সন্ত্রাসী হামলায় পা হারিয়েছিলেন, এবার প্যারালিম্পিক প্রতিযোগী
বিয়েট্রিস ডি লাভালেট যেদিন বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের জাভেনটেম বিমানবন্দরে আমেরিকাগামী বিমানের অপেক্ষা করছিলেন, তার বয়স তখন মাত্র ১৭ বছর। বসন্তের ছুটি কাটাতে সেদিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার কথা ছিল তার।
কিন্তু কিছু সময় পরেই বদলে যায় তার চেনা দুনিয়া। চোখের সামনে শুধুই অন্ধকার দেখছিলেন। টের পাচ্ছিলেন, কেউ তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
দিনটা ছিল ২০১৬ সালের ২২ মার্চ। জাভেনটেম বিমানবন্দরে সেদিন দুটি বোমা হামলা হয়। দুর্ভাগ্যবশত, বিয়েট্রিস সেই আত্মঘাতী হামলাকারীদের একজনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
ব্রাসেলসে সেদিনের হামলায় ৩২ জন নিহত এবং ৩০০ জন আহত হন। বিয়েট্রিস সেই আহতদের একজন। আইসিস পরে এই হামলার দায় স্বীকার করে।
সেদিনই হয়তো শেষ হয়ে যেতে পারত বিয়েট্রিসের সব আশা। নিভে যেতে পারত তার জীবন প্রদীপ। তার কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হয় সবকিছু, 'অন্ধকার, ধোঁয়া আর আগুন... আমার এখনো মনে আছে মুহূর্তটা। চিৎকার করে সাহায্য চাইছিল আশেপাশের মানুষজন। মনে হয়েছিল, আমারও তাই করা উচিত।'
শেষ পর্যন্ত একজন উদ্ধারকারীর নজরে পড়েন তিনি। দ্রুত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দিয়ে তার শরীরের আগুন নেভানো হয়।
দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় মাত্রায় আগুনে পোড়া শরীর, স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি এবং দুই পায়ের নিম্নাংশ কেটে বাদ দেওয়া- এই ছিল বিয়েট্রিসের পরিণতি।
কিন্তু নিজের জীবনকে এখানেই শেষ হয়ে যেতে দেননি তিনি। দুর্ঘটনার পরেও আছে এক নতুন জীবনের গল্প। বিমানবন্দরে সেদিনের বিভীষিকার ছয় বছর পর টোকিও প্যারালিম্পিকে ড্রেসেজ রাইডার হিসেবে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন ২২ বছর বয়সী বিয়েট্রিস। নিজের প্রথম প্যারালিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি।
সেরে ওঠা ও পুনর্জন্ম!
বিয়েট্রিস কথায় ফুটে ওঠে পুনর্বাসনকালের কঠিন দিনগুলো। সেসময় তিনি ঘোড়ায় চড়তে পারতেন না। দীর্ঘ এক মাস কোমায় থাকার পর যখন জ্ঞান ফিরল, তারপর থেকে আইসিইউতে শুয়ে প্রতিদিনই কাঁদতেন।
এর কয়েক মাস পর বেলজিয়ামে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাকে দেখতে হাসপাতালে আসেন এবং ২০১৬ রিও অলিম্পিক নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন।
'তিনি বলছিলেন, টোকিওতে যদি আমি আমার শুরুটা করতে পারি, তাহলে দারুণ হবে! তখন অবশ্য তার কথা অত গুরুত্ব দেইনি। কারণ ওই মুহূর্তে যে অবস্থা ছিল আমার, এসবের কথা ভাবতেও পারিনি,' বলেন বিয়েট্রিস।
তবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন তিনি। আর প্যারালিম্পিকই ছিল তার সেই সুযোগ।
তবে দুর্ঘটনার আগের চেয়ে পরের শারীরিক অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। বিয়েট্রিস বলেন, 'আমার কোনো পেশী ছিল না, শুধু হাড়-চামড়া। তাই ঘোড়ার পিঠে নিয়ন্ত্রণ রাখতে খুবই কষ্ট হয়েছে।'
অন্য রাইডাররা পা দিয়ে তাদের ঘোড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও বিয়েট্রিসের সেই সুযোগ নেই। তাই ঘোড়াকে দিকনির্দেশনা দিতে তিনি একটা চাবুক ব্যবহার করেন।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্যারা ড্রেসেজ দলে যোগ দেন। তার নিজের ঘোড়াটির নাম ডেলেগা-এক্স; যাকে তিনি আদর করে 'ডিডি' বলে ডাকেন। ঘোড়ার সঙ্গে তার বোঝাপড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান তিনি।
তবে সম্প্রতি ডাচ ওয়ার্মব্লাড প্রজাতির ১৪ বছর বয়সী নতুন ঘোড়া 'ক্লার্ক' তার সঙ্গী হয়েছে। গত ৯ মাস ধরে এটি তার সঙ্গে রয়েছে এবং ক্লার্ককে 'অসাধারণ' বলে অভিহিত করেছেন তিনি।
গত জুলাই মাসে বিয়েট্রিসকে জানানো হয়, টোকিও প্যারালিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তাকে নির্বাচন করা হয়েছে। সেই মুহূর্তটাকে এক কথায় 'অলৌকিক-পরাবাস্তব' বলে মনে করেন বিয়েট্রিস। যদিও এটা বিগত বছরগুলোতে তার কঠোর পরিশ্রমের ফল; তবু প্যারালিম্পিকের মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ানোর স্বপ্নই তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়। অবশ্য নিজের পরিবার ও বন্ধুদের সহযোগিতা ছাড়া এত দূর আসতে পারতেন না বলেও জানালেন।
২০১৬ সালের সেই দিনের কথা এখনো মনে পড়ে তার। বিয়েট্রিস বলেন, 'এটা আমার জন্য এক রকম আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার আগে এ ছিল এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন!'
-
সূত্র: সিএনএন