সহি বড় আমলানামা
আপনি কি জীবিত?
আপনি যে জীবিত, তার প্রমাণ কী? আপনি বলবেন, এই যে আমি, দেখুন—আমি হাত-পা নাড়ছি, আমার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে, আমি কথা বলছি, চিমটি কাটলে ব্যথা পাচ্ছি।
তাতে কী? আপনি যদি ট্যাঙ্গো নাচও দেখান, তাতেও প্রমাণিত হবে না যে আপনি বেঁচে আছেন। আপনি যে জীবিত সেই সার্টিফিকেট দিন।
২০০০ সালের জুন মাসের কোনো এক দিন। ঘটনাটি কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটায়। সেখানকার গণপূর্ত বিভাগের একজন সাবেক কর্মচারী আর্তুরো সুস্পে। শরীর জীর্ণ ও দুর্বল, বয়সও কম নয়, ৮৭ বছর। তিনি বাড়ি থেকে ব্যাংকে এসে পেনশনারদের লাইনে দাঁড়িয়েছেন। মাসের টাকাটা তুলবেন। তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে শুনলেন নতুন ফরমান অনুযায়ী পেনশনের টাকা ছাড় করা হচ্ছে। তিনি সত্যিই যে বেঁচে আছেন তা প্রমাণের জন্য তাকে 'সারভাইভাল সার্টিফিকেট' দাখিল করতে হবে।
আজীবন পেনশন, মানে যতক্ষণ শ্বাস আছে ততক্ষণ পাওয়া যাবে। মৃত্যুর পর পাওয়ার সুযোগ নেই। তবে মৃতদের কারও কারও নাম ভাঙিয়ে একটি প্রতারক চক্র টাকা তুলে আত্মসাৎ করছে, এটা সরকারের নজরে এসেছে। সরকারি তহবিলের তছরুপ ঠেকাতে সবচেয়ে যোগ্য পরামর্শদাতা আমলারাই। এসব তাদেরই কাজ। পরামর্শ এল পেনশন তোলার আগে সারভাইভাল সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে। সার্টিফিকেট দেখে ব্যাংক কর্মকর্তারা বুঝে নেবেন মানুষটি মৃত নন, জীবিত। তাহলেই কেবল তার পাওনা পেনশনের টাকাটা দেওয়া যায়।
বোগোটার স্থানীয় সরকার কার্যালয় সারভাইভাল সার্টিফিকেট দেবে। আর্তুরো সুস্পে যে বেঁচে আছেন, সেই সার্টিফিকেট জোগাড় করতে লম্বা লাইনে দাঁড়ালেন। লাইনে দাঁড়িয়েছেন প্রায় ৭০০০ বুড়ো। তারা যে বেঁচে আছেন সেই সনদ চাই। তাদের দেখেশুনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেই সার্টিফিকেট দেওয়া হবে।
ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত আর্তুরো সুস্পে একসময় মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন, তার শ্বাস উঠল। কিছু সময় পর ডাক্তার এসে নাড়ি টিপে বলে দিলেন বুড়ো আর্তুরো আর বেঁচে নেই। পেনশন তোলার জন্য তার সার্টিফিকেট আর তোলা হলো না। বুড়োরা মরার আর জায়গা পায় না!
গভর্নর আদ্রে গঞ্জালেস আর্তুরোর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করলেন। সারভাইভাল সার্টিফিকেট দাখিলের প্রথা যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেল। আর্তুরো সুস্পে মরে প্রমাণ করলেন মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি জীবিতই ছিলেন। তিনি প্রায় ১৩৩ ডলার পেনশন পেতেন, জীবন ধারণ করতেন এই টাকায়। মৃত্যু তাকে টাকার প্রয়োজন থেকে মুক্তি দিয়েছে। একই সঙ্গে তাকে পেনশনের লাইনে দাঁড়ানোর যাতনা থেকেও মুক্তি দিয়েছে। মৃত্যুর চেয়ে ভালো মুক্তিদাতা আর কে আছে!
এটি একটি দেশ-নির্দিষ্ট উদাহরণ হলেও নৈর্ব্যক্তিক আমলাতন্ত্রের জনভোগান্তির একটি বৈশ্বিক চিত্র।
যুক্তরাষ্ট্রও ব্যতিক্রম নয়
ফেব্রুয়ারি ২০২০-এর একটি মার্কিনি সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদন:
ইথেল ফ্রাঙ্কের কথা ভাবুন। তার বয়স ৮৪ বছর। জীবনের কোনো পর্যায়েই তিনি জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেট গ্রহণ করেননি। তিনি কখনো গাড়ি চালাননি, কাজেই তার ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্রয়োজন হয়নি। তার কখনো অন্য দেশে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি, সুতরাং তার কোনো পাসপোর্ট নেই। তিনি কখনো এমন কিছুর জন্য আবেদন করেননি, যেখানে তার জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেট বা সরকারি আইডির প্রয়োজন হয়। তিনি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে সাহায্যও প্রার্থনা করেননি। তবে একটি কাগজ তার ছিল। একজন খ্রিষ্টীয় যাজক, যে তাকে ব্যাপটাইজড করেন এটিই সেই 'ব্যাপটিজেশন সার্টিফিকেট'। কিন্তু এটি আর গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি আগে কখনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলেননি, ঋণের জন্য আবেদন করেননি। এমনকি তিনি কাউকে ভোটও দেননি। ইথেল ফ্রাঙ্ক জীবিত না মৃত—এ প্রশ্নটি অবান্তর হয়ে পড়েছে। সরকারের কোনো খাতায় তার নাম নেই। তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন তাকে সমাহিত করতে সমস্যা হবে। তিনি কে? সরকারি ক্লিয়ারেন্স ছাড়া তাকে সমাহিত করা নিষেধ, ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারি ক্লিয়ারেন্সের জন্য সরকারি পরিচয় জানা লাগবে। এটি অদ্ভুত এক 'ক্যাচ ২২' পরিস্থিতি (জোসেফ হেলারের ক্যাচ ২২ পড়তে পারেন); আপনার যদি সরকারি আইডি না থাকে তাহলে সরকারি আইডি পাবেন না। এত দিনে ইথেল মৃত্যুবরণ করেছেন কি না, জানা নেই। তবে এটা জানা আছে, উত্তর আমেরিকায় ইথেলের মতো অন্তত এক মিলিয়ন অধিবাসী রয়েছে, যাদের জন্য অপেক্ষা করছে 'ক্যাচ ২২' পরিস্থিতি। মাত্র কদিন আগে ২২ মার্চ ২০২২ আসামের শিলচরের মৃত শ্যামাচরণ দাস সরকারের জরুরি চিঠি পেয়েছেন, আপনি আদৌ ভারতীয় নাগরিক কি না, তার প্রমাণপত্রসহ অবিলম্বে হাজির হন।
৬ মে ২০১৬ যে মানুষটি মৃত্যুবরণ করেছেন, চার বছর পর 'ডেড ম্যান ওয়াকিং' (ভৌতিক চলচ্চিত্রটি দেখুন) করে আদেশদাতার সামনে হাজির হলে তিনি স্থির থাকতে পারবেন তো? শ্যামাচরণ পুনরায় মৃত্যুবরণ করার একটি দুর্লভ সুযোগ পেয়ে গেলেন। তার পরিস্থিতি অন্যদের ঠিক উল্টো। তাকে মৃত প্রমাণ করার জন্য তার স্বজনেরা সরকারি অফিসে ধরনা দিচ্ছে। বোগোটায় জীবিত প্রমাণ করতে আর্তুরো সুস্পেকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনীর কথা মনে পড়ে? যাকে মরে প্রমাণ করতে হয়েছে যে তিনি মরেননি।
আমলাদের কর্মতুষ্টি
'কী পাইনি তার হিসাব মেলাতে মন মোর নহে রাজি'—এই হলেন রবীন্দ্রনাথ। আমলাদের কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের এই গানটি গান হিসেবে পছন্দ করে থাকতে পারেন, কিন্তু নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে রাজি হবেন না। না পাওয়ার আক্ষেপ থেকেই যাবে। বেতন যতই বাড়ানো হোক, বেতন বরাবরই কম। ১৯৩০-এর দশকের শেষ দিককার আইসিএস জনাব নরুনাকে ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যান জিজ্ঞেস করেছিলেন বেতন ছাড়া আর কোন বিশেষ কারণে আপনি সিভিল সার্ভিসের প্রতি আকৃষ্ট হলেন?
তার সাফ জবাব, বেতন ছাড়া সিভিল সার্ভিসে আর কিছু আছে নাকি? জব স্যাটিসফেকশন নেই। কিন্তু জবটি ছাড়ছেন না। তৃপ্তিকর কোনো কাজের অনুসন্ধানও করছেন না। বরং অবসর নেওয়ার সময় এসে গেলে হাতে-পায়ে ধরে দু-এক বছর চুক্তিভিত্তিক আমলাতান্ত্রিক চাকরি চালিয়ে যাওয়া যায় কি না, সে কসরত করছেন। তারপরও যেতে চান না। তৃপ্তি না থাকার বিষয়টি তাহলে পুরো সত্য নয়।
বিলেতিদের অবস্থাটা দেখা যাক। আমলাদের অসন্তোষ সেখানেও। আমলাতন্ত্রের স্টিল ফ্রেম ব্রিটেনে। দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রশ্নে ব্রিটিশ আমলারা বেশ এগিয়ে। তবে দুর্নীতির প্রশ্নে আমাদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে।
বিলেতে সিটি অ্যান্ড গিল্ড বেশ বড়সড় একটা জরিপ চালায় বিভিন্ন পেশার মানুষের ওপর। সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে। উত্তরদাতারা প্রাণখুলে কথা বলেছেন জরিপকর্মীদের সঙ্গে। জরিপ দেখা গেল, সবচেয়ে বেশি জব স্যাটিসফেকশন পাচ্ছেন হেয়র ড্রেসার, সোজা কথায় নাপিতরা; আর আমলারা সেখানেও কাজের তৃপ্তি পাচ্ছেন না। বড্ড মন খারাপ তাদের। জরিপের ফলাফলের একটি সারসংক্ষেপ: পেশা ও শতকরা কতভাগ পেশাজীবী জব স্যাটিসফেকশন পান তার হিসাব—নাপিত ৪০%, ধর্মগুরু ২৪%, পাচক ২৩%, বিউটিশিয়ান ২২%, পানির মিস্ত্রি ২০%, মেকানিক ২০%, রাজমিস্ত্রি ২০%, ইলেকট্রিশিয়ান ১৮%, পুষ্পজীবী ১৮%, ব্যায়াম প্রশিক্ষক ১৮%, সেবক ১৮%, স্বাস্থ্যকর্মী ডাক্তার ১৭%, গণমাধ্যমকর্মী ১৬%, চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার ১৫%, ফার্মাসিস্ট ১৫%, বিজ্ঞানী ১৫%, কসাই ১৪%, ডিস্ক জকি ১৩%, অভ্যন্তরীণ ডিজাইনার ৯%, ট্রাভেলস এজেন্ট ৯%, শিক্ষক ৮%, ব্যাংকার ৮%, অ্যাকাউন্টেন্ট ৭%, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ৫%, আইনজীবী ৫%, পার্সোনাল সেক্রেটারি ৫%, জমির দালাল ৪%, আমলা ৩%, স্থপতি ২% এবং সমাজকর্মী ২%।
জব স্যাটিসফেশন নির্ধারণে যেসব অনুষঙ্গ বিবেচনায় আনা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে বেতন কাঠামো, কাজের ভার, মানসিক চাপ, কর্মক্ষমতা, বসের আচারণ, কাজের প্রশংসা ইত্যাদি। তৃপ্তির মাপকাঠতে হেয়ার ড্রেসার বা নাপিতরাই সবাইকে হারিয়ে দিয়েছেন।
পুলিশ খুবই ক্ষমতাধর আমলা। পুলিশের কথামতো কাজ না করলে খুন, ধর্ষণ, কিংবা ড্রাগের মামলায় ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করা যায় না। কলকাতার পুলিশ সেকালে সেখানে ভিন্ন ধরনের এক কল্পিত অপরাধের আশ্রয় গ্রহণ করত: ব্যাটা বড্ড বেড়ে গেছে, সাহেব মারার মামলায় ফাঁসিয়ে দে। সাহেব মানে সাদা চামড়ার সাহেব। সাহেব মারা গুরুতর অপরাধ। সরকারি ডাক্তার হরগোবিন্দ চট্টোপাধ্যায়কে পুরোদস্তুর একজন বাঙালি দারোগা (সাব ইন্সপেক্টর বা এসআই দারোগার নিজের ভাষায় এছাই) সাহেব মারার মামলায় সাক্ষ্য দিতে বললে তিনি চটে গেলেন। মিথ্যে সাক্ষ্য তিনি কেন দেবেন?
দারোগারও একটা যুক্তি থাকতে পারে—ইংরেজ সাহেব মারা যে অপরাধ, এটা তো অস্বীকার করা যায় না। নিজের হাতে আইন নেবে কেন? কিন্তু পুলিশ যাদের ধরেছে, তারাই যে কাজটা করেছে, এটা তো সাক্ষ্যে প্রমাণিত হতে হবে। দারোগা ধরেই নেয় সরকারি চাকরি করবে, বেতন নেবে আর সরকারের পক্ষে দাঁড়াবে না, তা কী করে হয়? হরগোবিন্দ নিজেকে কী মনে করেন? হরগোবিন্দ যে তলে তলে একজন স্বদেশি। এ অনাচার তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। তিনি দারোগাকে রীতিমতো 'গেট-আউট' করে দিলেন।
হরগোবিন্দের মতো মানুষ দারোগাকে অমান্য করেন! একি কলিকাল! দারোগা মিথ্যে মামলা দিয়ে হরগোবিন্দের দুই পুত্রকে জেলে পাঠায়। হরগোবিন্দ তাকে রাষ্ট্রীয় কাজে বাধা দিয়েছেন এবং লাঞ্ছিত করেছেন এই আবেদন আদালতে পেশ করে খানা-তল্লাশির অনুমতি নিয়ে আসেন।
হরগোবিন্দ তার মেয়েদের রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দারোগার নজর থেকে দূরে রাখতে পাহারা দিচ্ছিলেন। তল্লাশির সময় ব্র্যান্ডি ভেবে দারোগা বোতল থেকে তরল ঢেলে পান করেন, সে রাতেই তার অবস্থা মর মর হয়ে যায়। দারোগার স্ত্রী স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে ডাক্তার হরগোবিন্দের শরণাপন্ন হলে তিনি চিকিৎসকের নৈতিক দায়িত্ব পালন করেন। বিশিষ্ট এই দারোগা খানা-তল্লাশির আদেশ পেতে আদালতে যে আর্জি পেশ করেছেন, বানান অক্ষত রেখে তা হুবহু উপস্থাপন করা হলো:
'বিচারপতী
হুজুরের হুকুম মোতাবেক সাহেব মারার মোকর্দ্দমার তদন্ত করিতে করিতে আরও দুই আসামীর নাম প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে অজয়চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও শুসীলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ইহাদের পীতা সরকারী ডাক্তার হরগোবীন্দ চট্টোপাধ্যায় হয়। অজয়চন্দ্র অতী দুর্দ্দান্ত বেক্তী কলিকাতার সুরেন্দ্রবাবুর কলেজে অধ্যায়ন করে প্রকাশ তাহারাই হুকুম সূত্রে অন্যান্য আসামীগণ শাহেবকে মাইরপীট করিয়াছে দুইজনকে ৫৪ ধারা অনুসারে অদ্যই ধৃত করিবার বন্দোবস্ত করিয়াছী।
২। বিসেস তদন্তে আরও জানিয়াছী উক্ত অজয়চন্দ্র কলিকাতা বীভিন স্কোয়ার হাঙ্গামাতে লীপ্ত ছিল সে এখানে আসিয়া একটি লাঠীখেলা সমিতী স্থাপন করিয়াছে তাহাতে স্থানীয় অনেক লোক চাঁদা দেয় ডাক্তারের ছোট পুত্র শুসীলচন্দ্র অল্প বস্ক হইলেও অত্যন্ত দুষ্ট সে এখানে অনেক বালক লইয়া একটি ঢীল ছোঁড়া সমিতী স্থাপন করিয়াছে উদ্দেশ্য সাহেব মেম দেখিলেই ঢীল ছুঁড়িবে।
৩। গোপন অনুসন্ধানে জানিলাম উক্ত ডাক্তারের বাসায় সাহেব মারা রক্তাক্ত লাঠী প্রভিতী লুক্কাইত আছে লাঠীখেলা সমিতির চাঁদার খাতা মেম্বরের তালিকা দৃষ্টে অনেক আসামী আস্কারা হইতে পারে বিধায় প্রার্থনা ফৌঃ কাঃ বিঃ ৯৬ ধারা অনুসারে উক্ত হরগোবীন্দ ডাক্তারের বাটী খানাতল্লাসী করিতে ছার্চ্চ ওয়ারেন্ট দিয়া শুবিচার করিতে আগ্যা হয়।
আগ্যাধীন
শ্রী বদনচন্দ্র ঘোষ
এছাই
(এই আবেদনের সঙ্গে দু'টি পুনশ্চঃ সংযুক্ত আছে)
—দফা প্রকাশ থাকে যে উক্ত হরগোবীন্দ ডাক্তার সদেসীয় বিসেস স্বপক্ষ দেশী চিনী ও করকচ নবন সর্ব্বদা আহার করে স্ত্রির বেনামীতে ভারত কটন মীলে ৫ শত্ত টাকার সেয়ার খরিদ করিয়াছে তাহাতে পুত্রগণ আসামী কদাচ সত্য কথা বলিবে না এ মতে তাহাকে সাক্ষী করিয়া পাটাইতে সাহস করি না।
—দফা আরো প্রকাশ থাকে পরম্পরায় সুনিলাম উক্ত হরগোবীন্দ বলিয়াছে আমি জজ ম্যাজিস্টরকে গ্রাহ্য করি না।'
দারোগা শ্রীবদনচন্দ্র ঘোষের আবেদনের পুরোটাই উদ্ধৃত হলো। ফৌজদারি কার্যবিধি ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের পূর্ণ ক্ষমতা দারোগার রয়েছে, তবে বিধান অনুযায়ী গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি, যার পরিচিতি তখন আসামি, তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করতে হবে। বিজ্ঞ আদালত মামলার মেরিট বুঝে আসামিকে অব্যাহতি দিতে পারেন, জামিন দিতে পারেন, একালে অবশ্য রিমান্ড চালু হয়ে গেছে। রিমান্ডে এনে যা কিছু স্বীকার করিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
মান্ধাতার বাবার আমলের চর্চার নাম আমলাতন্ত্র
মান্ধাতার বাবার আমল বলেও একটা কাল ছিল। সেটি যুবনাশ্বের কাল। যুবনাশ্ব প্রকৃতপক্ষে মান্ধাতার বাবা।
একদা আমলা, অবসরোত্তর এমপি ও মন্ত্রী স্মরণ করিয়ে দিলেন ফেরাউনের আমলেও (কে জানে সেটা যুবনাশ্বের বাবার মানে মান্ধাতার পিতামহের আমল কি না) আমলা ছিলেন। বিলক্ষণ ছিলেন। তারও পিতামহের আমলে গ্রিক ভগবান যেসব দেবদেবী দিয়ে বিশ্ব পরিচালনা করতেন, তারা কি আমলা নন? শয়তানের অভ্যুদয় ঘটার পর স্বর্গরাজ্যে অদৃষ্টপূর্ব যেসব সংকট সৃষ্টি হয় তারই যতটা সম্ভব সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত হন তাদের হাতেই আমলাতন্ত্রের সূচনা। লক্ষণীয় আমলার কাজ সংকটের মূলোৎপাটন নয়, সংকটের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। সংকট যদি না-ই থাকল আমলার আর গুরুত্ব কিসের? ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে দেখেছেন:
চোরেরে ডাকিয়া কানে কহে চৌকিদার
তুই না থাকিলে বন্ধু হইতাম বেকার।
বুদ্ধিজীবীরা কেবল কজন সচিব, প্রতিষ্ঠানপ্রধান বা জেলার প্রধান নির্বাহীকে আমলা হিসেবে চিহ্নিত করতে পছন্দ করেন। প্রকৃতপক্ষে যেকোনো রাষ্ট্রেই, হোক গণতান্ত্রিক কি স্বৈরতান্ত্রিক, হোক লিংকনশাসিত কি হিটলারশাসিত; রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে চোরের বন্ধু চৌকিদার পর্যন্ত সবাই আমলা। চৌকিদার আমলা সোপানের নিম্নতম পা-দানিতে, রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চটিতে। প্রত্যেকেরই যার যার বেকারত্ব ঘুচানো ও চাকরিটা রক্ষা করার জন্য কিছু বন্ধু, কিছু খদ্দের সৃষ্টি করতেই হয়।
ফেরাউনের আমল যদি প্রতীকী অর্থে পুরোনো কোনো আমল না হয়ে ঐতিহাসিক অর্থে হয়ে থাকে, তাহলে কালটাও বিবেচনা করা দরকার। খ্রিষ্টজন্মের ৩১৫০ বছর আগে থেকে শুরু করে খ্রিষ্টজন্মের ৩০ বছর আগপর্যন্ত মোট ৩১২০ বছর মিসর ফেরাউনদের শাসনে ছিল। খ্রিষ্টজন্মের ২৪৩ বছর আগপর্যন্ত নেটিভ অর্থাৎ মিসরীয় ফারাও রাজত্ব করেছেন। খ্র্রিষ্টজন্মের ৩০ বছর আগে থেকে মিসর রোমান সাম্রাজ্যের বর্ধিত অংশে পরিণত হয়। সময়টা বিবেচনা করে গণতন্ত্রের জন্য হা-পিত্যেশ করাটা কি সমীচীন? আমরা যাকে গণতন্ত্র বিবেচনা করে আসছি, তার উদ্ভব ফেরাউনের কাল পেরোনোর পর। ফেরাউনের প্রধান আমলা উজির নামেই অভিহিত হতেন। তিনি যুগপৎ প্রশাসন ও বিচার উভয় বিভাগেরই সর্বোচ্চ নির্বাহী ছিলেন। ফেরাউনকে জিজ্ঞেস না করেই নিজের বিবেচনা শক্তি খাটিয়ে কোনো অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে কার্যকরও করাতে পারতেন। তিনি একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের প্রধান অধ্যক্ষ ছিলেন, রাষ্ট্রীয় সব দলিলের তিনি ছিলেন প্রধান হেফাজতকারী। ব্রিটিশ হোন কি ভারতীয় হোন, কি বাংলাদেশি, কেবিনেট সেক্রেটারিকেই প্রতীকী অর্থে হলেও রাষ্ট্রের এক নম্বর আমলা মনে করা হয়। ফেরাউন আমলের প্রধান আমলার ক্ষমতার কাছে তিনি নস্যি। তারই তত্ত্বাবধানে আপার ও
লোয়ার ইজিপ্টে ৫০টি প্রশাসনিক ইউনিট চালু ছিল। সেখানে ছিল বিকেন্দ্রীকৃত শাসন। সেই ফেরাউন যুগের আমলার ওপর না চটে বরং তাদের দক্ষতা, নিষ্ঠা এবং আনুগত্য (একালে আনুগত্যের নাটকই বেশি মঞ্চায়িত হয়) বিবেচনা করে এটা তো নিঃসন্দেহে বলা যায়, তারা ফেরাউনদের ৩১২০ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখতে অন্যতম সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। আমাদের যেটুকু অভিজ্ঞতা, আমরাও দেখেছি সরকারের ব্যর্থতা এবং এমনকি সরকারের পতনেরও অন্যতম কারিগর এই আমলাশক্তি, সাফল্যেরও।
ডি এল রায় বলেছেন আমলা-স্বভাবের নন্দলালের কথা:
নন্দর ভাই কলেরায় মরে তাহারে দেখিবে কেবা
সকলে বলিল যাও না নন্দ করোনা ভাইয়ের সেবা
নন্দ বলিল, 'ভায়ের জন্য জীবনটা যদি দিই
না হয় দিলাম, কিন্তু অভাগা দেশের হইবে কি?
বাঁচাটা আমার অতি দরকার, ভেবে দেখি চারিদিক'
তখন সকলে বলিল, 'হাঁ হাঁ হাঁ, তা বটে, তা বটে ঠিক।'
নন্দলাল ভাবছেন, ভেবে ভেবে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে একটু সময় তো লাগবেই। নন্দলালীয় যুক্তির কাছে শাস্ত্রীয় যুক্তি এমনিতেই মার খায়। সুতরাং কলেরার মতো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শ পরিত্যাজ্য।
আমার একটি স্মৃতি
১৯৯৮ সালে কক্সবাজার জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করছি। কক্সবাজার এমনিতেই প্রটোকল স্টেশন। স্ত্রী, কন্যা কিংবা নাতনির সমুদ্র দেখার শখ হলে অনেক সময় ব্যস্ত মন্ত্রীদেরও নামমাত্র একটা কাজ দেখিয়ে ট্যুর প্রোগ্রাম বানিয়ে চলে আসতে হয়। কোনো কোনো সময় একাধিক মন্ত্রীরও প্রটোকল করতে হয়। স্টমাক আপসেট অবস্থায় একজন প্রতিমন্ত্রী এলেন। তার প্রটোকল করতে এলেন তারই মন্ত্রণালয়ে পুরো মাত্রার সচিব—একদার সবচেয়ে কুলীন সার্ভিসের সদস্য। জেলা প্রশাসন থেকে শুধু দুই টাকা দামের (তখন এসএমসির স্যালাইনের দাম দুই টাকাই ছিল) কয়েক প্যাকেট স্যালাইনই সরবরাহ করা হয়েছে। গ্লাসে তা গুলিয়ে দীর্ঘদেহী প্রতিমন্ত্রীর পেছন পেছন স্যালাইন নিয়ে সচিব হেঁটেছেন এবং বলেছেন, স্যার, আরেক ঢোক খেয়ে নেন, পেটটা ঠিক হয়ে যাবে।
আমলার জন্য সচিবই সর্বোচ্চ পদ (এ আমলে অবশ্য সিনিয়র সচিবও আছে), সেই সচিবই যখন স্যালাইন নিয়ে পেছন পেছন হাঁটেন, বেশ লাগে। এই না হলে ব্যুরোক্র্যাট!
- পাদটীকা: একজন ব্রিটিশ ভারতীয় সিভিল সার্ভেন্ট সিএইচ সিসন কবিতাও লিখতেন। নিজের জন্য তার রচিত এপিটাফ:
HERE LIES A CIVIL SERVANT
HE WAS CIVIL
TO EVERYONE
SERVANT TO THE DEVIL
ফেরাউনি আমলার আনুগত্য নিয়ে কখনো প্রশ্ন ওঠেনি। একালের আমলার? উপরের এফিটাফ আমলে নিলে শয়তানেরই কি অনুগত!