বেন স্টোকস: ইডেন গার্ডেন্সের খলনায়ক থেকে মেলবোর্নের রাজা
কার্লোস ব্রাথওয়েটের টানা ছক্কার ঝড় ততোক্ষণে শেষ, ক্যারিবীয় শিবির উল্লাসে উন্মত্ত। একটু দূরেই উইকেটের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে একজন, দুই হাতে মুখ লুকানো। অধিনায়ক ভরসা করে বল হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বল সীমানার মধ্যে রাখতে পারেননি তিনি, আকাশ ছুঁয়ে বলটি বারবার আছড়ে পড়েছে সীমানার ওপাশে। তাতে ইংল্যান্ডের শিরোপার স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ, তার কাঁধে সব দায়।
ক্রিকেটের খোঁজ রাখেন যারা, উপরের বর্ণনায় খুব সহজেই হয়তো তারা বুঝে ফেলেছেন। হ্যাঁ, বোলারের নাম বেন স্টোকস। ছয় বছর আগের সেই ফাইনালে ভারতের ইডেন গার্ডেন্সে ক্যারিবীয় রূপকথায় ইংল্যান্ডের এই অলরাউন্ডারের ঠাই হয়েছিল 'দুঃখিনী' নামে। কিন্তু সেই দুঃখিনী মানুষটিই পরে ইংল্যান্ডের ত্রাতা হয়ে উঠেছেন। বাঁচিয়েছেন অ্যাশেজ সিরিজ, হয়েছেন ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের শিরোপা জয়ের নায়ক।
এবার স্টোকসের হাতে লেখা হলো উপাখ্যান, যে উপাখ্যানে তিনি নায়ক। কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু্। অস্ট্রেলিয়ার ঐতিহাসিক মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে স্টোকস ছুটলেন আলোক বর্তিকা হাতে, দিক হারালেন না একবারও। ম্যাচ জেতানো ইনিংসে বুক ফুলিয়ে হুঙ্কার দিয়ে জানালেন 'এবার আমি পেরেছি, আমরা চ্যাম্পিয়ন।'
মানুষটি স্টোকস বলেই সবাই ফিরে গেলেন ছয় বছর আগে। যে ম্যাচে চার ছক্কা হজম করে রাজ্যের অপবাদ নিয়ে মুখ লুকিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এবার স্টোকস ইংলিশদের উদযাপনের মধ্যমনি। ১৯তম ওভারের শেষ বলে থেকে এক রান আসতেই ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারদের গন্তব্যে পরিণত হন তিনি। নিজে একটু উদযাপন করার পর সতীর্থের আলিঙ্গনে-ভালোবাসায় ভাসেন স্টোকস। ছয় বছর পর এসে যেন দায়মুক্ত হলেন, ইডেন গার্ডেন্সের ভূত তাড়ালেন মেলবোর্নে সবুজ গালিচার বুকে শাসন করে।
পুরো আসরজুড়ে আলো ছড়ানো স্যাম কারান, আদিল রশিদদের বোলিং তোপে পাকিস্তান ১৩৭ রানেই থামে। ছোট লক্ষ্য হলেও ইংল্যান্ডের পথচলা সহজ ছিল না। শুরুতেই উইকেট হারানো ইংলিশরা চাপ কাটিয়ে উঠলেও পরে ফিল সল্ট ও অধিনায়ক জস বাটলারকে হারিয়ে বিপদে পড়ে। সেখান থেকে দলের হাল ধরে শেষ পর্যন্ত লড়াই করেন স্টোকস। খেলেন ৪৯ বলে ৫টি চার ও একটি ছক্কায় ৫২ রানের মহামূল্যবান এক ইনিংস, তাতে সহজেই জয় নিশ্চিত ইংল্যান্ডের।
সাধারণত টি-টোয়েন্টিতে চার-ছক্কার হিসেবটা কর গুণে গুণে করা হয়, ব্যাটসম্যানদের স্ট্রাইট রেটও থাকে সবার রাডারে। সেখানে স্টোকসের ইনিংসে ৪টি চার ও একটি ছক্কা। স্ট্রাইক রেটও টি-টোয়েন্টির মতো নয়, ১০৬.১২। অন্য যেকোনো সময়ে এই ব্যাটিংয়ের কারণে তাকে কাঠগড়ায় তোলা হতো। কিন্তু অবস্থা বিবেচনায় এই ইনিংসটাই এখন সোনার অক্ষরে লেখা। তার ইনিংসটিই যে ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জেতার পথে সবচেয়ে অবদান।
২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ২.৪ ওভারে ১৫.৩৭ গড়ে ৪১ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকেন স্টোকস। যদিও প্রথম দুই ওভারে তার খরচা ছিল ১৭ রান। কিন্তু ইনিংসের শেষ ওভারে হাতে বল পাওয়া স্টোকস চার বলের সবকটিতে হজম করেন ছক্কা। এবারের ফাইনালে ব্যাট হাতে নেতৃত্ব দেওয়ার আগে বোলিংয়েও অবদান রাখেন তিনি। ৪ ওভারে ৩২ রানে নেন এক উইকেট। এরপর ব্যাটিংয়ে কাণ্ডারী হয়ে ছিনিয়ে নেন জয়।
পাকিস্তানের বিপক্ষে শিরোপা জিততে শেষ ১২ বলে ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ৭ রান। যা ১৯তম ওভার থেকেই উঠে আসে। পাকিস্তানের পেসার মোহাম্মদ ওয়াসিমের করা ১৯তম ওভারের শেষ ডেলিভারিটি মিড উইকেট দিয়ে পাঠিয়ে ১ রান পূর্ণ করেন স্টোকস। রান পূর্ণ হতেই নন স্ট্রাইকার লিয়াম লিভিংস্টোন ছুটতে থাকেন স্টোকসের দিকে, দলের বাকি ক্রিকেটাররাও তাই। এরপর চ্যাম্পিয়নের মেডেল পরে স্বপ্নের শিরোপা হাতে চলতে থাকে উদযাপন, যে উদযাপনে সবচেয়ে সুখী মানুষটির নাম বেন স্টোকস।