শেষ ওভারে হেরে বাংলাদেশের বিদায়
এশিয়া কাপ মানেই যেন বাংলাদেশের জন্য হৃদয় ভাঙার গল্প। আগের কয়েক আসরে তবু ফাইনালে গিয়ে হতাশা সঙ্গী হয়েছিল। এবার যাত্রাটা অতদূরও পৌঁছালো না। প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে হেরে কোণঠাসা হয়ে পড়া বাংলাদেশ দ্বিতীয় ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হার মেনে নিলো নো বোলের চক্করে পড়ে। মহাগুরুত্বপূর্ণ সময়ে চারটি নো বল করে নিজেরাই যেন নিজেদের হারিয়ে দিলো বাংলাদেশ।
বৃহস্পতিবার দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপে সুপার ফোরে ওঠার ম্যাচে রুদ্ধশ্বাস লড়াই শেষে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২ উইকেটে হেরে গেছে বাংলাদেশ। রোমাঞ্চকর এই জয়ে সুপার ফোরে উঠে গেলে বাংলাদেশ। দুই ম্যাচেই এশিয়া কাপের মিশন শেষ হয়ে গেল সাকিব আল হাসানের দলের।
টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নামা বাংলাদেশকে দারুণ সূচনা এনে দেন ঝড়ো ব্যাটিং করা মেহেদী হাসান মিরাজ। ইনিংস উদ্বোধনের গুরুদায়িত্ব পেয়েই দারুণ এক ইনিংস খেলেন ২০১৮ সালের পর টি-টোয়েন্টি খেলতে নামা ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। এরপর আফিফের খুনে ব্যাটিং ও শেষ দিকে মোসাদ্দেকে হোসেন সৈকতের ছোট ক্যামিওতে ৭ উইকেটে ১৮৩ রান তোলে বাংলাদেশ। যা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাটিতে তাদের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ।
জবাবে দাপুটে শুরু করা শ্রীলঙ্কা দিক হারালেও এক পাশ আগলে খেলে যান ম্যাচসেরা কুশল মেন্ডিস। পরে মহাকার্যকর এক ইনিংস খেলে দলকে জয়ের পথে রেখে ফেরেন অধিনায়ক দানুস শানাকা। শেষটা খুব কঠিন মনে হলেও চামিকা করুনারত্নে ও অভিষিক্ত আসিথা ফার্নান্দো দলকে দারুণ এক জয় এনে দেন। অভিষেক টি-টোয়েন্টি খেলতে নামা আসিথা ৩ বলে ১০ রান তুলে ৪ বল বাকি থাকতেই খেলা শেষ করেন।
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের এশিয়া কাপে এটাই কোনো দলের সর্বোচ্চ সফল রান তাড়া। নিজেদের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের এটা শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সফল রান তাড়া। ১৮৪ রানের লক্ষ্য পেরোতে অবশ্য বাংলাদেশের কাছ থেকে সাহায্যই পেয়েছে লঙ্কানরা। বাংলাদেশ এমন সময়ে গিয়ে চারটি নো বল করেছে যে, প্রতিটা নো বলে অনেকটা করে পথ পিছিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের বোলারদের করা চারটি নো বলই ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ২৯ রান করেই থামতে পারতেন ৬০ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলা কুশল। শেখ মেহেদির বলে তার তোলা ক্যাচ নেন মুশফিকুর রহিম। কিন্তু নো বল হওয়ায় বেঁচে যান তিনি। ১৩তম ওভারের তৃতীয় বলে মেন্ডিসের বিরুদ্ধে কট বিহাইন্ডের আবেদন করে বাংলাদেশ। কিন্তু এবাদতের করা ডেলিভারিটি নো বল দেন আম্পায়ার।
১২ বলে ২০ দরকার দাঁড়ায় শ্রীলঙ্কার, এই ওভারটি করতে আসেন এবাদত। প্রথম দুই বলে চার রান দিয়ে তৃতীয় বলটি নো করেন ডানহাতি এই পেসার। পরে ছন্দ হারিয়ে এই ওভারেই ১৭ রান খরচা করেন তিনি। শেষ ওভারে শ্রীলঙ্কার প্রয়োজন ছিল ৮ রান। প্রথম দুই বলে ৫ রান দেওয়া শেখ মেহেদি তৃতীয় বলটি নো করেন। চার বল বাকি থাকতেই জয় নিশ্চিত হয়ে যায় লঙ্কানদের।
বিশাল লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে উড়ন্ত সূচনা করেন শ্রীলঙ্কার দুই ওপেনার পাথুম নিসাঙ্কা ও কুশল মেন্ডিস। ৫.২ ওভারে ৪৫ রানের জুটি গড়েন এ দুজন। নিসাঙ্কাকে ফিরিয়ে শ্রীলঙ্কার এই জুটি ভাঙেন অভিষিক্ত এবাদত হোসেন। ফেরার আগে ১৯ বলে ২টি চার ও একটি ছক্কায় ২০ রান করেন লঙ্কান এই ওপেনার।
একটু পরই আবার আঘাত হানে এবাদত। ডানহাতি এই পেসারের শিকার এবার চারিথ আসালাঙ্কা। চোখ ধাঁধানো বোলিং টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার শুরু করা এবাদতই শ্রীলঙ্কার তৃতীয় উইকেট তুলে নেন। দলীয় ৬৭ রানে দানুশকা গুনাথিলাকাকে ফিরিয়ে দেন তিনি। দারুণ শুরু পরও এবাদতের তোপে দ্রুত তিন উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় শ্রীলঙ্কা।
১০ রান পরই লঙ্কানদের চাপ আরও বাড়ান তাসকিন আহমেদ। ব্যাট হাতে শেষ দিকে অবদান রাখা ডানহাতি এই পেসার ফিরিয়ে দেন মারকুটে ব্যাটসম্যান ভানুকা রাজাপাকশেকে। ৭৭ রানে ৪ উইকেট হারানো দলের হাল দলেন ওপেনার কুশল মেন্ডিস ও অধিনায়ক দাসুন শানাকা। এই জুটি থেকে ৫৪ রান পায় শ্রীলঙ্কা। এ দুজনের ব্যাটিংয়ে ম্যাচ যখন হাত থেকে ফসকে যাচ্ছিল, তখনই আঘাত হানেন মুস্তাফিজুর রহমান।
বাংলাদেশের বাঁহাতি এই পেসারের এক বাউন্সারে র্যাম্প করে সীমানা ছাড়া করতে পারেননি, বল গিয়ে জমা হয় তাসকিনের হাতে। নো বলে দুইবারসহ পাঁচবার জীবন ফিরে পাওয়া ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান ৩৭ বলে ৪টি চার ও ৩টি ছক্কায় ৬০ রান করে আউট হন। এরপর ৩৩ বলে ৩টি চার ও ২টি ছক্কায় ৪৫ রানের ইনিংস খেলে দলকে অনেকটাই এগিয়ে দেন শানাকা।
আর রোমাঝ্চকর লড়াইয়ের শেষটা করেন চামিকা করুনারত্নে ও আসিথা ফার্নান্দো। করুনারত্নে ১০ বলে ১৬ রান করে রান আউটে কাটা পড়লেও দলকে বিপদে পড়তে দেননি আসিথা। ডানহাতি এই পেসার ৩ বলে অপরাজিত ১০ রান করে দলকে জেতান। এবাদত ৪ ওভারে ৫১ রান খরচায় ৩ উইকেট নেন। তাসকিন নেন ২ উইকেট। এ ছাড়া মুস্তাফিজ ও শেখ মেহেদি একটি করে উইকেট পান।
এর আগে ব্যাটিং করতে নামা বাংলাদেশ এদিন নতুন দুই ওপেনারের ব্যাটে নতুনভাবে শুরু করে। শুরু থেকেই টি-টোয়েন্টি মেজাজের ব্যাটিংয়ের চেষ্টা দেখা যায় সাব্বির ও মিরাজের মধ্যে। উদ্বোধনী জুটি থেকে বেশি রান না পেলেও এদিন ধুঁকতে দেখা যায়নি বাংলাদেশকে। দলীয় ১৯ রানে তুলে মারতে গিয়ে এজ হয়ে উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন তিন বছর পর জাতীয় দলের হয়ে ম্যাচ খেলতে নামা সাব্বির। ৬ বলে একটি চারে ৫ রান করেন তিনি।
এরপর অধিনায়ক সাকিব আর হাসানের সঙ্গে জুটি বাধেন মিরাজ। সাকিবকে এক পাশে রেখে ঝড়ো ব্যাটিং শুরু করেন ডানহাতি এই অলরাউন্ডার। ইনিংস উদ্বোধনে বাংলাদেশের ভাগ্য পাল্টানোর সুযোগ পেয়ে তা ভালোভাবেই কাজে লাগান মিরাজ। দারুণ সব শটে দ্রুত গতিতে দলের রান বাড়িয়ে নিতে থাকেন তিনি। তার মারকুটে ব্যাটিংয়েই পাওয়ার প্লের ৬ ওভার থেকে ৫৫ রান পায় বাংলাদেশ।
দ্বিতীয় উইকেটে সাকিবের সঙ্গে ৩৯ রানের জুটি গড়ে থামেন মিরাজ। ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান ২৬ বলে ২টি করে চার ও ছক্কায় ৩৮ রানের কার্যকরী ইনিংস খেলে লঙ্গান লেগ স্পিনার ভানিন্দু হাসারাঙ্গার বলে বোল্ড হন মিরাজ। এরপর সাকিবকে বেশি সময় সঙ্গ দিতে পারেননি মুশফিকুর রহিম। ৫ বলে ৪ রান করে লঙ্কান পেসার চামিকা করুনারত্নের লাফিয়ে ওঠা বলে ব্যাট চালিয়ে উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান।
এদিন সাকিবকে রান তুলতে সংগ্রাম করতে দেখা যাচ্ছিল। আফিফ হোসেন ধ্রুবর সঙ্গে ২৩ রানের জুটি গড়ার শুরুতে সেভাবে ব্যাটে-বলে করতে পারছিলেন না বাংলাদেশ অধিনায়ক। তবে সময়ের সাথে সাথে মানিয়ে নিয়ে সাবলীল ব্যাটিং শুরু করেন সাকিব, তার ব্যাট থেকে আসতে থাকে বাউন্ডারি। যদিও ইনিংস বড় করা হয়নি তার। ২২ বলে ৩টি চারে ২৪ রান করে আউট হন সাকিব।
সাকিবের বিদায় বুঝতে দেননি আফিফ ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। উইকেটে থিতু হতে একটু সময় নিলেও পরে চার-ছক্কায় দ্রুত রান তুলে পুষিয়ে দেন এ দুজন। দারুণ ব্যাটিংয়ে পঞ্চম উইকেটে ৩৭ বলে ৫৭ রানের জুটি গড়েন আফিফ-মাহমুদউল্লাহ। এই জুটি গড়ার পথে দুজনই দারুণ কিছু শট খেলেন। খুনে ব্যাটিং করা আফিফ ২২ বলে ৪টি চার ও ২টি ছক্কায় ৩৯ রানের ক্যামিও ইনিংস খেলে বিদায় নেন।
আফিফের বিদায়ের দুই বল পর থামেন মাহমুদউল্লাহও। হাসারাঙ্গাকে তুলে মারতে গিয়ে মিড উইকেটে ধরা পড়েন ২২ বলে একটি করে চার ও ছক্কায় ২৭ রান করা অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান। যদিও দ্রুত দুই উইকেট হারানোর চাপ বুঝতে হয়নি বাংলাদেশকে। উইকেটে গিয়েই ঝড় তোলেন আগের ম্যাচে দারুণ ব্যাটিং করা মোসাদ্দেক। কিন্তু শেখ মেহেদির দ্রুত বিদায়ে তাতে ছন্দপতন ঘটে।
তাসকিন আহমেদকে অবশ্য দ্রুতই তা কাটিয়ে ওঠেন। প্রথম বলেই তিন রান নেওয়া বাংলাদেশের পেসার নিজের খেলা পঞ্চম বলে দারুণ এক শটে ছক্কা মারেন। পরের কয়েক বল দারুণভাবে কাজে লাগান মোসাদ্দেক। ৯ বলে ৪টি চারে ২৪ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি। তাসকিন ৬ বলে করেন ১১ রান। শ্রীলঙ্কার হাসারাঙ্গা ও করুনারত্নে ২টি করে উইকেট নেন। একটি করে উইকেট নেন মাদুশাঙ্কা, থিকসানা ও ফার্নান্দো।