বাফুফের আর্থিক অনিয়ম: যেসব প্রশ্ন করেছে ফিফা
আর্থিক অনিয়মের দায়ে বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে ফিফা। সেইসাথে দশ হাজার সুইস ফ্রাঁ জরিমানা করা হয়েছে তাকে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১১ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ফিফার কাছে জাল কাগজপত্র পাঠিয়েছেন সোহাগ। বাফুফেকে দেওয়া ফিফার টাকার হিসাবে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, ফিফার ২০২০ সালের 'কোড অফ এথিকস'র ১৩, ১৫ এবং ২৪ নং নিয়ম ভঙ্গ করেছেন বাফুফে সাধারণ সম্পাদক।
বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ যে সব কারণে ফুটবলীয় কার্যক্রম থেকে নিষিদ্ধ হয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম ফিফা ফরোয়ার্ড ফান্ডের অর্থের অপব্যবহার।
নিয়মানুযায়ী, ফরোয়ার্ড ফান্ডের অর্থ খরচের নির্দিষ্ট কিছু খাত আছে। ফিফার নিয়মে, এই অর্থ নির্দিষ্ট একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখা বাধ্যতামূলক। লেনদেনও শুধু সেখান থেকেই করার নিয়ম। ফিফার তদন্তে এখানেই তিনটি বড় ধরণের অনিয়ম দেখা গিয়েছে।
এর মধ্যে আছে ফিফার তহবিলের জন্য নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা নগদে উত্তোলন করা, ফিফা সম্পর্কিত প্রকল্প বা প্রোগ্রামে অন্য অ্যাকাউন্টের টাকা ব্যবহার এবং ফিফা তহবিলের টাকা ভিন্ন খাতে ব্যয় করা।
ফিফার নৈতিকতা বিষয়ক কমিটি বেশ কিছু লেনদেন বিশ্লেষণ করে ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৮৪ মার্কিন ডলার লেনদেনে আর্থিক অসঙ্গতি খুঁজে পেয়েছে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ কোটি ৪০ লাখ টাকার বেশি। এটি যাচাইকৃত লেনদেনের ১৭.৭৩ শতাংশ। কোনোভাবেই এই অংককে তুচ্ছ বিবেচনা করা যায় না বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া ২০১৬ সালে ফিফা ফান্ডের মাত্র ১২.৬৯ শতাংশ সঠিকভাবে লেনদেন করা হয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
যা পেয়েছে ফিফা
ফরোয়ার্ড নীতিমালা প্রতিপালনে বাফুফে ক্রমাগত ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে ফিফার প্রতিবেদনে।
ফিফা ফরোয়ার্ড ফান্ডের অর্থ সদস্য অ্যাসোসিয়েশন যথাযথভাবে খরচ করছে কিনা, এ নিয়ে প্রতি বছর কেন্দ্রীয় পর্যালোচনা করে ফিফা।
ইনভেস্টিগেটরি চেম্বারের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, ফান্ডের খরচের আওতায় থাকা খাতে নির্ধারিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বদলে বাফুফের নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে খরচ করা হয়েছে। যেমন ২০১৬ সালের কেন্দ্রীয় পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওই বছর ফিফা ফরোয়ার্ড ফান্ডে ৭ লাখ ৮ হাজার ৮২০ ডলার পেয়েছিল বাফুফে। এর মধ্যে মাত্র ৯০ হাজার ১৪ ডলার ফিফা নির্ধারিত অ্যাকাউন্ট থেকে খরচ করা হয়। যা ফিফার দেওয়া অর্থের মাত্র ১২.৬৯ শতাংশ।
এ ক্ষেত্রে কিছু উদাহরণও তুলে ধরা হয়েছে। যেমন:
* নারী ফুটবলে ভ্রমণ ও বেতন বাবদ ১ লাখ ৭ হাজার ৬৩৪ ডলার খরচের কোনো সহায়ক কাগজপত্র দেখানো হয়নি।
* জাতীয় দলের কোচ ও টেকনিক্যাল ডিরেক্টরকে ৪৪ হাজার ১০০ ডলার বেতন নগদ দেওয়া হয়েছে। আবার বাফুফের ব্যাংক রেকর্ডে দেখা যায়, এই বেতন ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। যাতে মনে হচ্ছে, এই বেতন দুইবার দেওয়া হয়েছে।
* ২০১৪ ও ২০১৫ সালের প্রশাসনিক খরচ বাবদ ৩৫ হাজার ৫৭৩ ডলার খরচের কথা ২০১৬ সালেও উল্লেখ করা হয়। এখানেও দুইবার পরিশোধের ব্যাপার থাকতে পারে।
* বাংলাদেশের ফুটবল ক্লাবগুলোকে ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩৫ ডলার ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিল। যেটা ফিফা ফরোয়ার্ড নীতিমালার অংশ নয়, ফিফার সঙ্গে সম্মতিক্রমেও হয়নি। এই অর্থ বিতরণের পক্ষে যথাযথ প্রমাণও নেই, যার মধ্যে ৫৩ হাজার ৫৮৮ ডলার নগদ দেওয়া হয়েছে ।
এইসব অনিয়মের দায়ে ফিফার অডিট এন্ড কমপ্লায়েন্স কমিটি বাফুফেকে দেওয়া ফান্ড স্থগিত করে এবং ২০১৭ সালে একটি কর্ম-পরিকল্পনা ঠিক করে দেয়। কর্ম-পরিকল্পনা অনুসারে বাফুফেকে নগদ পরিশোধ ন্যুনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছিল। নগদ লেনদেন যা হবে, সেটিও যেন ফিফার সম্মতি সাপেক্ষে হয়।
কিন্তু ইনভেস্টিগেটরি চেম্বারের তদন্তে দেখা যায়, ২০১৭ ও ২০১৮ সালের কেন্দ্রীয় পর্যালোচনায়ও নগদ ব্যবহারের একই অবস্থা দেখা গিয়েছে। যার জেরে ফিফার অডিট এন্ড কমপ্লায়েন্স কমিটি ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে অর্থ ছাড়ে আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ২০১৯ সালের পর্যালোচনায় পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি ঘটে। নিষেধাজ্ঞাও আংশিকভাবে তুলে নেওয়া হয়। তবে ইনভেস্টিগেটরি চেম্বার দেখতে পায়, ফিফা ফান্ডে নগদ পরিশোধের ঘটনা আবারও ঘটেছে।
ফিফার নিয়োগ করা নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান বিডিওর ২০১৭-২০২০ নিরীক্ষায় দেখা যায়, ফিফা ফরোয়ার্ড ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অর্থ ফিফা সম্পর্কিত খাতে ব্যয় করার কথা থাকলেও সেটি অনুসরণ করা হয়নি। ফরোয়ার্ড প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত নয়, এমন খাতের জন্য নগদ টাকা তোলা হয়েছে।
কী উদ্দেশ্যে নগদ টাকা তোলা হয়েছে সেই ব্যাখ্যা বা প্রমাণপত্র বাফুফের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। বাফুফে নগদ খরচের যে হিসাব দিয়েছে, তার সঙ্গে তুলে নেওয়া নগদ অর্থের বড় অসঙ্গতিও পেয়েছে ফিফা। যার পরিমাণ ৫ লাখ ৬১ হাজার ৮৬৫ ডলার।
ফিফার প্রতিবেদনে এই বিষয়ে বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগের ব্যাখাও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যেখানে সোহাগ বলেছেন, 'অনেক সময় স্পন্সরদের থেকে সময় মতো টাকা পাওয়া যায় না। কিন্তু বিভিন্ন টুর্নামেন্ট ও অনুষ্ঠান সময়মতোই আয়োজন করতে হয়। এ ধরনের ঘটনায় বাফুফের সিদ্ধান্তে সাময়িকভাবে ফিফা ফান্ড থেকে অর্থ নিয়েছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেও আমরা স্পন্সরদের অর্থ পাইনি। তখন আমাদের ব্যাংক ও নির্বাহী কমিটির সদস্যদের থেকে ধার নিতে হয়েছে। এসব অর্থ আমরা বাফুফের অন্য অ্যাকাউন্টে জমা রেখেছি। ওই সব অ্যাকাউন্ট থেকে ফিফা অনুমোদিত বাজেটের মধ্যে খরচ করা হয়। আমরা ফিফা অ্যাকাউন্ট থেকে শুধু ধার হিসেবে অর্থ নিয়েছি ।'