চিত্রকর্ম জালিয়াতির আদ্যোপান্ত
গিলবার্ট স্টুয়ার্টের আঁকা জর্জ ওয়াশিংটনের আইকনিক পোট্রেটটি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিবার দেখা ছবিগুলোর একটি। ১৭৯৬ সালে আঁকা এবং প্রায়ই শৈল্পিক ছবি অ্যাখ্যা পাওয়া সদ্য প্রতিষ্ঠিত মার্কিন প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্টের অসমাপ্ত প্রতিকৃতিটি এক শ বছরেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন এক ডলার নোটে ছাপা হচ্ছে। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল পোট্রেট গ্যালারি এবং বস্টনের মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস তিন বছর অন্তর পালাক্রমে এটি প্রদর্শনের সম্মান পেয়ে থাকে। ছবিটি একাধারে নজরকাড়া শিল্পকর্ম এবং মার্কিনিদের জাতীয় সম্পদও বটে।
ছবিটি নিঃসন্দেহে ফিলাডেলফিয়ার সাউথওয়ার্ক অঞ্চলের সাগর-বণিক ক্যাপ্টেন জন ই সোর্ডসের নজর এবং কল্পনা, দুটিকেই আকর্ষণ করেছিল। ১৮০১ সালের ১ মার্চ ক্যাপ্টেন সোর্ডস স্টুয়ার্টের সাথে দেখা করে প্রায় এক বছর আগে পরলোকগত ওয়াশিংটনের ছবিটির একটি কপি কেনার আগ্রহ দেখান। জীবনভর ঋণের বোঝায় ভারাক্রান্ত থাকলেও একটিমাত্র শর্তে স্টুয়ার্ট ক্যাপ্টেনের কাছে ছবি বিক্রিতে রাজি হন: সোর্ডস কিছুতেই ছবিটির অনুলিপি তৈরি করতে পারবেন না।
বোধগম্য দাবি ছিল এটা। ওয়াশিংটন তখনো আমেরিকান জাতির হৃদয়ের কাছাকাছি ছিলেন। তিনিই এই জাতি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছেন। সম্মানিত আমেরিকান নাগরিকদের ছবি বিক্রি করে স্টুয়ার্ট সংসারের খরচ জোগাতেন। ক্যাপ্টেন নিমেষে স্টুয়ার্টের শর্তে সায় জানিয়ে ছবির অনুলিপি না করার কথা দেন। ভার্জিনিয়ায় এক ভদ্রলোককে উপহার দিতে ছবিটি কিনতে চাওয়ার কথা বলেন তিনি। ক্যাপ্টেনের কথায় আস্থা রেখে স্টুয়ার্ট ছবিটি বিক্রি করেন।
সেই বছরই জর্জ ওয়াশিংটনকে নিয়ে কানেক্টিকাট নামে এক জাহাজে সওয়ার হন ক্যাপ্টেন সোর্ডস। কিন্তু ভার্জিনিয়া তার গন্তব্য ছিল না। সেটা ছিল দূর প্রাচ্য। এবং স্টুয়ার্টকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার ছিল না। তার বদলে গুয়ানঝোউতে (ক্যান্টন) পৌঁছেই ক্যাপ্টেন সোর্ডস সেখানকার ওস্তাদ নকলবাজের শরণাপন্ন হয়ে কাচের পিঠে ছবিটির ৩০ গুণন ২৫ ইঞ্চি মাপের এক শটি উল্টো অনুলিপি তৈরির ফরমাশ দেন।
নাবিকের বেলায় এমনি বেইমানি ব্যতিক্রমী কিছু ছিল না। ফিলাডেলফিয়ায় মায়ের কাছে লেখা বিভিন্ন চিঠিতে তার চোরাচালানের কাহিনি উঠে এসেছে। ইতিহাসবিদ ই পি রিচার্ডসনের মতে, 'কাস্টমসের বিধিবিধান এবং এই জাতীয় খুচরো আইনের প্রতি সোর্ডসের ভক্তি-শ্রদ্ধার' বালাই ছিল না। সুতরাং, আমেরিকায় ফেরার সময় কানেক্টিকাটের বিদেশি পণ্যের তালিকায় জর্জ ওয়াশিংটনের ১০০টি পোট্রেটের কথা উল্লেখ করার বদলে 'এক কেস ছবি'র কথাই বলা হয়েছিল। রিচার্ডসনের মতে, এটা স্টুয়ার্টের কাছ থেকে কেনা মূল ছবি হতে পারে।
ক্যাপ্টেন সোর্ডসের পক্ষে নাগরিকদের চোখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ জর্জ ওয়াশিংটনের ছবি কেনায় আগ্রহী লোকজনের খোঁজ পেতে কষ্ট হয়নি। তিনি ছবি বিক্রি করে গেছেন। বিক্রেতার মতো ক্রেতার কাছেও ছবির আদি উৎসের গুরুত্ব ছিল না। কিছুতেই তারা তর্ক সাপেক্ষে দেশের মহান শিল্পীর আঁকা ছবির মালিকানা হাতে পাওয়ার সুযোগ পায়ে ঠেলতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেনের এভাবে ছবি বিক্রির কথা স্টুয়ার্টের কানে যায়। বোধগম্যভাবেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বেশির ভাগ আমেরিকানের মতো সরাসরি ক্যাপ্টেন সোর্ডসের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে দেন তিনি। ১৪ মে, ১৮০১, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সার্কিট কোর্ট এবং পেনসিলভানিয়ার ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্টে অভিযোগ দায়ের করেন স্টুয়ার্ট। এই মামলায় তখনো ব্রিটিশ নাগরিক স্টুয়ার্ট আদালতে তার পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা এবং সোর্ডসের সেটা মেনে নেওয়ার দাবি করেন। তিনি তার ভাষায় পুরো ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে আদালতে ক্যাপ্টেনের নামে হুলিয়া জারি করে তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করেন। জন ই সোর্ডসকে ছবি বিক্রি থেকে বিরত থাকার এবং অবশিষ্ট অনুলিপি ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ারও আবেদন জানান তিনি। দিন শেষের আগেই আদালত ক্যাপ্টেনের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে তাকে এবং তার সহযোগীদের 'ছবিটির অনুলিপি বিক্রি বা অন্যভাবে বণ্টন থেকে বিরত' থাকার এবং অবশিষ্ট অনুলিপি আদালতের পরবর্তী নির্দেশের জন্যে তৈরি রাখার নির্দেশ দেন।
গিলবার্ট স্টুয়ার্টের সাথে ক্যাপ্টেন সোর্ডসের বিশ্বাসঘাতকতা আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম শিল্পকর্ম কেলেঙ্কারির ঘটনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিল্পকর্ম-সংক্রান্ত সব ধরনের জাল-জালিয়াতি মামুলি ঘটনা হলেও এটা মোটেই কেবল আমেরিকান সমস্যা নয়। দুনিয়াজুড়ে প্রতিবছর কয়েক লক্ষ মিলিয়ন ডলার মূল্যের শিল্পকর্মের হাতবদলের ঘটনা ঘটে। ধুরন্ধর ক্যাপ্টেন যেমন অন্যের শিল্পকর্ম চুরির সাথে জড়িত প্রথম ব্যক্তি নন, তেমনি শিল্পী বা এর খাটিত্ব ভুলভাবে তুলে ধরাও শত শত বছরের পুরোনো দস্তুর। সত্যি বলতে, খোদ মহান শিল্পী মিকেলেজ্ঞোলো পর্যন্ত ঘুমন্ত কিউপিডের ভাস্কর্য তৈরি করে স্যান জর্জিওর কার্ডিনাল রিয়ারির কাছে গছাতে একে প্রাচীন বানাতে ছোপ দেওয়ার পেছনে যথেষ্ট মেধা খরচ করেছেন।
নিরীহ কার্ডিনাল রিয়ারিও সত্যিকারের বিশেষ কিছু পাচ্ছেন, এই প্রগাঢ় বিশ^াস থাকায় মিকেলেঞ্জোলের সহজ শিকারে পরিণত হন। অপরূপ কিছু পাচ্ছেন এই বিশ^াস থাকায় কার্ডনাল শিল্পকর্ম নিয়ে কোনো সন্দেহ মনে ঠাঁই দেননি। অ্যাডলফ হিটলারের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুচর হারম্যান গোয়েরিংও এভাবে প্রতারিত হয়েছিলেন।
গেস্টাপোর প্রতিষ্ঠাতা শিল্পকর্মপ্রেমী গোয়েরিং কেউ চাইলেই ঠকাবে, অত সহজ পাত্র ছিলেন না। শত্রুদের প্রতারণার বেলায় ভীষণ সতর্ক হলেও ইয়োহানেস ফারমিরের ক্রাইস্ট অ্যান্ড দ্য অ্যাডাল্টেরেস দেখে তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছিল। মহান ওলন্দাজ গুরুর মাত্র ৩৫-৩৬টা (পণ্ডিতরা হয়তো সত্যিকারের শিল্পকর্মের সংখ্যা নিয়ে তর্কে মাতবেন) পরিচিত শিল্পকর্ম থাকতে একটি 'নতুন' ফারমির তার ক্রমবর্ধমান, বিস্ময়কর এবং সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে জোগাড় করা শিল্পকর্ম সংগ্রহে বিরাট সংযোজন হতে পারত। এমনকি সেই সময় চোরাই ও লুটতরাজের সুবাদে আয়ত্তে আনা নিজের বিরাট শিল্পকর্ম সংগ্রহ প্রদর্শনীর জন্যে ফুয়েরারমিউজিয়াম নির্মাণে ব্যস্ত ব্যর্থ শিল্পী স্বয়ং হিটলার এ পর্যন্ত অজানা ফারমিরের মতো কোনো ছবির নাগাল পাননি। ক্রাইস্ট অ্যান্ড দ্য অ্যাডাল্টেরেস যে ফারমিরের অন্যান্য ছবির মতো নয়, সেটা ব্যাপার ছিল না। জোনাথান লোপেসের অনন্য বই 'দ্য ম্যান হু মেইড ফারমিরস' অনুযায়ী গোয়েরিংয়ের ছবিটির উৎস সম্পর্কে সন্দেহ পোষণেও কিছু এসে যায়নি। ছবিটি সম্ভবত 'পরে তাকে ব্ল্যাকমেইল করার মতলবে কোনো ইহুদির তরফ থেকে এসেছে,' ভেবেছিলেন তিনি। রাইখমার্শাল জীবনের সেরা জিনিসের দেখা পাওয়ার কথা বিশ্বাস করতে চেয়েছিলেন।
ক্রমবর্ধমান সংগ্রহের জন্যে গোয়েরিংয়ের ছবিটি না হলেই নয়। এই তথাকথিত 'নিখের্ঁাজ ফারমির' পেতে ১.৬৫ মিলিয়ন গিল্ডার দিয়েছেন তিনিÑআজকের দিনের হিসাবে ১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সত্যি বলতে, ছবিটি ছিল অসফল শিল্পী হ্যান ফন মিহগেরেনের আঁকা। জাল হওয়ায় জালিয়াতের পক্ষে খাঁটি উৎসের হদিস দেওয়া সম্ভব ছিল না। তো উৎস-সংক্রান্ত উদ্বেগ দূর করতে গোয়েরিং ছবিটির পটভূমি তুলে ধরা একটি চিঠি গ্রহণ করেন। পরে যুদ্ধ শেষ হলে, ওলন্দাজ জাতীয় সম্পদ লুটপাটের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়ে ফন মিহগেরেন কথিত ফারমির জাল করার কথা স্বীকার করেন। আদালত নিযুক্ত সাক্ষীর সামনে ফের ছবি এঁকে তার প্রমাণও দেন। বিভ্রান্তি এত জোরাল ছিল যে ন্যুরেমাবর্গে বিচারের সময় গোয়েরিংকে তার প্রিয় ফারমিরটি আসলে জাল জানানো হলে একগুঁয়ে নাৎসি জোর গলায় সেটা বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেন। আজকের দিনে ফন মিহগেরেনের ছবি যাচাই করতে গেলে তার ছবিতে কীভাবে কেউ ফারমিরকে দেখতে পারেন বোঝা দায়। কিন্তু শুধু বিকৃত মন, মরফিন আসক্ত নাৎসিই জাল ফারমিরে বোকা বনেননি। এমনকি ফন মিহগেরেনের জালিয়াতি যাচাইকারী তখনকার কিছু বিশেষজ্ঞও ছবিগুলো মহান গুরুর বলে বিশ্বাস করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ নতুন আবিষ্কৃত কিছুর অংশ হওয়াটা যেন তাদের বিচার-বিবেচনাকে অন্ধকার করে দিয়েছিল। ইতিহাসজুড়ে বহুবার এই ধারার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
শিল্পকর্ম-সংক্রান্ত অপরাধের ইতিহাসে সফল জালিয়াতের অভাব নেই। তাদের বহু কাহিনি বিভিন্ন বই এবং টেলিভিশনে বয়ান করা হয়েছে। কেন ফলেটের মদিগ্লিয়ানি ক্যাপার এমনি চিত্রকর্ম জালিয়াতি নিয়ে লেখা একটি অনন্য রোমঞ্চোপন্যাস।
তবে নিশ্চিতভাবে এদের ভেতর সবচেয়ে কুখ্যাত মানুষটির নাম জন ড্রিউ। ব্রিটিশ এই জালিয়াত এর আগপর্যন্ত অসফল শিল্পী জন মায়াটের নকল ছবি বিক্রি করেছেন। এসব ছবির পেছনের গল্প ছিল এ রকম: এগুলো সবই বিভিন্ন নামীদামি শিল্পীর সদ্য আবিষ্কৃত ছবি। শেষতক ড্রিউ দোষী সাব্যস্ত হন এবং ১৯৯৯ সালে জালিয়াতির দায়ে তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ছয় বছর জেল খাটেন তিনি। মুক্তি পেয়েই এই জাত অপরাধী ফের ৭১ বছর বয়স্কা এক মহিলার সম্পত্তি বিক্রি করে সমুদয় টাকা তছরুপ করেন। 'আপনার মতো এমন অসৎ এবং দুষ্কৃতকারী আর দেখিনি,' সাজা ঘোষণার সময় বলেন বিচারক।
ড্রিউর মতো অপরাধীরা শিকার খুঁজে পাওয়ার ক্ষমতার সুবাদেই সফল হয়ে থাকে। বিশেষ করে সব রকম বিপরীত ইঙ্গিত সত্ত্বেও বিশ্বাস করার জোরাল এক ধরনের ধাত থাকে যাদের। এ ক্ষেত্রে মূল্যবান বস্তুর নাগাল পাওয়ার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়েই তারা শিকারকে ঘায়েল করে। জালিয়াতের বানোয়াট কাহিনিই মূল শক্তি। যেমন জাল শিল্পকর্মের প্রশ্নে অপরাধী সাধারণত সদ্য মৃত কোনো আত্মীয়ের হাতে বছরের পর বছর নিখোঁজ থাকা সংগ্রহের কাহিনি ফাঁদে। শিল্পকর্মটি নাৎসিদের কবল থেকে বাঁচাতে লুকিয়ে রাখার কথা বলা হতে পারে। কিংবা খোদ শিল্পীর কাছ থেকে উপহারের অজুহাতও দেখানো হতে পারে। ঘটনা যাই হোক, অপরাধীকে অবশ্যই তার বিক্রি করা ছবিগুলোর অন্য দাবিদার না থাকার গল্প ফাঁদতে হবে। বিশেষত তার হাঁকা দামের বেলায়। সত্যি বলতে, শিল্পকর্মের উৎসের প্রশ্নটিই জালিয়াতের অন্যতম সমস্যা।
সহজতর অর্থে, কোনো শিল্পকর্মের ঐতিহাসিক মালিকানাকেই উৎস বলা হয়। ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক ঠেকলেও আসলে বেশ প্যাঁচালো। একটি শিল্পকর্মের বয়স হাজার বছর না হলেও কয়েক শ বছর হতে পারে। এই ধরনের রেকর্ড রাখার প্রমিত, সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বিধিবদ্ধ নিয়ম না থাকায় বিভ্রান্তি দেখা দেয়। সোলোমন আর গাগেনহাইম মিউজিয়ারমের কিউরেটর মেগান এম ফন্টেলা লিখেছেন, 'সাধারণত, উপহার, বিক্রি, উত্তরাধিকার, বিনিময় বা অন্য যেকোনোভাবে প্রতিবার হাতবদল হওয়ার নিরাপদ দালিলিক প্রমাণই লোকে চায়Ñ যেমন বিক্রির রসিদ। কিন্তু মহাফেজখানার রেকর্ডপত্র অনেক সময় বিক্ষিপ্ত, ব্যাখ্যার অতীত বা আরও খারাপÑ খোয়া যেতে পারে। এমনও সময় থাকতে পারে যখন মালিক এবং জিনিসটির হদিস সম্পূর্ণ অজানা ছিল।'
সত্যি বলতে, শিল্পকর্ম চুরিকে চুরি না বলে শিল্পকর্ম বিক্রি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পেছনের কাহিনিই আসলে শিল্পকর্মেও হাতবদলের জালিয়াতি, খোদ ছবিটি নয়। উদাহরণ হিসেবে জালিয়াত ডেভিড স্টেইনের কথা বলা যায়। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি ডেভিড বিখ্যাত শিল্পীদের ছবি বিক্রেতা ধনী ডিলার হিসেবে জালিয়াতদের খাতায় নাম লেখান। আসলে ছবিগুলো তারই নিপুণ হাতে আঁকা ছিল। বিক্রির আগপর্যন্ত এসব ছবি ছিল কোথায়? মিসরে হেনির হাদ্দাদ নামের জন্মগ্রহণকারী হতদরিদ্র স্টেইনের পক্ষে এসব ছবি কেনা ছিল প্রশ্নের অতীত। তাই শিকারকে ধোঁকা দিতে ভুয়া পরিচয় ভাড়ান তিনি। ছবির উৎস গোল্লায় যাক। তার একজন শিকার, পাম বিচের ধনী সংগ্রাহক এল ডি কোহেন। তিনি ডেভিডের সাফল্যের পেছনে জাল ছবি হাজির করা নয় বরং তার ভুয়া জীবন কাহিনিকেও কৃতিত্ব দিয়েছেন। প্রাচুর্যময় পর্যটন শহরে নিজেকে তুলে ধরতে স্টেইন 'ঝটপট একটা রোলস রয়েস কেনেন, যেটার দাম তিনি মেটাননি। সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেলের একটা অ্যাপার্টমেন্টে ওঠেন...চারপাশে রূপসী নারীদের জড়ো করেন। এবং কিছু বোঝার আগেই লাইমলাইটে আসতে তার বিখ্যাত ছবি দান করার কথা জানাজানি হওয়ায় শিল্পকর্ম কিনতে উদ্গ্রীব বহু লোককে কায়দা করে ফেলেন। সত্যিকার অর্থে, নিপুণ
প্রদর্শনবাদী ছিলেন তিনি,' বলেছেন কোহেন। স্পষ্টতই তার নৈপুণ্যও ছবির মতো বিক্রিতে কাজে এসেছে।
স্টেইন তার সাফল্যের আরেকটি কারণ দেখিয়েছেন। 'টাকা কামাতেই ডিলাররা ছবির উৎসের কাহিনি উপেক্ষা করতে চান,' বলেছেন তিনি। 'ছবি সম্পর্কে সন্দেহ থাকলেও তারা চোখ বুজে থাকেন। বাজারটাই এ রকম।' তবে লোভ ছাড়াও কোহেনের ভাষায় এটা ছিল 'দুঁদে অপরাধী'র কাজ। শেষ পর্যন্ত স্টেইনের জালিয়াতি গ্রেপ্তার, কারাবাস, দেশান্তরে পর্যবসিত হয়। পাওনাদারদের ফাঁকি দিতে বছরের পর বছর পালিয়ে বেড়িয়েছেন।
ইতিহাসসংশ্লিষ্ট কালে সম্ভাব্য সেরা জালিয়াত ভাবা মানুষের কাহিনিতে আকীর্ণ। অপরাধীর বদলে এক অর্থে তাদের প্রায় রোমান্টিক দৃষ্টিতেই দেখা হতো। কথিত আছে, জালিয়াতের পরিচয় জানাজানি হওয়ার পর ফন মিহগেরেনের জনপ্রিয়তা বেড়ে গিয়েছিল। লোপেসের মতে, এই জালিয়াতকে 'দুুনিয়াকে ধোঁকা দেওয়া' বেপথু প্রতিভা মনে করা হয়।
১৯৭০ এবং ৮০ দশকের বহুপ্রজ ছবি জালিয়াত তেত্রো আজও একটি ওয়েবসাইট ব্যবহার করছেন। এখানে নিজেকে 'অফিশিয়াল ওয়েবসাইট অব ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট লিভিং আর্ট ফোরজার' বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। ভাস্বর্যের উনিশ শতকীয় জালিয়াত গিওভান্ন্নি বাস্তিয়ানিকে সত্যিকার অর্থে 'ইতালীয় রেনেসাঁর আবক্ষমূর্তির সবসেরা ভাস্কর' বলা হয়। ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় এরিক হেব্বর্নের শোক সংবাদে তাকে 'শতকের সবচেয়ে সফল জালিয়াত' হিসেবে উল্লেখ করা হয়। শিল্পী এবং গ্রন্থবণিক মাইকেল ও'কিফি লিঙ্কড-ইন পেজে 'বিশ্বের সেরা শিল্পকর্ম জালিয়াত টমাস কিটিংয়ের সাথে পড়াশোনার' দাবি করেছেন। কেন পেরেনির ক্যাভিট এম্পটর: দ্য সিক্রেট লাইফ অব অ্যান আমেরিকান ফার্স্ট অ্যান্ড অনলি গ্রেট আর্ট ফর্জার' খোদ পেরেনি ছাড়া কেউ নন। সম্প্রতি মিসিপিয় মার্ক ল্যান্ডিসের (ডেইলি বিস্টের জাস্টিন জোনসের ভাষায় 'পৃথিবীর সেরা জালিয়াত') ছবি এবং প্রতারণা আলোচনায় এসেছে। তার যাজক রূপে জালিয়াতি কর্ম দেশময় বিভিন্ন জাদুঘরে দানের প্রামাণ্যচিত্রে তাকে তুলে ধরা হয়েছে। সম্ভবত মোদিগ্লিয়ানির শিল্পকর্ম জালিয়াতির কারণে বিখ্যাত জালিয়াত এলমিরন দে হেনরি ক্লিফোর্ড আরভিংয়ের ফেক! বইটির বিষয়বস্তু। এখানে তাকে 'আমাদের কালের সেরা জালিয়াত' বলে উল্লেখ করা হয়।
একইভাবে জালিয়াতদের ভেতর একটা প্যাটার্ন দেখা দেয়। সাধারণত শিল্পী হিসেবে ব্যর্থ (অথবা তাদের প্রতিভার স্বীকৃতি দিতে পৃথিবীর ব্যর্থতা) মাঝবয়সী হতাশ ব্যক্তি হতে দেখা যায় এদের। প্রায়ই এরা বেপরোয়া অহংকারী এবং নিজেদের নৈপুণ্যের বেলায় অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হন। শুধু অনুকরণ সহজ বলেই এদের পুরোনো গুণী শিল্পীদের কাছ থেকে দূরত্ব তৈরি করে ইম্প্রেশননিস্ট ও অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিস্টদের দিকে ঝুঁকতে দেখা যায়। এরা আবার জলরং থেকে দূরে থেকে তেলরং এবং স্কেচ নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসে। পেশাদার শিল্পী মেগান উইকসের মতে, এর ভালো কারণ আছে। 'আপনি তেল রংয়ে কিছু আঁকলে এক অর্থে স্থায়ী হয়ে যায়। তুলির আঁচড় ক্যানভাসের বুকে থেকে যায়। শুকোনার আগেই খতিয়ে দেখে বদলানোর প্রচুর সময় মেলে। 'কাক্সিক্ষত' চেহারা না পেলে সব সময় নতুন করে ছবি আঁকা যায়। অন্যদিকে জলরংয়ে তুলির আঁচড় একেবারেই নাজুক...ছোঁয়ানোর পর ছড়িয়ে পড়তে পারে।' এভাবে ভুল হওয়ার বিরাট শঙ্কা থাকে, বড় ধরনের প্রতিভা ও প্রয়াসের দরকার হয়।
মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অব আর্টের সাবেক পরিচালক এবং চিত্রকর্ম সমঝদার টমাস হোভিং ১৯৯৬ সালে জাদুঘরের সমস্ত ছবির ৪০ শতাংশই জাল বা নকল হওয়ার দাবি করেছিলেন। আরও সম্প্রতি সুইটজারল্যান্ডের ফাইন আর্ট এক্সপার্ট ইনস্টিটিউট শিল্পকর্মের বাজারের ৫০ ভাগ শিল্পকর্মই জাল বা ভুলভাবে কৃতিত্ব দেওয়ার অনুমানটি সম্ভবত রক্ষণশীল হওয়ার দাবি করেছেন।
এই সংখ্যাগুলোর সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক, শিল্পকর্মের দুনিয়ায় জালিয়াতির গুরুতর সমস্যা রয়েছেই।
সৌভাগ্যক্রমে এর বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো সক্রিয় মেধাবীদের অস্তিত্ব আছে। বিশ্বজুড়ে নিবেদিতপ্রাণ গবেষকেরা উৎস গবেষণায় ক্রমাগত সাফল্য লাভ করছেন। ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর আর্ট রিসার্চ বিভিন্ন জাদুঘর, ব্যক্তিমালিক এবং বলতে গেলে অন্য সবার পক্ষে সত্যতা যাচাইয়ের গবেষণা করে। অসাধারণ খ্যাতি এবং অলাভজনক শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এদের কাজের বিপুল চাহিদা। এ ছাড়া বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যাপকতর অর্থে উৎস গবেষণার স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসছে বলে মনে হয়। স্মিথোসিনিয়ান ইনস্টিটিউট কিউরেটর জেন সি মিলোখ সম্প্রতি গোটা প্রতিষ্ঠান থেকে নির্বাচিত উৎস বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছেন। এবং বস্টনের মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস প্রথমবারের মতো বর্তমান এবং প্রশ্নসাপেক্ষ উৎসের সংগ্রহের উৎস গবেষণার জন্যে ভিক্টোরিয়া রিডকে কিউরেটর অব প্রভেন্যান্স নিযুক্ত করেছে।
জালিয়াতি শনাক্তে কী ঘটছে
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সক্রিয়তার বিচারে উৎস গবেষণা ক্ষেত্রে অব্যাহত উন্নতি ঘটে থাকলে শিল্পকর্মের সত্যতা যাচাইয়ের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি আলোর গতিতে এমনকি ধূর্ততম জালিয়াতকেও ধরার মতো পর্যায়ে পৌঁছেছে। চিত্রকর্মের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ কতটা এগিয়েছে, তার ধারণা দিতে ১৯৯৭ সালে নিউজউইকে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের কথা বলা যায়। ভ্যান গখের নামে চালু প্রায় ১০০টি ছবি মহান ওলন্দাজ শিল্পীর আঁকা নাও হতে পারে বলে উল্লেখ করে কেবল স্টাইলিস্টিক বিশ্লেষণের মাধ্যমেই এগুলো যাচাই সম্ভব বলা হয়েছিল। যার মানে সত্যতা যাচাইয়ের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আজকের দিনে সেই সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেছে।
ডক্টর নিকোলাস ইস্টাগ এবং ডক্টর জিলিন নাদোলনি চিত্রকলার নিবিড় প্রশিক্ষণের সাথে বিজ্ঞানের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে সামনের কাতারে রয়েছেন। সাম্প্রতিক চিত্রকর্ম জালিয়াতি নিয়ে তাদের গবেষণার ফলাফল নিয়ে লেখা নিবন্ধে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কারিগরি শিল্পকর্মের গবেষকের কাজ অতি জটিল হওয়ায় যাচাইয়ের কাজটি কেবল বিজ্ঞানে দক্ষ কারও হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয় বলে সঠিক যুক্তি দেখিয়েছেন তারা। বরং 'আদর্শগতভাবে শিল্পকর্মের ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম কারিগরি গবেষকে'র দক্ষতা অর্জনকারী গবেষককে এ দায়িত্ব দিতে হবে। অন্যকিছু করতে গিয়ে ক্ষেত্রকে খাটি 'বিজ্ঞানে' সীমিত করা হবে 'শিল্পকর্মের ইতিহাসবিদ, শিল্পকর্মের ডিলার, শিল্পকর্মের রক্ষকদের মতো মানুষদের একটা সংগঠন থেকে বাদ দেওয়ার শামিল।'
অন্য কথায়, কারিগরি শিল্পকলার গবেষকের কাজ এতটা অনন্য হওয়ার কারণ, প্রশ্নসাপেক্ষ কোনো ছবির বিশ্লেষণ কেবল কম্পিউটার থেকে বেরুনো প্রিন্টআউট যাচাই বিদ্যায় প্রশিক্ষিত কারও কাজ নয়, বরং এমন একজন বিজ্ঞানীর কাজ, যিনি চিত্রকর্মের দ্যোতনা, শিল্পী এবং উপকরণের কথা জানেন। এই কায়দা কেবল নকল চিত্র শনাক্ত করার ক্ষেত্রেই উপকারী নয়, বরং এর খাটিত্বও নিরূপণ করা যায়। ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে গ্রেট ব্রিটেনে ন্যাশনাল ট্রাস্ট রেমব্র্যাঁর একটি আত্মপ্রতিকৃতির সত্যতা যাচাইয়ের কাজে এই কৌশল প্রয়োগ করে। প্রায় এক শ বছর ধরে ছবিটির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ ছিল। গবেষকেরা রেম্ব্র্যাঁর স্বাক্ষর প্রমাণের লক্ষ্যে উন্নত প্রযুক্তি কাজে লাগাতে পেরেছিলেন।
তবে জালিয়াতি ধরার আগে জাল ছবিটিকে অবশ্যই পরীক্ষার জন্যে জমা দিতে হবে। কিন্তু বিজ্ঞান বেশির ভাগ মানুষের অনন্য কোনো চিত্রকর্ম হাতে পাওয়ার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়তে পারে না। গবেষকেরা এই ধরনের চিত্রকর্ম ক্রেতাদের তাদের সংগ্রহ বিশ্লেষণের জন্যে হাতছাড়া করতে রাজি করাতে অক্ষম। সত্যি বলতে, অনেক ক্ষেত্রেই এ ব্যাপারে তারা অজ্ঞ থাকতেই পছন্দ করেন। এই ধরনের দষ্টিভঙ্গিই শিল্পকর্মামোদীদের বৈশিষ্ট্য।
চিত্রকর্মের সত্যতা যাচাইয়ের গবেষণা সব সময় নৈতিকতা ও শুদ্ধাচারের খাতিরে করা হয় না। প্রায়ই এখানে বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং সম্ভাব্য বিব্রতকর পরিস্থিতির প্রশ্ন থাকে। সেটা ব্যক্তি সংগ্রাহক বা সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানই হোক। চিত্রকর্মের নিরেট উৎস এবং খাটিত্ব সমর্থনে বিশ্লেষণ ডলারের নিরিখে চিত্রকর্মের দাম বাড়িয়ে দেয়। তবে উদ্দেশ্য যা-ই হোক, এ ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয়দের হাতে চালানো সত্যতা যাচাই শিল্পী ও মালিকের স্বার্থ রক্ষাতেই কাজ দেবে।
লেখার শেষ প্রান্তে এসে এ কথা বলতে চাই, আপনারা যারা শিল্পাচার্য জয়নুলের ড্রইং কেনেন, তারা সতর্ক হন। এই তালিকায় মুর্তজা বশীরও আছেন।