শুমিলাহ, শুমিলাহ: যেভাবে কাতারের অনানুষ্ঠানিক ফুটবল সঙ্গীত হয়ে উঠেছে রহস্যময় এই গান!
ফুটবলের নাম নিলেই অবধারিতভাবে চলে আসে সঙ্গী্তের কথা, যে সঙ্গীত অনুপ্রেরণা দেয়, সাহস যোগায় খেলোয়াড় ও ভক্তদের। ২০১৯ সালে কাতার সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এশিয়ান কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট জয়ের পর 'শুমিলাহ শুমিলাহ' শিরোনামের একটি গান ছড়িয়ে পড়ে দেশটির আনাচে-কানাচে এবং সীমান্ত পেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতেও। এর আগে ২০১৭ সালে প্রতিবেশি দেশগুলোর অবরোধের মুখে যখন সংকটে পড়েছিল কাতার, তখনো এই গানটিই হয়েছিল কাতারিদের সঙ্গী। ফুটবলের মাঠ থেকে উৎসারিত না হলেও, একসময়ের স্বল্প-পরিচিত দুটি শব্দ 'শুমিলাহ শুমিলাহ'ই হয়ে উঠেছে কাতারের অনানুষ্ঠানিক ফুটবল সঙ্গীত।
কাতারের ইতিহাসের সঙ্গে ফুটবলের নাম খুব বেশি জড়িয়ে না থাকলেও, ইতোমধ্যেই ফুটবলের সাথে বেশ সখ্যতা ও আবেগের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে কাতারিদের... কারণ ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপ যে কাতারেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে!
প্রাচীন আরবি শব্দগুচ্ছ 'শুমিলাহ' শব্দের অর্থ 'তার আকাঙ্ক্ষা বা কামনা'। প্রচলিত অর্থে এটি বিয়ের উপযুক্ত তরুণীদের উদ্দেশ্য করে বলা হয় যেন তারা সবচেয়ে সেরা পুরুষকেই নিজের স্বামী হিসেবে বেছে নেয়। একটি জাতি ও তাদের নেতার মধ্যে সমর্থন ও প্রশংসাসূচক সম্পর্ক বোঝাতে প্রেমের ভাষাকে রূপক অর্থে ব্যবহার করে গাওয়া এই গান অল্প সময়ের মধ্যেই কাতারের লাখো মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। দেশের সব জায়গায়, এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানেও বাজতে দেখা গেছে এই গান!
২০১৭ সালে প্রতিবেশি দেশ সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশরের দেওয়া অবরোধের মধ্যে থেকেই যখন কাতার তাদের জাতীয় দিবস উদযাপন করে, সেই সময় প্রথম 'শুমিলাহ শুমিলাহ' গানটি জনসাধারণের নজরে আসে। একই বছরের ৫ জুন এই চারটি দেশ কাতারের সাথে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। কাতার 'সন্ত্রাসবাদ'কে সমর্থন দিচ্ছে বলে অভিযোগ এনে কাতারের উপর স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে অবরোধ জারি করে এই দেশগুলো; যদিও কাতার বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে।
কাতারের ওপর জারি করা এই অবরোধ তিন বছরেরও বেশি সময় বহাল ছিল। এ সময়ে কাতারের জনগণের মধ্যে প্রতিবাদের অভিব্যক্তি ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশটির একজন স্বনামধন্য কবি ও গীতিকার আয়েদ বিন গিদাহ জানান, তিনি কাতারের ওপর এসব হামলার 'একটি রূপক জবাব' দিতে চেয়েছিলেন, কাতারিরা যে তাদের নেতার প্রতি অনুগত তা বোঝানোর বার্তা দিতে চেয়েছিলেন।
আয়েদ বিন গিদাহর লেখা 'শুমিলাহ শুমিলাহ' গানের কথায় প্রকাশ পায় যে- সুন্দর 'চোখের পাপড়ির' একজন নারীর সঙ্গে একজন তলোয়ারধারী, সত্যিকার শেখের দেখা হবে এবং তাদের মধ্যে একটি প্রেমময় সম্পর্কের আভাস- আর সেই শেখ হবেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি ছেলেবেলা থেকেই 'বিশেষ একজন মানুষ' এবং যার 'কাজের মধ্যেই তার অধ্যবসায়' প্রকাশ পাবে।
'শুমিলাহ'র রহস্য!
সত্যি কথা বলতে, কাতারিদের মধ্যে 'শুমিলাহ শুমিলাহ' ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলেও এই শব্দগুচ্ছের অর্থ অনেকের কাছেই ছিল এক রহস্য।
শুমিলাহ গানটির প্রোডাকশনের কাজ দেখাশোনা করেছে যে প্রতিষ্ঠান, সেই আল রাইয়ান টিভির ততকালীন সাধারণ ব্যবস্থাপক সাবাহ আল-কুয়ারি বলেন, "আমি এই শব্দের কথা শুনেছিলাম কিন্তু এর সঠিক অর্থটা জানতাম না।" ২০১৯ সালে 'সংস অব দ্য গালফ' প্রামাণ্যচিত্রের জন্য এক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা অ্যারাবিককে তিনি বলেছিলেন, বয়োজ্যেষ্ঠরাই এই শব্দটি বেশি ব্যবহার করেন।
তিনি আরও বলেছিলেন, তিনি শুরু থেকেই গানটি পছন্দ করতেন যখন অন্য কারো জন্য বাজানো হতো। তার ভাষ্যে, "লোকে আমাকে বলেছিল- নিজে এর প্রোডাকশনের সঙ্গে জড়িত থাকার বা এটিকে প্রচার করার পেছনে তোমার থাকা উচিত না, কারণ এটা হিট হবে না।"
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই কবিতা লেখায় হাতেখড়ি 'শুমিলাহ শুমিলাহ'-এর গীতিকার বিন গিদাহর। "আমার গানের কথাগুলো দেখে অনেকে বলেছিল কথাগুলো খুব কঠিন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে এই গানের মধ্যেই থাকবে রহস্য, যার ফলে মানুষ কৌতূহলী হবে। মানুষ আমাকে এখনো জিজ্ঞেস করে 'শুমিলাহ' মানে কী।"
বিন গিদাহ বলেন, "এই শব্দগুচ্ছের মানে হলো 'তার আকাঙ্ক্ষা বা কামনা'। এই গানের উদ্ভব হয়েছে এমন একটা সময়ে যখন আমাদের ওপর চারপাশ থেকে ছিল অবরোধ, কিন্তু এর মাঝেও যে কাতারিরা তাদের নেতার প্রতি আনুগত্য ও সমর্থন দেখিয়েছে তা প্রকাশ করা হয়েছে এই গানের মাধ্যমে। এটা একজন শিল্পীর কল্পনা। গানের বিষয়টা ছিল এমন... আমির একজন অবিচল মানুষ... তার ইচ্ছাশক্তি অটুট। আমরা তার শাসনের অনুগত এবং আমরা তার সৈন্য। আমরা তার সামনে মাথাবনত করি। তাকে গিয়ে বলো যে তোমার দেশের মানুষেরা তোমার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করছে!"
'সংস অব গালফ' নামক প্রামাণ্যচিত্রে বিন গিদাহ স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন যে, তার গানের কথাগুলো বর্তমান যুগে অনেকের কাছেই অপরিচিত লাগতে পারে, কিন্তু এগুলো তাদেরই নিজ সংস্কৃতির, পরিবেশের ও ভাষার অংশ।
মূলত নাবাতি আরবীয় কবিতা থেকে এই গানের কথাগুলো উৎসারিত বলে জানিয়েছিলেন বিন গিদাহ। ক্লাসিক্যাল আরবি থেকে বিচ্যুত, একটি বেদুইন আঞ্চলিক শৈলী হলো নাবাতি আরবীয় কবিতা।
ভৌগলিক সীমারেখা পেরিয়ে
২০১৯ সালে যখন কাতার প্রথম এশিয়ান কাপ জয় করে, তখন 'শুমিলাহ শুমিলাহ' কাতারের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের দেশগুলোতেও, বিশেষ করে কুয়েত, ওমান ও উপসাগরী অঞ্চলেরর সংকটকালে নিরপেক্ষ দেশগুলোতে এটি খুবই জনপ্রিয় হয়।
কোনো কোনো ভক্ত জানিয়েছেন, তারা কুয়েতি গায়ক ইব্রাহিম দাস্তির গলায় এই গানের নতুন সংস্করণটি শুনতে পছন্দ করেন কারণ সেটি বেশ দুর্দান্ত ও উত্তেজনাকর! আবার অনেকে বলছেন, তারা ইয়েমেনি শিল্পী মারিয়া কাহতানের গাওয়া সংস্করণটি শুনতে ভালোবাসেন।
ইনস্টাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সার জাহরা আল আনসারি আল-জাজিরাকে বলেন, এই গানটি শুনলে কাতারি হিসেবে তার গর্ববোধ হয়। আরেকজন কাতারি তাদের আমির তামিম বিন হামাদ আল থানির সেই বিখ্যাত সিলুয়েটের দিকে ইঙ্গিত করে জানান, গানের সঙ্গে মিলিয়ে এই বিশেষ বিষয়টি তার পছন্দ হয়েছে। শুধু তাই নয়, বয়কটের সময়টায় কাতারের বাড়িঘর, দোকানপাট সব জায়গায় এটি ছিল অতি পরিচিত দৃশ্য এবং এটির মাধ্যমে তারা জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রকাশ করেছেন।
মানবসম্পদ বিষয় নিয়ে কর্মরত পেশাদারি ব্যক্তিত্ব আল বাকের বলেন, "এটা কাতার এবং তাদের ফুটবলকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার জন্য বেশ ভালো একটা গান।"
কিন্তু কাতারের জাতীয় সঙ্গীত 'আন্নাবি'র সাথে কিভাবে যুক্ত হলো 'শুমিলাহ'?
এ গল্পের পটভূমিও ২০১৯ সালের। সেবছর এশিয়া কাপের সেমিফাইনালে আবুধাবিকে হারানোর পর কাতারের জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা তাদের লকার রুমে এই গানটি গেয়েছিলেন, শিরোপা যেন যোগ্য দলের হাতেই যায়-এই ছিল তাদের চাওয়া।
এর কিছুদিন পর ফাইনালে জাপানের সাথে খেলার দিন টুইটারে কাতার জাতীয় দলের সেই গান গাওয়ার ভিডিওটি শেয়ার করা হয়।
'ফুটবল ইন দ্য মিডল ইস্ট' বইয়ের একটি চ্যাপ্টার 'হোমল্যান্ড: ন্যাশনাল আইডেন্টিটি পারফরমেন্স ইন দ্য কাতার ন্যাশনাল টিম' এর লেখক থমাস রস গ্রিফিনের মতে, সেদিন লকার রুমে 'শুমিলাহ শুমিলাহ' গানটি বাজিয়েছিলেন দলেরই একজন খেলোয়াড়। ঐ খেলোয়াড় গ্রিফিনকে বলেছেন, "আমি আমার সতীর্থদের সাথে একটা চুক্তি করেছি... আমরা খেলতে নামার আগে 'শুমিলাহ' গানটি বাজাবো অনুপ্রেরণা নেওয়া জন্য এবং খেলায় জিতে এসে আনন্দ উদযাপনের জন্যও।"
গ্রিফিন আরও লিখেছেন, যেসব খেলোয়াড় গানের কথাগুলো ঠিকঠাক বুঝতে পারেননি, তারাও মনে করেন এই গানটি কাতারকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার এক শক্তিশালী উপায়। আর কাতারিরা মনে করেন, নিজেদের জাতীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি এই গানটিও খেলোয়াড়দের জয়ী হওয়ার সাহস যোগাবে।
গতবছর ফিফা আরব কাপে কাতার বাহরাইনকে ১-০ গোলে হারানোর পর আল-বায়েত স্টেডিয়ামে ৬০,০০০ মানুষ জড়ো হয়ে 'শুমিলাহ শুমিলাহ' গানে সুর মিলিয়েছিলেন!
আজ রোববার (২০ নভেম্বর) পর্দা উঠেছে কাতার বিশ্বকাপের। শুরুর দিনেই ইকুয়েডরের বিপক্ষে খেলা স্বাগতিকদের। আর এই দিনে যে কাতারিরা তাদের খেলোয়াড়দের সমর্থন ও সাহস দেওয়ার জন্য 'শুমিলাহ শুমিলাহ' গানে সুর মেলাবেন তা তো বলাই বাহুল্য!
সূত্র: আল-জাজিরা