বাবা বিছানায়, ভাইয়ের আত্মহত্যা; সাকারিয়া তখন স্বপ্নের পেছনে ছুটছেন
পাঞ্জাব কিংস ও রাজস্থান রয়্যালসের মধ্যকার ম্যাচটি যারা দেখেছেন, তাদের কাছে চেতন সাকারিয়াকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। রান বন্যার ম্যাচেও বল হাতে মুন্সিয়ানা দেখানো ভারতের এই তরুণ পেসার রাতারাতি তারকা বনে গেছেন। ক্রিস মরিস, বেন স্টোকস, মুস্তাফিজুর রহমান, ঝাই রিচার্ডসনদের মতো বোলারদের মাঝে থেকেও স্পট লাইট নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছেন তিনি।
রাজস্থানের বাকি বোলাররা যখন পাঞ্জাব কিংসের ব্যাটসম্যানদের ঝড়ের মুখে, সাকারিয়া তখন দলের কান্ডারি। ৪ ওভারে ৩১ রান খরচায় ৩টি উইকেট তুলে নেন বাঁহাতি এই সুইং বোলার। এরপর থেকেই গুগলের সার্চ ইঞ্জিনে পড়তে থাকে তার নামটি। সেখান থেকে অনেক তথ্যই জেনেছেন ক্রিকেটভক্তরা। কিন্তু সাকারিয়ার জীবন যুদ্ধের অনেক কিছুই ছিল না সেখানে। এক সাক্ষাৎকারে যা জানিয়েছেন তার মা।
সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ টুইট করেছেন ভারতের সাবেক ব্যাটসম্যান বীরেন্দর শেবাগ। যেখানে সাকারিয়ার মা তার পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়া করুণ গল্প শুনিয়েছেন। ২৩ বছর বয়সী তরুণ সাকারিয়ার জীবনে কেমন উত্থান-পতন ছিল, এসব জানলে যে কারও চোখ ভিজে উঠবে।
'অ্যারাউন্ড দ্য উইকেট' নামের এক পডকাস্ট সাক্ষাৎকারে সাকারিয়ার মা বলেছেন, 'আমরা যেমন কষ্টের দিন কাটিয়েছি, আশা করব কাউকে যেন তা কাটাতে না হয়। চেতনের চেয়ে যে এক বছরের ছোট ছিল, আমার মেজ ছেলে, সে মাসখানেক আগে আত্মহত্যা করে। চেতন তখন সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফি খেলছিল। আমরা চেতনকে ওর ভাইয়ের মৃত্যুর খবরটা জানাইনি। জানালে ওর খেলায় খারাপ প্রভাব পড়তে পারতো। ১০ দিন ওকে ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ দিইনি আমরা। ওকে শুধু বলেছিলাম, ওর বাবার শরীর খারাপ।'
পরিবারের দুঃসময়ের গল্প শোনাতে গিয়ে সাকারিয়ার মা আরও বলেন, 'সে সময় ও যখনই ফোন করতো, ওর বাবার সম্পর্কে জানতে চাইতো। ওকে বাবার সঙ্গে কথা বলতে দিইনি। কারণ, তিনি কথা লুকিয়ে রাখতে পারবেন না, বলে দেবেন যে তার ভাই মারা গেছে। ও যখন ওর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইতো, তখন আমি প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলতাম। কিন্তু এক দিন আমি আর সত্য লুকিয়ে রাখতে পারিনি। কাঁদতে কাঁদতে ওর ভাইয়ের মৃত্যুর খবর দিই। ও এক সপ্তাহ আমাদের সঙ্গে কথা বলেনি, কিচ্ছু খায়নি। ওরা দুই ভাই অনেক ঘনিষ্ঠ ছিল।'
সাকারিয়ার ট্রাক ড্রাইভার বাবাও সন্তানের মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে শুয়েই চোখের জল ফেলেন তিনি। সাকারিয়ার মা বলেন, 'ওদের বাবা ছিলেন ট্রাক ড্রাইভার। তিনটি সড়ক দুর্ঘটনায় তিনবার অস্ত্রোপচার হয়েছে তার। এখন বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। উনি এখন আর উপার্জন করতে পারেন না। উনি এখনও ছেলের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কিচ্ছু খান না, কোনো কথা বলেন না।'
এর মাঝেই আলোর দেখা মেলে। মাস খানেক পর আইপিএলে দল পেয়ে যান শাকারিয়া। আবারও নতুন করে স্বপ্নে দেখতে শুরু করে তার পরিবার। সাকারিয়ার মা বলেন, 'এক মাস পর চেতন আইপিএলের চুক্তি পায়, ১ কোটি ২০ লাখ টাকার। মনে হচ্ছিল, আমরা যেন স্বপ্ন দেখছি। আমরা আর্থিকভাবে অনেক কষ্ট করেছি। ছোটবেলায় মামার স্টেশনারি দোকানে কাজ করত চেতন। পাঁচ বছর আগেও আমাদের বাসায় টিভি ছিল না।'
'ক্রিকেটের মাঠে চেতনের উন্নতির খবর ওর বাবা বাইরে থেকে শুনে এসে আমাদের বলতো। আমার স্বামীর অসুস্থতার পর থেকে আমাদের পরিবারের ভার চেতন একাই বহন করে। এতো কিছুর মধ্যে চেতনের আইপিএল চুক্তিটা আমাদের কাছে অনেকটা ক্ষত স্থানে মলম লাগার মতোই মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় আসতে আমার ছেলেকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।'
রাজকোট শহর থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে ভারতেজ নামের এক অঞ্চলে জন্ম নেওয়া সাকারিয়ার ক্রিকেটে আসার গল্পেও ক্লাইম্যাক্সের শেষ নেই। ব্যাটসম্যান হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু স্কুলে থাকতে ব্যাটসম্যানদের কদর নেই দেখে সিদ্ধান্ত বদলে হয়ে যান পেস বোলার। তবে ১৬ বছর পর্যন্ত মেলেনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। নিজে থেকেই বিভিন্ন কৌশল আয়ত্ব করে বোলিং করে যেতে থাকেন তিনি।
শুরুতে সাকারিয়ার লক্ষ্যই ছিল জোরে বল করা। তার কাছে মনে হতো পেসার মানেই গতির ঝড় তুলতে হবে ২২ গজে। কিন্তু তার এই ভাবনাই কাল হয়। জোরে বল করতে গিয়ে এমনই চোটে পড়েন সাকারিয়া যে, দীর্ঘ এক বছর মাঠের বাইরে থাকতে হয় তাকে। এরপর তার গল্প বদলাতে থাকে। এমআরএফ পেস বোলিং ফাউন্ডেশনে অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রার কাছ থেকে শেখার সুযোগ মেলে তার।
সাকারিয়া ২০১৮-১৯ মৌসুম থেকে রঞ্জি ট্রফি খেলতে শুরু করেন। রঞ্জিজয়ী সৌরাষ্ট্র দলে খেলেছেন বাঁহিাতি এই পেসার। তবে তার আইপিএল ভাগ্য খুলেছে সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফি খেলতে গিয়ে। এখান থেকেই রাজস্থান রয়্যালসের কর্মকর্তাদের নজরে পড়েন তিনি। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সও তাকে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু ট্রায়াল থেকে বাদ পড়েন সাকারিয়া। ১ কোটি ২০ লাখ রুপিতে তার ঠিকানা হয় রাজস্থানে। তরুণ এই পেসার ১৫টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন। এ ছাড়া ৭টি লিস্ট 'এ' ম্যাচ ও ১৭টি ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি খেলেছেন তিনি।