‘ইউক্রেন যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রিয় ইচ্ছাকে পূর্ণ করেছে; সোনার থালায় করে ইউরোপকে আমেরিকার হাতে তুলে দিয়েছে’
ইউক্রেনের মাটিতে রাশিয়ার আগ্রাসন (এ সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়) ৫০ দিনের বেশি ধরে চলছে। অব্যাহত ভাবেই চলছে গণমৃত্যু এবং ধ্বংসলীলা। গত সাত সপ্তাহে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। তারপরও লড়াই আরো তীব্র রূপ নিয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এ আগ্রাসনের বিষয়ে নিজ অবস্থানে অটল রয়েছেন। ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞের এ আগ্রাসন লাগামহীন ভাবে চলবেই বলে আভাস দেন তিনি। এর আগে পুতিন বলেছেন, আলোচনা "অচল অবস্থায়" যেয়ে ঠেকেছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ কড়া ভাষায় হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেন, আগামীতে আলোচনার চলাকালেও সেনা অভিযান বন্ধ রাখা হবে না। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনকে আগের চেয়েও অত্যাধুনিক এবং ভারি অস্ত্র যোগানোর জন্য ৮০ কোটি ডলার বরাদ্দ দেন। এরিমধ্যে ন্যাটো আরো বিস্তার ঘটানোর পাকাপাকি ব্যবস্থা নিতে চলেছে। ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন উভয় দেশই ন্যাটোর ছাতার নিচে আশ্রয় নেওয়াকে সক্রিয় বিবেচনায় রেখেছে। জার্মানি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ আরও অস্ত্র বেচাকেনার প্রকাশ্য ঘোষণা দিচ্ছে। প্রকাশ্য ঘোষণা দিচ্ছে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানোর। ইউরোপে স্থায়ী সামরিক উপস্থিতির বিস্তার ঘটানোর সম্ভাবনার কথা বলছে ন্যাটো। আর নিরাপত্তা বিষয়ে ইউরোপের ওপর রাজনৈতিক আধিপত্য পুনরুদ্ধার করছে ওয়াশিংটন।
এনবিসিতে দেওয়া সাক্ষাতকারে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেন, এ যুদ্ধ শুধুমাত্র ইউক্রেনের প্রতিরক্ষার জন্য নয় বরং রুশ রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার ওপরও উল্লেখযোগ্য আঘাত হানার এক সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, "দিন শেষে, আমরা যা দেখতে চাই, মুক্ত ও স্বাধীন ইউক্রেন, দুর্বল এবং বিচ্ছিন্ন রাশিয়া এবং শক্তিশালী, আরও ঐক্যবদ্ধ, আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ পশ্চিম। আমরা বিশ্বাস করি যে দৃশ্যমান এই তিন উদ্দেশ্যই সফল করা যেতে পারে।"
ইউক্রেন এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা রুশ বাহিনীকে জঘন্য যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করছে। বিপুল সংখ্যক বেসামরিক মানুষ রুশ গণহত্যার শিকার হয়েছে বলেও দাবি করা হচ্ছে। পুতিন সরকার এবং রুশ মিডিয়াগুলো এ সব অভিযোগকে ডাহা মিথ্যা এবং ভুয়া খবর হিসেবে উল্লেখ করে প্রচারণায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।
বাইডেন আনুষ্ঠানিকভাবে পুতিনকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করেন। পুতিনকে "যুদ্ধাপরাধের বিচারের" মুখোমুখি হওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতোই রাশিয়াও দৃঢ়ভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠার চুক্তিটি অনুমোদন করতে অস্বীকার করেছে। তাই মার্কিন প্রশাসন কীভাবে বা কোথায় পুতিনের এ ধরনের বিচার করতে চায় তা স্পষ্ট নয়।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ, শক্তিশালী দায়বদ্ধতা, যুদ্ধে মিডিয়া এবং প্রচারের ভূমিকা, পাশাপাশি ইউক্রেনের রক্তপাত বন্ধের জন্য যা করা দরকার বলে মনে করেন তা নিয়ে ইন্টারসেপ্টের জেরেমি স্কাহিলের সাথে বিস্তারিত আলাপচারিতা করেন মার্কিন ভিন্নমতাবলম্বী এবং ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কি।
আলোচনার শুরুতেই চলমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন জেরিমি স্কাহিল। রুশ সরকারের ইউক্রেনে আগ্রাসনের জেরে প্রতিনিয়ত খবর আসছে রক্তপাত এবং গণহত্যার আতঙ্ক নিয়ে।
পাশাপাশি ইউরোপে ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপে মার্কিন সমরবাদের সম্প্রসারণ ঘটানোর আহ্বান জানাচ্ছে। ইউরোপীয় সরকারগুলো অস্ত্র খাতে আরো অর্থ ব্যয়ের এবং অস্ত্র দালাল হিসেবে তাদের তৎপরতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র ব্যবসায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
স্কাহিল প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে যে সব প্রশ্ন করেন সেগুলোও ছিল আকারে বড়। কখনো প্রশ্ন না করে নিজ বক্তব্য উপস্থাপন করেন এবং চমস্কি সে প্রসঙ্গে কথা বলেন। সব মিলিয়ে প্রায় আট হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারকে প্রায় ২২'শ শব্দ কাঠামোতে তুলে ধরার পরিণতিতে অনির্বায ভাবেই বক্তব্য সংক্ষিপ্ত এবং বর্জন করতে হয়েছে।
স্কাহিল: ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানো, ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং শুধুমাত্র রাশিয়া এবং পুতিনের বিরুদ্ধেই নয় বরং সাধারণ রুশবাসীদেরকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা নয় কী? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সরকারগুলো যে সব প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তার কোন কোনটির সাথে আপনি একমত?
চমস্কি: ইউক্রেনের আত্মরক্ষার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করাকে আমি মনে করি বৈধ। তবে খুবই সতর্কতার সঙ্গে এ সমর্থনের মাত্রা বেঁধে দিতে হবে। সমর্থন যেন প্রকৃতপক্ষে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটায় এবং ইউক্রেনের ধ্বংস হতে পারে এমন ভাবে সংঘাতকে বাড়িয়ে না দেয়। আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তার বাইরে কারও যেন ক্ষতি না হয়। ইরাক বা আফগানিস্তান বা অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে হামলার সময় এমন নিষেধাজ্ঞা ওয়াশিংটনের জন্য উপযুক্ত ছিল। অবশ্য, শক্তির কথা বিবেচনায় নিয়ে এমন নিষেধাজ্ঞা আমেরিকার ওপর দেওয়া অকল্পনীয়। প্রথম প্রথম কয়েকবার এমনটি ঘটেছিল। একবার এ ভাবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর আমেরিকা তা ধর্তব্যের মধ্যেই নেয় নি বরং সংঘাতকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। নিকারাগুয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব আদালতে নেওয়ার পর বেআইনিভাবে বলপ্রয়োগের জন্য আমেরিকা নিন্দা করে। এবং এ জন্য ক্ষতিপূরণও দিতে বলে। আমেরিকা হামলা বাড়িয়ে দিয়ে এর প্রতিক্রিয়া জানায়। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এমন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা অকল্পনীয় হলেও সেটাই উপযুক্ত ।
যাইহোক, আমি এখনও মনে করি প্রশ্নটি সঠিক নয়। সঠিক প্রশ্ন হলো: ইউক্রেনকে আরও ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সবচেয়ে ভালো কাজ কী? এবং এ সমস্যাকে একটি আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির দিকে অগ্রসর হতে হবে।
যুদ্ধ বন্ধের পথ দুটো। তা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। একটি পথ হলো, এক পক্ষ বা অপর পক্ষকে মৌলিক ভাবে ধ্বংস করতে হবে। এবং রুশ পক্ষ ধ্বংস হবে না। কাজেই এ কথা অর্থ হলো, ইউক্রেনকে ধ্বংস হতে হবে।
অন্যটি হলো আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করা। যদি তৃতীয় কোনও পথ থেকে থাকে এখনো কেউ তা বের করতে পারেনি। কাজেই প্রাথমিক ভাবে সম্ভাব্য আলোচনার মধ্য দিয়ে সুরাহার দিকে আমাদের এগোতে হবে। এটাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
ভ্লাদিমির পুতিন এবং তাকে ঘিরে থাকা ছোট চক্রটি কি ভাবছে তা আমার বুঝতে পারি না। কেবল অনুমান করতে পারি। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেখতে পাই, আমরা দেখতে পাই আমাদের খোলামেলা নীতি—খোলামেলা—হলো যে কোনও আলোচনাকে প্রত্যাখ্যান করা। এ খোলামেলা নীতি অনেক দিনের। তবে ২০২১'এর সেপ্টেম্বরে, ১ সেপ্টেম্বরে নীতি সংক্রান্ত যৌথ বিবৃতিতে এ নীতির সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেওয়া হয়। তারপর ১০ নভেম্বরের চুক্তি-সনদে পুনর্ব্যাক্ত করা এবং বিস্তার ঘটানো হয়।
একে মৌলিক ভাবে কোনও আলোচনা বলা যায় না। বরং এটি ন্যাটোতে ইউক্রেনের ঢোকার জন্য একটি বর্ধিত কর্মসূচি। এটিই আলোচনার পথ বন্ধ করে দিয়েছে।
এ সব ঘটেছে (ইউক্রেনে) অভিযান চালানোর আগে। লক্ষ্য করুন—ইউক্রেনে উন্নত অস্ত্র পাঠানো বৃদ্ধি করা, আরো সামরিক প্রশিক্ষণ, যৌথ সামরিক মহড়া, সীমান্তে অস্ত্র মোতায়েন। আমরা নিশ্চিত নই, তবে সম্ভবত এই শক্তিশালী বিবৃতিগুলো পুতিন এবং তার চক্রকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করার বদলে সরাসরি আগ্রাসনের দিকে নিয়ে যাওয়ার একটি কারণ হতে পারে।
সুতরাং আপনি যে প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ, আকর্ষণীয়, কেবলমাত্র ইউক্রেনীয়দের নিজেদের রক্ষা করার জন্য কিন্তু সংঘাতকে বৃদ্ধির দিকে না নিয়ে যাওয়ার বা কেবল ভয়াবহ ধ্বংসের দিকে না নেওয়ার উপযুক্ত সামরিক সহায়তা কী হতে পারে? এবং কি ধরনের নিষেধাজ্ঞা বা অন্যান্য পদক্ষেপ আগ্রাসীদের নিবৃত্ত করতে কার্যকর হতে পারে? এগুলো সবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রাথমিক প্রয়োজনের তুলনায় এগুলো সবই তুচ্ছ, এটি ইউক্রেনের ধ্বংসের একমাত্র বিকল্প হতে পারে, অবশ্য রাশিয়াই কেবল এ কাজ করতে সক্ষম।
স্কাহিল: আপনি জানেন, ভলোদিমির জেলেনস্কিকে সত্যিই সিংহ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপীয় মিডিয়াতে।
জেলেনস্কিকে ঘিরে পৌরাণিক কাহিনি গড়ে তোলায় মার্কিন এবং ইউরোপীয় সংবাদ মাধ্যমে ভূমিকা সম্পর্কে আপনার কাছে জানতে চাইবো। এ ভূমিকা ইউক্রেনের আলোচনার গুরুত্বকে খাটো করছে।
চমস্কি: জি। আপনি পুরোপুরি ঠিক বলেছেন। সংবাদ মাধ্যমে যে ভাবে খবর প্রকাশ করছে তার দিকে নজর দিলে দেখা যাবে রাজনৈতিক সমঝোতা নিয়ে পরিষ্কার, খোলামেলা, গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি জেলেনস্কির। ইউক্রেনের নিরপেক্ষ অবস্থানের বিষয়ে সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তবে দীর্ঘ সময় ধরে এগুলোকে চাপা দেওয়া হয়েছে, বীরত্বপূর্ণ বক্তব্যের জন্য এ গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কংগ্রেসসদস্য এবং অন্যান্যরা জেলেনস্কিকে উইনস্টন চার্চিলের ছাঁচে ফেলছেন।
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ আগ্রাসনের শুরুতে ঘোষণা করেছিলেন যে তার দেশের দুটি প্রধান লক্ষ্য। ইউক্রেনের নিরপেক্ষকরণ এবং নিরস্ত্রীকরণ। নিরস্ত্রীকরণ মানে সকল অস্ত্র মুক্ত করা নয়। এর অর্থ হলো রাশিয়াকে তাক করা ন্যাটোর ভারী অস্ত্র থেকে মুক্তি পাওয়া। ল্যাভরভের শর্তাবলীর অর্থ হলো কার্যত ইউক্রেনকে মেক্সিকোর মতো কোনও রাষ্ট্রে পরিণত করা। সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মেক্সিকো বিশ্বে নিজের মতো চলতে পারে এবং এর কোনও সীমাবদ্ধতা নেই। তবে ইচ্ছে করলেও চীনা নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে যোগ দিতে পারে না, মার্কিন সীমান্তে চীনা আধুনিক অস্ত্র মোতায়েন করতে পারে না। চীনের গণমুক্তি ফৌজের সাথে যৌথ সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে পারে না। এসব অভাবনীয় এবং কেউ এ নিয়ে মুখ খুলতেও সাহস পায় না। মেক্সিকোর এমন কিছু করার সামান্য আভাসও পাওয়া গেলে পরবর্তী মার্কিন পদক্ষেপ কী হবে আমরা জানি- এ নিয়ে কথা বলার দরকার নেই। এটি অভাবনীয়। কিন্তু মেক্সিকোর জন্য যা অভাবনীয় ইউক্রেনের জন্য সে পথই পছন্দ করেছে আমেরিকা।
ক্রিমিয়া প্রসঙ্গে জেলেনস্কি বলেন, বিষয়টি আরো আলোচনার জন্য তোলা থাক। তার এ কথাই বেশ যুক্তিপূর্ণ। দোনাবাস নিয়ে সঠিক প্রতিক্রিয়া দেখানো দরকার ছিল। হামলা শুরুর আগে, গণভোটের কথা বলা যেত, আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে গণভোট, দেখতে এই অঞ্চলের মানুষ কী চায়। হয়ত এটা রাশিয়া মেনে নিতো। দ্বিতীয় মিনস্ক চুক্তি অনুযায়ী সুইজারল্যান্ড বা বেলজিয়ামের মতো বৃহত্তর ইউক্রেনীয় ফেডারেশনের কথা বলা যেত। এটা কাজ করবে কিনা বোঝার একমাত্র উপায় ছিল এ পদ্ধতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা। আমেরিকা এ চেষ্টা করতে অস্বীকার করে। বদলে, মহা-সামরিক অবস্থান নেওয়ার ওপর জোর দেয়।
স্কাহিল: সংবাদ মাধ্যমের সাথে কারসাজি মার্কিন সরকারের নতুন কোনও কার্যকলাপ নয়। আমি যা অসাধারণ বা আকর্ষণীয় মনে করছি তা হলো যে মার্কিন সরকার এখন শুধু প্রকাশ্যে এমন তৎপরতার কথা স্বীকারই করছে না বরং এমন সব তৎপরতাকে তারা প্রায় উদযাপন করছে। আমেরিকার নিজস্ব সংবাদ মাধ্যম এবং শক্তিশালী সাংবাদিকদের মার্কিন সরকার নিজ যুদ্ধ প্রচেষ্টার অংশ বানিয়ে এ সব খবর ছড়িয়ে দিতে ব্যবহার করতে পারছে।
চমস্কি: হ্যাঁ এটা কোনোভাবেই নতুন নয়। এ প্রচেষ্টার ঘনীভূত এবং সংগঠিত রূপ খুঁজে পাবেন প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে; ব্রিটিশরা সে সময়ে একটি তথ্য মন্ত্রণালয় গঠন করে। কেনও এটি গঠন করা হয়েছিল আমরা জানি। তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্য ছিল জার্মান যুদ্ধাপরাধের ভয়ঙ্কর গল্পগুলো উপস্থাপন করা যাতে মার্কিনীদের যুদ্ধে নামতে প্ররোচিত করা যায়।
প্রেসিডেন্ট উইলসন তার নিজস্ব তথ্য মন্ত্রণালয় স্থাপন করেছিলেন। যার অর্থ হলো জনগণের কাছে মিথ্যা কথা ছড়ানো। অর্থাৎ যা কিছু জার্মান তা ঘৃণা করতে শেখানো।
তারপরও এ খেলা চলল। রিগ্যান খুললেন গণ-কূটনীতির দপ্তর। যার অর্থ হলো আমরা যা করছি সে সম্পর্কে জনসাধারণ এবং মিডিয়ার কাছে মিথ্যা বলার দপ্তর। তবে মার্কিন সরকারের জন্য এ কোনও কঠিন কাজই না।
স্কাহিল: জো বাইডেন বলছেন, ভ্লাদিমির পুতিন একজন যুদ্ধাপরাধী। যুদ্ধাপরাধের দায়ে তার বিচারের আহ্বানও জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠা হয়েছে যে চুক্তির ভিত্তিতে রাশিয়ার মতো আমেরিকাও তা অনুমোদন করেনি। জর্জ বুশ এবং ডিক চেনি মুক্ত মানুষ হিসেবে যখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন, হেনরি কিসিঞ্জারের কথা নাই বা বললাম? দুনিয়ার সব শক্তির ওপর ওই আদালতের সম বৈচারিক এখতিয়ার আমেরিকায়ই যখন মেনে নিচ্ছে না তখন বাইডেন কি করে যুদ্ধ অপরাধের বিচারের আহ্বান জানান?
চমস্কি: এখানে দুটো প্রশ্ন, দুটো বিষয় রয়েছে: হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন, আমরা এ বিষয়টি বিবেচনা করছি যে রাশিয়া মারাত্মক যুদ্ধ অপরাধ করেছে। এ নিয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই। এ সবই হলো বড় ধরণের যুদ্ধ অপরাধ। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের তৎপরতাকে পুরোই আটকে দিয়েছে আমেরিকা। এটাও নতুন কিছু না। এর চেয়েও মারাত্মক বিষয় আছে যা কিনা পুরো ধসিয়ে দেবে। আইসিসি'র রায় মেনে নেয়নি একটি মাত্র দেশ সেটি হলো আমেরিকা। এ বাবদ আমেরিকার অবশ্য দু'জন সঙ্গী ছিল। আলবেনিয়ার আনোয়ার হোজ্জা এবং লিবিয়ার মোয়াম্মাদ গাদ্দাফি। তবে সে দু'জন আর নেই। বিশ্ব আদালতের রায় অমান্যকারী হিসেবে এখন একাই দাঁড়িয়ে আছে আমেরিকা। ১৯৮৬ সালে তাও নিকারগুয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওয়াশিংটন ছোটখাটো অপরাধ করেছিল। "অবৈধভাবে শক্তিপ্রয়োগের দায়ে" আদালত আমেরিকার নিন্দা জানায়। এখানে "অবৈধভাবে শক্তিপ্রয়োগ"এর মানে হলো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ। এবং এ তৎপরতা বন্ধ করতে ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য আমেরিকাকে নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল।
এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় রিগ্যান প্রশাসন এবং কংগ্রেস অপরাধ তৎপরতা আরো বাড়িয়ে দেয়। ওটাই হলো প্রতিক্রিয়া। সংবাদ মাধ্যমেও প্রতিক্রিয়া বর্তায়: নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তে লেখা হলো যে আদালতটির সিদ্ধান্ত প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ আদালত হলো বৈরী মঞ্চ। কেনও বৈরী মঞ্চ? কারণ আমেরিকাকে অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করার মতো দুঃসাহস দেখিয়েছে এ আদালত। এর একটা বিহিত করতে হবে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে অপরাধ তৎপরতা বাড়াতে হবে।
নিকায়াগুয়া নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে ইশতেহার নেওয়া হয়। আমেরিকার নাম উল্লেখ না করে সব দেশকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার আহ্বান এতে জানান হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ইশতেহারে ভেটো দিলে সাধারণ পরিষদে এরকম ইশতেহার ব্যাপক ভোটে জয়ী হয়। তবে ইশতেহারটি বিরোধিত করে আমেরিকা, বিরোধিতা করে ইসরায়েল। এ দুই রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন মানবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (এখন) বুঝতে পারে না কেন বিশ্বের বেশিরভাগ (তার আরোপিত) নিষেধাজ্ঞায় যোগ দেয় না। কোন কোন দেশ নিষেধাজ্ঞায় যোগ দিয়েছে? দেখা যাক, মানচিত্র তা তুলে ধরছে। ইংরেজিভাষী দেশগুলো, ইউরোপ, এবং যারা বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকাকে সম্মানসূচক শ্বেতাঙ্গ নামে ডাকে: জাপান, তার কয়েকটি সাবেক উপনিবেশ। ব্যাস এই হলো নিষেধাজ্ঞায় যোগদানকারীরা। বাদবাকি দুনিয়া বলছে, : হ্যাঁ, ভয়ানক, কিন্তু নতুন কি? কি নিয়ে এতো হৈচৈ? তোমার ভণ্ডামিতে আমরা কেন জড়াব?
স্কাহিল: আপনি কী দেখছেন — বা আপনি এই মুহূর্তে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন, বিশেষ করে ভারত ও চীনের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ?
চমস্কি: আচ্ছা, এটা ভিন্ন কথা। একটি বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত সরকারকে যথেষ্ট সমর্থন করে। ভারতে একটি নব্য ফ্যাসিবাদী সরকার রয়েছে। মোদি সরকার ভারতীয় গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য ভারতকে বর্ণবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে। হিন্দু তস্করতন্ত্রে রূপান্তরের জন্য মুসলমানদের ওপর হামলা করছে, কাশ্মীর জয় করেছে - এ নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করা হয়নি। (ভারতের এ সবই) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করছে। (আমেরিকা ভারতের জন্য) খুবই সহায়ক। (আর ভারত) ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র—আমাদের (আমেরিকার) মতোই দেশটি, অন্য কথায়, অতএব কোন সমস্যা নেই।
এবং ভারতের সাথে সমস্যা হলো দেশটি যথেষ্ট এগিয়ে আসে না। আমরা যতদূর এগোতে চাই, রাশিয়ার বিরুদ্ধে হামলায় যোগ দিতে চায় না। দেশটি এক নিরপেক্ষ খেলায় মেতেছে। খেলছে গোটা দক্ষিণ গোলার্ধের মতোই, বলছে: হ্যাঁ, (রাশিয়ার) কাজটি অপরাধ, কিন্তু আমরা আপনার খেলায় জড়িয়ে পড়তে চাই না।
এবং অন্য বিষয় হল ভারত অংশগ্রহণ করছে ঠিকই কিন্তু বাইডেন প্রশাসন যাকে "চীনকে ঘিরে রাখা" নীতি বলছে তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যতটা সক্রিয়ভাবে চায় ততটা নয়। আমাদের প্রধান নীতিগুলোর মধ্যে একটি হলো রাশিয়াকে কোণঠাসা করা, কিন্তু প্রধান নীতি হলো চীনকে ঘিরে ফেলা - চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি এখন সেকেলে হয়ে গেছে। তাই চীনকে ঘিরে ফেলো—প্রহরী দেশগুলোকে নিয়ে। আর এটি এমন শব্দ যা ব্যবহৃত হয়, চীনের হুমকি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে ব্যাপক আক্রমণাত্মক সক্ষমতাসহ আপাদ-মস্তক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করতে। এটি দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের মতো দেশগুলোর একটি বলয়। তবে ভারত সক্রিয়ভাবে যোগ দিচ্ছে না। এ সব দেশকে আমরা (অস্ত্র) সরবরাহ করব, বাইডেন প্রশাসন সম্প্রতি উন্নত নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে যা চীনকে তাক করবে।
অস্ট্রেলিয়ার বেলায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের সাথে, তার কুকুরছানা, অস্ট্রেলিয়াকে উন্নত পারমাণবিক ডুবোজাহাজ সরবরাহ করছে। এ সব সাবমেরিনকে শনাক্ত করার আগেই চীনা বন্দরে প্রবেশ করতে এবং দুই বা তিন দিনের মধ্যে চীনা নৌবহরকে ধ্বংস করতে সক্ষম বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। চীনের নৌবহর প্রাচীন এবং প্রাগৈতিহাসিক - এমনকি তাদের পারমাণবিক ডুবোজাহাজও নেই—সবই সেকেলে ডিজেল ডুবোজাহাজ।
এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আত্মরক্ষার জন্য নিজেদের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এখনও অবধি, আমাদের কাছে ট্রাইডেন্ট ডুবোজাহাজ রয়েছে। (এ শ্রেণির) প্রতিটি সক্ষম ডুবোজাহাজ পারমাণবিক হামলার মাধ্যমে বিশ্বের যে কোনও জায়গায় প্রায় ২০০ শহর ধ্বংস করে দিতে পারে। কিন্তু তাই যথেষ্ট নয়। আমরা এখন আরও উন্নত হতে চলেছি, আমি মনে করি একে ভার্জিনিয়া-শ্রেণির ডুবোজাহাজ বলা হয় যা কিনা অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক হবে। আর এই হলো চীনের প্রতি আমাদের নীতি।
আর পুতিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক অভূতপূর্ব উপহার দিলেন। ইউক্রেনের যুদ্ধ ছিল অপরাধমূলক, কিন্তু তার দৃষ্টিকোণ থেকেও, পুরোই বোকামি। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রিয় ইচ্ছাকে পূর্ণ করেছেন; এ ইচ্ছাটি হলো সোনার থালায় করে ইউরোপকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া।