'বুড়িয়ে যাওয়া' ফরোয়ার্ডদের বিশ্বকাপ যুদ্ধে এগিয়ে পর্তুগাল, এখনও গোল খরায় উরুগুয়ে
কাতার বিশ্বকাপে কোন দল সবচেয়ে বেশি বয়স্ক সেন্টার ফরোয়ার্ড নিয়ে খেলছে তা একটি বড় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইকুয়েডরের হয়ে বিশ্বকাপে চমক দেখানো এনার ভ্যালেন্সিয়া (৩৩) থেকে শুরু করে পোল্যান্ডের রবার্ট লেভানদোভস্কি (৩৪), ফ্রান্সের অলিভিয়ের জিরুদ (৩৬) এবং জার্মানির নতুন 'হিরো' নিকলাস ফুলক্রুগ (যদিও তার বয়স মাত্র ২৯)- এদেরকে আপাতদৃষ্টিতে কেউ কেউ 'বুড়ো' মনে করলেও, তাদের পারফরমেন্স কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে, এই যেমন- ২৩ বছর বয়সী ফরাসি তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পের কথাই ধরা যাক; যদিও পুরনো দিনের ফুটবলীয় চিন্তার আলোকে তাকে ঠিক স্ট্রাইকার বলা যায় না- তবে আধুনিক ফুটবলের বিবেচনায় এমবাপ্পে এখন পুরোদস্তুর সেন্টার ফরোয়ার্ড।
কিন্তু বয়স্ক খেলোয়াড়দের নিয়েই যে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বকাপের মহারণে নেমে পড়া যায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো পর্তুগাল ও উরুগুয়ে। পর্তুগালের নাম নিলেই প্রায়ই যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তা হলো- ৩৭ বছর বয়সে রোনালদো আসলেই এই দলে খেলার যোগ্য কিনা? হ্যাঁ, তিনি গোল করেন বটে, যদিও গেল সোমবারের আগপর্যন্ত হিসাব করলে এবছর পর্তুগালের হয়ে আট ম্যাচ খেলে পেনাল্টি ব্যতীত তার গোল সংখ্যা মাত্র দুটি।
কিন্তু রোনালদো আজকাল প্রায়ই গতিহীন থাকেন এবং অনেকেই মনে করেন রোনালদোর কারণে পর্তুগালের তরুণ আক্রমণাত্বক ফুটবলারদের খেলার গতি মন্থর হয়ে যায়। কিন্তু পর্তুগালের কোচ ফার্নান্দো সান্তোস একজন পুরনো ধাঁচের কোচ এবং ২০১৬ সালে ইউরো জয়ের পর থেকে তার খেলার কৌশল খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আর আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচগুলো এমনিতেই ক্লাবের ম্যাচগুলোর চাইতে ধীরগতির হয় এবং এই খেলায় একক কারো চমৎকার পারফরমেন্সের জেরেই সাফল্যের সম্ভাবনা থাকে।
সোমবার উরুগুয়ের বিরুদ্ধে ২-০ গোলের জয় নিয়ে বিশ্বকাপের নকআউট পর্ব নিশ্চিত করার পর পর্তুগালের কোচ ফার্নান্দো সান্তোস বলেন, "আমরা দলগতভাবে দারুণ খেলেছি। খেলার মান এবং খেলোয়াড়দের মধ্যে ঐক্য দেখা গিয়েছে। এভাবেই আসলে ইতিবাচক জিনিগুলো অর্জন করা যায়।"
তবে পর্তুগাল পার পেয়ে গেলেও, উরুগুয়ের সমস্যাটা একটু আলাদা। উরুগুয়ে দলে রয়েছে দুজন বয়স্ক ফরোয়ার্ড লুইস সুয়ারেজ এবং এদিনসন কাভানি, দুজনের বয়সই এখন ৩৫। যদিও চার বছর আগে শেষ ষোলর লড়াইয়ে উরুগুয়ের কাছে পর্তুগালের পরাজয়ের মূলে ছিলেন তারাই। কাতারে উরুগুয়ের শুরুর একাদশেই ছিলেন সুয়ারেজ। দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে ০-০ গোলে ড্র করে উরুগুয়ে, কিন্তু এই ম্যাচে সুয়ারেজ খেলার সাথে খুব বেশি কার্যকরীভাবে নিজেকে জড়াতেই পারেননি, ছিল গতির অভাব। সেদিন ৪-৩-৩ ফরমেশনে খেলায় সুয়ারেজ দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিলেন।
এদিকে পর্তুগালের বিপক্ষে উরুগুয়ের কোচ দিয়েগো আলোনসো বেছে নিয়েছিলেন ৩-৪-১-২ ফরমেশন, কাভানির সঙ্গী হিসেবে রেখেছিলেন ডারউইন নুনিয়েজকে, যিনি কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে ছিলেন লেফটে। কিন্তু এদের একজনও খেলায় বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেননি, বরং মিডফিল্ডার রদ্রিগো বেন্টাকুরের মাধ্যমেই যা একটু চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছিল উরুগুয়ে।
বেন্টাকুর, মাতিয়াস ভেসিনো এবং ফেদেরিকো ভালভার্দেকে নিয়ে উরুগুয়ের রয়েছে বিশ্বমানের মিডফিল্ড, কিন্তু তবুও ভারসাম্য ঠিক রাখতে তাদের সমস্যা হচ্ছে। দুই সেন্টার ফরোয়ার্ড, নুনিয়েজ এবং একজন ওল্ড মাস্টারকেই হয়তো মাঠে রাখতে চাইবেন কোচ আলোনসো, কিন্তু তাতে আবার উরুগুয়ের মিডফিল্ড ছোট হয়ে যায়। সুয়ারেজ বা কাভানি সেন্টারে থাকলে আর নুনেজ পাশের অংশে চলে গেলেও দলে শক্তি ও গতিশীলতার অভাব থেকে যায়।
ব্যাক থ্রি ফরমেশন এক্ষেত্রে একটি সমাধান হতে পারে, কিন্তু এতে করে মাথিয়াস অলিভেরা ও গিজের্মো ভারেলার মতো উইংব্যাকদের ওপরে আবার বড় প্রত্যাশার চাপ সৃষ্টি হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে খেলায় দেখা গেছে উরুগুয়ে নিজেদের মধ্যেই বেশি বল চালাচালি করছে। এই ম্যাচে শুরু থেকে উরুগুয়ের খেলায় গতি ছিল না, অথচ যখন তারা চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে তখন তা বিপক্ষ দলকে সত্যিই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল বলে বোঝা গেছে।
সোমবারের ম্যাচে শত্রুব্যুহভেদ করেছেন রোনালদোই, প্রাথমিকভাবে অন্তত তাই মনে করা হয়েছে। ঘানার বিপক্ষে পেনাল্টিতে স্কোর করে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে পাঁচটি বিশ্বকাপে গোল করার রেকর্ড গড়েছেন রোনালদো। তবে রোনালদোকে এই পেনাল্টি দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচেও একই কায়দায় পেনাল্টি আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন রোনালদো, কিন্তু এবার ইরানি রেফারি আলিরেজা ফাঘানি সেই সুযোগ দেননি, যা আগের ম্যাচের মার্কিন রেফারি ইসমাইল এলফাথ দিয়েছিলেন।
বছরের পর বছর ধরে রোনালদোর ক্যারিয়ারে গোলের পাহাড় জমে ওঠা নতুন কিছু নয়। কিন্তু ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে এসে পুরোপুরি শক্তি ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই আরও নতুন নতুন রেকর্ড গড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছে এই পর্তুগিজ তারকা। উরুগুয়ের বিপক্ষে দ্বিতীয়ার্ধের ৫৪ মিনিটে ব্রুনো ফার্নান্দেজের ক্রসে রোনালদোর মাথার খুব কাছ দিয়ে বল চলে যায় উরুগুয়ের জালে। আর তখন রোনালদোর গোল উদযাপন দেখে মনে করা হচ্ছিল গোলটি ব্রুনোর ক্রসে নয়, বরং রোনালদোর হেডেই হয়েছে। ফিফার ওয়েবসাইটেও দেখাচ্ছিল এটি রোনালদোর গোল। কিন্তু স্টেডিয়ামের বড় পর্দায় জানিয়ে দেওয়া হয়, গোলটি ব্রুনোর; ফার্নান্দেজের ক্রস রোনালদোর মাথা স্পর্শ করেনি।
পর্তুগালের দ্বিতীয় গোলটি ছিল পেনাল্টি থেকে, গোল করেন ব্রুনো ফার্নান্দেজ। রোনালদোকে ততক্ষণে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পর্তুগালের এই পেনাল্টি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
এদিকে দলের মধ্যে এত এত প্রতিভাবান খেলোয়াড় থাকার পরেও টুর্নামেন্টজুড়ে গোলশূন্য রয়ে গেছে উরুগুয়ে। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে তাদের ঘানাকে পরাজিত করতেই হবে। এদিকে নিজেদের আক্রমণভাগের সমস্যাগুলো পুরোপুরি সমাধান না করেই দুই ম্যাচের দুটিতেই জিতে ইতোমধ্যে নকআউট পর্ব নিশ্চিত করে ফেলেছে পর্তুগাল।
সূত্র: এসআই