শিয়ালকোট: ফুটবলের সূতিকাগার! যেখানে তৈরি হয় বিশ্বের প্রায় ৭০% ফুটবল!
সেরা সেরা দলগুলো বাছাইপর্বে রীতিমতো অগ্নিপরীক্ষায় উতরে ফুটবল বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। ১৯৯০ সাল থেকে বিশ্বকাপে হাজির থাকে পাকিস্তানও! যদিও পাকিস্তান এই মুহূর্তে র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের চেয়েও পিছিয়ে আছে!
তবে সুনির্দিষ্ট করে বললে, ঠিক পাকিস্তান নয়, পাকিস্তানের ছোট্ট শহর শিয়ালকোট হাজির থাকে বিশ্বকাপে। কারণ এ বছর ফিফা বিশ্বকাপ খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে পাকিস্তানে তৈরি ফুটবল দিয়ে। এসব বল তৈরি হয়েছে উত্তরপূর্ব পাকিস্তানের কাশ্মীর সীমান্তের কাছাকাছি শহর শিয়ালকোটে।
শুধু এবারের বিশ্বকাপ নয়, ১৯৯০ সাল থেকে প্রায় প্রতিটি বিশ্বকাপেই ফুটবল গেছে শিয়ালকোট থেকে। তবে বিশ্বকাপে প্রথম শিয়ালকোটে তৈরি বল ব্যবহার হয় তারও আট বছর আগে।
ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদন অনুসারে, আপনার বাড়িতে যদি কোনো ফুটবল থাকে, তাহলে সেটিও শিয়ালকোট থেকে আসার ভালো সম্ভাবনা আছে। কারণ বিশ্বের মোট ফুটবলের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি—প্রায় ৭০ শতাংশ—একাই তৈরি হয় শহরটির ১ হাজার কারখানায়। ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপের অফিসিয়াল বল অ্যাডিডাস আল রিহলাও তৈরি হয়েছে শিয়ালকোটেই।
শুধু ফুটবল বিশ্বকাপে নয়, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, জার্মান বুন্দেসলিগা, ফরাসি লিগেও শিয়ালকোটে বানানো ফুটবলেই খেলা হয়।
শিয়ালকোটের প্রায় ৬০ হাজার—অর্থাৎ মোট বাসিন্দার প্রায় ৮ শতাংশ—মানুষ কাজ করেন ফুটবল উৎপাদন কারখানায়। দীর্ঘক্ষণ কাজ করেন তারা। অধিকাংশ বল তৈরি করেন হাতে সেলাই করে।
শিয়ালকোটে তৈরি বলের ৮০ শতাংশের বেশি বানানো হয় হাতে সেলাই করে। এই প্রক্রিয়াটি বেশ শ্রমসাধ্য। তবে হাতে সেলাই করার কারণে ফুটবল বেশি স্থায়িত্ব পায়, বাতাসে ভারসাম্য বজায় থাকে বেশি। শিয়ালকোটের বলের সিম গভীর হয়। আর সেলাইও মেশিনে সেলাই করা বলের চেয়ে বেশি ভালো।
আনোয়ার খাজা ইন্ডাস্ট্রিজ নামক উৎপাদন কারখানায় কাজ করে সেলাইকারীরা বলপ্রতি ১৬০ পাকিস্তানি রুপি—প্রায় ০.৭৫ ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭৬ টাকা—মজুরি পান। প্রতিটি বল সেলাই করতে তিন ঘণ্টা সময় লাগে।
দিনে তিনটি বল বানাতে পারলে একজন সেলাইকারী মাসে প্রায় ৯ হাজার ৬০০ রুপি আয় করতে পারেন। দারিদ্র্যপীড়িত এলাকার পক্ষেও এই মজুরি বেশ কম। শিয়ালকোটে বাস করার জন্য মাসিক গড় ব্যয় প্রায় ২০ হাজার রুপি।
শিয়ালকোটে যারা বল সেলাই করেন, তাদের অধিকাংশই নারী। আনোয়ার খাজা ইন্ডাস্ট্রিজে তারা দিনে সাধারণত দুটি বল সেলাই করেন। তারপর বাড়ি ফিরে সন্তানদের জন্য রান্নাবান্না করেন। তারপর বিকালবেলায় নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
পুরুষরা সাধারণত বল উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপে কাজ করেন। বিভিন্ন উপাদান প্রস্তুত করেন কিংবা বলের মান পরীক্ষা করেন। ১৯৯৭ সালে শ্রম আইন কার্যকর করার আগপর্যন্ত শিয়ালকোটে বাবা-মায়েদের সঙ্গে ৫ বছর বয়সি শিশুরা পর্যন্ত কাজ করত।
কর্মীরা টেক্সটাইল উপাদানে অ্যাডহেসিভ লাগিয়ে ফুটবলের সিনথেটিক চামড়া তৈরি করেন। সিনথেটিক চামড়ার উপাদান তুলা, পলিয়েস্টার ও পলিইউরিথেন বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে আনা হয়। সবচেয়ে সস্তা বলগুলোতে চীনের উপাদান ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত ভালো মানের বলে দক্ষিণ কোরিয়ান উপাদান ব্যবহৃত হয়। জার্মান বুন্দেসলিগা বা অন্যান্য ইউরোপীয় লিগের বল তৈরির জন্য জাপান থেকে আসা উপাদান ব্যবহার করা হয়।
শিয়ালকোটে প্রথাগত বলগুলোতে সাধারণত ২০টি ষড়ভুজ ও ১২টি পঞ্চভুজ থাকে। ষড়ভুজ ও পঞ্চভুজগুলোকে ৬৯০টি সেলাইয়ের মাধ্যমে যুক্ত করা হয়।
তবে এখন থার্মো বন্ডিং নামক প্রক্রিয়ায় গরম আঠার সাহায্যে ফুটবল তৈরির পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। এই বলগুলো যেমন মানে ভালো হয় তেমনি উৎপাদন ব্যয়ও তুলনামূলক কম। তবে থার্মো বন্ডিংয়ের বল পরিবহন করার খরচ বেশি। এছাড়া সেলাই করা বল সারাই করা গেলেও, আঠা দিয়ে তৈরি বল সারাই করা যায় না।
সম্পূর্ণ প্রস্তুত বল ফিফার মানদণ্ড উতরানোর জন্য নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। বলগুলো নিখুঁতভাবে গোল করা হয়েছে কি না, বাউন্স কেমন, বাতাসে গতিপ্রকৃতি কেমন—এসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয়। সারা বিশ্বে প্রতি বছর ৪০ মিলিয়ন ফুটবল বিক্রি হয়। বিশ্বকাপের মৌসুমে এই বিক্রি আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
শিয়ালকোট যেভাবে ফুটবল তৈরির কেন্দ্র হয়ে উঠল
কবে, কীভাবে শিয়ালকোট ফুটবল তৈরির জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠল, সেই আখ্যান বেশ চমকপ্রদ।
সৌদি গ্যাজেটের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আনুষ্ঠানিকভাবে ফুটবল উৎপাদনের শুরুটা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে।
ব্রিটিশরা ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করত। কিন্তু ১৮৮০-র দশকের শেষভাগে ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ ভারতে ফুটবল উৎপাদন হতো না। তখন তাদের জন্য বল আসত ব্রিটেন থেকে, জাহাজে করে।
কিন্তু ওই সময় ফুটবলের চালান আসতে অনেক দেরি হয়ে যেত। বলের চালান আসার অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকে ভারতবর্ষের ব্রিটিশ দারুণ অধৈর্য হয়ে উঠত।
প্রচলিত আছে, ১৮৮৬ সালে শিয়ালকোটের এক ব্রিটিশ সার্জেন্ট তার ফুটে যাওয়া ফুটবলটি সারাতে দেন স্থানীয় মুচিকে। ওই মুচির নিপুণ কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে এক ব্যাচ ফুটবল বানানোর ফরমায়েশ দেন তিনি।
তারপর থেকেই শুরু ফুটবল মাঠে শিয়ালকোটের একক আধিপত্য। সেই থেকে ফুটবলার ও ভক্তদের জন্য বাজারের সিংহভাগ ফুটবল তৈরি করে আসছে পাকিস্তানের শহরটি।
শিয়ালকোটের কারিগরদের হাতে তৈরি ফুটবলের সেলাই এতই নিপুণ হতো যে ১৯৮২ স্পেন ফুটবল বিশ্বকাপের জন্য ফুটবল তৈরির সম্মানজনক চুক্তি পায় শহরটি। ওই বিশ্বকাপেই শিয়ালকোট বিশ্বের সর্বপ্রথম পানিনিরোধক ফুটবল সরবরাহ করে।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ ও সৌদি গ্যাজেট