বব মার্লের ফুটবল প্রেমী কন্যা যেভাবে জ্যামাইকার নারীদের জীবন বদলে দিয়েছেন
সঙ্গীতশিল্পী বব মার্লের কন্যা সেডেলা মার্লে বর্তমানে নিজেকে যুক্ত করেছেন নারী ফুটবলে। তবে তার ফুটবলের সাথে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি একদম হুট করেই ঘটেছে, এমনটি নয়। বরং বিশ্ব সংগীত থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অঙ্গনে রীতিমতো তারকা বনে যাওয়া বব মার্লে নিজেও ছিলেন একজন ফুটবল প্রেমী। তাই ছোটবেলা থেকেই কমবেশি ফুটবলের সংস্পর্শে ছিলেন সেডেলা।
সিএনএন স্পোর্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেডেলা জানান, তার বাবা অর্থাৎ বব মার্লে বলতেন যে, তিনি সঙ্গীতশিল্পী না হলে হয়তো একজন ফুটবলার হতে চাইতেন।
সেডেনা বলেন, "বাবা প্রতিদিনই ফুটবল খেলতেন। তিনি যেখানেই যেতেন, সেখানেই খেলতেন। সেটা রাস্তায়, মাঠে কিংবা দলের সাথে যেভাবেই হোক না কেন।"
সেডেলা নিজেও যদিও ফুটবল খেলতে ভালোবাসতেন, তবে জ্যামাইকাতে নারী হিসেবে তার ফুটবল খেলার তেমন সুযোগ ছিল না। তাই শৈশবে তার বাবা ও ভাইদের সাথেই টুকটাক নামমাত্র ফুটবল খেলেছেন তিনি।
কিন্তু ২০১৪ সালে সেডেলার জীবনে ঘটে বিরাট এক পরিবর্তন। একদিন সন্তান স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মা সেডেলাকে একটি প্রচারপত্র হাতে দেন। ছেলে জানান, এটি স্কুল শিক্ষক তার মা-কে দিতে বলেছেন।
প্রচারপত্রটি পড়ে সেডেলা জানতে পারেন, জ্যামাইকাতে ফের গঠিত হতে যাচ্ছে নারী ফুটবল দল! ২০০৮ সালে অর্থ সংকটে জ্যামাইকার ফুটবল ফেডারেশন নারী ফুটবল দলটি বন্ধ করে দিয়েছিল।
প্রচারপত্রটিতে নারী ফুটবল দলের কার্যক্রম শুরু করতে অর্থ সহযোগিতার অনুরোধ করা হয়েছিল। এটি দেখেই সেডেলা দ্রুত ফুটবল ফেডারেশনকে ফোন করে তাদের প্রয়োজন সম্পর্কে জানতে চান।
মূলত ফের নারী ফুটবল দলের কার্যক্রম শুরু করতে বহু জিনিসের প্রয়োজন ছিল। ভ্রমণ, পুষ্টিকর খাবার, আবাসন, ট্রেনিং ক্যাম্প ইত্যাদির ব্যবস্থা করার জন্য প্রয়োজন ছিল বহু অর্থের।
এক্ষেত্রে নারী ফুটবল দলকে সহযোগিতার জন্য সেডেলা সংগীতকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "এই কাজে আমার সাথে সাথে আমার পরিবারের সদস্যরাও এগিয়ে আসেন। আমার দুই ভাই এবং আমি মিলে ফান্ড সংগ্রহের জন্য 'স্ট্রাইক হার্ড' নামের একটি গান তৈরি করি।"
গানটি থেকে অর্জিত অর্থ, বব মার্লে ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় স্পন্সর যোগাড় করা ও 'গো ফান্ড মি' নামের একটি অনলাইন উদ্যোগের সহযোগিতায় সেডেলা প্রথম বছরেই প্রায় ৩ লাখ মার্কিন ডলারের সহায়তা তুলতে সক্ষম হন।
তবে দুর্ভাগ্যবশত ২০১৬ সালে ফের দেশটির নারী ফুটবল দলটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু হাল ছাড়েননি সেডেলা। ২০১৯ সালে তার নিরলস প্রচেষ্টা ও অন্য আরও বহু মানুষের চেষ্টায় প্রথম ক্যারিবিয়ান দেশ হিসেবে জ্যামাইকা নারী ফুটবল বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার যোগ্যতা অর্জন করে।
সেডেলার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শুধু দেশটির নারী ফুটবলারদের মান উন্নয়ণ হয়েছে এমনটিই নয়। বরং একইসাথে নারী ফুটবল দলের প্রতি দেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হয়েছে।
এ বিষয়ে সেডেলা বলেন, "জ্যামাইকাতে একটা দীর্ঘ সময় ধরে বলা হতো যে, ফুটবল খেলা নারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানে এটা কোনো কাজে আসবে না। নারীরা ফুটবল খেললে টাকা আসে না, দর্শকের ভিড় হয় না ইত্যাদি।"
সেডেলা আরও বলেন, "কোনো প্রতিষ্ঠানই নারী ফুটবল দলের ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হতে চাইতো না। কিন্তু এটা খুব মজার যে, বর্তমানে একটা বিশাল পরিবর্তন এসেছে। এমনটা আমাদের দেশের নারীদের ক্ষেত্রেই নয়, বরং পুরো বিশ্বের নারীদের ক্ষেত্রেই। এটা আমাকে বেশ উচ্ছ্বাসিত করে।"
মূলত সেডেলা সাক্ষাৎকারটি নেদারল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত জ্যামাইকার নারী ফুটবল দলের প্রি-ওয়ার্ল্ড কাপ ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে দিয়েছেন; যেটা আয়াক্স ও অ্যাডিডাসের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে একটি ফুটবল দলের ট্রেনিংয়ের জন্য প্রায় সকল সুযোগ-সুবিধা ছিল।
সেডেলা জানান, ট্রেনিংয়ে ফাস্ট ক্লাস জিম, সুইমিং পুল, বাস্কেটবল কোর্ট, স্পোর্টস কমপ্লেক্স ইত্যাদি সবই রয়েছে। বিশ্বকাপের জন্য জ্যামাইকান খেলোয়াড়দের সেরা প্রস্তুতি গ্রহণের এটাই ছিল মোক্ষম সুযোগ।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে চলমান ফুটবল বিশ্বকাপে আগের বিশ্বকাপ দলের ১১ জন খেলোয়াড় রয়েছে। সেখানে নতুনদের সাথে অভিজ্ঞদের নিয়ে দল গড়ায় নারী ফুটবল দলের প্রতি দেশের জনগণের আশাও আরও বেশি।
২০১৯ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত নারী বিশ্বকাপে ইতালি, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রাজিলের সাথে বেশ শক্ত গ্রুপে পড়েছিল জ্যামাইকা। ফলে ঐ বিশ্বকাপে দলটিকে টানা তিনটি ম্যাচই হেরে বিদায় নিতে হয়েছিল।
তবে বর্তমানে জ্যামাইকার নারী ফুটবল দলটি বহু তারকায় সমৃদ্ধ। এই দলে রয়েছে ম্যানচেষ্টার সিটির তারকা ফুটবলার খাদিজা শ। তিনি গত সিজনে উইমেন্স সুপার লিগে মোট ২০ গোল করেছেন।
সবমিলিয়ে ২০১৯ সালে ব্যর্থতার পর গত চার বছরে জ্যামাইকার নারী ফুটবল দলে বেশ অগ্রগতি করেছে। যার ফলাফল মিলেছে হাতেনাতেই।
ঐ সাক্ষাৎকারে সেডেলা বলেছিলেন, "আমরা বিশ্বকাপে যেতে চাই এবং জিততে চাই।"
এবারের বিশ্বকাপে মূলত ব্রাজিল, ফ্রান্স ও পানামার গ্রুপে রয়েছে জ্যামাইকা। সেক্ষেত্রে নক আউট পর্বে জন্য ওঠা দলটির জন্য বেশ কঠিন হবে বলেই মনে করা হচ্ছিল। তবে ইতোমধ্যেই দলটি প্রথমে ফ্রান্সের বিপক্ষে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ম্যাচে গোলশূন্য ড্র করে বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথম পয়েন্ট অর্জন করেছে জ্যামাইকা।
সাক্ষাৎকারে সেডেলা বলেন, "আমাদের মেয়েদের খেলা দেখাটা বেশ সৌন্দর্যের ব্যাপার। আমি আপনাকে অন্তত এটা বলতে পারি যে, ওরা নিজেদের লক্ষ্যে বেশ দৃঢ়। তারা সেখানে যুদ্ধ করার মতো মনোভাব নিয়ে যাচ্ছে।"
তবে চলতি বিশ্বকাপের জন্য জ্যামাইকা নারী ফুটবল দলের সবকিছু যে পরিকল্পনামাফিক চলছে, এমনটা নয়। বরং গত মাসেই নারী ফুটবল দলের প্রাথমিক স্কোয়াডের পক্ষ থেকে সার্বিক সুযোগ সুবিধা নিয়ে ফুটবল ফেডারেশনের কাছে 'চরম হতাশা' প্রকাশ করা হয়েছিল।
সিএনএনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে এখনো কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে ফেডারেশনের ওয়েবসাইটে স্বীকার করা হয়েছে যে, সবকিছু হয়তো নিখুঁতভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে তাদের পক্ষ থেকে সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে সেডেলা জানান, খেলোয়াড়রা ফেডারেশনে খোলা চিঠি পাঠানোর পর থেকে তার সাথে ফেডারেশনের কোনো যোগাযোগ নেই। বরং তিনি সরাসরি কোন কাজগুলো দলের কাজে আসতে পারে, সেটা নিয়ে কাজ করছেন। এমনকি ২০১৪ সালে তিনি যখন নারী ফুটবল দল নিয়ে কাজ শুরু করেন, তখনও ফেডারেশনের সাথে তার খুব নিবিড় যোগাযোগ ছিল না।
সেডেলা নারী ফুটবল দল নিয়ে কাজ করে অনেক কিছুই অর্জন করেছেন। তবে তার ফুটবলে সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে 'ফুটবল ইজ ফ্রিডম' ইনিশিয়েটিভ গ্রহণ।
সেডেলা এই ইনিশিয়েটিভের নামটি মূলত বব মার্লের একটি উক্তি থেকে নিয়েছেন। একইসাথে ২০২১ সালে অক্টোবর মাসে ইনিশিয়েটিভের পক্ষ থেকে জ্যামাইকা ও কোস্টারিকার মধ্যকার ফ্রেন্ডলি ম্যাচ উপলক্ষে ফ্লোরিডায় সপ্তাহব্যাপী ট্রেনিং ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছিল।
একইসাথে বব মার্লের ৭৭ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইনিশিয়েটিভটির পক্ষ থেকে নারী ফুটবলারদের জন্য দেশের প্রথম ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইনিশিয়েটিভটির পক্ষ থেকে এমন সব উদ্যোগ গ্রহণের ফলে নারীদের লাইফ স্কিল, পরামর্শ প্রদান ও উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির জন্য কাজ করা হয়।
এ বিষয়ে সেডেলা বলেন, "আমাদের 'ফুটবল ইজ ফ্রিডম' ইনিশিয়েটিভ একদিন সারা বিশ্ব অনুকরণ করবে বলে আশা করি। এর অধীনে বর্তমানে জ্যামাইকার একদম তৃণমূল পর্যায় থেকে কাজ করা হচ্ছে। জীবনে পরিবর্তন আনতে আমরা প্রতিটি নারীকে সুযোগ করে দিচ্ছি। এটা শুধু মাঠের ক্ষেত্রে নয়, বরং নিজের পরিবার থেকে শুরু করে কমিউনিটি; সাধারণভাবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে।"
সেডেলা বিশ্বাস করেন, ফুটবলের মাধ্যমে প্রতিকূল কমিউনিটিতে বেড়ে ওঠা নারীদের সফলতা অর্জন সম্ভব। এতে করে কিছু নারী ফুটবলার যেমন বৃত্তির সুযোগ পাবেন তেমনি 'ফুটবল ইজ ফ্রিডম' ইনিশিয়েটিভ এর মাধ্যমে অ্যাডিডাস ও কমন গোল এর মতো আরও পার্টনারদের আনা সম্ভব হবে।
সাক্ষাৎকারে সেডেলা বলেন, "কাজগুলো করতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। কিন্তু আমি জানি যে, আমি যেটা করার চেষ্টা করছি সেটা করা সহজ হবে না। আমি মূলত পরিবর্তন আনতে একই ধরণের বিশ্বাসের মানুষকে একত্রিত করতে চাই। আমি তাই এমন সকলের কাছে যাচ্ছি। আমি নারীদের যতটা সম্ভব সুযোগ করে দিতে চাই।"
এতসব পদক্ষেপ সত্যিকার অর্থেই জ্যামাইকার তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছে। যার ফলাফল এসেছে চলতি বিশ্বকাপের গ্রুপ এফ পর্বে ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচে। ম্যাচটিতে গোলশূন্য ড্র করে শেষ ষোলোর টিকেট নিশ্চিত করেছে জ্যামাইকা। যা ক্যারিবিয়ান দেশ হিসেবে ইতিহাসে প্রথম।