ক্রিকেটে বোলিং বিবর্তনের আদ্যোপান্ত
১৯৯৩ বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপের ফাইনালে মুখোমুখি ওয়েস্ট ইন্ডিজ-অস্ট্রেলিয়া। বোলিংয়ে তখন ক্যারিবীয় পেসার কার্টলি অ্যামব্রোস, গতির জন্য মানুষের মনে যিনি থেকে যাবেন বহুকাল। সেই অ্যামব্রোসই কিনা আচমকা করে বসেন স্লোয়ার এক ডেলিভারি। বলটা পৌঁছানোর আগেই শট খেলেন ব্যাটসম্যান ইয়ান হিলি, ব্যাটে-বলে না হওয়ায় স্টাম্প উপড়ে যায় তার।
এভাবে প্রতিপক্ষের উইকেট নিতে পেরে বেশ মজাই পান অ্যামব্রোস, উইকেটরক্ষক জুনিয়র মারেসহ মাঠের বাকি ফিল্ডাররা। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে আউট হয়ে হাসতে হাসতে মাঠ ছাড়েন হিলিও। যার গতিতে ব্যাটসম্যানদের পিলে চমকে যায়, সেই অ্যামব্রোসের স্লোয়ারে বিভ্রান্ত হয়ে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক এই ব্যাটসম্যান যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
এর প্রায় তিন দশক পর ভারতীয় পেসার হার্শাল প্যাটেল এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'চার ওভারের একটা টি-টোয়েন্টি স্পেলে ২৪টি স্লোয়ার ডেলিভারি করার মধ্যে ভুল কিছু নেই।'
তার এমন মন্তব্যই বলে দেয়, ফাস্ট বোলিং বা ফাস্ট বোলারদের চিন্তা-ধারায় কতোটা পরিবর্তন এসেছে। আগে যেখানে পেসাররা যথাসম্ভব জোরে বল ছোঁড়ার চেষ্টায় থাকতেন, এখন তারা চেষ্টা করেন নিজেদের ভাণ্ডারে নিত্যনতুন অস্ত্র যোগ করতে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আসার পর বলের গতি কমিয়ে প্রায়ই ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করতে দেখা যায় তাদের।
পেসারদের গতির এই আকস্মিক পরিবর্তন প্রায়ই ব্যাটসম্যানদের পক্ষে মোকাবেলা করা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। নাসুম আহমেদের কথাই ধরা যাক। এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে মোহাম্মদ শামি, প্রসিদ কৃষ্ণদের এক্সপ্রেস পেস অবলীলায় মোকাবেলা করে তিনি আউট হন ৯৫ কি.মি. গতির এক স্লোয়ারে। অথচ এর আগের বলটাই ১৪৫ কি.মি. বেগে করেন প্রসিদ। ফলে গতির এই পরিবর্তন সহজেই বিভ্রান্ত করে ফেলে নাসুমকে।
বলে সিমের (সেলাই) চারদিকে আঙুল ঘুরিয়ে বলের গতিটা কমান প্রসিদ। এটা স্লোয়ার বলের একটা জনপ্রিয় ধরন হলেও এটাই যে একমাত্র, তা নয়। একই ম্যাচে বাংলাদেশের অভিষিক্ত পেসার তানজিম হাসান সাকিব ম্যাচের শেষ ওভারে করেন দুটি 'ব্যাক অব দ্য হ্যান্ড' স্লোয়ার, যেটা তিনি রিলিজ করেন হাতের পেছন থেকে। এই ধরনের স্লোয়ার বল ব্যাপক পরিসরে ব্যবহার শুরু করেন ইংল্যান্ডের পেসার জেড ডার্নবাখ।
স্লোয়ার বলের কথা বলতে গেলে মুস্তাফিজুর রহমানের কথা বলতেই হয়। নিজের সেরা সময়ে অ্যাকশন ও গ্রিপ পরিবর্তন না করেই বাংলাদেশের এই পেসার করতে পারতেন দুই ধরনের গতির কাটার; ফাস্টার কাটার ও স্লোয়ার কাটার। এই কাটার আবার দুই ধরনের। সহজ করে বলতে গেলে, পেস বোলারের করা অফ স্পিন হলো অফ কাটার আর লেগ স্পিন লেগ কাটার।
স্লোয়ারের আরেকটা ধরন নাকল বল, যেটা মূলত এসেছে বাস্কেটবল থেকে। এই ডেলিভারিতে সিমের কোনো রোটেশন থাকে না। ফলে গতিও থাকে কম আর গতির অভাবে ব্যাটসম্যানরা সহজে খেলতেও পারেন না। এই বৈচিত্র্য ব্যবহার করা বোলারদের মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক পেসার চার্ল ল্যাঙ্গেভেল্ট। ২০১১ বিশ্বকাপে স্লগ ওভারে এই ডেলিভারি করে অনেক উইকেট পান ভারতের সাবেক পেসার জহির খানও।
স্লোয়ার ডেলিভারি যে শুধু সীমিত ওভারের খেলায়-ই করা হয়, এমন নয়। ইংল্যান্ডের গতি তারকা জফরা আর্চার ২০১৯ অ্যাশেজে নাকল বল করে সাফল্যের দেখা পান। এর বছর খানেক আগে স্লোয়ার ইয়র্কারে অস্ট্রেলিয়ার শন মার্শকে টেস্টে বোল্ড করেন ভারতের তারকা পেসার জাসপ্রিত বুমরাহ।
তবে কি চিরাচরিত সিম আর সুইং বোলিং এখন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে? সত্যি বলতে, এতেও যুক্ত হয়েছে নতুন সব অস্ত্র। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ওবল সিমের কথা। সিমের ঘূর্ণনটা হয় দুই পাশে, বোলার নিজেও জানেন না পিচ করার পর বল কোনদিকে যাবে। অনেকেই জেমস অ্যান্ডারসনকে এই ডেরিভারির উদ্ভাবক মনে করলেও ইংল্যান্ডের এই পেসার এর কৃতিত্ব দেন সাবেক পাকিস্তানি পেসার মোহাম্মদ আসিফকে।
বোলিংয়ে বৈচিত্র্যের কথা বলতে গেলে সাকলাইন মুশতাকের নাম এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। নিজে হয়তো উদ্ভাবন করেননি, তবে অফ ব্রেকের বিপরীত দিকে টার্ন করানো 'দুসরা' জনপ্রিয় হয় সাবেক এই পাকিস্তানি স্পিনারের কল্যাণেই। যদিও দুসরা এখন আর সেভাবে দেখা যায় না, কারণ এই ডেলিভারি করতে অনেক বোলারেরই কনুই বেশি বাঁকাতে হয়; যা আইসিসির চোখে অনৈতিক।
এরপরও থেমে থাকেননি অফ স্পিনাররা, উল্টো দিকে টার্ন করার নতুন কায়দা দেখান শ্রীলঙ্কার অজন্তা মেন্ডিস। অস্ট্রেলিয়ার জ্যাক আইভারসনের উদ্ভাবন 'ক্যারম বল'কে পুনরুজ্জীবিত করেন তিনি। মেন্ডিসকে দেখে ভারতের রবিচন্দ্রন অশ্বিন আয়ত্ত করেন ক্যারম বল এবং কয়েক বছর পর নিজেই বের করেন নতুন এক ধরনের ডেলিভারি, যাকে বলা হয় 'রিভার্স ক্যারম বল'। ডানহাতি ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে যেটা ভেতরের দিকে ঢোকে। শ্রীলঙ্কার মাহিশ থিকসানাও আয়ত্ত করেছেন রিভার্স ক্যারম বল।
বাংলাদেশের স্পিন বোলিং কোচ থাকাকালীন 'আন্ডারকাটার' নামের আরেকটা বৈচিত্র্য শিখিয়েছিলেন মুশতাক। পিচ করার পর নিচু হয়ে ব্যাটসম্যানের দিকে স্কিড করা বলটা এখনও মাঝে মাঝে করতে দেখা যায় সাকিব আল হাসানকে। তার সতীর্থ মেহেদী হাসান মিরাজ ও শেখ মেহেদি হাসানও আয়ত্ত করেছেন এই আন্ডারকাটার।
ফিঙ্গার স্পিনারদের জন্য 'আর্ম বল' একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। শোনা যায়, নিউজিল্যান্ডের ড্যানিয়েল ভেট্টোরি বাংলাদেশের মোহাম্মদ রফিকের কাছ থেকে আর্ম বল শিখতে চেয়েছিলেন। রফিকের পরবর্তী প্রজন্মকে প্রতিনিধিত্ব করা সাকিবকে প্রায়ই দেখা যায় আর্ম বলে ব্যাটসম্যানদের বোকা বানাতে।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এখন বল টার্ন না করিয়ে সুইং করানোর দিকে মনোযোগ দিতে দেখা যায় স্পিনারদের। ইমাদ ওয়াসিম, মুজিব-উর-রহমান, আকিল হোসেনসহ যারা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নতুন বলে বোলিং করেন, রান আটকানোর জন্য তাদেরকে এভাবে বোলিং করতে দেখা যায়। রশিদ খান, ভানিন্দু হাসারাঙ্গার মতো লেগ স্পিনাররাও নতুন নতুন অস্ত্র যোগ করছেন, যেন ব্যাটসম্যানরা তাদের গ্রিপ দেখে ডেলিভারি বুঝতে না পারেন।
ব্যাটসম্যানরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ, আর ঝুঁকি নিতেও পিছপা হন না। ফলে এক কদম এগিয়ে থাকার জন্য দক্ষতা বাড়াতে হচ্ছে বোলারদের। ব্যাট-বলের এই তুমুল লড়াই ক্রিকেটকে করছে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত।