সহলেখক প্রেতলেখক
আমার যথেষ্ট টাকাকড়ি থাকলে কিংবা যথেষ্ট টাকাকড়ি পাবার সম্ভাবনা থাকলে আমি এ লেখাটি আমার একজন প্রেতলেখকে দিয়ে লেখাতাম এবং প্রাপ্য লেখক সম্মানীর অর্ধেক তাকে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতাম।
আমাদের স্কুলজীবন এবং কলেজজীবনেও নায়ক দুজন, 'কুয়াশা' ও 'মাসুদ রানা'। 'মাসুদ রানা' পুরোদস্তুর বড়দের সিরিজ হলেও আমাদের ইঁচড়ে পাকামি তার কীর্তিকলাপ স্কুলপাঠ্য করিয়ে ছেড়েছে। আমরা জানতাম দুটোই একই লেখকের সিরিজ গ্রন্থ। লেখকের নাম কাজী আনোয়ার হোসেন। তার বাবাও খুব বিখ্যাত মানুষ কাজী মোতাহার হোসেন। তার প্রকাশনা সংস্থার নাম সেবা। সেগুন বাগিচায় সেবার অফিস, লেখালেখির কারখানাটিও সেখানেই। সেবার বই মানেই বেস্ট সেলার, সেবার বই মানেই সস্তা দামের সুখপাঠ্য বই।
২০০৮। তত দিনে আমি ও আমার বয়সী একদা সেবার পাঠক ৫০ ছুঁয়েছি। একদিন শুনলাম এবং খবরের কাগজেও পড়লাম, সর্বনাশ: 'লেখক বনাম লেখক' মামলা রুজু হতে যাচ্ছে। কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করেবেন শেখ আবদুল হাকিম। তিনিও ক্রাইম, থ্রিলার, রহস্য, এ লাইনে বড় লেখক। এ ধরনের রচনার পাঠক বেশি। সুতরাং ঈদ সংখ্যায় শেখ আবদুল হাকিমের লেখা চাই, নতুবা তার নিস্তার নেই।
বরাবরই অর্থ ঘাটতি মোকাবিলা করা মানুষ শেখ আবদুল হাকিম প্রতিশ্রুতি দিতেন এবং পালনও করতেন। জানা গেল 'কুয়াশা' সিরিজের ৫০টি বই এবং 'মাসুদ রানা' সিরিজের ২৫০টি বইয়ের প্রচ্ছদে যে নামই লেখা থাক, আসলে এগুলোর লেখক হচ্ছেন শেখ আবদুল হাকিম। ২০১০ সালে তিনি কাজী আনোয়ার হোসেন তথা সেবা প্রকাশনীর কাছে পাওনা ২ কোটি টাকা দাবি করেন। কিন্তু দাবিকৃত অর্থের কিছুই আদায় করতে না পেরে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে কপিরাইট আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে কপিরাইট আদালতে মামলা করেন।
দুজনের যে সম্পর্ক, তা কখনো মামলা পর্যন্ত গড়াবার নয়। ১৯৬৬ কি ১৯৬৭ থেকে এক রাতে লেখা সদ্যজাত একটি গল্পের জন্য ১০০ টাকা গ্রহণ করে সম্পর্কের সূচনা। তারপর উপন্যাস লিখে জমা দিলেন, কিছু টাকাও পেলেন। বই ছাপা হলো, লেখকের নাম কাজী আনোয়ার হোসেন। ভেতরে কোথাও শেখ আবদুল হাকিম লেখা থাকল। তাতে তিনি মোটেও আপত্তি করেননি, কারণ, তার টাকার দরকার। 'মাসুদ রানা' সিরিজের সাড়ে চার শ বইয়ের মধ্যে ২৬০টাই তার লেখা, সেই সাথে 'কুয়াশা' সিরিজের ৫০টাও।
কাজী আনোয়ার হোসেন ও শেখ আবদুল হাকিমের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে উঠে এসেছে যে 'মাসুদ রানা' সিরিজের সব বই কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা নয়, তবে 'মাসুদ রানা'সহ এই সিরিজের কিছু চরিত্রের তিনিই স্রষ্ঠা। অত্যাধিক ব্যস্ততার জন্য কাজী আনোয়ার হোসেনকে প্রেতলেখকের ওপর নির্ভর করতে হয়, ওদিকে সিরিজের বিপুল জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে মাসে দু-একটি বই প্রকাশ করতেই হয়।
শেখ আবদুল হাকিম সেবার একজন চাকুরে, এ দাবি করা হলে এর সমর্থনে কাজী আদালতে কোনো প্রমাণ দাখিল করতে পারেননি। বিরোধের সূত্রপাত রয়ালটি নিয়ে, বিক্রিত বইয়ের সংখ্যা নিয়ে। হাকিমের অভিযোগ ৬০ হাজার বই বিক্রি হলেও তা খাতায় লিপিবদ্ধ না করে বলা হতো ৭ হাজার এবং তাকে সম্মানী থেকে বঞ্চিত করা হতো। কাজী মনে করেন, বই প্রকাশনায় পূর্ণ বিনিয়োগ, পরিকল্পনা, সম্পাদনা, বাজারজাত করা, এত কিছু করে এবং লেখককে এককালীন সম্মানী ও বিক্রিত বইয়ের ওপর কমিশন দেওয়ার পর হাকিম মালিকানা দাবি করতে পারেন না।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরে তিন দফা শুনানি। জেরা যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের পর ১৪ জুন ২০২০ আদালত 'মাসুদ রানা'র ২৬০টি গ্রন্থের ও 'কুয়াশা'র ৫০টি গ্রন্থের স্বত্ব ও মালিকানা শেখ আবদুল হাকিমের অনুকূলে ঘোষণা করেন।
এই রায় চ্যালেঞ্জ করে সেবা প্রকাশনীর পক্ষে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হলে বিচারকদ্বয় আশফাকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ ইকবালের দ্বৈতবেঞ্চ শুনানির পর সম্প্রতি রিট আবেদন খারিজ করে দেন। ২৬০+৫০টি গ্রন্থের গ্রন্থস্বত্ব¡ শেখ আবদুল হাকিমের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রন্থস্বত্ব বিভাগের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে: শেখ আবদুল হাকিম প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মালিকের নির্দেশেই লিখুন কিংবা অন্য কারও নির্দেশে লিখুন কিংবা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই লিখুন, তাতে কিছু এসে যায় না, গ্রন্থের ওপর নৈতিক অধিকার লেখকেরই, অন্য কারও নয়। শেখ আবদুল হাকিমের মৃত্যুর প্রায় সাড়ে তিন মাস পর এই রায়টি হয়েছে, আর মাত্র কদিন আগে কাজী আনোয়ার হোসেনও প্রয়াত হয়েছেন। নিবন্ধকারের পর্যবেক্ষণ: আদালতের রায় অবশ্য শিরোধার্য এবং প্রতিপাল্য। কিন্তু শেখ আবদুল হাকিম যদি আর্থিকভাবে প্রত্যারিত বোধ না করতেন, তাহলে কি মামলা-মোকদ্দমা হতো? সম্ভবত এতগুলো গ্রন্থের গ্রন্থকার কে, সে প্রশ্নও চাপা পড়ে যেত।
এখানে উভয়ের ক্ষেত্রে লেনদেনের ভিত্তি মৌখিক আশ্বাস এবং পারস্পরিক বিশ্বাস। কেউই লিখিত কোনো চুক্তিনামায় আগ্রহী হননি। বলা আবশ্যক ইউরোপ-আমেরিকায় প্রকাশিত বেস্ট সেলার্স গোত্রভুক্ত জনপ্রিয় উপন্যাস ও সিরিজের ৬০ ভাগই প্রেতলেখকের রচনা। দুই পক্ষের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশককে নিয়ে তিন পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী লেনদেন সমাধা হয়। প্রেতলেখক প্রচ্ছদে প্রকাশিত লেখকের সাথে আলোচনা না করে এবং এমনকি তার নির্দেশনা না নিয়েও যদি চুক্তি অনুযায়ী কাজ করেন এবং চুক্তি অনুযায়ী টাকা পেয়ে যান, তাহলে তার গ্রন্থস্বত্ব দাবি করার সুযোগই থাকে না। বাংলাদেশের রায়টি প্রেতলেখকবান্ধব। তাকে গোস্টরাইটাররা উৎসাহিত হবেন কিন্তু অর্থ জোগানদাতা ও স্বীকৃত লেখকের নিরুৎসাহিত হবার সম্ভাবনাই বেশি।
সহলেখক প্রেতলেখক
অর্থনীতি যাদের পাঠ্যবিষয় নয়, তারাও কোথাও না কোথাও পল স্যামুয়েলসনের 'ইকোনমিক্স' নামের মৌলিক ও সূচনামূলক গ্রন্থটি দেখেছেন। ১৯৪৮ সালে বইটি যখন প্রকাশিত হয়, পুরো টেক্সট বইটিরই লেখক ছিলেন অর্থনীতির অধ্যাপক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পল স্যামুয়েলসন। পরবর্তীকালে বইটি যখন রিভাইজ করতে হয় এবং নতুন কয়েকটি অধ্যায় সংযোজন করতে হয়, তার সাথে যোগ দেন তার ছাত্র, পরবর্তীকালে অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার বিজয়ী উইলিয়াম নর্ডহাউস। নতুন অধ্যায়গুলো তারই লেখা। বিপুল চাহিদার এই বইটি এখনো অর্থনীতির সেরা টেক্সট বই। বইয়ের প্রচ্ছদে দুজনেরই নাম লেখা: পল স্যামুয়েলসনের সহলেখক উইলিয়াম লর্ডহাউস। তবে সর্বসাধারণের কাছে এই বইটি এখনো স্যামুয়েলসনের ইকোনমিক্স, তিনিই লিড রাইটার।
কেবল দুজন নয়, বহু লেখকও একটি বই রচনায় অংশীদার হতে পারেন। তাদের একজন হচ্ছেন লিড অথবা শীর্ষ লেখক, অন্যরা কো-অথর বা সহলেখক। প্রেতলেখক তার সঙ্গে চুক্তিকারী কিংবা তাকে নিয়োগ প্রদানকারী ব্যক্তির প্রেতাত্মা হয়ে তার পক্ষে গোস্টরাইটার হিসেবে কাজ করবেন। প্রেতলেখকের সাথে সম্পর্কটি চুক্তিভিত্তিক (লিখিত বা মৌখিক, কিংবা উভয়ই)।
আর্ল স্ট্যানলি গার্ডনারের নিযুক্ত ছয়জন প্রেতলেখক ছিলেন। তিনি তাদের তার পরিকল্পিত ফিকশনের আইডিয়া দিতেন, তারা লিখতেন, তিনি সেই লেখার ওপর কলম চালাতেন, সম্পাদনা করতেন, একসময় বইটি বাজারে আসত, আর স্ট্যানলি গার্ডনারের বই নামেই বেস্ট সেলার্স লিস্টের বই, মিলিয়ন ডলার ছোঁয়া আয়। প্রেতলেখকেরা ভালোই পেতেন। স্ট্যানলি গার্ডনারের বিরুদ্ধে কেউ মামলা-মোকদ্দমা করেছেন শোনা যায়নি, অন্তত পত্রিকায় ছাপা হয়নি।
নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন ঔপন্যাসিক সিঙ্কক্লেয়ার লুইস লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার আগে অন্য একটি ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছিলেন। প্লট বিক্রি। জমিজমার প্লট নয়, গল্পের প্লট। তিনি ঔপন্যাসিক জ্যাক লন্ডনের কাছে লেখার প্লট বিক্রি করতেন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়ে জ্যাক লন্ডনের কাছে প্লট বিক্রি করে যা পেতেন, তাতে তার মোটামুটি চলে যেত। তখন এটাই ছিল আয়ের একমাত্র উৎস। জ্যাক লন্ডনের 'দ্য অ্যাসাসিয়েশন ব্যুরো' নামের গ্রন্থ এবং অনেকগুলো গল্প সিঙ্কলেয়ার লুইয়ের কাছ থেকে কেনা প্লটের ওপর ভিত্তি করে রচিত।
সিঙ্গলেয়ার লুইস পুরোপুরি প্রেতলেখক হয়েও কাজ করেছেন। তিনি বিখ্যাত আমেরিকান টেনিস খেলেয়াড় মরিস ম্যাকলাফলিনের হয়ে 'টেনিস অ্যাজ আই প্লে ইট' লিখে দিয়েছেন।
অতিপ্রাকৃতিক ভীতিকর ভৌতিক গল্প ও সায়েন্স ফিকশন লেখক এইচ পি লাভক্রফটকে 'আন্ডার দ্য পিরামিডস' প্রেতলিখনের জন্য ভাড়া করলেন জে সি হেলেনবার্গ। বইটি বিশ্বখ্যাত জাদুকর হুডিনির অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখিত। বইটি হাতে পেয়ে হুডিনি এতই সন্তুষ্ট হলেন যে তাকে তিনিও ভাড়া করে নিয়ে এলেন এবং 'দ্য ক্যানসার অব সুপারস্টেশন' লেখালেন।
ক্যাথেরিন অ্যান পোর্টার তখন লাগাতার ব্রঙ্কাইটিসে ভুগছেন। বেঁচে থাকার জন্য প্রেতলিখন শুরু করেছেন। ১৯২১ সালে প্রকাশিত হলো 'মাই চাইনিজ ম্যারেজ'। মাই তিয়াম ফ্র্যাঙ্কিংয়ের বইটি বেস্ট সেলার্স লিস্টে চলে এল। একসময় জানা গেল, কাহিনিটি মাই তিয়ামের হলেও পুরো বইটিই ক্যাথেরিন পোর্টারের লেখা।
'ক্লদিন' সিরিজের ৪টি আধা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ লিখে অঁরি গথিয়ে ভিলার্স প্যারিসের সহিত্যাঙ্গনে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছেন। প্রকৃতপক্ষে বইগুলো তার স্ত্রী কোলেটির লেখা। লেখক খ্যাতি তার স্বামীকে এতই আপ্লুত করে রেখেছেন যে আরও বই লিখে দেবার জন্য তিনি স্ত্রীকে ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখতেন। ১৯০৬ সালে তাদের ছাড়াছাড়ি ঘনিয়ে আসার সময় কিছু বদনাম দেওয়া হলো তাকে, শেষ পর্যন্ত তিনি প্রকাশ করে দিলেন চারটি বইয়েরই তিনি লেখক। পরবর্তীকালে কোলেটি ফ্রান্সের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফিকশনে লেখক হয়ে ওঠেন।
প্রেতলেখকের মামলা: পক্ষে ও বিরুদ্ধে; প্রেতলেখক নিয়ে
মাত্র দেড় মাস আগের খবর। আমেরিকার আইওয়া অঙ্গরাজ্যের মার্সি ক্লার্ক (মার্সি বোলডেন মার্সি বোরদু, এমিলিয়া মানচিনি প্রভৃতি ছদ্মনামে লিখে থাকেন) বই থেকে ভালো কামাই করেন। তিনি তার লিটারেরি এজেন্ট ডেভিড গ্রিশামের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। কারণ, গ্রিশাম প্রেতলেখক নিয়োগ দিয়ে তার নামে বই লেখাতে শুরু করেছেন। প্রকাশিত বইয়ে সেটাই প্রতিভাত হয়েছে। তাতে এজেন্ট লেখকের সুনামের পুরোটা ফায়দা লুটে নিলেন আর প্রেতলেখককে অল্প কিছু সম্মানী দিয়ে বিদায় করলেন। এটি বড় ধরনের প্রতারণা।
প্রেতলেখক বাহ্যত গ্রন্থকার কিম রিচার্ডসের বিরুদ্ধে ৯৯৯৯ ডলার ঠকানোর জন্য মামলা করেছেন। প্রেতলেখকের নাম এলিসন কিঙ্গস্লে বেকার। কিম রিচার্ডস চুক্তি অমান্য করে এলিসনকে ঠকিয়েছেন।
কোর্টনি লাভ এর প্রেতলেখক এ্রন্থনি বোৎসা ১২৩৩৭৫ শব্দের আত্মজীবনীর জন্য পেয়েছেন কেবল ১ লক্ষ ডলার। কিন্তু 'গার্ল উইথ দ্য মোস্ট কে' এখনো প্রকাশিত না হওয়ায় তিনি বই বিক্রির কমিশনসহ অন্যান্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এদিকে কোর্টনি লাভ প্রকাশক হার্পার কলিন্স থেকে ১.২ মিলিয়ন ডলার আগামের ৪ লক্ষ ডলার নিয়ে নিয়েছেন। এন্থনি মামলা করে দেবার পর কোর্টনি জানিয়েছেন, তিনি এই পাণ্ডুুলিপি প্রত্যাখ্যান করেছেন, এতে তাকে বিষণ্নভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে।
আইনজীবীর পরামর্শ দুই পক্ষকেই: অ্যাটর্নিও ভেটিং যুক্ত চুক্তিনামা ছাড়া প্রেতলেখক নিয়োগ করবেন না। অপর পক্ষের সাথে স্পষ্ট চুক্তি না হলে প্রেতলেখকও কাজে হাত দেবেন না।
গণেশরা এখন প্রেতলেখক
বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ ঔপন্যাসিক আলেকজান্ডার দুমা তার বিশ্বখ্যাত দুটি উপন্যাস 'দ্য থ্রি মাস্কেটিয়ার্স' এবং 'দ্য কাউন্ট অব মন্টেক্রিস্টো' প্রেতলেখককে দিয়ে লিখিয়েছেন।
আয়ান ফ্লেমিংয়ের 'জেমস বন্ড' সিরিজের কিছুসংখ্যক বই প্রেতলেখক রচনা করেছেন। হালের সর্বোচ্চ আয়ের লেখক জেমস পেটারসনের ওপর লেখালেখির চাপ বেড়ে যাওয়ায় তিনিও প্রেতলেখকের সেবা ক্রয় করছেন।
বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সেবার বেশ কিছু জনপ্রিয় বইয়ের প্রেতলেখক আমাদের অনেকেরই প্রিয় লেখক শেখ আবদুল হাকিম, এটা আদালতের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেবা প্রকাশনীর শেখ আবদুল হাকিম হলেন এ সময়ের সেরা গণেশ। কাজী আনোয়ার হোসেন একাধিক গণেশ দিয়ে 'মাসুদ রানা' লিখিয়েছেন।
বাংলা একাডেমির 'ইংলিশ-বেঙ্গলি ডিকশনারি'তে গোস্টরাইটার মানে: যে ব্যক্তির লেখা তার মনিব স্বনামে চালায়, লেখক-কর্মচারী। ক্রিয়া হিসেবে গোস্টরাইট মানে: (কারও জন্য) লেখক-কর্মচারী হিসেবে কাজ করা। গোস্টেড মেমোয়ার্স মানে: কোনো লেখক-কর্মচারী দ্বারা রচিত স্মৃতিকথা। তিনি কি গণেশ নন! গণেশ তো এখনো ভালোই শোনাচ্ছে। আমি গল্প-উপন্যাসে যেসব চরিত্রের হয়ে লিখি, আমি কি তাদের গণেশ নই?
১৯৮১-৮২ সালে বিদেশে প্রকাশিত ইংরেজিতে লিখিত একটি কথিত গবেষণা গ্রন্থের প্রেতলেখক হিসেবে আমি ২১ হাজার ৬০০ (টাকার অঙ্ক অক্ষরে লেখার নসিহত রয়েছে: একুশ হাজার ছয় শত) টাকা মজুরি পেয়েছি; মূল লেখক কত সম্মানী পেয়েছেন, আমার জানা নেই। লক্ষ করুন, আমারটা কিন্তু মজুরি, সম্মানী নয়।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত একাধিক মুনশিকে ডিকটেশন দিতেন। অবশ্য ডিকটেশন গ্রহণকারী লিখিয়েকে প্রেতলেখকের মর্যাদা না দেওয়াই সমাচীন।
সৈয়দ আলী আহসান ১৯৭৯ সালে একবার আমাকে তাঁর কলাবাগানের বাসায় নিয়ে গেলেন। সমকালীন বাংলা সাহিত্য নিয়ে কোনো বক্তৃতা কিংবা প্রকাশনার জন্য তিনি ইংলিশ ডিকটেশন দেবেন, আমাকে তা শুনে লিখতে হবে। আমিও একজন খ্যাতিমান মানুষের সান্নিধ্য পেতে চাচ্ছিলাম। আমি তখন পর্যন্ত শ্রুতিলেখক বা গণেশ।
তিনি বলতে শুরু করলেন, আমি লিখতে শুরু করলাম।
একটি দীর্ঘ বাক্যের মাঝখানে এসে তিনি বললেন, কী লিখেছ পড়ে শোনাও।
এ রকম কয়েকবার ঘটার পর ব্যাপারটা আমার কাছে খুব বিরক্তিকর মনে হলো, আমি বেশ বুঝে গেলাম, শ্রুতিলেখক হওয়ার যোগ্যতা আমার থাকতে পারে; কিন্তু গণেশ হিসেবে টিকে থাকার মেজাজ বা টেম্পারমেন্ট আমার নেই।
আমি সবিনয়ে বললাম, এভাবে আমি পারছি না। আপনি যদি দয়া করে পুরো বিষয়টা আমাকে বাংলা বা ইংলিশে যেভাবেই হোক বুঝিয়ে দেন, আমি একটা লেখা দাঁড় করাতে পারব। আপনি সেটা কাটছাঁট করে যোগ-বিয়োগ করে ঠিক করে নিতে পারবেন। তাতে সময় বাঁচবে, আর আমি যখন কাজটা করব, তখন আপনি জরুরি অন্যান্য কাজও করতে পারবেন।
(মনে মনে বললাম, এক বাক্য একাধিকবার পড়ে শোনানোর যাতনা থেকে আমি মুক্তি পাব।)
তিনি অসন্তুষ্ট চিত্তে বললেন, বেশ করো। দেখো, কোনো পয়েন্ট যেন ছেড়ে না দাও।
পয়েন্ট ছেড়েছি কি না, মনে নেই। তিনি কিছু কাটছাঁট সত্যিই করলেন। অসন্তোষ সম্ভবত দূর হলো, সাবেক উপাচার্যের মেজাজ ধরে রেখেই বললেন, ভালোই তো!
সম্ভবত শ্রুতিলেখক বা গণেশ হিসেবে ব্যর্থ হয়ে আমি মোটামুটি মানের একজন প্রেতলেখক হিসেবে আবির্ভূত হলাম।
নগদ কিছু পাইনি, কাজেই বাংলা একাডেমির অভিধান অনুযায়ী আমাকে লেখক-কর্মচারী বলা সমীচীন হবে না, তবে কয়েক দিনের মধ্যেই ফ্রেঞ্চ অ্যাম্বাসির কালচারাল অ্যাটাশে মাদাম কুলোর একটি নৈশভোজের দাওয়াত পেলাম। আমাকে খাওয়ানোর যুক্তিসংগত কোনো কারণই নেই। আমার বয়স তখন একুশ ছাড়িয়েছে। ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় মিলটনের 'অন হিজ হ্যাভিং অ্যারাইভ অ্যাট দ্য এজ অব টোয়েন্টি টু' বাধ্য হয়ে পড়তে হয়েছে এবং আমিও মিলটনের মতো আফসোস করতে শুরু করেছি: বাইশ তো হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুই তো করতে পারলাম না!
মাদাম কুলোর বাড়িতে দাওয়াতপত্রটি হাতে নিয়ে ঢুকলাম। ভেতরে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা অঙ্গনের বড় বড় সব মানুষ, বয়সও বেশি। সৈয়দ আলী আহসান ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে তুমি এসেছ। তুমি পরেও ডাক পাবে।
তার একটাই মানে, সৈয়দ আলী আহসান মাদাম কুলোর মেইলিং লিস্টে আমার নাম ঢুকিয়ে দিয়েছেন। একবার কিঞ্চিত 'গোস্টিং' করে সম্মানী ক্যাশে না হলেও কাইন্ডে ভালোই পেলাম।
অল্পের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট না হতে পারা হিলারি ক্লিনটন তার 'লিডিং হিস্ট্রি' গ্রন্থটি প্রেতলেখক দিয়ে লিখিয়েছেন এবং স্বীকারও করেছেন। সেই প্রেতলেখকের নাম ম্যারিয়েন ভোলার্স! অভিনেতা-প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগানের আত্মজীবনী 'অ্যান আমেরিকান লাইফ' প্রেতলেখকের রচনা। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ও আলাস্কার গভর্নর সারাহ পেলিনের 'গোয়িং রোগ' অবশ্যই তার বই, কিন্তু লিখেছেন লিন ভিনসেন্ট।
ফেডারেল রিজার্ভের একদা চেয়ারম্যান অ্যালান গ্রিনস্প্যান প্রেতলেখক ব্যবহার করতেন। হালে বাংলাদেশে প্রতিটি পাঁচ কেজি ওজনের দুটি জীবনী/আত্মজীবনী প্রেতলিখিত বলেই সন্দেহ করা হয়।
শিশুদের মজার বই গুজবাম্পস সিরিজ আর এল স্টাইনেরই, কিন্তু তিনি প্রেতলেখক নিয়োগ করেছেন। 'হার্ডি বয়েস' সিরিজের লেখক ফ্রাংকলিন ডিক্সন এবং 'ন্যান্সি ড্রু' সিরিজের ক্যারোলিন কিন প্রেতলেখক পুষেছেন।
প্রেত-প্রকাশনার রমরমা বাজার
গত ২০০ বছরের সবচেয়ে খ্যাতিমান জাদুকর হ্যারি হুডিনি, এ নিয়ে সম্ভবত বিতর্ক নেই। তাঁর চোখ পড়ে লেখক এইচ পি লাভক্রাফটের ওপর। আধা ভৌতিক কাহিনির লেখক হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত। হুডিনি তাকে করে নিলেন নিজের প্রেতলেখক। তাদের প্রথম রচনা 'ইমপ্রিজনড উইথ ফ্যারাও'। সম্প্রতি আবিষ্কৃত আরও একটি রচনা 'দ্য ক্যানসার অব সুপারস্টেশন' চড়া দামে নিলামে বিক্রি হয়েছে।
শিল্পী এলটন জনের অনেক গান বিশেষ করে 'ক্যান্ডল ইন দ্য উইন্ড', 'টাইনি ড্যানসার', 'রকেটম্যান' প্রেতরচনা। সেই প্রেতগীতিকারের নাম বার্নি টোপিন।
প্রেতলেখক জোনাথান ফ্যাব্রুকে নিজের প্রেতলেখক হিসেবে বারাক ওবামার এতই পছন্দ ছিল যে, তিনি তাকে হোয়াইট হাউসে তার ভাষণ-লেখকদের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন। ওবামা বলতেন, জোনাথান হচ্ছেন 'মাইন্ড রিডার', তার মনের কথা পড়ে ফেলতে পারেন। ওবামার বইগুলো তার কলমেই লিখিত। ২০১৩ সালে জোনাথান হোয়াইট হাউস ছেড়ে অন্যত্র যোগ দেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের, 'দ্য আর্ট অব দ্য ডিল'-এ তার প্রেতলেখক টনি শোয়র্জ। জেনারেল নর্ম শোয়ার্জকফের আত্মজীবনী 'ইট ডাজ নট টেইক আ হিরো'র লেখক পিটার পেট্রে। রিচার্ড ব্র্যানসন (ভার্জিন এয়ারলাইনসের মালিক) একটি অসাধারণ ঘটনাবহুল জীবন কাটাচ্ছেন। তার আত্মজীবনীর নাম 'লুজিং মাই ভার্জিনিটি', প্রেতলেখক এডওয়ার্ড হুইটলে।
মোৎজার্ট অন্যের জন্য সুর রচনা করেছেন। প্রেতসুরকার! কার্ল ফোরম্যান ও মাইকেল উইলসনস নিজ দেশে নিষিদ্ধ ছিলেন বলে পিয়েরে বোলের নামে সিনেমার জন্য প্রেতলিখন করেছেন 'ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই'। অবশ্য পিয়েরে বোলই মূল উপন্যাসের লেখক।
সিনেমাটি অস্কার পেয়েছে। 'রোমান হলিডে'র ব্যাপারেও একই ঘটনা ঘটেছে।
প্রেতলেখকদের নিয়ে সেরা দুটি উপন্যাস ফিলিপ রথের 'দ্য গোস্টরাইটার' এবং রবার্ট হ্যারিসের 'দ্য গোস্ট'। রোমান পোলানস্কি রবার্ট হ্যারিসের উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে 'দ্য গোস্টরাইটার' সিনেমাটি করেছেন।
ফিলিপ রথের উপন্যাসটি নিয়ে একটি পৃথক নিবন্ধ রচিত হতে পারে। প্রকাশনা মোঘল নাইম আতাল্লার প্রেতলেখক হিসেবে টানা কুড়ি বছর কাজ করেছেন জেনি এরডাল। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে জেনির আত্মজীবনী 'গোস্টিং: অ্য মেমোয়ার'।
মুখোশটা হিলারি ক্লিনটনের, দেহটা তার প্রেতলেখক বারবারা ফিনম্যান টডের।
আত্মজীবনী প্রকাশকের বিরুদ্ধে মামলা
হেডি ল্যামার মেরিলিন মনরোর আগের যুগের মেরিলিন। জন্ম ৯ নভেম্বর ১৯১৪, প্রথম যুদ্ধকালে ভিয়েনায়, মৃত্যু ১৯ জানুয়ারি ২০০০, ফ্লোরিডায়। শুরুতে মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া সৌন্দর্য তাকে খ্যাতিমান করে তোলে। ১৯৩৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'এক্সট্যাসি' ছবিতে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে সাঁতার কেটে, সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দৌড়ে এবং সঙ্গমকালীন চরমানন্দের শীৎকার দিয়ে তিনি বিখ্যাত ও বিতর্কিত হয়ে ওঠেন। ধনকুবের ইহুদি অস্ত্র ব্যবসায়ী ফ্রেডরিখ ম্যান্ডল তাকে বিয়ে করেন। তার বাড়িতে বিভিন্ন সময় অতিথি হয়ে আসেন হিটলার এবং মুসোলিনি। অস্ত্রের বড় চুক্তি ও লেনদেনের সময় স্বামী সুন্দরী স্ত্রীকে সঙ্গে রাখতেন। একসময় তিনি বুঝতে পারলেন, এ ধনকুবেরের প্রাসাদে আসলে তিনি সোনার শিকলে বন্দী।
আরও অবাক হলেন নিজে ইহুদি হয়ে ইহুদি নিধনের জন্য ফ্রেডরিখ অস্ত্রের চালান পাঠাচ্ছেন! হেডি ছন্দবেশে রাস্তায় নামলেন এবং প্যারিস পর্যন্ত পৌঁছালেন। তারপর তিনি ফিরে এলেন তার স্বতঃস্ফূর্ততার জগতে, সিনেমায়, তারপর চলে এলেন হলিউডে। এমনকি দুর্বল সিনেমাও তার সৌন্দর্যের ভারে উতরে যেত। হডি এতেই সন্তুষ্ট নন। অভিনয়ের পাশাপাশি তার অনুসন্ধিৎসা ও বিজ্ঞানমনস্কতাও তাকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রেখেছে। তিনি আবিষ্কার করলেন বিশেষ স্বাদের কার্বোনেটেড ওয়াটার। পাখির উড়াল পর্যবেক্ষণ করে উড়োজাহাজের দক্ষ উড্ডয়নের জন্য পাখার ডিজাইন করলেন এবং তার প্রয়োগ হেডির মেধার প্রমাণ দেয়। তিনি রেডিও সিগন্যালযুক্ত পিয়ানো আবিষ্কার করেন, ১৯৪২ সালে তা পেটেন্ট রাইট পায়। আজকের ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক, ব্লুটুথ প্রযুক্তি এবং স্প্রেড-স্পেকট্রাম কমিউনিকেশন টেকনোলজির ঠিকানা তার আবিষ্কার থেকেই। সিনেমাতে বটেই, সায়েন্স চ্যানেল ও ডিসকভারি চ্যানেলে তিনি উপস্থাপিত হন; এবং ইলেকট্রনিক ফাউন্ডেশন ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশন পাইওনিয়ার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কল্যাণ তহবিল সংগ্রহে তিনি যুক্ত ছিলেন। চুম্বনের বিনিময়ে হেডি সাহায্য কর্মসূচি চালু করেন।
তিনি ছয়বার বিয়ে করেন। এলিজাবেথ টেলর তার রেকর্ড ভাঙেন।
একসময় সিনেমা ছেড়ে দেন, অবিশ্বাস্য অনেক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। শেষ দিকে ক্লিপটোম্যানিয়াক (চুরি করার বাতিকগ্রস্ত) হয়ে পড়েন। লস অ্যাঞ্জেলেস ও ফ্লোরিডায় শপলিফটিং মানে দোকান থেকে এটা-ওটা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন।
হেডি ল্যামারের আত্মজীবনী 'এক্সট্যাসি অ্যান্ড মি' প্রকাশিত হওয়ার পর আত্মজীবনী সঠিকভাবে লিখিত না হওয়ার অভিযোগ এনে প্রকাশকের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
হেডি ল্যামারের বর্ণাঢ্য আত্মজীবনীর প্রেতলেখক ছিলেন লুই গোল্ড।
লেখক-প্রেতলেখক সম্পর্ক
বলেছিই তো হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন তার প্রেতলেখককে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু কেমন করে? তার একজন প্রেতলেখকের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
লেখক-প্রেতলেখক সম্পর্কটি আসলে বৈবাহিক সম্পর্কের মতো। পুরো আশা নিয়েই সম্পর্কটি শুরু করবেন। টিকে থাকার সম্ভাবনা ৫০ঃ৫০। ১৯৯৬ সালে যখন হিলারির 'হোয়েন ইট টেইকস আ ভিলেজ' প্রকাশিত হলো, তিনি ঠিক করলেন আমাকে তার 'প্রেত' স্বীকার করবেন না। কারণটা এখন পর্যন্ত তিনি ব্যাখ্যা করেননি।
বইটি যে হিলারি নিজেই লিখেছেন, তা প্রমাণ করার জন্য সাংবাদিক ডেকে তার হাতের লেখা, নোটবই এসব দেখিয়েছেন। বলেছেন, সম্পাদনায় সামান্য সহযোগিতা নিয়েছেন শুধু। নির্বাচনী প্রচারণার সময় হিলারির এই শঠতার কথা বারবার তার মনে পড়েছে।
কিন্তু গত নির্বাচনে তিনি কি হিলারিকে ভোট দিয়েছেন? প্রেতলেখক বারবার ফিনম্যান টড লিখেছেন: আমি ভোট তাকেই দিয়েছি। কিন্তু আমার অন্তরে এটি ছিল ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আমার একটি ভোট।
হিলারিভক্তরা নিশ্চয়ই এই অনুচ্ছেদ পড়ে একটা ধাক্কা খাবেন। বলবেন, তাই নাকি?
আর একজন প্রেতলেখকের দুঃখগাথা আমি তাঁর মুখেই শুনেছি। লেখক শক্তিমান ও প্রভাবশালী। প্রেতলেখক একটি সরকারি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত চাকুরে। দর-কষাকষি না করেই তিনি আত্মজীবনীমূলক বইটির প্রেতলিখন শুরু করলেন। লেখার সময় কদাচিৎ চা পেয়েছেন। লেখা শেষ হলে যখন পাণ্ডুলিপি তুলে দিলেন, ভাবলেন টাকা পাবেন। পেলেন না। যখন বইটি প্রকাশিত হলো, পাতা উল্টে ভেঙে পড়লেন, কোথাও তার নাম নেই।
আত্মজীবনীর প্রেতলেখকদের জন্য পরামর্শ: আগাম টাকা নেবেন। ভেতরে কোথাও আপনার নাম প্রত্যাশা করবেন না।
পাদটীকা ১
অন্ধ হোমার কি ব্রেইল পদ্ধতি ব্যবহার করে 'ইলিয়াড' আর 'ওডিসি' রচনা করেছেন? ব্রেইলের সূচনা ১৮২৪ সালে ফরাসি ফ্রেঞ্চ হরফ দিয়ে। আর হোমারের কাল খ্রিষ্টজন্মের আট থেকে সাড়ে আট শ বছর আগেকার। প্রেতলেখক যিনিই হোন না কেন, বিনা পয়সায় বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম উপকারটি করেছেন।
ক্রিস্টোফার মারলো, শেকস্পিয়ার কিংবা অন্য কেউ, কে কার প্রেতলেখক এসব বিতর্ক আপাতত দূরেই থাকুক।
পাদটীকা ২
আমার প্রিয় লেখকদের একজন সিঙ্কলেয়ার লুইস। আমি সাগ্রহে তাঁর 'মেইনস্ট্রিট', 'ব্যাবিট' 'উডসওয়ার্থ' ও 'অ্যারোস্মিথ' পড়েছি। ১৯৩০ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার ১৩ বছর আগে প্রেতলেখক হিসেবে কাজ করেছেন। আমি করলে সমস্যা কোথায়?
আমি নিজের জন্য প্রেতলেখক পেতে চাই। টাকা দিব। কিন্তু তার আগে আরও বেশি টাকা কামাই করার জন্য নিজে প্রেতলেখক হতে চাই: উপন্যাস, স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী কী চাই? এমনকি পাঠ্যবইও।