আবারও সংবাদ হলো: বাংলাদেশের মানুষ কেন মেসি ও আর্জেন্টিনার জন্য এত পাগল?
ফুটবল বিশ্বকাপের ৯২ বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের আবেগ, ভালোবাসা ও সমর্থন। চার বছর পরপর অনুষ্ঠিত এই টুর্নামেন্টকে ঘিরে মানুষের উন্মাদনা অনেক সময়ই ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু বিশ্বকাপকে ঘিরে এযাবত যত সুন্দর গল্প বা অভিজ্ঞতা সৃষ্টি হয়েছে, সম্ভবত তার সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে বাংলাদেশের মানুষের ফুটবলপ্রেম! চলমান কাতার বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ার এই ছোট্ট দেশটিতে যা হচ্ছে তা দেখে অবাক ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ ইউরোপের ফুটবলপাগল জনতা!
"এটা আসলে অনেক বড় রকম একটা পাগলামো!' বলেন বাংলাদেশি নাগরিক সৌমিক। এই মুহুর্তে বাংলাদেশ যে বিশ্বকাপ জ্বরে কাঁপছে তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "যখনই আর্জেন্টিনার খেলা থাকে, আমরা বড় পর্দায় খেলা দেখার আয়োজন করি, তখন এটা প্রায় উতসবের মতো ব্যাপার হয়ে ওঠে।"
তার ভাষ্যে, "বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায়, ম্যাচগুলো বাংলাদেশ সময় রাত ১টার দিকে শুরু হয়। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। রাত একটায়ও হাজার হাজার মানুষ খেলা দেখতে জড়ো হয়, আর্জেন্টিনা যদি জিতে যায় তাহলে রাস্তায় বিজয় মিছিল বের করা হয়। খেলা শেষ হতে হতে তো রাত তিনটা বাজে, সবাই তখন গভীর ঘুমে, রাস্তার সব দোকানপাট বন্ধ। কিন্তু তখনো জেগে থাকেন ফুটবলপ্রেমীরা। এমনকি রাস্তায় ছন্নছাড়ার মতো ঘুরতে থাকা যে কুকুরটা, সেও হয়তো ভাবে যে এত রাতে কেন এত মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে?!"
আপাতদৃষ্টিতে এই গল্প অনেক ফুটবল পাগল মানুষের কাছে পরিচিত মনে হলেও, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা মোটেই সাধারণ কিছু নয়। ১৬৯ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশটি বিশ্ব মানচিত্রে বিখ্যাত তাদের ক্রিকেটের জন্য, ফুটবলের জন্য নয়। ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশিদের ভালোবাসা, পাগলামোর কথা সবারই জানা। কিন্তু ফুটবল নামক ছোট্ট চর্মগোলকটির প্রতিও যে তাদের এত আবেগ, তা এতদিন বিশ্ববাসীর অজানাই ছিল! এমনকি এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পা রাখলে আপনার মনে হতেই পারে আপনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আইরিসে আছেন! কিন্তু কেন? কারণ আশেপাশে যেদিকেই তাকাবেন, সেদিকেই শুধু আকাশি-সাদা পতাকা উড়ছে, আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন শত শত লোক... বিক্রি হচ্ছে মেসি-ম্যারাডোনার পোস্টার এবং আরও অসংখ্য ক্রীড়া সামগ্রী। ১৬ হাজার ৭৬৩ কিলোমিটার দূরের দুটি শহরকে একে অপরের কাছে নিয়ে এসেছে শুধুমাত্র ফুটবল!
কিন্তু বাংলাদেশে যা হচ্ছে তা সত্যিই খুব অদ্ভুত! ঢাকায় পা রাখলেই দেখা যাবে, অগণিত ভবন সেজেছে আর্জেন্টিনার জাতীয় পতাকার আকাশি-সাদা রঙে। নগরীর দেয়ালে দেয়ালে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তী ফুটবলার দিয়েগো ম্যারাডোনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ম্যুরাল। বাড়ির ছাদ, ব্যালকনি থেকে শুরু করে টং দোকান এবং গাড়ির সামনেও লাগানো আর্জেন্টিনার পতাকা। এমনকি পুরোপুরি আর্জেন্টিনা দলের থিমে সাজানো রিকশাও পাওয়া যাবে এখানে, যাতে চড়ে ঘুরে দেখা যাবে ঢাকা শহর, সেই রিকশায় আবার লাগানো থাকবে কোপা আমেরিকা ট্রফি হাতে লিওনেল মেসির ছবি!
বাংলাদেশে পা রাখলেই বাইরের দেশ থেকে আসা যে কেউ বুঝতে পারবেন, বাংলাদেশের এই ফুটবল উন্মাদনা হুট করে জেগে ওঠা কিছু নয়। দিয়েগো ম্যারাডোনা, বাতিস্তুতা, কেম্পেস থেকে আর্জেন্টিনার প্রতি যে ভালোবাসা শুরু হয়েছে তা এখনও লিওনেল মেসি, ডি মারিয়াদের সমর্থনের মাধ্যমে অব্যহত আছে।
কিন্তু এতবছর এই ভালোবাসা ছিল একপাক্ষিক। কিন্তু কাতার বিশ্বকাপে গণমাধ্যম ও অনলাইনের কল্যাণে আর্জেন্টিনাবাসীর কাছে পৌছে গেছে বাংলাদেশের ভালোবাসা। লাল-সবুজের এই দেশে আকাশি-সাদার জয়জয়কার দেখে তারা অভিভূত, মুগ্ধ! আর্জেন্টিনার বাইরেও যে কেউ আর্জেন্টিনাকে এতটা ভালোবাসতে পারে তা হয়তো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তাদের। আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশন ইতোমধ্যেই বাংলাদেশিদের এই সমর্থনকে ধন্যবাদ জানিয়ে টুইটারে পোস্ট দিয়েছে। এরপর আর্জেন্টাইন কোচ লিওনেল স্কালোনির মুখেও বাংলাদেশের প্রশংসা।
সংবাদ সম্মেলনে স্কালোনি বলেছেন, "জাতীয় দলের জার্সি যে আবেগ-ভালোবাসা সংক্রমিত করে তা অবিশ্বাস্য! বাংলাদেশের মানুষ এভাবে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন দিচ্ছে দেখে আমরা গর্বিত।"
অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশ ও ভারতে আর্জেন্টিনার সমর্থকের সংখ্যা খোদ আর্জেন্টিনার চাইতেও বেশি!
তবে এবার বাংলাদেশিদের ভালোবাসার প্রতিদান দিতে শুরু করেছে আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টাইন গণমাধ্যম এল ডেস্টাপে গেল রবিবার বাংলাদেশ বনাম ভারতের ক্রিকেট ম্যাচ সম্প্রচার করেছে। এই ম্যাচে বাংলাদেশ জয়লাভের পর তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টও দিয়েছে এই মিডিয়া আউটলেটটি। বাংলাদেশের প্রতি আর্জেন্টাইনদের আগ্রহ তৈরি হয়েছে বলেই যে এই ম্যাচ দেখানো হয়েছে তা বলাই বাহুল্য! বাংলাদেশি ক্রিকেটার মেহেদি হাসান মিরাজের ছবি পোস্ট করে তারা লিখেছে, "এই অসাধারণ জয়ের জন্য বাংলাদেশকে আর্জেন্টিনার পক্ষ থেকে অভিনন্দন।"
কাতার বিশ্বকাপ আরম্ভের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের একটি টিভি চ্যানেলের সংবাদ উপস্থাপিকা আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে দিয়ে সংবাদ পড়ছিলেন। এই দৃশ্য আর্জেন্টাইনদের নজরে আসে। আরেকজন বাংলাদেশি নাগরিক অর্ধমাইল লম্বা (হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়ছেন!) আর্জেন্টিনার পতাকা বানিয়েছিলেন বিশ্বকাপ উপলক্ষে এবং আরও কিছু সমর্থক মিলে তা নিয়ে মিছিল করেছিলেন ঢাকার রাস্তায়।
এদিকে কাতারের রাজধানী দোহায় আর্জেন্টিনার সমর্থক সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হওয়ার একটি কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, কাতারে বাস করছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অভিবাসী বাংলাদেশি। ব্রাজিল ভক্তদের সংখ্যাও এখানে কম নয়, কারণ আর্জেন্টিনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলটিরও বাংলাদেশে রয়েছে বড় একটি সমর্থক গোষ্ঠী; আর কাতারেও বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছ থেকে সমর্থন পাচ্ছে ব্রাজিল।
এদিকে দোহা থেকে ৩৯২০ কিলোমিটার দূরে, ঢাকায় আগামী ৯ ডিসেম্বর ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ম্যাচ উপলক্ষে নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।
গত বছর কোপা আমেরিকা ফাইনালে যেদিন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয়েছিল, সেদিন দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গিয়েছিল। না, সেই সংঘর্ষ মারাকানা স্টেডিয়ামে বা স্টেডিয়ামের বাইরে হয়নি; হয়েছিল ৯৫০০ মাইল দূরের বাংলাদেশে!
সৌমিকের ভাষ্যে, "এবার ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পুলিশের অবস্থান নিতে হবে আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকদের জন্য আলাদা আলাদা জায়গা বরাদ্দ থাকবে। বাংলাদেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দ্বন্দ্ব প্রবল। যেখানে খেলা হচ্ছে তা থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থান করলেও, ফুটবলের প্রতি, দলের প্রতি ভালোবাসা আমাদের হৃদয়ে।"