মুরগির খামারি, কসাইয়ের ছেলে কিংবা ভবিষ্যৎ কূটনীতিবিদ: অপ্রতিরোধ্য চার ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলারের গল্প
একজন বিশ্বখ্যাত গোলকিপার যার রয়েছে কূটনীতিবিদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। ফুটবল মাঠের একজন উইঙ্গার যিনি একসময় কাজ করতেন মুরগির ফার্মে। আরেকজন মিডফিল্ডার পেরোতে পারেননি স্কুলের গণ্ডিও। অন্যদিকে, দলের একজন ডিফেন্ডার একসময় ক্রোয়েশিয়ান ভাষাই জানতেন না! এমনই কিছু ফুটবলারকে নিয়ে গড়ে উঠেছে ক্রোয়েশিয়ার জাতীয় ফুটবল দল, যারা আজ রাতে খেলবেন কাতার বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে। তাও আবার টানা দ্বিতীয়বারের মতো! কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার এই চার খেলোয়াড় কিভাবে জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বিশ্বমানের তারকা হয়ে উঠলেন এবং সাফল্যের পথে এগিয়ে গেলেন সে গল্প অনেকেরই অজানা।
ইভান পেরিসিচ: মুরগির খামারের কর্মী ফুটবল হিরো
ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ড এই মুহূর্তে ফুটবলের সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ একটি মিডফিল্ড এবং সেখানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য হলেন হলেন ইভান পেরিসিচ। ফুটবল দুনিয়ায় পা রাখার আগে পেরিসিচ কাজ করতেন মুরগির ফার্মে; এরপর খেলেছেন বিচ ভলিবল। জীবনের এই দুটি পর্যায়ের টানাপোড়েনের মধ্যেও ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা লুকিয়ে রাখতে পারেননি পেরিসিচ।
ক্রোয়েশিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী শহর স্পিটের অধিকাংশ পরিবারের মতো পেরিসিচও তাদের স্থানীয় ক্লাব হায়দুকের সমর্থক ছিলেন। পেরিসিচের পরিবারের ছিল মুরগির খামার, ছোটবেলায় বাবার সাথে সেই খামারেই কাজ করতে শুরু করেন পেরিসিচ। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল একটাই- হায়দুক ক্লাবের হয়ে খেলা। তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড় হিসেবে পেরিসিচও ক্লাবটির অন্যতম প্রসপেক্ট ছিলেন, কিন্তু তবুও তাদের হয়ে খেলতে পারেননি তিনি। ২০০৬ সালে ফ্রান্সের সেকেন্ড ডিভিশন ক্লাব সোশোর হয়ে খেলার জন্য প্রস্তাব পান পেরিসিচ। তারা একটি প্রাইভেট জেট পাঠায় পেরিসিচের জন্য এবং হায়দুককে ৩৬০,০০০ ইউরো দেওয়ার প্রস্তাব করে। এই চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর ক্রোয়েশিয়া ছেড়ে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান ১৭ বছর বয়সী পেরিসিচ।
কিন্তু এই সিদ্ধান্ত তার নিজের ছিল না। সোশো থেকে যখন প্রস্তাব আসে তখন পেরিসিচের বাবা দেনায় দায়ে ডুবে ছিলেন, এমনকি তাদের মুরগির খামারের ব্যবসাও লাটে উঠেছিল। পেরিসিচ সোশোতে যোগদানের বিনিময়ে যে টাকা পেয়েছিলেন, সেই টাকা দিয়েই নিজের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন তার বাবা। তাই তিনি ছেলেকে বুঝিয়েসুঝিয়ে ফ্রান্সে পাঠান।
কিন্তু ২০০৯ সালে ফরাসি ক্লাবটিতে যথেষ্ট প্লেয়িং টাইম পাননি পেরিসিচ এবং পরে তাকে বেলজিয়ান ক্লাব রোসেলারেতে ধারে খেলতে পাঠানো হয়। এর এক বছর পর তিনি ক্লাব ব্রুজে যোগদান করেন এবং এখান থেকেই পেরিসিচের আসল প্রতিভা ফুটে উঠতে থাকে।
২০১১ সালে পেরিসিচ ছিলেন বেলজিয়ান লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। ক্রোয়েশিয়ার জাতীয় দলের কোচ স্লাভেন বিলিচের কাছে তিনি প্রায় হাতজোড় করে অনুরোধ করেছিলেন তাকে যেন জাতীয় দলে খেলার সুযোগ দেওয়া হয়। সেসময় পেরিসিচ এও বলেছিলেন যে, "দরকার হলে আমি অনুশীলন সেশনগুলোতে থেকে বল কুড়িয়ে এনে দিবো।" কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা দেখা গেল, জাতীয় দলের হয়ে বল কুড়িয়ে আনার চাইতে অনেক বেশি কিছুই করেছেন এই ফুটবলার।
দমিনিক লিভাকোভিচ: গোলপোস্টের সামনের যোদ্ধা
টাইব্রেকারে ক্রোয়েশিয়ার বহু ম্যাচ জয়ের নায়ক দমিনিক লিভাকোভিচ গোলপোস্টের সামনে দাঁড়ালেই যেন এক অন্য মানুষ, এক লড়াকু যোদ্ধা! কাতার বিশ্বকাপেই বিস্ময়কর সব সেভের মাধ্যমে এরই মধ্যে ক্রোয়েশিয়ানদের মন জয় করে ফেলেছেন লিভাকোভিচ; সেমিফাইনালেও তাকে ঘিরেই ভরসা মডরিচ-পেরিসিচদের। এমন একজন গোলকিপারের পক্ষে কূটনীতিবিদ পেশাকে বেছে নেওয়াটা অনেকের চোখে স্বাভাবিক না লাগলেও, গ্লাভস জোড়া তুলে রাখার পর লিভাকোভিচ আসলে সেটাই চান।
মাত্র ২৭ বছর বয়সে যেভাবে ক্রোয়েশিয়ার ত্রাণকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছেন লিভাকোভিচ, তাতে এটি বিশ্বাস করা কঠিন যে জীবনের শুরু থেকেই ফুটবলার হওয়া তার বাসনা ছিল না! একসময় নিজে বাস্কেটবল খেলতেন এবং অনুশীলনের পর মাঠে থেকে যেতেন স্থানীয় ফুটবলারদের খেলা দেখতে। সেই ফুটবলারদের একজন ছিলেন দানিয়েল সুবাসিচ, ২০১৮ বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার 'হিরো'!
লিভাকোভিচের পরিবার শুরু থেকেই বেশ অবস্থাসম্পন্ন ছিল। বাবা ইঞ্জিনিয়ার এবং ক্রোয়েশিয়া সরকারের সাবেক মন্ত্রী, দাদা ছিলেন ডাক্তার এবং দাদি ছিলেন শিক্ষিকা- তাই সব মিলিয়ে পড়াশোনার দিকেই বেশি ঝোঁক ছিল লিভাকোভিচের।
কিন্তু স্থানীয় একজন ফুটবল কোচ লিভাকোভিচকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন ফুটবলের মাঠে এবং বাস্কেটবল খেলোয়াড়কে উৎসাহ দিয়েছিলেন গোলকিপার হতে! তবে ছোটবেলা থেকেই সুবাসিচের ছায়ায় বেড়ে উঠেছেন লিভাকোভিচ। তাই রাশিয়া বিশ্বকাপে তিনি রিজার্ভ কিপার হিসেবে দলে থাকলেও, কাতার বিশ্বকাপ এখন তার নিজেকে প্রমাণের জায়গা... এবং ইতোমধ্যেই নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েও ফেলেছেন লিভাকোভিচ।
ডায়নামো জাগরেবের হয়ে খেলা এই গোলকিপার বলেন, "আমার পরিবারই এখন সবচেয়ে কম আফসোস করে যে আমি বইয়ের বদলে ফুটবলকে বেছে নিয়েছি। আমার তো মনে হয়, আমি কলেজে যোগদানের সিদ্ধান্ত না নেওয়াতে এখন তারাই সবচেয়ে বেশি খুশি!"
দেয়ান লোভরেন: একসময় বিদ্রুপের শিকার হওয়া ফুটবলার যখন জাতীয় দলে
সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় যুদ্ধের কারণে ক্রোয়েশিয়ান ডিফেন্ডার দেয়ান লোভরেনের মা-বাবা যখন বসনিয়ার শহর জেনিকা থেকে পালিয়ে মিউনিখে আসেন, তখন লোভরেনের বয়স তিন বছর। মিউনিখে তারা শরণার্থী হিসেবে ছিলেন সাত বছর। লোভরেন তার ছেলেবেলায় যুদ্ধের বিভীষিকার আঁচ পাননি। বরং মিউনিখের জীবনটা তার ভালোই কাটছিল- তিনি স্কুলে যেতেন, চমৎকার জার্মান বলতেন এবং স্থানীয় ক্লাবে ফুটবল খেলতেন।
কিন্তু দশ বছর বয়সে পা রাখার পর লোভরেনের জীবন বদলে যায়। জার্মানিতে তার পরিবারকে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয় না এবং সরকার তাদেরকে ক্রোয়েশিয়ায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়, যেখানে তারা মা-বাবার আদি বসতি।
সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লোভরেন বলেছিলেন, "প্রথম দিকে এটা খুব ভয়াবহ ব্যাপার ছিল আমার জন্য। স্কুলে ছেলেরা আমাকে নিয়ে বিদ্রুপ করতো কারণ আমি ভালোভাবে ক্রোয়েশিয়ান ভাষা বলতে পারতাম না। আমি বলতাম কিন্তু তারা আমার কথা বুঝতো না। তবে কয়েক বছরের মধ্যে আমার ভাষাগত উন্নতি হয়। আমার পরিবার থেকে আমি বুঝেছিলাম যে জীবন আসলে এমনই কঠিন।
তারুণ্যের প্রথম দিকে সংগ্রাম করলেও, একসময় লোভরেন তার ফুটবল ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। বলে রাখা ভালো, এযাবত পাচটি দেশের বিভিন্ন ক্লাবে খেলেছেন তিনি। এই মুহূর্তে দেয়ান লোভরেন ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণভাগের অন্যতম শক্তি।
মার্চেলো ব্রোজোভিচ: ফুটবলের জন্য স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলেন যিনি
ক্রোয়েশিয়ান মিডফিল্ডার ব্রোজোভিচের বয়স যখন ১৬ বছর, তখন তার বাবা তার জন্য এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন, যা সচরাচর কোনো বাবা-মা নেন না। পেশায় কসাই ছিলেন এই ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলারের বাবা। তিনি ব্রোজোভিচকে বলেন স্কুল ছেড়ে দিতে। কেন? কারণ স্কুলে থাকলে তিনি ফুটবল দিকে মনোযোগ দিতে পারবেন না।
সেসময় স্থানীয় ক্লাব রভাতস্কি দ্রাগোভোলিয়াকের ইউথ একাডেমিতে ছিলেন ব্রোজোভিচ এবং ক্রোয়েশিয়ান পপ গায়ক নিভেস সেলজিয়ুস ছিলেন তার অনুপ্রেরণা। তবে স্কুল ছেড়ে ফুটবলে মনোনিবেশ করার কৌশল যে শতভাগ উপকারে এসেছে তা ব্রোজোভিচের ক্ষেত্রে মেনে নিতেই হবে।
সূত্র: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস