ইতিহাস বদলে দেওয়া এক রান যেভাবে মনে রেখেছেন মাশরাফি-আফতাবরা
কেনিয়ার পেসার মার্টিন সুজির করা ডেলিভারিটি প্যাড ছুঁতেই হাসিবুল হোসেন শান্ত ও খালেদ মাসুদ পাইলটের ভোঁ দৌড়। এক রান পূর্ণ হতেই মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বিজয়ের গন্ধ। কুয়ালালামপুরের মাঠটি তখন উৎসবের নগরী। খুশিতে জ্ঞান হারিয়েও কেউ কেউ গ্যালারিতে লুটিয়ে পড়েন।
পুরো বাংলাদেশ তখন উৎসবে মাতোয়ারা। শহর কিংবা গ্রাম; সবখানে বিজয় উল্লাস আর রঙের মিছিল। সেই মিছিলে ছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা, আফতাব আহমেদ, মোহাম্মদ আশরাফুল, আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দ রাসেল, শাহরিয়ার নাফিসরাও।
সবে ক্রিকেট শুরু করা আফতাব-আশরাফুলরা প্লেট আর চামচ নিয়ে নেমে পড়েছিলেন রাস্তায়। মাশরাফি যোগ দেন মিছিলে। ক্লাস সেভেনে পড়া শাহরিয়ার নাফিস স্কুলেই উদযাপন সেরেছিলেন। ২৩ বছর পর ঘুরে এসেছে সেই দিনটি। অবিস্মরণীয় সেই ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশের আইসিসি ট্রফি জয়ের ২৩ বছর পূর্ণ হয়েছে গত ১৩ এপ্রিল।
ঐতিহাসিক সেই এক রানের মুহূর্ত কীভাবে মনে রেখেছেন মাশরাফি, আশরাফুল, রাজ্জাকরা? সেটা নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের সিনিয়র ছয় ক্রিকেটার।
মাশরাফি বিন মুর্তজা
ঐতিহাসিক সেই ম্যাচ, ঐতিহাসিক এক মুহূর্ত। এক বলে এক রান লাগবে, উত্তেজনার শেষ ছিল না। মনে আছে ভালো করেই। তখন রেডিওতে শুনেছি, টিভিতে দেখিনি। শান্ত ভাই এক বলে এক রান নেন, মিছিল হলো, এসব মনে আছে। অনেক আগের কথা হলেও ক্রিকেটের এমন একটি ম্যাচের কথা মনে থাকাটাই স্বাভাবিক।
ম্যাচটা শেষ হওয়ার পর আমাদের বয়সী কেউ-ই হয়তো বাসায় ছিল না। সবাই বাইরে চলে আসে। হই-হুল্লোর চলতে থাকে। আমরা বন্ধু-বান্ধবরা সবাই মিলে মিছিল করেছিলাম। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা থাকার কারণে অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করছিল। আগের ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয়, পরের ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন; উৎসব মুখর একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।
ওই টুর্নামেন্টটাই বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটা জোয়াড় এনেছিল। যে কারণে পুরো দেশে ক্রিকেট ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি। তখন আমি ক্রিকেট খেলি, তবে সেটা একেবারেই নিজের মতো করে। তখন টেনিস বা টেপ টেনিসে খেলতাম। আমি তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। তখনও আমার ক্রিকেট বলে খেলা হয়নি।
আফতাব আহমেদ
যদিও অনেক আগের কথা, তবে মনে আছে ঐতিহাসিক সেই এক রান ও ম্যাচটার কথা। আমাদের এখানে একটা প্রোগ্রাম হচ্ছিল। আমার মনে আছে আমি এবং অন্যান্য বাচ্চারা যারা ছিল, আমরা সবাই প্লেট আর চামচ নিয়ে আকরাম ভাই আর নান্নু ভাইয়ের বাসার দিকে দৌড়ে দৌড়ে গেছি। ঢোল তো আর সবার বাসায় ছিল না, যে কারণে তখন এটা নিয়ে সবাই বাজাতো।
শুধু আমরাই নই, হাজার হাজার মানুষ এসেছিল আকরাম-নান্নু ভাইদের বাসার সামনে। যে যা পেরেছে, সেসব নিয়ে ওখানে এসে আওয়াজ করে বাজাচ্ছিল। আমি আগে থেকেই রাস্তায় ছিলাম, দেখছিলাম খেলাটা কী হয়। খেলাটা রাস্তায় দেখি, জেতার সাথে সাথে ওনাদের বাসার ওখানে গিয়ে অনেক মজা করেছিলাম। অকল্পনীয় একটা দিন ছিল, সত্যি বলতে বোঝানো কঠিন।
ওই সময় আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। তখন আমি স্কুল ক্রিকেট খেলতাম। ৯৬ থেকে আমি স্কুল ক্রিকেট খেলি। তখন ক্রিকেট খেলাটা মোটামুটি শুরু করছিলাম আর কি। এরপর আস্তে আস্তে ক্রিকেটে ভালোভাবে জড়িয়ে পড়ি। তারপর তো ক্রিকেট ছাড়া তেমন কিছুই করা হয়নি। শুধু ক্রিকেটই খেলেছি।
মোহাম্মদ আশরাফুল
আইসিসি ট্রফির ফাইনাল খুব ভালোভাবেই মনে আছে। সেই এক রানের কথাও খুব ভালো করে মনে পড়ে। এমন একটি রানের কথা আসলে কোনো দিনই ভোলা সম্ভব নয়। শান্ত ভাইয়ের প্যাডে লাগলো, প্যাডে লেগে বল শর্ট ফাইন লেগে গেল, সেখান থেকে এক রান নিল। বাংলাদেশ জিতেছে বলতে বলতে আমি প্লেট আর চামচ নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে যাই।
প্লেট আর চামচ দিয়ে ঢোল বানিয়েছিলাম আর বলছিলাম বাংলাদেশ জিতে গেছে, বাংলাদেশ জিতে গেছে। ঢোল তো ছিল না সে সময়। প্লেট আর চামচ দিয়ে তাই ঢোল বানিয়েছিলাম। শুধু আমি নই, সে সময় সবাই এভাবে ঢোল বানাতো। মনে আছে চারদিকে রং ছেটানো হচ্ছিল। রেডিওতে শুনেছিলাম খেলাটা। তখন টিভিতে খেলা দেখার তেমন সুযোগ ছিল না।
আমি তখন ক্রিকেট খেলি, কেবল খেলা শুরিু করেছি। ১৯৯৬ সালে আমি খেলাধুলা শুরু করি। ক্রিকেট খেলা শেখার জন্য আমি ওই বছর ওয়াহিদ স্যারের (ওয়াহিদুল গণি) কাছে ভর্তি হই। তখন আমার বয়স ১২ বছর। বয়স কম হলেও ওই ম্যাচটার কথা ভালোভাবেই মনে আছে।
আবদুর রাজ্জাক
ম্যাচটা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয়। হয়তো সবচেয়ে স্মরণীয় ম্যাচই। এমন একটা ম্যাচ আসলে এমনিতেই মনে থেকে যায়। ম্যাচটা আমরা দেখিনি, রেডিওতে শুনেছিলাম। আসলে প্রচন্ড রকমের উত্তেজনা কাজ করছিল। কেমন সেই অনুভূতি, সেটা বলে বোঝানো কঠিন। স্মরণীয় সেই এক রান, যা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বদলে দিয়েছিল।
সেদিনের মতো করেই এখনও সেই এক রানের কথা মনে পড়ে। আমার মনে হচ্ছিল আমি নিজেই খেলাটা খেলছি। আমার মনে হয় ওই সময় যারা ক্রিকেট ফলো করতো, সবার কাছেই মনে হয়েছে যে, সে খেলাটা নিজেই খেলছে। দারুণ এক উন্মাদনা ছিল। পুরো ম্যাচটাই তো দারুণ রোমাঞ্চের ছিল।
খেলা শেষ বল পর্যন্ত গেছে ঠিক আছে, কিন্তু দেখুন বৃষ্টি হলো, নিজেদেরই পানি শুকাতে হলো। অন্য রকমের এক রোমাঞ্চ সব সময়ই ছিল। সব কিছু মিলিয়ে রোমাঞ্চের আসলে শেষ ছিল না। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছিল যে বাংলাদেশ জিতে গেছে। তখন আমি ক্রিকেট খেলি, খুব ভালোভাবেই খেলি। আমি তখন বিকেএসপিতে পড়ি। সম্ভবত অষ্টম বা নবম শ্রেণিতে পড়ি তখন।
সৈয়দ রাসেল
তখন তো ছোট ছিলাম। তবে স্পষ্ট মনে আছে খেলাটার কথা। আমরা জাগরণী সংসদে বসে খেলাটা দেখছিলাম। বোলিং করছিল মার্টিন সুজি, ওর গায়ে একদম কাদা লেগে ছিল। ফাইন লেগের দিকে ঠেলে এক রান নিয়ে নিলেন শান্ত ভাই আর পাইলট ভাই। পাইলট ভাই তো আগেই দৌড় দেন। অমন একটা ম্যাচ দেখা সত্যিই অন্যরকম এক অনুভূতির ছিল।
আইসিসি ট্রফি জয়ের ২৩ বছর হয়ে গেলেও মনে হয় খুব বেশিদিন আগের নয়। মনে হয় চোখের সামনে এখনও দেখতে পাই, মনে হয় যে কালই ম্যাচটা দেখেছি। ওই রকম একটা উত্তজনাপূর্ণ ম্যাচ হয়েছে বলেই হয়তো খুব ভালো করে এখনও মনে আছে।
আমি তখন ক্রিকেট খেলি। তবে সেটা টেনিস বলে। ক্রিকেট বলে তখন ওইভাবে খেলা হয়নি। নিউ টেনে উঠে আমি নির্মাণ ক্রিকেট খেলি স্কুলের হয়ে। সেটা ছিল ক্রিকেট বলে, ওটাই ছিল ক্রিকেট বলে আমার প্রথম খেলা। এরআগে আমি কখনও ক্রিকেট বলে খেলিনি। এটা ছিল ৯৭ এর পরে। এরআগে টেনিস খেলতাম, প্রচুর খেলতাম। এর জন্য অনেক মারধরও সহ্য করতে হয়েছে।
শাহরিয়ার নাফিস
আমরা ওইদিন স্কুলে ছিলাম। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমরা তো ফাইনালের আগেই বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করে ফেলেছিলাম। এটা নিয়ে আগে থেকেই একটা ভালো লাগা ছিল। দুপুরে খেলা শুরু হয়। আমাদের স্কুল সেন্ট জোসেফ হাই স্কুল খুব কড়াকড়ি ছিল। কিন্তু ওই দিন ক্লাসে স্যাররা রেডিও রাখার অনুমতি দেন। সবাই আমরা রেডিওতে খেলা শুনছিলাম।
শুনছিলাম এক বলে এক রান। এটা পরেও অনেকদিন তাজা ছিল যে এক বল, এক রান। আমরা তো খেলাটা দেখিনি, কিন্তু এক রান হওয়ার পরই পুরো স্কুল উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। স্কুলের খেলার মাঠে মিছিলও করেছিলাম আমরা। এটা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম বড় মাইলফলক। অসাধারণ ছিল সেই দিনটা।
পেশাদার হিসেবে ক্রিকেট খেলব, ওই ম্যাচটার কারণে আমি ব্যক্তিগতভাবে এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম। ওটার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে যায়, আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়। তখনই চিন্তা করেছিলাম খেলতে পারি। বাসা থেকে ক্যাডেট কলেজ এবং পরে আর্মিতে যাওয়ার চাপ ছিল। ওই ম্যাচটার কারণে ক্যাডেট কলেজের সিদ্ধান্ত বাদ দিয়ে খেলায় মনোনিবেশ করতে পেরেছিলাম। তখন আমি খেলা শুরু করেছি। আমি তখন ওয়াহিদ স্যারের (ওয়াহিদুল গণি) কাছে অনুশীলন করি।