রিচার্লিসন: তিনি কেন লাখে একজন?
ব্রাজিল-সার্বিয়ার দুর্দান্ত ম্যাচের তখন ৭৩ মিনিট চলছিল। ভিসিনিয়া জুনিয়ারের ভাসিয়ে দেওয়া পাসের পর জাদু দেখালেন রিচার্লিসন। বলটিকে মাটিতে পড়তে না দিয়ে হাল্কা স্পর্শে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিলেন, তুলে দিলেন সামান্য উপরে। এরপর শরীর বাঁকিয়ে শূন্যে থাকা অবস্থাতেই বলটিকে বাইসাইকেল কিক দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন সার্বিয়ার জালে।
এভাবেই রিচার্লিসন মুগ্ধ করলেন গোটা ফুটবল বিশ্বকে। তার জোড়া গোলে ভর করে সার্বিয়াকে ২-০ ব্যবধানে হারিয়ে দাপুটে জয়ে 'মিশন হেক্সা' শুরু করেছে ব্রাজিল।
কাতার বিশ্বকাপ ২০২২-এর সেরা গোলটা কি তাহলে রিচার্লিসনের হতে যাচ্ছে? টুর্নামেন্ট তো সবে শুরু। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে এটা নিশ্চিত যে এই বিশ্বকাপ আসরের সেরা গোলগুলোর অন্যতম একটি হতে যাচ্ছে রিচার্লিসনের বাইসাইকেল কিক।
লুসাইল স্টেডিয়ামে রিচার্লিসনের শৈল্পিক গোল তাকে সমর্থকদের কাছে নতুন নায়কে পরিণত করেছে। তিনি যেন এখন লাখে একজন! দ্য অ্যাথেলেটিক-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চোখ ধাঁধাঁনো গোল নিয়ে তার অনুভূতি, পরিশ্রম এবং স্বপ্নপূরণের গল্প।
দ্য অ্যাথেলেটিককে তিনি বলেন, 'আমি মনে করি এটি সুন্দর একটি গোল ছিল। ফ্লামিনেন্স এবং এভারটনের পক্ষ হয়ে এমন সুন্দর গোল আগেও করেছি। আজ এক অ্যাক্রোব্যাটিক গোল করার সুযোগ হলো; সম্ভবত আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা গোল এটি। ম্যাচটা যথেষ্ট কঠিন ছিল, সুতরাং আমি মনে করি গোলটি আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা গোলগুলোর একটি ছিল।'
হবেই বা না কেন! বাইসাইকেল কিক যে রিচার্লিসনের ট্রেডমার্ক! গত সপ্তাহে ইতালির তুরিনে এক প্রশিক্ষণ ক্যাম্পেও এমন গোল করেছিলেন তিনি।
ব্রাজিলের আরেক খেলোয়াড় ফ্রেডের মতে, এমন গোল কঠোর অনুশীলনের ফলাফল। তিনি বলেন, 'মাঠে নেমে হুটহাট এমন গোল করা মোটেও সহজ কাজ নয়। এটি তার (রিচার্লিসনের) এবং পুরো দলের প্রশিক্ষণের ফসল।'
আর যা-ই হোক, গাইতে গাইতেই তো গায়েন!
এবারের বিশ্বকাপে অধিকাংশ অনুমানের বিপরীত দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। বিরপরীত এই অর্থে যে, র্যাঙ্কে শীর্ষে থাকা দলগুলোকে হারিয়ে দিচ্ছে তুলনামূলকভাবে নিচের দিকে থাকা দলগুলো। প্রথমবারের মতো আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছে সৌদি আরব, জার্মানি হেরেছে জাপানের দুর্দান্ত খেলায়। এদিকে সার্বিয়ার বিপক্ষে প্রথমার্ধে নিজেদের সেরাটা দিতে পারেনি ব্রাজিল, ফলাফলও ছিল ০-০। তাই ভক্তদের মনে উদয় হয়েছিল আশঙ্কা!
কিন্তু খেলার মাঝামাঝি সময়ে বীরোচিত কাণ্ড করে বসলেন রিচার্লিসন। বিরতির সময় তিনি তার সতীর্থদের বলেছিলেন, 'আমার স্রেফ একটা পাস লাগবে।' কথা রেখেছিলেন সতীর্থরা। খেলার সময় পায়ে বল এসে গেল, আর চোখ ধাঁধানো গোল করলেন সদাপ্রস্তুত রিচার্লিসন!
ব্রাজিলের এবারের আক্রমণভাগ ছিল তারকায় ভরপুর; নেইমার তো আছেনই, সাথে আছেন রদ্রিগো, রাফিনিয়া, রিচার্লিসন এবং গ্যাব্রিয়েল জেসুসরা। নতুন তারকা পেদ্রো ছিলেন রিচার্লিসনের প্রথম একাদশে স্থান পাওয়ার দৌড়ের প্রতিদ্বন্দ্বী। পেদ্রো বলেছিলেন, 'টোটেনহাম
হটস্পার তারকা রিচার্লিসন একজন ব্রাজিলিয়ানের নির্যাস।' গোলটাই পেদ্রোর কথার প্রমাণ করে দিল।
ব্রাজিলের খেলা দেখতে লুসাইল স্টেডিয়ামে জড়ো হয়েছিলেন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা হাজারো দর্শক। তিতের দলের নৈপুণ্য দেখতে ব্রাজিলের জার্সি পরে এসেছিলেন শত শত প্রভাবশালী কাতারি ভক্তরা। দেখলেনও তা-ই। রিচার্লিসনের গোলের মুগ্ধতা কোটি ভক্তকে স্মরণ করিয়ে দিল ব্রাজিলের সোনালি অতীত; ১৯৫৮ সালের ফুটবলের রাজা পেলে এবং গারিঞ্চার কথা।
৬২ মিনিটে প্রথম গোলটি করেন রিচার্লিসন। সার্বিয়ার জালে বল যেতেই লাফিয়ে উঠেছিল ডাগআউটে থাকা ব্রাজিলের পুরো দল। লড়াকু একাদশের সাথে উদযাপন করতে সবাই দৌড়ে গিয়েছিলেন কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে ।
আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন কোচ তিতে। ৬১ বছর বয়সী এ ব্রাজিল কোচের ভাষায়, 'কিছু অনুভূতি ব্যাখ্যা করার মতো নয়।'
'এ গোলের পেছনে যে কত পরিশ্রম ছিল!' বলেন নীল স্যুট পরিহিত তিতে।
অক্টোবরের মাঝামাঝিতে ইনজুরিতে ভুগছিলেন রিচার্লিসন। ভয়ে ছিলেন পাছে এর কারণে বিশ্বকাপ খেলার পথ বন্ধ হয়ে যায়। তিতেও এ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।
২০১৯ সালের কোপা আমেরিকা ফাইনালে পেরুর বিপক্ষে নেমেছিল ব্রাজিল। গ্যাব্রিয়েল জেসুস ফাইনাল থেকে ছিটকে পড়লে ব্রাজিলের জয় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। সেসময় রিচার্লিসন পেনাল্টি গোলে জিতিয়ে দিয়েছিলেন ব্রাজিলকে। ২০২০ অলিম্পিকে টানা দ্বিতীয় স্বর্ণ লাভ করেছিল ব্রাজিল। সেবছর সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন রিচার্লিসন। এছাড়াও ২০২২ সালে ব্রাজিলের সেরা গোলদাতা তিনি।
তিতের মতে, রিচার্লিসন যেন 'গোলের গন্ধ ছড়ান।' তাইতো তিনি আর্সেনালের জেসুসের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পেয়েছিলেন।
সার্বিয়ার বড় শক্তি ছিল তাদের আক্রমণ ভাগ। জুভেন্টাস তারকা দুসান ভ্লাহোভিচ, আলেকজান্ডার মিত্রভিচ, দুসান তাদিচ ব্রাজিলের রক্ষণে কাঁপন ধরাতে পারতেন।
সার্বিয়ার কোচ স্তয়কোভিচ দলের হার নিয়ে বলেন, 'আমরা ব্রাজিলের মতো ২০০ মিলিয়ন (২০ কোটি) জনগণের দেশ নয়, আমরা সংখ্যায় ছোট জাতি। দুসান ভ্লাহোভিচ এবং ফিলিপ কোস্তিচ ইনজুরিতে থাকলে, আলেকজান্ডার মিত্রভিচ খেলার জন্য পুরোপুরি তৈরি না হলে, সেটি আমাদের জন্য অনেক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।'
অন্যদিকে প্রথম একাদশে কাকে রাখবেন তার অনেক বিকল্প ছিল তিতের; কোপা লিবের্তাদোরেস জেতা স্ট্রাইকার গ্যাব্রিয়েল বারবোসা, রবার্তো ফিরমিনো, ম্যাথিউস কুনহা এবং হাল্ক। সুতরাং রিচার্লিসনের নয় নাম্বার জার্সি পরে মাঠে নামার প্রতিযোগিতাটা কম কঠিন ছিল না।
২০০ মিলিয়ন ব্রাজিলিয়ানদের একজন রিচার্লিসন! এমন বীরোচিত জয়ে হেসে বলেছিলেন, 'শৈশবের স্বপ্ন পূরণ হলো।'