ফিরে দেখা: বিশ্বজয়ের বছরে করোনার দাপট
ক্রিকেটে ২০২০ সালটি হতে পারতো বাংলাদেশের জন্য দারুণ একটি বছর। বছরের শুরুতেই যুবাদের হাত ধরে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট জেতে বাংলাদেশ। পাকিস্তানে গিয়ে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি হারলেও ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দাপুটে সব জয় তুলে নেয় মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুমিনুল হক, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ দল।
বছরজুড়ে সিরিজ, টুর্নামেন্টসহ আরও অনেক ইভেন্ট ছিল। যে কোনোবারের চেয়ে বেশি টেস্ট (১০টি ম্যাচ) খেলার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রকোপে স্থবিরতা নেমে আসে ক্রিকেটাঙ্গনে। একের পর এক টুর্নামেন্ট, সিরিজ স্থগিত হয়ে যায়। ব্যস্ত সূচির বছরেই দীর্ঘ সময় ঘরে শুয়ে-বসে সময় কাটাতে হয় ক্রিকেটারদের। করোনার দাপটের বছরে কেমন ছিল বাংলাদেশের পথচলা, এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।
যুবাদের বিশ্বজয়: এমন বছর বা এতো বড় সাফল্য আগে কখনও আসেনি বাংলাদেশের ক্রিকেটে। বছরের শুরু দিকে পতপত করে উড়তে শুরু করে বাংলাদেশের বিজয় কেতন। একটি করে ম্যাচ গেছে আর শিরোপার পথে এগিয়েছে বাংলাদেশ যুবারা। লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ফাইনাল, এরপর ভারতকে হারিয়ে শিরোপাজয়।
অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হাত ধরে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ নিয়েছে বাংলাদেশ। গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত যুব বিশ্বকাপে আকবর আলী, মাহমুদুল হাসান জয়, শরিফুল ইসলাম, তৌহিদ হৃদয়দের বুক চেতানো লড়াইয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ইতিহাসের অমোচনীয় অধ্যায়ে নাম খোদাই করে নেয় বাংলাদেশ।
লিটনের রেকর্ড ১৭৬: ২০০৯ সালে বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করা তামিম ইকবালের ১৫৪ রানের ইনিংসটি দীর্ঘদিন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ছিল। চলতি বছরের মার্চে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই ১৫৮ রান করে নিজের রেকর্ড ভাঙেন বাংলাদেশের অভিজ্ঞ এই ওপেনার। কিন্তু তার রেকর্ডটি তিনদিনও টেকেনি।
৬ মার্চ সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে অনিন্দ সুন্দর ব্যাটিং করা লিটন কুমার দাস রেকর্ডটি নিজের করে নেন। ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান ১৪৩ বলে ১৬টি চার ও ৮টি ছক্কায় ১৭৬ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলেন। যা বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। ওই ম্যাচেও সেঞ্চুরি করেন তামিম, খেলেন ১২৮ রানের ইনিংস। এই ইনিংস খেলার সময়ই উইকেটে থেকে নিজের রেকর্ড ভাঙর দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখতে হয় তাকে।
অধিনায়ক মাশরাফি অধ্যায়ের ইতি: মাশরাফি বিন মুর্তজার ওয়ানডের অধিনায়কত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল ততোদিনে। ৫০ ওভারের ফরম্যাটের সফলতম অধিনায়ক কিছু না বললেও বোর্ডের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, জিম্বাবুয়ে সিরিজই অধিনায়ক মাশরাফির শেষ সিরিজ। ঘোষণাটা দিয়েছিলেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। যদিও তিনি পরে তার কথার মোড় ঘোরাতে চেয়েছেন, কিন্তু মাশরাফি সে পথে হাঁটেননি।
গত মার্চে সিলেটে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে সিরিজে অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দেন তিনি। তিন ম্যাচ সিরিজের শেষ ওয়ানডের আগে সংবাদ সম্মেলনে এসে মাশরাফি জানিয়ে দেন, ৬ মার্চের পর আর ওয়ানডের অধিনায়কত্ব করবেন না তিনি। সফলতম অধিনায়কের এমন ঘোষণায় মনে কেঁদেছে সতীর্থদের, ম্যাচের পর প্রিয় অধিনায়ককে কাঁধে চড়িয়ে মাঠ ঘুরেছেন তামিম ইকবালরা। কিন্তু ওই দৃশ্যই অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির শেষ স্মৃতি।
নতুন ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল: মাশরাফি অধিনায়কত্ব ছাড়ার পরের দিন থেকেই আলোচনা শুরু হয়ে যায়, কে হচ্ছেন নতুন ওয়ানডে অধিনায়ক। যদিও মাশরাফির পর সাকিব আল হাসানের ওয়ানডে অধিনায়কত্ব হওয়া ছিল অবধারিত বিষয়। কিন্তু বাঁহাতি এই অলরাউন্ডার এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হওয়ায় এই অপশন ছিল না বিসিবির কাছে।
বাকি তিন সিনিয়র ক্রিকেটারের মধ্য থেকে নতুন ওয়ানডে অধিনায়ক বাছাইয়ের কাজ শুরু করে বিসিবি। দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রথম পছন্দ ছিল মুশফিকুর রহিম। কিন্তু সাবেক এই অধিনায়ক নতুন করে দায়িত্ব নিতে বিন্দুমাত্রও আগ্রহ দেখাননি। আরেক সিনিয়র ক্রিকেটার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে চায়নি বিসিবির দায়িত্বশীল অনেকেই।
বাকি থাকেন তামিম ইকবাল। অভিজ্ঞ এই ওপেনারও শুরুতে রাজি ছিলেন না নেতৃত্বের দায়িত্ব নিতে। তাকে মানিয়ে অধিনায়কত্ব দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে বিসিবি। আলোচনার এক পর্যায়ে দীর্ঘ মেয়াদে অধিনায়কত্বের আশ্বাস পেয়ে দলের নেতৃত্বভার নিতে রাজি হন তামিম। মাশরাফি নেতৃত্ব ছাড়ার দুদিন পর (৮ মার্চ) তামিমকে ওয়ানডে অধিনায়ক ঘোষণা করে বিসিবি।
দীর্ঘ বিরতিতে ঘরোয়া ক্রিকেট: তখন ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে জমজমাট আসর ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ চলছিল। মাত্র একটি রাউন্ডের খেলা শেষ, এমন সময়ে করোনাভাইরাসের প্রকোপে বন্ধ হয়ে যায় দেশের সব ধরনের ক্রিকেট। লিগটি আর মাঠে গড়ায়নি। অনুষ্ঠিত হয়নি লঙ্গার ভার্সনের জাতীয় ক্রিকেট লিগ ও বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগও।
ম্যাচ আয়োজন তো দূরের কথা, দীর্ঘদিন ধরে মিরপুর স্টেডিয়ামসহ অন্যান্য ভেন্যুতে অনুশীলনও করার সুযোগ পাননি ক্রিকেটাররা। চার মাস পর গত ১৯ জুলাই থেকে একক অনুশীলন দিয়ে মাঠে ফেরেন ক্রিকেটাররা। ম্যাচে ফিরতে আরও সময় লেগেছে। ১৯৯ দিন পর অনুশীলন ম্যাচ দিয়ে মিরপুরে ক্রিকেট গড়ায়। প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট শুরু হয় ২০৮ দিন পর বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপের ম্যাচ দিয়ে।
করোনার পেটে আন্তর্জাতিক সিরিজও: করোনাভাইরাসের দাপটে স্থবির হয়ে পড়েছিল দেশের ক্রীড়াঙ্গন। স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও। শ্রীলঙ্কা সিরিজ নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হওয়ার পর সিরিজটি স্থগিতই হয়ে যায়। এরপর স্থগিত হয় নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া সিরিজ। পাকিস্তানে একটি টেস্ট এবং ওয়ানডে খেলার কথা থাকলেও বাংলাদেশের সফরটি হয়নি।
হয়নি আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজও। সব মিলিয়ে এবার দুটি টেস্ট, তিনটি ওয়ানডে ও চারটি টি-টোয়েন্টি খেলেছে বাংলাদেশ। ১৯৯৫ সালের পর কখনই এতো কম ওয়ানডে খেলেনি বাংলাদেশ। চলতি বছরের মার্চে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সর্বশেষ সিরিজ খেলা বাংলাদেশ এখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরেনি। জানুয়ারিতে ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার অপেক্ষায় বাংলাদেশ।
সাকিবের ক্রিকেটে ফেরা ও আইসিসির দশকসেরা একাদশে অন্তর্ভুক্তি: বাংলাদেশ দলের প্রাণভোমরা তিনি। ব্যাটে-বলে বহু ম্যাচে বাংলাদেশকে পথ দেখানো সাকিব আল হাসান ছিলেন ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত। জুয়াড়ির কাছ থেকে তিনবার ম্যাচ পাতানোর প্রস্তাব পেয়েও না জানানোয় আইসিসি তাকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। ক্রিকেটবিহীন ৩৬৫ দিন কাটানোর পর গত ২৮ অক্টোবর মুক্ত হন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার।
ক্রিকেটে ফিরতে তাকে আরও অপেক্ষা করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ দিয়ে ৪০৮ দিন পর ম্যাচ খেলেছেন দেশসেরা এই অলরাউন্ডার। জেমকন খুলনার হয়ে খেলা সাকিবের ফেরাটা অবশ্য ভালো হয়নি। ৯ ম্যাচে মাত্র ১২.২২ গড়ে ১১০ রান করেছেন তিনি। সর্বোচ্চ করেছেন ২৮ রান। বল হাতেও আগের সাকিবকে দেখা যায়নি। কম খরুচে থাকলেও ৯ ম্যাচে নিয়েছেন মাত্র ৬ উইকেট।
ভালোভাবে ফেরার তৃপ্তি না মিললেও বছর শেষে সাকিবের ঠোটে চওড়া হাসি ফুটেছে। আইসিসির দশকসেরা ওয়ানডে একাদশে রাখা হয়েছে বাংলাদেশ অলরাউন্ডারকে। ২৭ ডিসেম্বর দশকসেরা টেস্ট, ওয়ানডে টি-টোয়েন্টি দল ঘোষণা করে আইসিসি।
টেস্ট খেলতে না পারার হাহাকার: কম টেস্ট খেলতে হয় বলে বাংলাদেশের আফসোসের শেষ নেই। অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেটে এই হাহাকার। এবার সুযোগ এসেছিল বেশ কয়েকটি টেস্ট ম্যাচ খেলার। আইসিসির ভবিষ্যত সূচি অনুযায়ী ২০২০ সালে ১০টি টেস্ট খেলার কথা ছিল বাংলাদেশের। এক বছরে এতো টেস্ট কখনই খেলেনি বাংলাদেশ। কিন্তু করোনার থাবায় মাত্র দুটি টেস্ট খেলেই এ বছর সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে মুমিনুল হকের দলকে। এর মধ্যে পাকিস্তানের বিপক্ষে একটি টেস্টে হার এবং আরেকটিতে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জিতেছে বাংলাদেশ।