মেসির হাতে স্বপ্নের শিরোপা, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা
দলের হয়ে দ্বিতীয় গোলটি করে উদযাপনে আকাশে হাত ছুড়তে লাগলেন আনহেল দি মারিয়া। এদিক-সেদিক তাকিয়ে কিছু যেন খুঁজছিলেন, চোখটা ভিজে উঠছিল আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডের। বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জেতার ম্যাচের প্রথম দুই গোলেই তার নাম জড়িয়ে। প্রথমটায় আর্জেন্টিনার স্বপ্নের নায়ক লিওনেল মেসির গোল, দ্বিতীয়টি নিজেই করলেন দি মারিয়া।
কিন্তু ৮০ মিনিটে হঠাৎ বদলে গেল ম্যাচের দৃশ্যপট। যমদূত হয়ে হাজির হলেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। প্রথম গোলটি করলেন পেনাল্টি থেকে, পরেরটি একক কৃতিত্বে। দলকে সমতায় ফিরিয়ে ফরাসী ফরোয়ার্ড ম্যাচ নিয়ে গেলেন অতিরিক্ত সময়ে। এখানেও মেসি-এমবাপ্পে লড়াই। এ দুজনের একটি করে করা গোলে ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে।
যেখানে বরাবরের মতোই নায়ক, ত্রাতা, কাণ্ডারী হয়ে হাজির হলেন আর্জেন্টিনার গোলপোস্টের বাজপাখি এমিলিয়ানো মার্তিনেস। ফিরিয়ে দিলেন একটি শট, ফ্রান্স একবার হারালো পথ। দম বন্ধ করা ম্যাচে টাইব্রেকারে ফ্রান্সকে ৪-২ গোলে হারিয়ে ৩৬ বছর পর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলো আর্জেন্টিনা। আরাধ্যের শিরোপা উঠলো ফুটবল জাদুকর মেসির হাতে, নাম বসলো আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর দিয়েগো ম্যারাডোনার পাশে।
অসাধারণ, অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় কিংবা অন্য কোনো শব্দ। কী শব্দ সেটা? কোনো শব্দ দিয়ে এই ম্যাচকে উপমায় বাধার উপায় কই! প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার দাপটের পর ৮০ মিনিটে ম্যাচের রং পাল্টালো। এরপর প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মুহূর্তে জড়িয়ে থাকলো রোমাঞ্চ। নির্ধারিত সময় ও অতিরিক্ত সময়ের ৩-৩ গোলের সমতা ভুলে নতুন লড়াইয়ে নেমে দীর্ঘ অপেক্ষাকে ছুটিতে পাঠালো আর্জেন্টিনা।
১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনোর বিশ্ব জয়ের শিরোপা উঠলো এমন একজনের হাতে, যার হাতে সোনালী ট্রফিটি দেখতে চেয়েছিলেন খোদ আর্জেন্টিনার ফুটবল ঈশ্বরই। কিন্তু দেখে যাওয়া হয়নি ম্যারাডোনার, তার বিদায়ের দুই বছর পর শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জিতলো আর্জেন্টিনা। ব্রাজিল, ইতালি ও জার্মানির পর প্রথম দল হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তুললো আলবিসেলেস্তেরা।
লড়াইটা মূলত মেসি ও এমবাপ্পের মধ্যেই হয়েছে। আর্জেন্টাইন খুদে জাদুকর গোল গোল করেছেন ২টি, এমবাপ্পে করেছেন ৩টি। যদিও দলকে জেতানো হয় তার। এই দুজনের লড়াইয়ে সমতা অবস্থায় ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়ায়। ৬ গোলের ম্যাচে সমতা থাকলেও বেশিরভাগ সময় ছিল আর্জেন্টিনার রাজত্ব।
প্রথমার্ধে ফরাসীদের পাত্তাই দেয়নি আর্জেন্টিনা। পুরো ৪৫ মিনিট দাপুটে ফুটবলে এমবাপ্পেদের কোণঠাসা করে রাখে লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের দেশটি। ৬০ শতাংশ সময় বল দখলে রাখা আর্জেন্টিনা গোলমুখে শট নেয় ৬টি, এর মধ্যে ৩টি ছিল লক্ষ্যে। আর দুবার মেলে জালের ঠিকানা। এই অর্ধে ফ্রান্স গোলমুখে কোনো শটই নিতে পারেনি।
পুরো ম্যাচের পরিসংখ্যানে বল দখলের ব্যবধান ঘুচলেও আর্জেন্টিনা আক্রমণে অনেক এগিয়ে ছিল। ৫৫ শতাশ সময় বল পায়ে রাখা আলবিসেলেস্তেরা মুহুর্মুহু আক্রমণে গোলমুখে ২০টি শট নেয়, ১০টি ছিল লক্ষ্যে। সমতায় ফিরে খেলায় ধার বাড়ানো ফ্রান্স গোলমুখে ১০টি শট নেয়। তাদের নেওয়া শটের ৫টি ছিল লক্ষ্যে।
২৩তম মিনিটে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। আলভারেজের বাড়ানো বল ধরে বাঁ প্রান্ত দিয়ে দারুণ ড্রিবলিংয়ে ডি-বক্সে ঢুকে যান দি মারিয়া। দলকে বাঁচাতে গিয়ে তাকে ফাউল করেন উসমান দেম্বেলে, পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। স্পট কিক থেকে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন মেসি।
৩৬তম মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করে আর্জেন্টিনা। আলভারেজের পাস ধরে মেসি বল ঠেলে দেন সামনে থাকা ম্যাক আলিস্টারকে। তিনি নিখুঁত এক পাস বাড়ান দি মারিয়াকে, সহজেই বল জালে জড়ান আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড। ২-০ গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় আর্জেন্টিনা। বিরতি থেকে ফিরেও একই ছন্দে খেলতে থাকে তারা।
কিন্তু দি মারিয়া মাঠ ছাড়ার পর ছন্দে ভাটা পড়ে। আর ৮০ তম মিনিটে দুঃস্বপ্ন ঘিরে ধরে আর্জেন্টিনাকে। পেনাল্টি থেকে গোল করে ব্যবধান কমান এমবাপ্পে। কোলো মুয়ানিকে ডি-বক্সের মধ্যে নিকোলাস ওতামেন্দি ফাউল করলে পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। পরের মিনিটেই সমতা টানেন এমবাপ্পে। ডান পায়ের অসাধারণ শটে লক্ষ্যভেদ করেন তিনি। এবারের আসরে এটা তার সপ্তম গোল।
২-২ সমতায় নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ হয়, ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ১০৮তম মিনিটে আবারও এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। লাউতারো মার্তিনেসের জোরালো শট প্রথম দফায় ফেরালেও মেসির ফিরতি শট আর আটকাতে পারেননি ফ্রান্সের গোলরক্ষক হুগো লরিস। ৩-২ গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। যদিও এই স্বস্তি বেশি সময় থাকেনি।
ছয় মিনিট পরই সমতায় ফেরে ফ্রান্স। কোমানের শট ব্লক করতে লাফিয়ে উঠেন আর্জেন্টিনার মন্তিয়েল, বল লাগে তার হাতে। বক্সের মধ্যে থাকায় পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। আবারও স্পট কিক থেকে লক্ষ্যভেদ করেন এমবাপ্পে। হ্যাটট্রিকে পেলের পাশে নাম বসে তার। এবারের আসরে এটা এমবাপ্পের অষ্টম গোল। এই গোলেই মেসিকে ছাড়িয়ে গোল্ডেন বুট জিতে নেন ফরাসী ফরোয়ার্ড। বিশ্বকাপে এমবাপ্পের গোল এখন ১২টি।