তিন বলে তিন: হ্যাটট্রিক করতে দেখলে মনে হতো কত বড় মাপের বোলার
দুই বলে দুই উইকেট, আব্দুর রাজ্জাকের মনে হয় হ্যাটট্রিকটা এবার হয়েই যাবে। তিন বলে তিন উইকেট নেওয়ার এলিট ক্লাবে নাম উঠবে তারও। দুই-একবার নয়, বেশ কয়েকবার এমন মনে হয়েছে অভিজ্ঞ বাঁহাতি এই স্পিনারের। কিন্তু তৃতীয় বলে মেলে না উইকেটের দেখা, বাতাসে মিলিয়ে যায় হ্যাটট্রিক-স্বপ্ন।
শুধু সম্ভাবনাই তৈরি হয়, হ্যাটট্রিকের স্বাদ আর নেওয়া হয় না রাজ্জাকের। হতে হতে হয় না। তাই একটা সময়ে এসে 'এবার হয়েই যাবে', এই ভাবনাটা মাথা থেকে ঝেরে ফেলেন বাংলাদেশের হয়ে ১৩ টেস্ট, ১৫৩ ওয়ানডে ও ৩৪টি টি-টোয়েন্টি খেলা রাজ্জাক।
২০১০ সালে মিরপুরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই ম্যাচেও রাজ্জাকের মনে হয়নি, 'এবার হয়েই যাবে।' দুই উইকেটে বারবার আটকে যাওয়ায় তৃতীয় বলটি করার আগে রাজ্জাক ভাবলেন, 'হলে হবে, না হলে নাই।'
এবার আর দুইয়ে আটকায়নি। ৪৫তম ওভারের শেষ বলে প্রসপার উতসেয়াকে ফেরান রাজ্জাক। আর ৪৭তম ওভারের প্রথম দুই বলে রে প্রাইস ও ক্রিস এমপফুর উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বোলার হিসেবে ওয়ানডেতে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন বাঁহাতি এই স্পিনার।
টেস্ট এবং ওয়ানডে মিলিয়ে বাংলাদেশের সাতজন বোলার হ্যাটট্রিক করেছেন। হ্যাটট্রিকের নায়কদের নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নিয়মিত আয়োজনের চতুর্থ পর্বে আজ থাকছেন আব্দুর রাজ্জাক।
হ্যাটট্রিকে একজন বোলারের কতটা আনন্দ হয়, তৃতীয় ডেলিভারির আগে আম্পায়ার এনামুল হক মনিকে মাশরাফি বিন মুর্তজা কী বলছিলেন, এখনও কীভাবে মনে পড়ে সেই সুখস্মৃতি; এসব নিয়ে কথা বলেছেন রাজ্জাক। তার মুখেই শোনা যাক সে গল্প।
আব্দুর রাজ্জাক: খুবই স্বাভাবিকভাবে হ্যাটট্রিকে অসাধারণ একটা অনুভূতি কাজ করে। ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক বিশেষ একটা অর্জন। সব সময় যে সবার হবে বা হয়ে যায়, এমন না কিন্তু। সৌভাগ্যক্রমে হয়ে যায়। অবশ্যই ব্যাপারটা ভালো লাগার মতো। পাশাপাশি আবার দলও জিতেছিল, সব মিলিয়ে দারুণ একটা অভিজ্ঞতা।
সাধারণত কোনো বোলার হ্যাটট্রিক করলে দল জেতার কাছাকাছি চলে যায়। কারণ পরপর তিন বলে তিনটা উইকেট পড়লে খুব বেশি বাকি থাকে না। আমার হ্যাটট্রিকের পর দল জিতেছিল, এটা সবচেয়ে বড় তৃপ্তি। দলের জয়ে আমার পারফরম্যান্স কিছুটা সাহায্য করেছে, এটা বড় ব্যাপার।
কারণ হেরে গেলে কী করলাম, সেটা শুধু আমার হলো। যখন দল জিতবে, তখন আপনি অবদান রাখছেন, বা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা রাখছেন। সব মিলিয়ে এটা খুবই ভালো লাগার একটা বিষয়। আমার বেলাতেও ব্যতিক্রম কিছু নয়, খুবই ভালো লেগেছে।
হ্যাটট্রিকের কথা মনে পড়লে একটা ঘটনা মনে পড়ে। মাশরাফি মিড অনে ফিল্ডিং করছিল। ও আমাকে অনুপ্রাণিত করছিল। বলছিল হয়ে যাবে। ও মনি ভাইয়ের (আম্পায়ার ছিলেন এনামুল হক মনি) কাছে জিজ্ঞাস করছিল, "ভাই কী হলে বা কী রকম হলে আউট দিতে পারেন।" মনি ভাই বলছিলেন, "হলে পেয়ে যাবে। কোনো সমস্যা নেই। হলে দিবো না কেন।"
দিনটা আমার ছিল, এটা বলাই যায়। কারণ দল ম্যাচ জিতেছে, আমি হ্যাটট্রিকসহ ৫ উইকেট পেয়েছি, ম্যাচসেরা হয়েছি। তো এর বাইরে তেমন কিছু আর নেই কিন্তু। একজন বোলারের জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু পাওয়ার থাকে না একটা ম্যাচ থেকে। আর ভালোর তে শেষ সেই। ৭-৮ উইকেট পাওয়ার মতো কিছু থাকে। তবে ওই ম্যাচে যা হয়েছিল, সেটা আমার খুশি হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।
হ্যাটট্রিকের কথা মনে পড়লে ভালো লাগে। প্রতিটা সুখস্মৃতি ভালো লাগার মতো। ভালো তো লাগেই। তবে আমার সব অবস্থাই মনে হয়। কখনও কখনও খারাপ অবস্থাও গিয়েছে। সেগুলোও আমার মাথায় আসে। তাতে যে খুব খারাপ লাগে, তেমন নয়। মনে হয় যে ওই সময়টায় আমি খুব কঠিন সময় পার করেছি। আবার ভালো ব্যাপারগুলোও মনে পড়ে। এসব মনে পড়লে ভালো লাগে।
আমি আগেও হ্যাটট্রিকের মুখোমুখি হয়েছি। মানে হ্যাটট্রিক করার সুযোগ তৈরি হয়েছে, কিন্তু হয়নি। তো আমি তখন নিউট্রাল ছিলাম। যতবারই সুযোগ তৈরি হয়েছে হ্যাটট্রিকের, দুই উইকেট নিয়েছি পরপর, মনে হয়েছে হয়ে যাবে, কিন্তু হয়নি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও আমি পরপর দুই উইকেট নিয়েছিলাম, কিন্তু হয়নি।
তো ওটাও আমার মনে হয়েছিল হয়ে যাবে। অনেক দলের বিপক্ষেই আমার এমন হয়েছে। আমি পরপর দুই উইকেট অনেকবার নিয়েছি, কিন্তু দেখা গেছে হ্যাটট্রিক হয়নি।
হ্যাটট্রিক একজন বোলারের জন্য বেশ বড় ব্যাপার। তবে সবচেয়ে বড় তৃপ্তির হয়তো বলা যাবে না। মানুষ হয়তো দেখে বলবে তার হ্যাটট্রিক আছে, এ জন্য বড় ব্যাপার। কিন্তু একজন বোলারকে যদি জিজ্ঞাস করা হয়, তাহলে আমি বলব ধারাবাহিকতা ধরে রেখে বোলিং করাটা সবচেয়ে বড় ব্যাপার।
এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। অনেকের কাছে হ্যাটট্রিকই সব। তবে আমার কাছে মনে হয় হ্যাটট্রিক একটা ভালো পারফরম্যান্স। তবে মূল ব্যাপারের কথা বলা হলে আমি বলব ধারাবাহিকতার কথা।
এই হ্যাটট্রিকটা আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা। এ ছাড়া ৫ উইকেটও কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। সেটা আপনি যখনই পান, যার বিরুদ্ধেই পান না কেন। তো এটা আমার কারিয়ারের অন্যতম। তবে নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে এটা আমার জন্য কঠিন হবে।
হয়তো অনেকের জন্য বলাটা সহজ। হয়তো বলবে এটা আমার সেরা পারফরম্যান্স বা এটা দ্বিতীয় সেরা। কিন্তু আমার জন্য এটা করা খুবই কঠিন। অনেক সময় যদি বলি এই দিনের বোলিং আমার কাছে সেরা, আপনারা বলবেন কী বলে। কিন্তু আমার কাছে সেটা ভালো লেগেছে। দেখা গেছে আমি এক উইকেট পেয়েছি।
আবার হতে পারে একদিন আমি উইকেট পাইনি, কিন্তু বোলিংটা খুব ভালো লেগেছে। ভারতের বিপক্ষে এশিয়া কাপে ছিল। আমি উদ্বোধনীতে বোলিং করেছি, আমি ১০ ওভারে ৪১ রান দিয়েছিলাম। কোনো উইকেট পাইনি, কিন্তু ওই বোলিংটা আমার এখনও মনে পড়ে।
এশিয়ার উইকেটে ভারতের মতো দলের বিপক্ষে ৪১ রান দেওয়া খারাপ নয়। তখন শেবাগ, শচিন, গাঙ্গুলি সবাই ছিলেন। তো এমন হয় যে উইকেট না পাওয়া কোনো বোলিংও মনে ধরে। আবার যদি বলি এটা ভালো, পরে মনে তে পারে এটা নয়, ওটা মনে হয় ভালো। এটা আমার বেলায় একটু অন্যরকম মনে হয়। দেখতে অন্যরকম মনে হলেও হতে পারে। কিন্তু আমার হিসাবটা তো আমার কাছে।
হ্যাটট্রিক নিয়ে যখন ভাবনা আসতো, তখন আমার মনে হতো এমন হলে আমি খুব খুশি হবো। আমি যখন কাউকে হ্যাটট্রিক করতে দেখতাম, তখন তাদেরকে আমি খুবই বড় মাপের বোলার মনে করতাম। তাদের তুলনায় নিজেকে অনেক ছোট মনে করতাম। যখন করে ফেললাম তখন মনে হলো আমিও ওদের কাছাকাছি চলে গেছি। অল্প কথায় এটাই সত্যি কথা।
এটা কখনও বলা হয়নি। তবে মনে হতো হ্যাটট্রিক করেছি, এটা অনেক বড় ব্যাপার। তো যখন আমি করে ফেললাম তখন অত বড় মনে হয়নি। মনে হয়েছে আমিও ওদের কাছাকাছি চলে গেছি।