সৌরভে সুরভিত মেয়র কাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়ার ১৫ বছর হয়ে গেছে। কলকাতা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের (সিএবি) প্রধান হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করা সৌরভ গাঙ্গুলি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) সভাপতি হিসেবেও নিজের সাংগঠনিক দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। তার পরিচয় এখন ক্রিকেট প্রশাসক, কিন্তু এতোদিনেও জনপ্রিয়তায় এতোটুকু টান পড়েনি। ইডেন গার্ডেন্সে কোনো ম্যাচ চলাকালীন প্রিন্স অব কলকাতার দেখা মিললে গ্যালারিতে উল্লাসের জোয়ার বয়ে যায়। 'দাদা, দাদা' ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে গ্যালারি।
প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশেও তুমুল জনপ্রিয় গাঙ্গুলি, ৫০ বছর বয়সী ভারতের সাবেক এই অধিনায়কের জন্য আবেগটা যেন আগের মতোই রয়ে গেছে এখানকার ক্রিকেটমোদীদের। বাংলাদেশে গাঙ্গুলির আগমনের খবরে হইচই পড়ে গিয়েছিল, শুরুর অনেক আগেই জনাকীর্ণ হয়ে ওঠে অনুষ্ঠানের ভেন্যু। গাঙ্গুলি উপস্থিত হওয়ার পর মিডিয়াকর্মীদের দৌড়াদৌড়ি, অতিথিদের অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা আর বাংলাদেশের সাবেক খেলোয়াড়দের উচ্ছ্বাস বলে দিচ্ছিলো ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ককে ঘিরে এখনও কতোটা আগ্রহ সবার মাঝে।
একদিনের সফরে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন গাঙ্গুলি। একটি ব্যাংকের প্রতিশ্রুতি মেটাতে বাংলাদেশে আসা সাবেক এই ক্রিকেটার আগে অবশ্য অংশ নেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন আয়োজিত মেয়র কাপের দ্বিতীয় আসরের উদ্বোধনী ঘোষণা অনুষ্ঠানে। মেয়র কাপের শুভেচ্ছাদূত করা হয়েছে তাকে। ৯ বছর পর বাংলাদেশে এসে উষ্ণ অভ্যর্থনা পাওয়া গাঙ্গুলি অনুষ্ঠানে ঘণ্টা দুয়েক সময় কাটান। অনুষ্ঠানের প্রায় পুরোটাই সাজানো হয় তাকে কেন্দ্র করে। বেশিরভাগ আয়োজনই ছিল তাকে ঘীরে।
গতবার প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে মেয়র কাপ। দ্বিতীয় আসর আয়োজনের প্রায় সবকিছুই চূড়ান্ত। ক্রিকেট, ফুটবল ও ভলিভলের এই টুর্নামেন্ট শুরুর তারিখ শিগগিরই জানানো হবে। সফলভাবে প্রথম আসর সম্পন্ন করায় এবার শুরুর আগেই চমক দেওয়ার পরিকল্পনা সাজায় আয়োজকরা। যে চমকের কথা শুনে অনুষ্ঠানে হাজির হন রাকিবুল হাসান থেকে শুরু করে গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, আতহার আলী খান, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, আকরাম খান, হাবিবুল বাশার, খালেদ মাসুদ পাইলটরা পর্যন্ত।
ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে পৌঁছাতেই মিডিয়াকর্মীদের ভিড়ের মধ্যে পড়ে যান গাঙ্গুলি। নিরাপত্তা দিয়ে তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হয় অনুষ্ঠান। শুরুতে ঝলমলে আলোয় মেয়র কাপের একটি লাইভ ফ্ল্যাশমব প্রদর্শন করা হয়, এতে অংশ নেওয়া সবার গায়েই ছিল গাঙ্গুলি রেখা জার্সি। এরপর মেয়র কাপের আগের আসর নিয়ে তৈরি করা একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়।
কলকাতার মহারাজার ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়েও আয়োজকরা একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছে, বড় পর্দায় সেটা দেখানো হয়। এরপর তাকে নিয়ে তৈরি করা গান, 'দাদা, দাদা, ইউ আর দ্য বেস্ট, দাদা উই লাভ ইউ' গানে নৃত্য পরিবেশনা হয়। পরের অংশে গাঙ্গুলির হাতে শহরের চাবি (রূপক অর্থে) তুলে দেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। ভিন্ন ভিন্ন নম্বর সম্বলিত তিনটি জার্সিও উপহার দেওয়া হয় প্রিন্স অব কলকাতাকে।
মেয়র কাপের উদ্বোধনী ঘোষণার আয়োজনে গাঙ্গুলিকে পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন আতিকুল ইসলাম। বক্তৃতার এক অংশে তিনি বলেন, 'সৌরভ দাদা, তুমি এসে আমাদের যে আনন্দ দিলে, আমরা সত্যিই আনন্দিত, আমরা দিশেহারা। এতো সহজে তোমাকে আমরা আমাদের মাঝে পেয়ে যাবো, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি যখন দাদাকে বললাম, 'তোমাকে এখানে আসতে হবে মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে, তরুণদের আগামীর পথ ঠিক করতে"। সাথে সাথে দাদা বললো, 'আমি আসবো, কিন্তু একটা টাকাও নিবো না।'
আয়োজন, তার প্রতি এখানকার মানুষের আবেগ, ভালোবাসা দেখে আপ্লুত গাঙ্গুলিও। অনুষ্ঠানের শেষভাগে কথা বলা সাবেক ভারতীয় অধিনায়ক বলেন, 'আমি বহুদিন ধরে যাদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলেছি আকরাম (খান), আতহার (আলী খান), (খালেদ মাসুদ) পাইলট আছে। আমি অনেক দিন পর এলাম ঢাকায়। সবশেষ এসেছিলাম (২০১৪) টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়, যেবার শ্রীলঙ্কার কাছে ফাইনালে হারে ভারত। তখনই শেষ ঢাকায় এসেছিলাম। বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাওয়ায় এরপর আর সময় হয়ে ওঠেনি এখানে আসার। তবে একটা কথা আমি বলি, যতবারই আমি এখানে আসি, এতো মানুষের ভালোবাসা পাই যে, বুঝতে পারি না এটা ভারত না বাংলাদেশ। আমাকে এতো ভালোবাসা, এতো নিজের মনে করার জন্য আমার তরফ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা।'
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আসার স্মৃতি রোমন্থন করে গাঙ্গলি বলেন, 'আমার যতদূর মনে পড়ে, বাংলাদেশে আমি প্রথম আসি ১৯৮৯ সালে। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে এশিয়া কাপ খেলতে এসেছিলাম। সেই থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। প্রচুর মানুষ বন্ধু আমার। (ইফতেখার রহমান) মিঠুর কথা শুনলেন। সেই দিন থেকে আমার বন্ধু। দশ বছর আমি বাংলাদেশে আসিনি। তবে তার সঙ্গে, তার পরিবারের সঙ্গে ও বাকি বন্ধুদের সঙ্গে প্রায়ই আমার দেখা হতো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।'
বাংলাদেশ অভিষেক টেস্ট খেলে ভারতের বিপক্ষে। ম্যাচটি ছিল অধিনায়ক হিসেবে গাঙ্গুলির প্রথম। সে কথা মনে করে তিনি বলেন, 'আমার প্রথম টেস্ট অধিনায়কত্ব বাংলাদেশের মাটিতে। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সঙ্গে আমার নাম সব সময় জড়িয়ে থাকবে। কারণ ওটা ছিল বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচ, ২০০১ সালে (আসলে ২০০০)। আর আমার প্রথম টেস্ট, ভারতের অধিনায়ক হিসেবে।'
'আমার এখনও মনে আছে, তখনও নতুন স্টেডিয়াম হয়নি। পুরনো স্টেডিয়াম, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে খেলা হয়েছিল। বাংলাদেশ মনে হয় প্রথম ইনিংসে লিড নিয়েছিল। তারপর যখন ড্রেসিং রুমে ঢুকি আমি, আমার মনে হলো, 'এ কী! আমি অধিনায়ক হিসেবে আমার প্রথম ম্যাচ হেরে যাব!' তারপর আমরা ফিরে এসে টেস্ট ম্যাচটা জিতি।' যোগ করেন তিনি।
সবশেষে গাঙ্গুলি বলেন, 'সবাইকে অনেক শুভেচ্ছা, অনেক ভালোবাসি। তোমরা এ রকমই থাকবে, তোমরা ভালো থাকো। আবার বলি, যতবার আমি বাংলাদেশে আসি, আমার অসাধারণ লাগে। এতো মানুষের ভালোবাসা, ভালোবাসা মানে সত্যিকারের ভালোবাসা। এসব দেখে আমি সত্যিই আপ্লুত হই। আপনারা সবাই ভালো থাকবেন।'