পেলে: যাকে একনজর দেখার জন্য থেমে গিয়েছিল যুদ্ধ!
কখনো কী কেউ ভেবেছিল, একজন মানুষকে দেখার জন্য একটা যুদ্ধ থেমে যেতে পারে! সেই অভাবনীয় ঘটনাটিই ঘটেছিল নাইজেরিয়াতে, সেখানে গৃহযুদ্ধ থেমে গিয়েছিল কেবল মাত্র একটি মানুষকে দেখার জন্য, তিনি পেলে।
যখন মন হচ্ছিল, এ যুদ্ধ থামবার নয়, সব ধ্বংস করে তবেই শেষ হবে। ঠিক তখনই, আলোকবর্তিতা হাতে হাজির এক দূত, থামিয়ে দেন গৃহযুদ্ধ। তাকে একনজর দেখার জন্য সব যুদ্ধ ফেলে একত্রিত হয় নাইজেরিয়ার মানুষ। কীভাবে এটি সম্ভব করেছিলেন পেলে?
ভারতের ক্ষেত্রে ক্রিকেট যেমনটা ধর্মের মতোন, ব্রাজিলের জন্য ফুটবল ঠিক তাই। নিজেদের ফুটবল পাগলামিকে শক্তপোক্ত একটা ভিত দেওয়ার জন্য ব্রাজিলের দরকার ছিলো বিশ্বকাপ জেতা। যার জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল একজন নায়কের। বস্তি থেকে উঠে আসা এক কিশোর তাদের সেই নায়কে পরিণত হয়।
১৯৫৮ বিশ্বকাপ জেতানোর পর আরো দুইটি বিশ্বকাপ সে জেতায় ব্রাজিলকে। মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোদের আগে ছিলেন জিদান, রোনালদো নাজারিও, রোনালদিনহোরা। তাদেরও আগে ছিলেন দিয়েগো ম্যারাডোনা, ইয়োহান ক্রুইফরা। আর তাদের সবার আগে ছিলেন আরেকজন, এদসন আরান্তেস নাসিমেন্তো, যাকে সবাই চেনে পেলে নামে।
পেলেই ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় যিনি তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছেন, এই রেকর্ড সুদূর ভবিষ্যতে ভাঙ্গার খুব একটা সুযোগ নেই। পেলেকে নিয়ে অনেক গল্পই প্রচলিত আছে। যার বেশিরভাগই সত্যি।
যেমন আমেরিকার এক সময়ের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সঙ্গে পেলের প্রথম সাক্ষাৎয়ের মুহূর্তের কথাই ধরা যাক। রিগ্যান পেলের হাত ঝাঁকিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, 'আমি রোনাল্ড রিগ্যান, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। আপনার পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সবাই জানে, আপনি পেলে।'
নিজের ক্যারিয়ারে ৭৮৬ ম্যাচ খেলে ৭৫৭ টি গোল করেছেন পেলে। জিতেছেন অসংখ্য শিরোপা, তিনটি বিশ্বকাপ তো আছেই। একজন ফুটবলার ক্যারিয়ারে যা যা পেতে পারেন, তার সবকিছুই পেয়েছেন তিনি। কিন্তু পেলের মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে ফুটবলের চেয়েও বড় জায়গায়।
কীভাবে পেলে একটি যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিলেন সেই গল্প বলা যাক-
পেলে তখন খেলতেন ব্রাজিলের ক্লাব সান্তোসের হয়ে। ১৯৬৯ সালে, সান্তোস আফ্রিকাতে ভ্রমণ করে প্রীতি ম্যাচ খেলার জন্য। নাইজেরিয়াতে তখন গৃহযুদ্ধ চলছিল পুরোদমে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সান্তোস নাইজেরিয়া খেলার সিদ্ধান্ত নেয়।
নাইজেরিয়া জাতীয় দলের বিপক্ষে সেই ম্যাচ খেলা নিশ্চিত হওয়ার পর সবাই যখন জানতে পারল, তারা পেলেকে চোখের সামনে দেখতে পারবেন, ৪৮ ঘন্টার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়! এই যুদ্ধবিরতির উদ্দেশ্য ছিল, পেলে যেন নির্বিঘ্নে ম্যাচটি খেলতে পারেন এবং সবাই যেন তাকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে।
পেলের এক সতীর্থ, লিমা বলেন, লোকজন নিজেদের মাথায় করে চেয়ার নিয়ে এসেছিল। যেন তারা পেলেকে দেখতে পারে।
একজন ফুটবলার হয়েও তিনি গৃহযুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিলেন। কী তার মাহাত্ম্য! কী তার কারিশমা! পেলেকে যিশু খ্রিস্টের সঙ্গে তুলনা দেওয়া হতো। এ নিয়ে পেলে মজা করে বলেছিলেন, 'পৃথিবীতে এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে যিশু খ্রিস্টকে খুব বেশি মানুষ চেনে না!'
পেলেই প্রথম মানুষ, যিনি ফুটবলকে 'সুন্দরতম খেলা' হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। কারণ, ফুটবল শুধুমাত্র মাঠের খেলাতেই সীমাবদ্ধ নয়। ফুটবল জাত, ধর্ম, বর্ণ, অর্থ সবকিছুকে ছাপিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। এমনকি যুদ্ধও থামিয়ে দিতে পারে ফুটবল, ঠিক যেমনটা করেছিলেন পেলে।