলরের (১৮৪০) 'কোম্পানী আমলে ঢাকা' থেকে জানা যায়, সেকালে ঢাকায় অধিকাংশ ঝগড়াবিবাদ, হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতো বারবনিতাদের কেন্দ্র করে। নাজির হোসেনের (১৯৭৬) 'কিংবদন্তির ঢাকা'তেও একই সুর অনুরণিত হয়েছে।
গনিউর রাজা
সে সময়ের ঢাকার নেশাপান ও বেশ্যাগমনের এক সম্মিলিত চিত্র ফুটে উঠেছে মরমি কবি হাছন রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র গনিউর রাজার আত্মকাহিনি 'গনিউর রাজার ঢাকা ভ্রমণ'-এ (১২ ভাদ্র ১৩১২ বাংলা)। এ রোজনামচায় তিনি তৎকালীন গণিকা-সংস্কৃতির সামাজিক চিত্রায়ণ করেছেন নিপুণ হস্তে। এখানে দেখা যায় গণিকালয়ে গমনের পাশাপাশি সে সময় অনেকে বাঁধা রক্ষিতাও রাখতেন। এ রকমই একজন ঢাকার বিখ্যাত জমিদার মৌলভী গোলাম মওলা সাহেবের পুত্র, নান্না মিয়া। ওই রক্ষিতার জন্য নান্না মিয়ার কী পরিমাণ খরচ হয়, গনিউর রাজা জানতে চাইলে বাড়িওয়ালা সুনা মিয়ার উত্তর ছিল: 'ওই মাগির বেতন মাসিক ১০০ টাকা, একজন মেয়ে চাকরানিও আছে, বেতন ১ টাকা ও একজন পুরুষ চাকরও আছে, বেতন ৫ টাকা। এ ছাডা নাপিত ধোপা সরকারি, খোরাকিতে এই মাগির তলে মাসিক ১০-১২ টাকা যায়। ...মাগি গাঁজা-মদ উভয়টাতেই অভ্যস্ত, কিন্তু গাঁজা কিছু বেশি খায়, সমস্তই নান্না মিয়া দেন ও সমস্তে আনুমানিক ১২৫, ১৫০ টাকা বা ততধিক কোন [কোন] মাসে তাহার তলে খরচ যায়...।' যখন (২৮ জুন, ১৯০৩ সাল) ঢাকায় ১ টাকায় ১২ সের চাল পাওয়া যেত! সে সময়ে একজন রক্ষিতার জন্য মাসিক খরচ ছিল ১৫০ টাকারও অধিক।
ঐতিহ্যবাহী সাঁচিবন্দর
বারবনিতা আকীর্ণ গলি হিসেবে সাঁচিবন্দরের (বর্তমান বাদামতলী) ঐতিহ্য ছিল একসময়। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত কথাশিল্পী সালাদীনের 'সাঁচিবন্দর ফার্স্ট লেন' থেকে জানা যায় লোমহর্ষক অজানা তথ্য। যুদ্ধফেরত ক্লান্ত গোরা সৈন্যরা চাঙা হতে আসত সাঁচিবন্দরের গলিতে। বারাঙ্গনা নিয়ে দ্বন্দ্ব হতো অনেক সময়। গভীর রাতে চুপি চুপি বারাঙ্গনা আর বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বী ফেলে দিয়ে আসত মৃত সৈনিকের দেহ, বুড়িগঙ্গার জলে। সমাজ ছিল এখানে মাতৃজাত। গর্ভজাত সন্তান ছেলে হলে তার ভাগ্যে ঘটত অবধারিত মৃত্যু। মারা হতো 'নুন' বা 'তেল' দিয়ে। তার ওপর ছিল পুলিশি হয়রানি। ব্যতিক্রমও ঘটত মাঝে মাঝে। দালালের হাত বাঁচিয়ে কোনো বারবনিতা-নন্দন যখন বড় হয়ে উঠত এবং কর্মক্ষেত্রে বৃহত্তর সমাজে যখন সে নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় হিসেবে দেখতে পেত, তখন জন্ম দেওয়ার অপরাধে এই ছেলেরই দৃঢ়মুষ্ঠি চেপে বসত মায়ের গলায়; যে কারণে ঔরসজাত মেয়েসন্তানই ছিল মায়ের একমাত্র আশা-ভরসা। আর এই মেয়ের রোজগারই শেষ বয়সে মাকে বাঁচিয়ে রাখত।
রাবেয়া খাতুনের স্মৃতিকথায় কান্দুপট্টি
মোগল ও ব্রিটিশ আমলের মাঝামাঝি বারনারীদের যে রমরমা অবস্থা ছিল, তার উচ্ছিষ্ট একটি অংশ ছিল কান্দুপট্টি (বর্তমান নবাবপুর এলাকা)। কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের সহপাঠিনী ছিল রেণু নামে এই কান্দুপট্টিরই এক বারনারীর কন্যা। লেখিকার 'স্বপ্নের শহর ঢাকা' গ্রন্থে রেণুর জীবনকাহিনি নানাভাবে তুলে ধরেছেন। রেণুর পিতৃপরিচয় নিয়ে সহপাঠিনীদের জিজ্ঞাসা তাকে বিব্রত করত। রেণুর বাড়ির মেহফিল আর ঘুঙুরের শব্দ নিয়েও সহপাঠিনীদের কৌতূহলের অন্ত ছিল না।
তত্ত্বীয়ভাবে উচ্চস্থান বারাঙ্গনাদের জন্য বরাদ্দ করা হলেও অভিজ্ঞতা হতে দেখা যায়, সমাজ এদের খুবই খারাপ চোখে দেখে। এ প্রসঙ্গে মীজানুর রহমান তাঁর 'ঢাকা পুরান' গ্রন্থে মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন, 'একবার দেখেছি লাশ বহনকারী চারপায়া কাঁধে চার রমনীকে। নিঃশব্দে তাদের অনুসরণ করছিল আরও কয়েকজন রমণী, পাশে দু-তিনটি ছেলেমেয়ে। ওরা কাঁদছিল। বোধ করি ওদের মাকেই নিয়ে যাচ্ছিল বেওয়ারিশ কোনো শ্মশানঘাটে। কারণ, ভদ্রলোকের শ্মশানঘাটে তার গতি হওয়ার নয়। তেমন পয়সা রেখে না গেলে বারবিলাসিনীর গতি হবে মা বুড়িগঙ্গার কোলে। মজা কী, শব বহন করতে পুরুষ দালালদেরও ইজ্জতহানির আশঙ্কা! তাই তো অবলা ওই বারনারী নিজেদের বলে বহন করছিল ওই চারপায়া।'
রেসকোর্সে বারাঙ্গনা
বেশ্যা ও বাইজি গমনের অনুষঙ্গ হিসেবে সেকালে জুয়ার প্রতারণাটাও ছিল একটা স্বীকৃত ব্যাপার। বাজিটা যে শুধু টাকায় হতো, তা নয়, ঘোড়া বাজি রাখা হতো। সুন্দরী রমণী বাজি রাখা হতো। বুদ্ধদেব বসু তাঁর 'আমার যৌবন' স্মৃতিকথায় ঢাকার রমনার রেস, বারবনিতা আর জুয়াড়িদের বর্ণনা দিয়েছেন। রমনার রেসকোর্সের ঘোড়দৌড় ছিল সেকালের বারবনিতাদের বিনোদনের অন্যতম অবলম্বন। কান্দুপট্টি, সাঁচিবন্দর, কুমোরটুলির হট্টবিলাসিনীদের দেখা মিলত রমনার রেসকোর্সের ভিড়ে।
বাইজিদের সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম
শুধু বারাঙ্গনা নয়, নৃত্যগীত পটিয়সী বাইজিদেরও সমাজ দেখত হেয় চোখে। যদিও আর্থিক স্বচ্ছলতার কারণে তাদের সামাজিক অবস্থান ছিল বারাঙ্গনাদের চেয়ে ওপরে, তথাপি সামাজিক মর্যাদা ও পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতো তারা। ঢাকার এক অবাঙালি উচ্চপদস্থ কর্মচারীর একমাত্র সুন্দরী মেয়ের বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল বিয়ের মজলিসে। কারণ, ওই ভদ্রলোকের 'মা' ছিলেন এক নওয়াবের তাওয়ায়েফ। সমাজের চোখে অশুচি হলেও তাদের মানবিক গুণাবলির ঘাটতি ছিল না। ঢাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহব্যবস্থা চালুর জন্য ১৮৭৪ সালে জমিদার-বিত্তশালীদের কেউই নওয়াব আব্দুল গণির আহ্বানে সাড়া দেননি। শুধু সমাজের চোখে ভ্রষ্টাচারী বাইজী-রাজলক্ষ্মীও আমীরজান পাঁচ শ টাকা করে দান করতে এগিয়ে এসেছিলেন। যদিও নওয়াব পরবর্তী সময়ে কারও কাছ থেকে টাকা না নিয়ে নিজেই দান করেছিলেন এক লক্ষ টাকা। ১৮৮৬ সালে ভূমিকম্পের পর জিন্দাবাহারের কালীবাড়ি ভেঙে গেলে রাজলক্ষ্মী তা তৈরি করে দিয়েছিলেন। রমনার কালীবাড়ি সংস্কারের জন্যও তিনি চাঁদা দিয়েছিলেন বড় অঙ্কের। নসিবুন বাইজি সিদ্দিকবাজারে একটি পুকুর খনন করেছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছোঁয়া, দেশভাগ ও জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ বদলে দেয় বাইজি সংস্কৃতির ধারাকে। চেনা বাইজিপাড়া বদলে যায়। স্তব্ধ হয়ে যায় সারেঙ্গির সুর, তবলার ঠেকা আর নূপুরের নিক্বণ। জীবনের শূন্য আবর্তে হারিয়ে যায় কর্মক্লান্ত গীতি আর জীবনের আঁধারে নিভে যায় জলসাঘরের বাতি। বাইজিদের স্মৃতি রয়ে যায় শুধু কিছু সংগীতজ্ঞ ও প্রাচীন মানুষের অতীতচারণায়। আর রয়ে যায় তাঁদের দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য কিছু আলোকচিত্র, যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে বিস্মৃতির এক বিষাদময় অধ্যায়।