ইউরো ২০২০ স্পন্সরে চীনা প্রযুক্তি ব্র্যান্ডগুলোর আধিপত্যের কারণ কী?
গেল সপ্তাহে ইউরো ২০২০ এর ইংল্যান্ড বনাম জার্মানির ম্যাচে সকলেরই নজর ছিল বলের দিকে এবং এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি কি লক্ষ্য করেছেন যে, যতবার আপনি ডিজিটাল বিলবোর্ডের স্পন্সর ব্র্যান্ডের দিকে তাকাচ্ছেন, ততবারই সেখানে একটা চীনা সুপার-ব্র্যান্ডের স্পন্সর লোগো ভেসে উঠছে?
২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত গত টুর্নামেন্টের সময় সেখানে শুধু একটিই চীনা স্পন্সর ছিল, তা হলো- টিভি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান 'হাইসেন্স'।
কিন্তু এবার হাইসেন্স এর সাথে বিলবোর্ডে যুক্ত হয়েছে টিকটক, ভিভো এবং আলিপের নাম।
আপনি নিশ্চয়ই এও লক্ষ্য করেছেন যে সেখানে কোনো মার্কিন ব্র্যান্ড এর নাম নেই। নেই গুগল, আমাজন বা অ্যাপলও এবং অফিসিয়াল পার্টনার এর তালিকায়ও তারা নেই।
টুর্নামেন্টের আয়োজক উয়েফা বিবিসিকে জানিয়েছে, চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যৌথভাবে কাজ করার পেছনে তাদের বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য ছিলনা। তারা আরও বলে, 'আমরা বিশ্বব্যাপী দর্শকদের সাথে যুক্ত হতে চাই এবং আমাদের বাণিজ্যিক প্রোগ্রামে যেসব ব্র্যান্ড যুক্ত হয়, তারাও এটাই চায়।'
টিকটক দাবি করে আসছে যে, তাদের বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম তাদের চীনা অংশ থেকে আলাদা রাখা হয়েছে। তারা এও জানিয়েছে যে, উয়েফার সাথে তাদের অংশীদারত্ব শুধু এই টুর্নামেন্টের পেছনে এবং তারা এর জন্য নিজেদের প্ল্যাটফর্মে উদ্দীপ্ত করা, হ্যাশট্যাগ চ্যালেঞ্জ, টিকটক লাইভের মত প্রচারণামূলক কার্যক্রম জোরেশোরেই চালিয়েছে।
টুর্নামেন্ট উপলক্ষে উয়েফা তাদের অফিসিয়াল টুর্নামেন্ট একাউন্ট পর্যন্ত চালু করেছে; যেখানে ৪২ লাখ অনুসারী রয়েছে।
আলিপে একটি চীনা পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম। তারা 'অ্যান্টচেইন' নামক একটি সহায়ক ব্লকচেইন ফার্ম চালু করেছে এবং দুটি প্রতিষ্ঠানই টেক জায়ান্ট 'অ্যান্ট গ্রুপ' এর অংশ।
ব্লকচেইন হলো এমন একটি ডিজিটাল খতিয়ান যা বহু মানুষের ব্যক্তিগত কম্পিউটারে সংরক্ষিত থাকে। এর ফলে ওই কম্পিউটার থেকে কেউ সহজে তথ্য পরিবর্তন বা জাল করতে পারেনা। ভার্চুয়াল মুদ্রা বিনিময়ে এটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হলেও, এটি অন্যান্য তথ্যও নিরাপদ রাখতে পারে।
তবে এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, আপনি চীনা আইডি ছাড়া কোনো দেশেই আলিপে ব্যবহার করতে পারবেন না। গত মাসে অ্যান্টচেইন উয়েফার সাথে পাঁচ বছর মেয়াদী স্পন্সরশীপ চুক্তি করেছে। অন্যদিকে উয়েফার সাথে আগে থেকেই আলিপে এর ৮ বছর মেয়াদি চুক্তি তো আছেই।
এই মুহূর্তে সবগুলো খেলায় টপ স্কোরার এর জন্য আলিপে একটি ট্রফি দিয়ে যাচ্ছে। এর সবগুলো স্কোরের হিসাবই অ্যান্টচেইনে রেকর্ড করা থাকবে।
উয়েফার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা থেকে জানা যায়, ট্রফিতে থাকা একটি হ্যাশট্যাগ প্রতীকের মাধ্যমে বুঝানো হচ্ছে যে, ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে অ্যান্টচেইন টপ স্কোরারের সকল অর্জনের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
প্রচারণার ফলে উপকার হয় ঠিকই, কিন্তু খুব বেশি নয়। তাহলে এসব চীনা ব্র্যান্ডের মধ্যে কী আছে?
বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পোর্টস পলিসি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ক অধ্যপক শুশু চেন জানালেন, ২০১৬ সালের টুর্নামেন্টে স্পন্সর হওয়ার পর হাইসেন্স এর বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল।
তবে যাইহোক, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যে ফুটবলের একজন দারুণ ভক্ত; সেটিও হয়তোবা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। দেশের টেক জায়ান্টদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব জোরদার করার সাথে সাথে এটাকে একটা কৌশলী পিআর পদক্ষেপ বলেও বিবেচনা করা যায়, যার মাধ্যমে ফুটবলের প্রতি চীনাদের সমর্থন প্রমাণের সুযোগ পাওয়া যাবে।
অমিডা নামক ফার্মের সিনিয়র অ্যাডভার্টাইজিং অ্যানালিস্ট ম্যাট বেইলি স্বীকার করলেন যে, দেশীয় বাজারে তারা 'চাপ অনুভব' করছেন। তিনি বলেন, 'চীনা কোম্পানিগুলোর জন্য ইউরোপ ক্রমশ গুরুত্বপূরণ বাজার হয়ে উঠছে।' ২০২০ সালে টিকটক উন্মাদনার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
২০১৪ সালে জিনপিং জাতীয় স্কুল শিক্ষা কার্যক্রমে খেলাধুলাকে অন্তর্ভুক্ত করেন। ২০১৬ সালেই চীনা সুপার লীগের (সিএসএল) আবির্ভাব ঘটে এবং তা ব্যাপক সাড়া পায়। খুব শিগগিরই তারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়ের সাথে চুক্তি করে ফেলে।
এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সাইনিং ছিল চেলসির ব্রাজিলীয় ফুটবল তারকা অস্কারকে সাংহাই এসআইপিজি তে নিয়ে আসা। ৬০ মিলিয়ন পাউন্ডে তাকে নিয়ে আসে সাংহাই এবং প্রাথমিকভাবে অস্কারের সাপ্তাহিক বেতন ধরা হয়েছিল ৪০০,০০০ পাউন্ড।
তবে এত এত টাকার ঝলকানি সত্ত্বেও, সম্প্রতি চীনাদের পকেটের অবস্থা অতটা রমরমা নয় বলেই জানা গেছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সিএসএল ঘোষণা দেয় যে তারা একটা নতুন বেতন কাঠামো চালু করবে 'ফুটবল খাতে ব্যয় বাঁচাতে'।
তবে চীনা ফুটবল ভক্তদের পশ্চিমা প্রীতির কথা নতুন নয়। ইংল্যান্ডের ক্লাব আর্সেনাল এফসি রিপোর্ট করে, চীনে তাদের ২০০ মিলিয়ন ভক্ত রয়েছে যা যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যার তিন গুণ।
আর এবারও যে চীনারা টুর্নামেন্টগুলো দেখছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিবিসির গণমাধ্যম বিশ্লেষক কেরি অ্যালেন জানিয়েছেন, চীনের মাইক্রোব্লগিং সাইট ওয়েইবো তে ইউরো হ্যাশট্যাগে ৫ মিলিয়নেরও বেশি পোস্ট হয়েছে।
ইউরোর তিন ভাগ স্পনসরের এক ভাগই চীনা কোম্পানি হওয়া নিয়ে চীনা অর্থনৈতিক আউটলেটগুলো বেশ ইতিবাচক রিপোর্ট করেছে বলেও জানান অ্যালেন।
তবে ফুটবল নিয়ে এত আগ্রহ তাহকা সত্ত্বেও চীনের নিজেদের জাতীয় ফুটবল দলের র্যাংকিং বিশ্বে ৭৫ তম এবং শেষবার তারা ফিফা বিশ্বকাপ খেলেছে আরও ২০ বছর আগে, ২০০২ সালে।
তবে কি বিজ্ঞাপন দেওয়াই ফুটবলের খ্যাতি থেকে তাদের একমাত্র পাওয়া?
যুক্তরাজ্যের মার্কেটিং ফার্ম অরেঞ্জ মিডিয়া'র এমডি জো ডি কান্ট স্টোনার জানালেন, 'এটা হওয়া সম্ভব। তবে এটাই একমাত্র লক্ষ্য নয় তাদের। ব্র্যান্ডের পরিচিতি পাওয়াই এখানে সবচেয়ে বড়।'
'এমন কোনো প্রচারণা এখানে চালানো হচ্ছে না যা দিয়ে পণ্যের ব্যাপারে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে। আসলে ব্র্যান্ডের নামটাই মানুষ বারবার দেখছে। এমনকি আমার আট বছর বয়সী ছেলেও এখন ট্রেইলার দেখে দেখে তাদের নাম জানে', বললেন তিনি।
জো আরও জানালেন যে টিভি বিজ্ঞাপনের ক্ষমতা কতটা শক্তিশালী, এটা তারও প্রমাণ। ইউরো সত্যিকারের গণ-বাজার পাওয়ার একটা সুযোগ করে দেয়। ফলে মানুষ তার ব্র্যান্ডের নাম জানে।
অ্যাডভারটাইজিং ভেটেরান সিন্ডি গ্যালোপ এর মতে, এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা লুকিয়ে আছে। তা হলো, সকল দেশে এশীয়দের প্রতি ঘৃণা বন্ধ করতে হবে। 'আমি মনে করি, ফুটবলের ভাষাকে আন্তর্জাতিকীকরণে চীনা ব্র্যান্ডগুলোর অংশ নেয়ার মাধ্যমে আমরা একটা পরিচিত পরিবেশ পাবো।'
- সূত্র: বিবিসি