ভারতবর্ষে ‘হোয়াইট ব্যাবো’ বা ‘সাদা বাবু’র পোশাক-আশাক
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/13/esel_pic_1_0.jpg)
ইংরেজরা ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ সম্পর্কে খুব একটা ভালো ধারণা পোষণ করত না। উপমহাদেশের মানুষের পোশাকের ব্যাপারেও তাদের চিন্তাধারা ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের।
ইংরেজরা এ উপমহাদেশের আসার পর সবচেয়ে অবাক হয় ভারতীয় জেলেদের পোশাক দেখে। বেশির ভাগ জেলেই খালি গায়ে শুধু ধুতি কিংবা লেংটি পরেই মাছ ধরতে চলে যেত। অনেক ইংরেজ তো এটাও প্রচার করতে থাকে, 'ভারতীয় জেলেরা নগ্ন হয়ে মাছ ধরতে যায়!'
ধীরে ধীরে অভিজাতদের সাথেও মেলামেশা শুরু হয় ইংরেজদের। অভিজাতদের পরনের রঙিন আংরাখাগুলোর তারিফও করেছেন অনেক ইংরেজ পর্যটক। ইংরেজরা সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিল উপমহাদেশের রাজাদের রত্নখচিত পোশাকগুলো দেখে।
পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ইংরেজ পর্যটকদের বর্ণনা পড়লেই বোঝা যায় যে তাদের মতে ভারতীবর্ষের উচ্চবিত্তদের পোশাক 'দৃষ্টিনন্দন' আর নিম্নবিত্তদের পোশাক 'দৃষ্টিকটু'।
কিন্তু ভারতবর্ষে ইংরেজদের ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তার চিন্তাধারারও পরিবর্তন হয়। তখন তারা উচ্চবিত্তদের পোশাকগুলোকে 'মেয়েলি', 'শিশুসুলভ' ইত্যাদি বলতে থাকে। অনেকে এটাও বলত, 'ভারতীয় পুরুষেরা মূলত মেয়েলি স্বভাবের।'
এই বিষয়ে ভারতীয় মনোবিজ্ঞানী আশিস নন্দী বলেন, 'ক্ষমতা লাভের আগে ইংরেজরা, ভারতীয় উচ্চবিত্তদের সাথে বেশ ভালো সদ্ভাব রেখে চলত। তাদের পোশাক, খাবারদাবার, সংস্কৃতি ইত্যাদির বেশ ভালোই প্রশংসা করত। কিন্তু ক্ষমতা লাভের সাথে সাথে উচ্চবিত্তদের নানা ব্যাপার নিয়ে তারা মজা করতে শুরু করে, ভারতীয়দের সব ক্ষেত্রে নিচু দেখানোর চেষ্টা করতে থাকে।'
উপমহাদেশের মানুষের মাথার পাগড়ি নিয়েও বেশ ভালো রকমের ঝামেলা হয়েছিল।
ভারতীবর্ষের অনেক সম্প্রদায়, ধর্মীয় এবং অন্যান্য নানান কারণে পাগড়ি পরে। কাউকে সম্মান জানাতে পাগড়ি খোলার রীতি নেই ভারতবর্ষে। অপর দিকে ওই সময়ে ইংরেজরা পরত হ্যাট। বড় অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে তারা হ্যাট খুলে সম্মান জানাত। কিন্তু ভারতীয়রা কখনোই পাগড়ি খুলত না। এই ব্যাপার নিয়ে অনেক ইংরেজ অফিসারা অসন্তুষ্ট ছিলেন। বেশ কয়েকবার তো স্থানীয়দের পাগড়ি খুলতেও বাধ্য করা হয়েছিল।
ক্ষমতা লাভের আগে ব্রিটিশ অফিসাররা ভারতীয় মহারাজাদের দরবারে ঢোকার আগে জুতো খুলে প্রবেশ করত। কিন্ত ক্ষমতা লাভের পর তারা আর জুতো খুলত না।
ইংরেজরা নানান গল্প, কাহিনি, ছবি এবং চিঠির মাধ্যমে প্রচার করতে থাকে যে ভারতীবর্ষেও অধিবাসীরা মূলত অসভ্য। উনিশ শতকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জন ব্রিগস একজন নিম্নপদস্থ অফিসারকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটির কিছু অংশ নিচে উল্লেখ করা হলো-
ভারতীয় অসভ্যদের মাছ ধরার দৃশ্য দেখতে অদ্ভুত লাগে। মনে হয় যেন একদল কদাকার কালো পশু উঠে বসেছে নৌকাতে, তারপর ওরা চলে যাচ্ছে সাগরে! বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওদের পরনে কিছুই থাকে না!
একবার ভেবে দেখো... এদের মাঝে কীভাবে বাস করছি? ইউরোপের যেকোনো মানুষের পক্ষে এদের সাথে মিলেমিশে থাকা প্রায় অসম্ভব। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সভ্যতা হলো ইউরোপীয় সভ্যতা। পৃথিবীর সেরা শহরগুলো ইউরোপে অবস্থিত। সেই অসম্ভব সুন্দর জায়গা থেকে এসে এখানে বসবাস করাটা রীতিমতো দুঃস্বপ্নের মতো।
তবে ভারতীয় পোশাক নিয়ে সব ইংরেজদের চিন্তাধারা কিন্তু খারাপ ছিল না। অনেকেই বেশ আগ্রহ নিয়ে ভারতীয় পোশাক পরত। বেশ কিছু ব্রিটিশ অফিসার স্থানীয় অভিজাতদের মতো করে আংরাখা বানিয়ে তাতে বোতাম লাগিয়ে নিত। তারা মনে করত যে এই পোশাকগুলো ভারতবর্ষের মানুষের সাথে তাদের বন্ধন আর মজবুত করবে।
ব্যাপারটা ভারতীয়রাও বেশ ভালোভাবে নিয়েছিল। উপমহাদেশের রাজাদের আয়োজন করা অনুষ্ঠানে ইংরেজ অফিসাররা স্থানীয় পোশাক পরে যেত।
কিন্তু অনেক ইংরেজ পণ্ডিতই ব্যাপারটাকে বেজায় নেতিবাচকভাবে নিয়েছিলেন। কিছু বিশেষজ্ঞ তো এমন মতামতও দিয়েছিলেন, 'ইংরেজরা জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতিতে ভারতীয়দের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে। ইংরেজরা শ্রেষ্ঠ আর ভারতের মানুষ নিকৃষ্ট। তাই ভারতীয়দের পোশাক এবং তাদের সংস্কৃতি থেকে সর্বদাই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। নইলে ইংরেজরাও ভারতীয়দের মতো অসভ্য হয়ে যাবে। এই অসভ্য ইংরেজরা নিজের দেশে ফিরে গিয়ে দেশের মানুষকেও ভারতীয়দের মতো অসভ্য করে তুলবে!'
১৮৩০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নির্দেশনা জারি করে, 'কোনো ইংরেজ অফিসার দায়িত্বরত অবস্থায় কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে ভারতীয় পোশাক পরে যেতে পারবে না।'
এটা ছিল ভারতীয়দের ওপর ইংরেজদের শ্রেষ্ঠত্ব (!) রক্ষার একটি প্রয়াস।
তবে অনেক ইংরেজ অফিসারই বাড়িতে ভারতীয় পোশাক পরে থাকতেন। পরবর্তী সময়ে লর্ড লিটন, নিজের একটি লেখাতে এমন অফিসারদের 'হোয়াইট ব্যাবো' বা 'সাদা বাবু' বলে অভিহিত করেন। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, সেকালে ইংরেজ সরকারের অধীনে কর্মরত ভারতীয় কর্মচারীদের ইংরেজরা 'ব্যাবো' বা 'বাবু' বলে ডাকত।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল জন ব্রিগস আরেকটি চিঠিতে লিখেছিলেন-
'যেভাবেই হোক ভারতীয়দের বুঝিয়ে দিতে হবে যে আমরা ইংরেজরা ওদের থেকে সর্বক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ। আমরা কোনোভাবেই ওদের মতো পোশাক পরতে পারি না। ব্যাপারটা আমাদের সংস্কৃতির প্রতি রীতিমতো এক প্রকার অপমান। আমরা ভারতীয়দের শাসক আর ওরা আমাদের প্রজা। প্রজাদের সাথে শাসকদের খানিকটা দূরত্ব বজায় রাখতেই হয়। আজকাল দেখছি বেশ কিছু ইংরেজ অফিসার ভারতীয়দের মতো পোশাক পরছে... ওদের সাথে মিশছে!
'অদ্ভুত ব্যাপার না? আমরা যদি ওদের সাথে মিশেই যাই... তাহলে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাকবে কীভাবে? আমাদের রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে না?
'ওরা হয়তো ভাবছে যে ভারতীয়দের মতো পোশাক পরলেই ওরা আমাদের শাসক হিসেবে আপন করে নেবে। কিন্তু ব্যাপারটা তেমন হবে না... ওদের মতো করে চলতে চলতে একটা সময়ে আমরাও ওদের মতো হয়ে যাব, হারিয়ে যাব ওদের মাঝে। নিজস্বতা বলতে আর কিছু থাকবে না!'
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/13/esel_pic_2.jpg)
বেশির ভাগ ইংরেজের চিন্তাধারাই ছিল মি. ব্রিগসের মতো। এই বিরাট উপমহাদেশে ইংরেজরা ছিল সংখ্যালঘু। ব্রিটিশ পোশাকগুলোকে ওরা ধরে নিয়েছিল নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে।
কোনো ইংরেজ দীর্ঘকাল উপমহাদেশে থাকার পর ইংল্যান্ডে গিয়ে যদি ভারতীয় পোশাক পরত, তাহলে তাকে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে নানান কথা শুনতে হতো।
অনেকে তো এটাও বলত, 'ভারত থেকে যে ইংরেজরা ফেরে, তারা আর বিশুদ্ধ ইংরেজ থাকে না।'
ধীরে ধীরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং সাহিত্যকর্মেও পোশাক-আশাকের ব্যাপারে লেখালেখি শুরু হয়। ১৮৭৩ সালে একটি রম্য ম্যাগাজিনে 'আধুনিক শিষ্টাচারের নানান কথা' নামের একটি কলাম ছাপা হয়। সেই কলামের কাল্পনিক চরিত্র লর্ড লুসিংস্লপ তার ছেলেকে বলেন, 'ভারতবর্ষ এখনো প্রকৃত সভ্যতা থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে!'
তিনি আরও বলেন, 'ওই অদ্ভুত দেশের অশিক্ষিত লোকেদের মতো পোশাক পরাটা রীতিমতো বোকামি ছাড়া আর কিছু না। একজন ইংরেজ ভদ্রলোকের পোশাক সব সময় এমন হওয়া উচিত যেন তাকে যেকোনো সময় বন্ড স্ট্রিটে ছেড়ে দিলেও কেউ তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে না তাকায়।'
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের মানুষের চিন্তাধারায় বেশ খানিকটা পরিবর্তন আসে। ওরা তখন আর পোশাক নিয়ে খুব একটা ভাবত না। বিভিন্ন দেশে গিয়ে ইউরোপীয় পর্যটকদের সেই দেশের পোশাক পরে অসংখ্য ছবি তুলতেও দেখা যায় এ সময়ে।
কিন্তু ভারতবর্ষে অবস্থানরত ইংরেজদের মন-মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
লেখক ও দার্শনিক অ্যালডাস হাক্সলে ১৯৩০ সালের দিকে খেয়াল করেন যে ভারতে অবস্থানরত প্রায় সকল ইংরেজ কর্মকর্তাই দিনের বেশির ভাগ সময় কোট-প্যান্ট পরে থাকেন।
লেখকের ভাষায়, 'ভাইসরয় থেকে শুরু করে কেরানি... প্রায় সারাটা দিনই তারা কোট-প্যান্ট পরে আছেন। গম্ভীর মুখে অফিস করছেন... সহজে হাসছেন না। এদের দেখলে মনে হয় যেন শুধু কোট-প্যান্টের জোরেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য টিকে আছে ভারতের বুকে। ব্যাপারটা বড়ই অদ্ভুত!'
লেখকের সাথে পরিচয় হয়েছিল আসামে কর্মরত একজন ইংরেজ অফিসারের। তিনি লেখককে বলেছিলেন, ভারতীয়দের এটা ভুলতে দেওয়া যাবে না যে ওরা আমাদের অধীনে রয়েছে। মাঝে মাঝেই আমি কোট-প্যান্ট পরে চলে যাই খাবার টেবিলে...তারপর বাংলোর সব চাকরবাকরদের ডেকে বলি, 'মনে করে নাও যে এখানে একটা ডিনার পার্টি চলছে, আমার পাশে অসংখ্য অতিথি বসে রয়েছেন। তোমরা সবাই খাবার দাও!' ওরা খাবার দেওয়ার অভিনয় করে... আমিও চুপচাপ বসে বসে ওদের অভিনয় উপভোগ করি। আমরা যে ওদের শাসক, এই ব্যাপারটা সব সময় ওদের মনে করিয়ে দিতে হবে।
কিন্তু ভারতবর্ষের আবহাওয়া তো ইংল্যান্ডের মতো নয়, তা-ই না?
দিনের বেশির ভাগ সময়ে কোট-প্যান্ট পরে থাকার কারণে অনেক ইংরেজ কর্মকর্তাই গরমে বেজায় কষ্ট পেতেন। নারী ও শিশুদেরও ভোগান্তির শেষ ছিল না।
কিন্তু তারপরেও সবাইকে কষ্ট করে ভারী পোশাকই পরতে হতো। অনেক ইংরেজ আবার মনে করত যে ভারী পোশাকই তাদের ভারতবর্ষের বিভিন্ন ছোঁয়াচে রোগ থেকে নিরাপত্তা দিচ্ছে।
ইংরেজ নারী ও পুরুষেরা গরম থেকে বাঁচার জন্য লিনেনের বদলে পশমের তৈরি অন্তর্বাস পরিধান করত। ইংরেজদের অন্তবার্সগুলো তৈরি হতো বিশেষ কিছু দোকানে। ওই সব দোকানে স্থানীয়দের কোনো পোশাক বানানো হতো না।
উনিশ শতকের শেষের দিকে ইংরেজরা মাথায় 'সাফারি হেলমেট' বা 'সোলা টুপি' পরতে শুরু করে। রোদ থেকে বাঁচার জন্য বেজায় কার্যকর ছিল এই টুপি। এ ছাড়া ভারতীয়রাও বহুদূর থেকে এই টুপি মাথায় কাউকে দেখলে বুঝতে পারত যে সে ইংরেজ।
বিভিন্ন ম্যাগাজিনে ভারতীয় পোশাকের সমালোচনা করে নানান ধরনের লেখা চলতেই থাকল। এই ধরনের লেখাগুলোর জন্যই ইংল্যান্ডে অবস্থানরত অনেকেই ভাবত যে ভারতের লোকেদের পোশাকগুলো রীতিমতো অশালীন।
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, একটা সময়ে এই ভারত থেকে হাতে বোনা কাপড় ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হতো। পরবর্তী সময়ে আঠারো শতকের শেষের দিকে ইংল্যান্ডের কারখানায় তৈরি কাপড় প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা লাভ করে। ফলে ভারতের হাতে বোনা কাপড়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল ব্রিটিশদের কাছে। তারা ভারত থেকে সস্তা দরে কাঁচামাল কিনে নিয়ে যেত ইংল্যান্ডে; তারপর সেখান থেকে কাপড় তৈরি করে এনে বিক্রি করত ভারতে। স্থানীয় তাঁতিদের ওপর কর আরোপ করে তাদের তৈরি কাপড়ের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে তুলনায় ইংল্যান্ডের কারখানায় তৈরি কাপড়গুলো হতো অনেক সস্তা। একটা সময়ে জনগণ ইংল্যান্ড থেকে আসা কাপড়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তরা ইংল্যান্ডের কাপড়ই বেশি কিনত।
ধীরে ধীরে কাপড়ের বাজারের প্রায় আশি শতাংশ দখল করে ফেলে ইংরেজরা।
ওদিকে ভারতীয় উচ্চবিত্ত পরিবারের পুরুষেরা ইংরেজদের মতো পোশাক পরতে আগ্রহী হয়ে গেল। অনেকেই কোট-প্যান্ট পরে পার্টিতে যেত, ইংরেজদের মতো করেই চলাফেরা করত! অনেক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবকও সাহেবি চালচলনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
ব্যাপারটা একেবারেই ভালোভাবে নিল না ইংরেজরা। ওরা ভারতীয়দের পোশাকগুলোকে নানা প্রকার কটূক্তি করত; কিন্তু এটাও চাইত না যে ভারতীয়রা ওদের মতো পোশাক পরুক।
১৮৩৫ সালে ভারতীয়দের শিক্ষার ব্যাপারে টমাস ব্যাবিংটন মেকলে লেখেন, 'ভারতীয়দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হলে ভারতীয় তরুণদের একটা অংশকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। এরা আমাদের সাথে সাধারণ ভারতীয়দের যোগাযোগ রক্ষা করবে। এই তরুণেরা মনেপ্রাণে হবে ইংরেজ। এদের পোশাকও হবে ইংরেজদের মতো।'
কিন্তু মেকলের কথাগুলোর সাথে পুরোপুরি একমত ছিল না ব্রিটিশ সরকার। বিশেষ করে পোশাকের ব্যাপারটাতে।
তাই ইংরেজরা প্রথমেই নজর দিল ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণদের ওপর। বিভিন্ন অফিস-আদালতে ঠিক করে দেওয়া হলো যে 'ভারতীয়রা কী ধরনের পোশাক পরবে'। ইংরেজ কর্মচারীদের পোশাক ও ভারতীয়দের পোশাকের বেশ ভালোই পার্থক্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া কোনো ভারতীয় যেন পদোন্নতি পেয়ে কোনো ইংরেজ কর্মচারীর ওপরের পদে যেতে না পারে, সে জন্য ভারতীয় কর্মচারীদের পদোন্নতিও দেওয়া হতো কম।
ভারতীয় কর্মচারীদের জুতোগুলোও হতো আলাদা এবং বেশ সস্তাদরের। সেগুলোও আবার কিনতে হতো ইংরেজদের কাছ থেকেই। বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ঘরে ইংরেজ কর্মচারীরা জুতো না খুলেই প্রবেশ করতে পারত... কিন্তু ভারতীয় কর্মচারীদের প্রবেশ করতে হতো জুতো খুলে।
বেশির ভাগ পার্টিতে ভারতীয় কর্মচারীদের ঢোকারই অধিকার ছিল না। যে পার্টিগুলোতে তারা যেতে পারত, সেগুলোতেও তাদের পরে যেতে হতো এমন সব পোশাক, যেগুলো ইংরেজদের পোশাকের তুলনায় ছিল নিতান্তই মামুলি।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/13/esel_pic_3.jpg)
এভাবে তো ভারতীয় মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত তরুণদের ইংরেজদের মতো পোশাক পরা থেকে আটকানো গেল। কিন্তু উচ্চবিত্ত পরিবারের লোকেদের কীভাবে আটকানো যাবে?
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো। মোগল দরবারে তত দিনে 'শেরওয়ানি'র প্রচলন হয়েছিল। শেরওয়ানিতে ইংরেজদের কোটের মতোই বোতাম ছিল। অনেকের মতে, ইংরেজদেও ফর্ক কোটের আদলেই শেরওয়ানির নকশা করা হয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে খানিকটা মতপার্থক্য রয়েছে। কিছু বিশেষজ্ঞ বলেন, ভারতে শেরওয়ানি বহুকাল আগেই প্রচলন করেছিল কুশান রাজবংশের লোকেরা। উচ্চবিত্ত মুসলমানদের মধ্যে প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিল শেরওয়ানি।
যা-ই হোক, তত দিনে ভারতীয় অনেক জমিদার এবং রাজারা ইংরেজদের মতো পোশাক পরা শুরু করেছিলেন। ইংরেজরা দরজির দোকানগুলোয় মানা করে দেয় যেন তারা ভারতীয়দেও জন্য ইংরেজদের মতো পোশাক তৈরি করে না দেয়। কিন্তু তত দিনে অনেক ভারতীয় দরজিও ইংরেজদের মতো পোশাক তৈরি করতে শিখে গেছিল... তাই উচ্চবিত্তদের ইংরেজদের মতো পোশাক পরা থামছিলই না।
অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করতে যেত। সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় তাদের ইংরেজদের মতো পোশাক পরতে নিরুৎসাহিত করা হতো।
এমনকি খোদ ভারতের বুকেই যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ভারতীয় আর ইংরেজদের একসাথে পড়াশোনা করার ব্যবস্থা ছিল, সেগুলোয় ভারতীয় ছাত্রদের ইউনিফর্ম ছিল আলাদা।
এ ক্ষেত্রে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয়।
কবি ইংরেজি শিক্ষা লাভের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতার বিশপস কলেজে। সেখানে ছাত্রদের ইউনিফর্ম ছিল একটি কালো আলখাল্লা আর চার কোনা টুপি। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ কবিকে কালোর জায়গায় সাদা রঙের আলখাল্লা পরতে নির্দেশ দেয়... যাতে করে বোঝা যায় যে তিনি ভারতীয়, ইংরেজ নন।
ব্যাপারটাতে বেজায় বিরক্ত হন কবি এবং বলেন, 'হয় আমি কলেজের ইউনিফর্ম পরে আসব, নয়তো ভারতীয় পোশাক পরে আসব।'
কলেজ থেকে তাকে বলা হয় যে তিনি চাইলে ভারতীয় পোশাক পরে আসতে পারেন।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/13/3._bhaartbrsser_bibhinn_ansher_muslmaander_paagrri_mogl_o_brittish_upnibeshik_smyy.jpg)
পরদিন কবি কলেজে এসে উপস্থিত হন সাদা রঙের মখমলের আংরাখা, রঙিন পাগড়ি আর রঙিন শাল পরে। এই ধরনের পোশাক দেখে তো কলেজ কর্তৃপক্ষ রীতিমতো হতবাক! অবশেষে তারা কবিকে কলেজের সাধারণ ইউনিফর্ম পরে আসার অনুমতি দেয়।
এটা ছিল কবির জন্য এক বড় বিজয়।
সেনাবাহিনীর পোশাক নিয়েও বেজায় খুঁতখুঁতে ছিল ইংরেজ সরকার। ভারতীয় সৈন্যদের যেন আলাদা করে চেনা যায়, সে জন্য তাদের পোশাকগুলো একটু আলাদা করে বানানো হতো। বেশির ভাগ বড় বড় অফিসারই ছিল ইংরেজ। ভারতীয় সৈন্যরা যেন ইংরেজদের মতো পোশাক না পরে, সেই ব্যাপারটা দেখার দায়িত্ব দেওয়া হতো অফিসারদের।
ভারতীয় রাজা-মহারাজা এবং জমিদারদেরও পোশাক নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা চালায় ইংরেজরা। তবে ব্যাপারটা তেমন একটা সফল হয়নি।
নিজেদের ভারতীয়দের থেকে আলাদা করে রাখা সব রকমের প্রচেষ্টাই চালিয়েছিল ইংরেজরা। সব সময় ওরা বোঝাতে চাইত যে তারা সর্বক্ষেত্রে ভারতীয়দের থেকে শ্রেষ্ঠ। এমনকি ইংরেজ সাহেবদের খাবার দেওয়ার সময় ভারতীয় চাকরেরা কোন পোশাক পরবে, সেটাও তারা নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
ব্যাপারটা অদ্ভুত না? ইংরেজরা তাদের নানা লেখাতে ইঙ্গিত করত যে ভারতীয়রা 'অসভ্য'। তাহলে সেই অসভ্যরা যদি ইংরেজদের মতো পোশাক পরে একটু 'সভ্য' হতে চায়, তাহলে ইংরেজদের সমস্যা কোথায়?
সমস্যা মূলত মানসিকতায়। ইংরেজরা চিরকালই ভারতীয়দের নিজেদের গোলাম বলে বিবেচনা করত। সে জন্যই তারা চাইত না যে ভারতীয়রা তাদের মতো পোশাক পরুক। মূলত ভারতীয় শিক্ষিত শ্রেণিকে তারা ভয় পেত। কারণ, শিক্ষিতরাই বিদ্রোহ করে।
ইংরেজরা এটাও মনে করত যে অন্যান্য ইউরোপীয় জাতিগুলোর তুলনায় তাদের পোশাকগুলোই সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন। ভারতে অবস্থানরত ফরাসি এবং পর্তুগিজদের পোশাক নিয়েও ইংরেজরা নানান কটূক্তি করেছিল। অনেক ইংরেজ বিশেষজ্ঞ, পতুর্গিজদের পোশাকগুলোকে 'জলদস্যুসুলভ' বলেও বর্ণনা করেন।
সব মিলিয়ে সকল ক্ষেত্রে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে ইংরেজদের কোনো জুড়ি ছিল না।
আশিস নন্দী এই বিষয়ে বলেন, 'ইংরেজরা খুব গর্ব করে বলে যে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন অসভ্য জাতিকে সভ্য করেছে... শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা কি সত্যিই এমন? ইংরেজরা ভারতীয়দের ঠিক ততটুকুই শিক্ষা দিয়েছিল, যতটুকু কোম্পানির ব্যবসার কাজে লাগে। ইংরেজরা সব সময় ভয়ে থাকত যে ভারতীয়রা হয়তো জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাদের পিছে ফেলে দেবে। ওরা ভারতীয়দের পোশাক নিয়ে হাসাহাসি করত... আবার ভারতীয়রা ওদের মতো পোশাক পরতে শুরু করলে সেটাও পছন্দ করত না! মূলত ভারতবর্ষে ইংরেজরা কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি, তারা এসেছিল প্রভুত্ব স্থাপন করতে।'
সহায়ক গ্রন্থ: 'Clothing Matters Dress and Identity in India': Emma Tarlo