তারকাঠাসা দল নিয়েও কেন গোলপোস্টে শট নিতে 'অপারগ' ক্রোয়েশিয়া?
লিওনেল মেসির জাদুকরী দক্ষতা এবং আর্জেন্টিনার উদীয়মান তারকা হুলিয়ান আলভারেজের নৈপুণ্যে কাতার বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে ক্রোয়েশিয়া। এবারের বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার সফলতার যাত্রা নিয়ে প্রশ্ন ছিল অনেকের মনে। দুর্দান্ত এক মিডফিল্ড, রক্ষণভাগের শক্তিতে টানা ৯০ মিনিট গোল হজম না করার ক্ষমতা দেখা গেছে তাদের মধ্যে। তাই খোদ আর্জেন্টাইন কোচও ক্রোয়েশিয়াকে নিয়ে শঙ্কায়ই ছিলেন। কিন্তু মাঠের খেলায় দেখা গেছে, ক্রোয়েশিয়ার তারকাঠাসা মিডফিল্ড ছিন্নভিন্ন করে জয় ছিনিয়ে এনেছে আলবিসেলেস্তেরা এবং বিপরীতে একটি গোলও পরিশোধ করতে পারেনি ক্রোয়েটরা। ফলে এই ম্যাচের পর আবারও ফুটবলভক্তদের মনে যে প্রশ্ন জেগেছে, ক্রোয়েশিয়া কি সত্যিই নব্বই মিনিটের খেলায় গোল করতে অপারগ?
স্বাধীন দেশ হিসেবে ১৯৯৮ সাল থেকে বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া ক্রোয়েশিয়া এরই মধ্যে সাতটি টুর্নামেন্টে তিনবার সেমিফাইনালে পৌঁছেছে। মাত্র চার মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ ক্রোয়েশিয়া বরাবরই ফুটবলের প্রতি ইতিবাচক। মিডফিল্ডে প্লেমেকারদের রেখে যেভাবে পজেশনভিত্তিক ফুটবল খেলেছে তারা, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
কিন্তু ২০১৮ সালে তাদের পারফরমেন্স এবং ২০২২ সালে এখন পর্যন্ত তাদের সাফল্যের দৌড় দেখে এখনও প্রশ্ন থেকেই যায় যে ক্রোয়েশিয়া কি সত্যিই ভালো ফুটবল খেলে?
বিশ্বকাপের দুই আসরে ছয়টি নক-আউট ম্যাচে তাদের ফলাফল ক্রমানুসারে- ড্র, ড্র, অতিরিক্ত সময়ে এক গোলে জয়ী, হার, ড্র এবং ড্র এবং সর্বশেষ লিওনেল মেসির দলের কাছে হার। এখানে বলে রাখা ভালো, যে চারটি ম্যাচে তারা ড্র করেছে, সবগুলোই তারা টাইব্রেকারে জিতেছে। সুতরাং যা দেখা যাচ্ছে, ক্রোয়েশিয়ার ট্রাম্প কার্ড হচ্ছে ধীরে ধীরে উন্নতির পথে এগিয়ে যাওয়া; যদিও মাঝেমধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তারা টাইব্রেকারে জয়ে বের করে এনেছে।
এছাড়া, আরও একটি যৌক্তিক প্রশ্ন হলো- চার বছর আগে ফ্রান্সের কাছে হেরে যাওয়া ক্রোয়েশিয়া দলের চেয়ে কাতার বিশ্বকাপের ক্রোয়েশিয়া আরও ভালো নাকি খারাপ ছিল?
ক্রোয়েশিয়ার পারফরমেন্সের কথা বিবেচনা করলে দুর্দান্ত এক টুর্নামেন্ট পার করছেন ক্রোয়েট গোলকিপার ডমিনিক লিভাকোভিচ। কিন্তু কোনো কারণে তাকেও বিচলিত লেগেছে, ছন্দহীন ফুটবল খেলছেন।
এদিকে রক্ষণভাগে বল পায়ে জসকো ভার্দিওল ক্রোয়েশিয়াকে বেশি সাহায্য করেছেন, খেলায় গতি এনে দিয়েছেন। বর্তমান লেফট ব্যাক বর্না সোসা রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলা ইভান স্ট্রিনিচের চেয়ে এবার ভালো পারফরমেন্স দেখিয়েছেন। অন্যদিকে, ২০১৮ বিশ্বকাপে খেলা সাইম ভারসালিকোর বদলে এবার কাতার বিশ্বকাপে মাঠে নামা ডিফেন্ডার ইয়োসিপ জুরানোভিচকে নিয়ে হয়তো সন্দেহ থেকেই যেত, যদি না তিনি ব্রাজিলের বিপক্ষে ভিনিসিয়ুস জুনিয়রকে মার্কিংয়ে রাখতে ব্যর্থ হতেন!
খেলার স্টাইল, মান ও খেলোয়াড়দের বিবেচনায়, কাতার বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ডে গত আসরের চেয়ে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। দলের সবচেয়ে বড় তারকা লুকা মদরিচের বয়স এখন ৩৭ বছর। খেলার নিয়ন্ত্রণে তিনি এখনও বড় রকম প্রভাব বিস্তার করে চললেও, কখনো কখনো ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আর বুধবার আর্জেন্টিনার বিপক্ষেই আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিজের শেষ ম্যাচটি খেলেছেন এই রিয়াল মাদ্রিদ তারকা।
তবে ক্রোয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে তাদের আক্রমণভাগে।
ইভান পেরিসিচ তার খেলার গতি এখনো ধরে রেখেছেন বটে, কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার দুটি পজিশনে দক্ষতার অভাব রয়েছে- আপ ফ্রন্ট এবং রাইটে। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে, আক্রমণভাগে গতি না থাকায়ই এতটা দক্ষ মিডফিল্ডের সুযোগ তারা কাজে লাগাতে পারে না।
বাকী নয়টি পজিশনে ক্রোয়েশিয়ান কোচ দালিচ তার সেরা খেলোয়াড়দের সম্পর্কে জানেন এবং সেখানে তার পরিকল্পনা আগের মতোই রেখেছেন, ব্যতিক্রম শুধু একজন- অসুস্থতার কারণে জাপানের বিরুদ্ধে নক-আউটের ম্যাচে ছিলেন না সোসা; তার বদলে খেলেছেন বর্না বারিসিচ।
চার বছর আগে ক্রোয়েশিয়ার লাইনে ছিলেন মারিও মানজুকিচ এবং রাইট পজিশনে ছিলেন আন্তে রেবিচ। ৩৬ বছর বয়সী মানজুকিচ এখন অবসরে গেছেন, এবছর তিনি ক্রোয়েশিয়ান কোচিং স্টাফদের সাথে আছেন এবং রেবিচ ২৬ জনের স্কোয়াডে জায়গা পাননি।
গ্রুপ পর্বের ম্যাচে মরক্কোর সাথে গোলশূন্য থেকেই বিশ্বকাপ শুরু করেছিল ক্রোয়েশিয়া। দ্বিতীয় ম্যাচে দারুণ খেলে কানাডার বিপক্ষে জয় পায় ক্রোয়েটরা। এটিই বিশ্বকাপের একমাত্র ম্যাচ যেখানে নব্বই মিনিটের খেলায়ই জয়ে পেয়েছে লুকা মদরিচের দল। বেলজিয়ামের সাথে গোলশূন্য ড্র করে গ্রুপের রানার্সআপ হয়ে শেষ ষোলোতে ওঠে ক্রোয়েশিয়া।
নক-আউট পর্বে জাপানের সাথেও ড্র করে টাইব্রেকারে জিতে যাওয়ার পর কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছে ক্রোয়েশিয়া।
ক্রোয়েশিয়ার আক্রমণভাগের খেলায় ছন্দহীন। কানাডা ছাড়া প্রতিটি ম্যাচেও ৯০ মিনিটের তেমন গোলই করতে পারেনি কোচ দালিচের এই দল। তাই সত্যিকার অর্থে প্রতিপক্ষের জন্য ভীতিকর কোনো আক্রমণের চাপই সৃষ্টি করতে পারেনি ক্রোয়েশিয়া।
আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচের আগেও ক্রোয়েশিয়ার কোচ দালিচ বলেছিলেন, তিনি শুধু মেসিকে আটকানোর কৌশলে বিশ্বাসী নন; বরং পুরো আর্জেন্টিনাকেই আটকাতে চান। ম্যাচের শুরুর ৩০ মিনিট, বল দখল ও আক্রমণ সাজানোসহ সবখানে দাপট দেখিয়েছেন মদ্রিচ-পেরিসিচরা। ম্যাচের ফল যাই হোক, সাধারণত বল দখলে এগিয়ে থাকে আর্জেন্টিনা। কিন্তু এই ম্যাচে দেখা গেছে উল্টোটা। ৬১ শতাংশ সময় বল নিজেদের পায়ে রাখে ক্রোয়েশিয়া। বারবার আক্রমণ সাজিয়ে গোলমুখে ১২টি শট নেয় তারা, এর মধ্যে ২টি ছিল লক্ষ্যে। কিন্তু একবারও জালের ঠিকানা মেলেনি।
ভিন্ন কৌশলে খেলা আর্জেন্টিনা এদিন বল দখলে রাখতে পেরেছে মাত্র ৩৯ শতাংশ, যা তাদের নামের সাথে বেমানানই। কিন্তু এই সময়টুকুতেই তারা যেভাবে আক্রমণে গিয়ে ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণদূর্গ তছনছ করে দিয়েছে, সেটা অবিশ্বাস্য। বেশিরভাগ সময়ে পাল্টা আক্রমণে যাওয়া আলবিসেলেস্তেরা গোলমুখে শট নেয় ৯টি, এর মধ্যে সাতটি ছিল লক্ষ্যে। পেনাল্টি থেকে গোল করেন মেসি। পরে জোড়া গোল করেন আলভারেজ।
সম্ভবত নিজেদের ডিফেন্ডারদের নিয়ে বেশ নির্ভার ছিল ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু ভার্দিওলের মতো ডিফেন্ডারকে পেয়ে লিওনেল মেসি তাকে যেভাবে চরকির মতো ঘুরিয়েছেন এবং অবশেষে হুলিয়ান আলভারেজের দিকে বল বাড়িয়ে দিয়ে গোল করিয়েছেন, তাতে ক্রোয়েশিয়ার দুর্বলতা আবারও প্রমাণ হয়ে গেছে।
ফুটবলপ্রেমী মাত্রই জানেন যে পেনাল্টি শ্যুটআউট মানে গোলকিপার ও খেলোয়াড়দের দক্ষতার পাশাপাশি অনেকটা ভাগ্যও প্রয়োজন। কিন্তু একের পর এক পেনাল্টি শ্যুটআউটে জেতাই ক্রোয়েশিয়ার জন্য হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। ক্রোয়েশিয়ানদের পেনাল্টির প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরতা তাদের আক্রমণভাগের দুর্বলতাকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে।
ক্রোয়েশিয়ানরা এমন একটি সংস্কৃতিতে বড় হয়েছে যেখানে খেলায় ড্র করাকে প্রায় ধর্মদ্রোহিতার সমান অপরাধ হিসেবে দেখা হতো একসময়! যুগোস্লাভ ফার্স্ট লিগ, যেটি ১৯৯২ সালে গুটিয়ে যায় এবং ক্রোয়েশিয়ান ক্লাবগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে, সেখানে ক্লাব মৌসুমের নিয়মিত খেলায়ও পেনাল্টি শ্যুটআউট থাকতো। লিগের পয়েন্ট টেবিল নির্ধারিত হতো এক ম্যাচ জয়ে দুই পয়েন্ট এবং পেনাল্টিতে জিতলে এক পয়েন্ট ভিত্তিতে।
ক্রোয়েশিয়ার পেনাল্টি মাস্টারদের সেই ইতিহাস দেখেই হয়তো অনুপ্রাণিত হয়েছে লিভাকোভিচ এবং দেশের রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি তাকে ২০১৮ বিশ্বকাপের গোলকিপার সুবাসিচের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবেও ঘোষণা করেছিলেন বর্তমান কোচ দালিচ। কিন্তু লিভাকোভিচ বীরত্বও সেমি-ফাইনালে ফিকে হয়ে গেছে, গুনে গুনে তিনটি গোল হজম করেছেন তিনি আর্জেন্টিনার কাছে। তাই আগামী বিশ্বকাপে পা রাখার আগে ক্রোয়েশিয়াকে হয়তো তাদের খেলার কৌশল অনেকটাই ঢেলে সাজাতে হবে এবং শুধু পেনাল্টির ওপর নির্ভর না করে, আক্রমণাত্বক খেলে প্রতিপক্ষের জালে গোল দেওয়ার দিকে মনোযোগী হতে হবে।
সূত্র: দ্য অ্যাথলেটিক, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল