ছোট হওয়া গাছ, গজদন্তহীন হাতি: মানবসৃষ্ট পরিবর্তনের সাথে যেভাবে খাপ খাওয়াচ্ছে প্রাণীরা
বিবর্তনের ইতিহাসে—চারপাশের পরিবেশের ওপর মানবজাতির গোষ্ঠীবদ্ধ প্রভাব ব্যাপক। আমরা উজার করেছি আদিম সব অরণ্য, হত্যা করেছি অজস্র প্রজাতিকে। মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণ ও দখলে বিপন্ন হয়েছে বন্য জীবন। মানুষের এই সর্বনাশা প্রভাবের মধ্যে প্রাণীরাও টিকে থাকতে কিছু অভিযোজন করছে। বিশেষজ্ঞরা এর মধ্যেই প্রমাণ পেয়েছেন কীটপতঙ্গ, গাছপালা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জীবের মধ্যে এ ধরনের পরিবর্তনের। আর সেটা দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ করেছেন তাঁরা।
যেমন, শিল্প বিপ্লবের সময় যখন গাছপালার পাতার ওপর কয়লার ছাইয়ের আস্তরণ পড়তে শুরু করেছিল, তখন কালো ও সাদা রঙের ছোপ থাকা পেপারড মথ ধীরে ধীরে রঙ বদলে কালো রঙ ধারণ করে, যাতে ওই পরিবেশের সাথে মিশে থাকতে বা বর্ণ লুকিয়ে থাকতে পারে। অভিযোজিত প্রথম প্রজন্মের জিন পরের প্রজন্মগুলোও পায়, এবং তা স্থায়ী হয়ে যায়।
এভাবে পরিবেশের ওপর মানবসৃষ্ট প্রভাবগুলো যত বিস্তার লাভ করেছে—ততোই নানান বিচিত্র অভিযোজনের উপায় গ্রহণ করেছে বিভিন্ন প্রজাতি। একুশ শতকে জীবজগতের এ ধরনের পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে জানতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষকদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য গার্ডিয়ান। আর সেই সূত্র ধরেই উল্লেখযোগ্য অভিযোজনগুলো এখানে তুলে ধরা হলো—
আকারে ছোট হয়েছে মেহগনি গাছ
গাঢ় লাল রঙের টেকসই, মজবুত কাঠের জন্য দামি আসবাব তৈরিতে মেহগনি কাঠের চাহিদা প্রচুর। কিন্তু সেই চাহিদার বলি হয়েছে বৃক্ষের এই প্রজাতি। বর্ষাবনের বাস্তসংস্থানের অন্যতম ভিত্তি এই গাছগুলোকে তাদের দামি কাঠের জন্য উজার করা হয়েছে। ১৯৭০-এর দশকের পর থেকে কিছু দেশের বন্য পরিবেশে মেহগনি গাছের সংখ্যা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।
আর পুরোনো ও বিশাল আকারের বন্য মেহগনির প্রায় হারিয়েই গেছে বলা যায়। তবে এখনও অনেক বনে মেহগনির দেখা পাওয়া যায়।
বোটানিক গার্ডেনস কনজার্ভেশন ইন্টারন্যাশনালের বিশেষজ্ঞ ড. মালিন রিভার্স বলেন, এখন ভিন্নভাবে বড় হচ্ছে এসব গাছ। যেমন, ক্যারিবিয় অঞ্চলের কিছু এলাকায় প্রচুর সংখ্যক মেহগনি দেখা যায়। তবে কম বয়সের গাছগুলো যখন বড় হয়, তখন আর আগের মতো বিশাল আকারের হয় না। অথচ এক সময়ে আকাশছোঁয়া উচ্চতার জন্যই এই প্রজাতির গাছগুলো বিখ্যাত ছিল। বিশেষত মেহগনির সিয়েতেনিয়া প্রজাতির উচ্চতা অনেক বেশি হতো; কিছুক্ষেত্রে এই উচ্চতা ২০ মিটার ছাড়িয়ে যেত।
এখন ক্যারিবিয় অঞ্চলে এই প্রজাতির গাছগুলো তুলনামূলক ছোট আকার নিয়ে বড় হয়। অনেকটাই ঝাঁকড়া গাছের আকার নিয়েছে এগুলো। যেখানে ডালপালা বেশি। ফলে এর বাণিজ্যিক দর তেমন নেই।
এই অভিযোজনের অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রাচীন সেই বড় গাছগুলো হারিয়ে যাওয়া। নির্বিচারে কেটে ফেলার ফলে তারা বংশবিস্তারের সুযোগ সেভাবে পায়নি। যেকারণে তাদের বৈচিত্র্যময় জিনসম্ভার পরের প্রজন্মগুলোকে দিয়ে যেতে পারেনি। হারিয়ে যাওয়া ওইসব জিন ছিল প্রজাতিটির উচ্চতা ও আকারে বিশালাকায় হওয়ার চালিকাশক্তি।
ম্যাগপাই পাখির বাসায় পাখি-বিতারক কাঁটা
পাখি বসে বিষ্ঠা ফেলে দেয়াল নষ্ট করবে—এজন্য পাখি তাড়াতে দেওয়ালের ওপর ইস্পাতের কাঁটা (অ্যান্টি-বার্ড স্পাইক) বসান অনেক বাড়ির মালিক। শহরাঞ্চলে এই দৃশ্য বিরল নয়। শিকারী প্রাণীর হাত থেকে ডিম ও ছানা চুরি ঠেকাতে ম্যাগপাই পাখিরাও তাঁদের গোলাকার বাসার চারপাশে কাঁটাঝোপ বসিয়ে একই ধরনের বাধা তৈরি করে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, গবেষকরা লক্ষ্য করছেন, এই পাখিগুলো এখন দেয়ালের ওপর লাগানো ইস্পাতের আলগা কাঁটাগুলো খুলে তাদের বাসার চারপাশে বসাচ্ছে।
পিএইচডি গবেষক ছাত্র অক-ফ্লোরিয়ান হিমেস্ত্রা জানান, পাখিদের বাসা তৈরিতে কৃত্রিম উপাদানের ব্যবহার বাড়ছে। ম্যাগপাইদের অ্যান্টি-বার্ড স্পাইক ব্যবহারের ঘটনাটিও এর সঙ্গে যুক্ত।
চোরাশিকারীদের থেকে বাঁচতে মাদি হাতিদের বিশাল গজদন্ত গজাচ্ছে না
স্থলভাগের প্রাণীকূলের মধ্যে আফ্রিকার হাতিরাই সবচেয়ে বড়। আর তাঁদের গজদন্তের বাহারও দশাসই। কিন্তু, আফ্রিকা গৃহযুদ্ধ আর সংঘাত-কবলিত এক মহাদেশ। গত কয়েক দশকে বহু রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়েছে আফ্রিকায়। যার মধ্যে অন্যতম ছিল মোজাম্বিকের গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধের সময় প্রায়ই যোদ্ধারা বিশালাকার আফ্রিকার সাভানা হাতিগুলোকে শিকার করতো। তাঁদের অন্যতম লক্ষ্যই ছিল দাঁতাল হাতি। কারণ, আইভরি বা হাতির দাঁত বহুমূল্য। ফলে মোজাম্বিকের গোরংগোসা জাতীয় উদ্যানে হাতির জনসংখ্যা প্রায় ৯০ শতাংশ কমে যায়।
গৃহযুদ্ধ অবসানের পর এখন গোরংগোসায় হাতিদের জনসংখ্যা পুনরুদ্ধার হচ্ছে। তবে গবেষকরা লক্ষ করছেন, মাদি হাতিদের আর গজদন্ত গজাচ্ছে না। তাঁরা মনে করছেন, চোরাশিকারীদের হাত থেকে বাঁচতে এ ধরনের পরিবর্তন হয়েছে এখানকার হাতিদের মধ্যে। প্রতিবেশী তাঞ্জানিয়াতেও চোরাশিকারীদের উৎপাত আছে, সেখানকার মাদি হাতিদের মধ্যেও একই পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচারের যুক্তরাজ্য শাখার জ্যেষ্ঠ পরামর্শক তানিয়া স্মিথ বলেন, 'আগের দশকগুলোয় হাতিদের জনসংখ্যার ওপর চোরাশিকারের যে মারাত্মক চাপ পড়েছিল—সেটি কাটিয়ে উঠতেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে নতুন প্রজন্মের আফ্রিকান হাতিদের মধ্যে ছোট গজদন্ত বা একেবারেই তা না থাকার মতো অভিযোজন আমরা লক্ষ করছি। গজদন্তের বাহারের কারণেই আফ্রিকান হাতির এত খ্যাতি। মানবসৃষ্ট চাপের মুখে সেটিও যে তাঁরা হারাতে বসেছে—এটি তারই করুণ উদাহরণ।'
গাড়ির সাথে সংঘর্ষ এড়াতে ডানা ছোট হয়েছে আবাবিল পাখির
আবাবিল বা সোয়ালো পাখি ইউরোপে বার্ন সোয়ালো বা গোলাঘরের পাখি হিসেবেও পরিচিত। শুধু গোলাঘর নয়, তাঁরা বাসা বাঁধে বাসাবাড়ির উঁচু কোণে, কখনোবা পাহাড়ের খাঁড়া দেওয়ালের ফাঁকফোকরে। আবাবিলের অনেক প্রজাতিই গাছের কোটর, গোলাঘর, আস্তাবল ইত্যাদি জায়গায় বাসা বাঁধে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কার ক্লিফ সোয়ালোরা প্রায়ই সড়ক সেতুর নিচেও বাসা বাঁধে। অনেক সময় এই বাসায় উড়ে আসা-যাওয়ার সময় গাড়ির ধাক্কায় মারাও পড়তো অনেকে। বিশেষ করে, যেসব পাখির লম্বা ডানার—দুর্ঘটনার শিকার তারাই বেশি হয়।
তবে ২০১৩ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, দুর্ঘটনা এড়াতে ডানার আকার ছোট হয়েছে ক্লিফ সোয়ালোদের। ছোট ডানা দিয়ে দ্রুত সঞ্চালন করে আরও ক্ষিপ্রবেগে উড়ছে তারা। যেকারণে রাস্তার গাড়িগুলোকে সহজেই এড়িয়ে পৌঁছাতে পারছে সেতুর নিচে বাঁধা বাসায়।
এই অভিযোজনের ব্যাখ্যা দিয়ে ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কা-লিংকনের গবেষক মেরি বমবার্জার ব্রাউন বলেছিলেন, ডানার দৈর্ঘ্য কমার এই বিষয়টা 'ইউ-২ গোয়েন্দা বিমানের (বিশাল) ডানার সাথে জঙ্গিবিমানের (তুলনামূলক ছোট) ডানার পার্থক্যের মতো।'
শামুকের খোলের রঙ ফিকে হয়েছে
নেদারল্যান্ডসের বেশিরভাগটাই সমুদ্রগর্ভ থেকে উদ্ধার করা জমি। দেশটির শহরগুলোয় গ্রুব স্নেইল নামে এক প্রকারের শামুক প্রায়ই দেখা যায়, আগের চেয়ে যাদের রঙ অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে।
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, শহরাঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণেই রঙের গাঢ়ত্ব কমেছে শামুকগুলোর খোলসে। কারণ নেদারল্যান্ডসে শহরাঞ্চলে তাপমাত্রা অনেক সময় গ্রামের চেয়ে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হয়। গাঢ় রঙ তাপ বেশি শোষণ করে। অতিরিক্ত এই তাপে শামুকগুলো মারা পড়তে পারে।
ডাচ জীববিজ্ঞানী অব্যাপক মেনো স্লিথুজেন বলেন, 'গাঢ় রঙের খোলসের নিচে থাকা শামুকগুলো দ্রুত উষ্ণ হয়ে ওঠে। একারণে তাঁদের মৃত্যুঝুঁকি দেখা দেয়। গ্রীষ্মকালে শহরের এই বাড়তি তাপ শোষণ থেকে বাঁচতেই হয়তো তাঁদের খোলসের রঙ আগের চেয়ে হালকা হয়েছে।'