ফুটবল ইতিহাসের মর্মান্তিক ৫ ট্র্যাজেডি
খেলায় নিজের দল যখন জিতে যায়, তখন নিঃসন্দেহে ভীষণ আনন্দ হয়। আবার হেরে গেলে একরাশ হতাশা ও কষ্ট এসে ভিড় করে ফুটবলপ্রেমীদের মনে। কিন্তু ইতিহাস বলে, কখনো কখনো ফুটবল শুধুমাত্র ম্যাচে হার-জিতের বিষয় নয়। এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায় ফুটবল জগতে, যা শুধু কষ্টই দেয় ভক্তদের।
শুনে অবাক হচ্ছেন কি? না, অবাক হবেন না। ইতিহাসে ফুটবলের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় মানুষ অনেক ট্র্যাজেডিরই সাক্ষী হয়েছে। কখনো কখনো তা ছিল শুধুমাত্র মাঠের খেলা চলাকালীন দুর্ঘটনা; কখনোবা স্টেডিয়ামে নেমে আসা বিশৃঙ্খলার ফলে বিপর্যয়, আবার কখনো বিমান দুর্ঘটনাও।
আজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস) পাঠকের সামনে তুলে ধরছে ফুটবল বিশ্বের এমন পাঁচটি ট্র্যাজেডির কথা, যা পুরো বিশ্বকে মর্মাহত করেছিল।
৫) ব্রাডফোর্ড সিটির অগ্নিকাণ্ড
ঘটনাটি ১৯৮৫ সালের ১১ মে'র। ব্রাডফোর্ড সিটি ও লিংকন সিটির মধ্যে একটি ম্যাচ চলাকালীন হঠাৎ আগুন লেগে যায় এবং স্ট্যান্ডের কাছ থেকে ধোঁয়া আসতে দেখা যায়। কিন্তু সমস্যাটা ছিল মূল স্ট্যান্ডের মধ্যেই। স্ট্যান্ডের ছাদ ছিল কাঠের তৈরি এবং এরমধ্যে কিছু ফুটো ছিল। তাছাড়া, এটি ছিল বেশ পুরনো।
সেদিনের আগেও একাধিকবার একই সমস্যার সম্মুখীন হলেও, কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বসার আসনের নিচে সব ময়লা-আবর্জনা জমে থাকায়, বিশালাকারে আগুনের শিখা ছড়িয়ে দিতে আগুনের একটি স্ফূলিঙ্গই যথেষ্ট ছিল।
ব্রাডফোর্ড সিটি স্টেডিয়ামে সেদিনের দুর্ঘটনায় ৫৬ জন নিহত ও ২৬৫ জন আহত হন। এটি এখনও পর্যন্ত ব্রিটিশ ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসেবে ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে।
৪) মিউনিখের বিমান দুর্ঘটনা
১৯৫৮ সালে রেড স্টার বেলগ্রেডকে হারিয়ে ইউরোপিয়ান কাপের সেমি-ফাইনালে উঠে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। পরদিন বিমানে করে ম্যানচেস্টারে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল তাদের।
যাত্রাপথে জ্বালানি নেওয়ার জন্য জার্মানির মিউনিখে থামতে হয় বিমানটির। জ্বালানি নেওয়ার পর পাইলট টেক-অফ করতে যান। কিন্তু ইঞ্জিনে যান্ত্রিক সমস্যার কারণে তিনি টেক-অফ করতে ব্যর্থ হন।
পাইলটের তৃতীয় বারের চেষ্টার সময়, বরফের কারণে বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং বিমানে আগুন ধরে যায়।
দুর্ঘটনার ফলে ঘটনাস্থলেই ২০ জন যাত্রী মারা যান। পরবর্তীতে হাসপাতালে মারা যান আরও তিনজন। মিউনিখের এই ট্র্যাজেডিতে ডানকান এডওয়ার্ডসহ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের আটজন খেলোয়াড় মারা যান। ১৫ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় থেকে মারা যান এডওয়ার্ড।
৩) চ্যাপেকোয়েন্সের বিমান দুর্ঘটনা
২০১৬ সালে ২৮ নভেম্বর কলম্বিয়ায় এক বিমান দুর্ঘটনায় প্রায় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ব্রাজিলের ফুটবল ক্লাব চ্যাপেকোয়েন্স-এর একটি স্কোয়াড। বিমানে থাকা ৭৭ জন যাত্রীর মধ্যে মাত্র ৬ জন বেঁচে ফিরেন।
সাউথ আমেরিকান ফাইনাল কাপ খেলতে সেদিন মেডেলিনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল ব্রাজিলীয় ক্লাবটি। ক্লাবের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ম্যাচ ছিল এটি।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ওই দিনটিই তাদের কালো অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়। বিমানের জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ায় গন্তব্যস্থল থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে একটি পর্বত অঞ্চলে আছড়ে পড়ে বিমানটি।
দুর্ঘটনায় ১৯ জন খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফ নিহত হন। শুধুমাত্র তিনজন খেলোয়াড় সেদিন বেঁচে ফিরেন।
২) লিমা'র ন্যাশনাল স্টেডিয়াম বিপর্যয়
ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসেবে ধরা হয় লিমা'র বিপর্যয়কে। দিনটি ছিল ১৯৬৪ সালের ২৪ মে। পেরুর রাজধানী লিমা'র জাতীয় স্টেডিয়ামে পেরু ও আর্জেন্টিনার মধ্যে অলিম্পিকের কোয়ালিফাইং পর্বের ম্যাচ চলছিল সেদিন।
খেলা চলাকালীন পেরুর একটি গোল বাতিল করে দেন রেফারি। ফলে সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয় এবং তারা প্রতিবাদ করে। বিশৃঙ্খলা থামাতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ে, ভিড়ের মধ্যে এলোপাথারি পেটাতে থাকে।
পুলিশের এই ভূমিকায় সাধারণ জনতা আতঙ্কিত হয়ে স্টেডিয়াম ছাড়ার চেষ্টা করে। তখনো পর্যন্ত স্টেডিয়ামে গেটের পরিবর্তে শাটার ব্যবহার করা হতো। খেলা চলার সময় সেই শাটার বন্ধ থাকতো।
কিন্তু আতঙ্কিত হয়ে পড়ায় দর্শকদের সেই কথা মনে ছিলনা এবং সবাই মিলে শাটারের দিকেই দৌড়ে যায়। এসময় ভিড়ের চাপে পৃষ্ঠ হয়ে ৩২৮ জন মানুষ মারা যান।
১) আন্দ্রেস এস্কোবারের মৃত্যু
এস্কোবার (১৩ মার্চ, ১৯৬৭- ২ জুলাই, ১৯৯৪) ছিলেন কলম্বিয়া ফুটবল দলের ডিফেন্ডার। অসাধারণ মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন হওয়ায় তিনি 'দ্য জেন্টলম্যান অফ দ্য ফিল্ড' বলেই পরিচিত ছিলেন।
কিন্তু এস্কোবার যে কারণে মারা যান, তা শুনলে হয়তো আপনারও বুক কেঁপে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ম্যাচ চলার সময় একটি আত্মঘাতী গোল করেন এস্কোবার। তার এই গোলের কারণে সেদিন ১-০ গোলে এগিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র এবং শেষ পর্যন্ত তারা ২-১ গোলের ব্যবধানে ম্যাচ জিতে।
সেই ম্যাচে পরাজয়ের ফলে ১৯৯৪ বিশ্বকাপের নক-আউট পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় কলম্বিয়াকে। শুধুমাত্র সেই আত্মঘাতী গোল করার দায়ে এস্কোবারের উপর ছয়বার গুলি করা হয় এবং তিনি মারা যান।
নক-আউট পর্ব থেকে কলম্বিয়ার বাদ পড়া নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন এস্কোবার। কলম্বিয়ান সংবাদপত্র 'এল তিয়েম্পো'তে সেটি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিটা ছিল এরকম-
"জীবন এখানেই শেষ হয়ে যাবে না। আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। জীবন এখানে শেষ হতে পারে না। পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক না কেন, আমাদের ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। আমাদের হাতে এখন দুটি পথ আছে: হয় রাগ-ক্ষোভ নিয়ে নিজেকে পঙ্গু হয়ে যেতে দেবো, সহিংসতা চালিয়ে যাবো; আর না হয় আমরা সমস্যা কাটিয়ে উঠবো এবং অন্যদের সাহায্য করবো। সবটাই এখন আমাদের হাতে। চলুন আমরা সম্মান বজায় রাখি। সকলের প্রতি আমার উষ্ণ শুভেচ্ছা রইলো। সবার সঙ্গে খেলতে পারা খুব দারুণ ও বিরল অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে আমার জীবনে। খুব শীঘ্রই আমাদের আবার দেখা হবে, কারণ জীবন এখানেই থেমে থাকবে না।"