নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও হেরে গেল বিশ্বকাপে দিকহারা বাংলাদেশ
উইকেটের পাশেই জমাট হয়ে সপ্তম উইকেটপ্রাপ্তির আনন্দে মাতোয়ারা নেদারল্যান্ডসের ক্রিকেটাররা। বাংলাদেশের দুই ব্যাটসম্যান মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও শেখ মেহেদি হাসান তখন উইকেটের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে নিজেদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে। দুজনই যেন মনে মনে বলছিলেন, 'হায়, এ কী ভুল করলাম আমরা!' নেদারল্যান্ডসের দেওয়া ছোট লক্ষ্য তাড়ায় এ দুজনই যে শেষ ভরসা ছিলেন বাংলাদেশের।
রান আউট হয়ে ফিরলেন শেখ মেহেদি, কিছুক্ষণ পর মাহমুদউল্লাহও সাজঘরে। তখনই লেখা হয়ে যায় বাংলাদেশের হারের শেষ অধ্যায়। পরে তাসকিন আহমেদ, মুস্তাফিজুর রহমান, শরিফুল ইসলামরা যতোক্ষণ ব্যাট চালালেন, ততোক্ষণ হয়তো বাংলাদেশের অন্য ব্যাটসম্যানদের অস্বস্তিতেই সময় কাটছিল। চরম ব্যাটিং ব্যর্থতার মিছিলে নিজের নাম লেখানো অনেকেই যে এতোটা সময় উইকেটে পার করতে পারেননি।
বিশ্বকাপে দিকহারা বাংলাদেশের অবশ্য একটি বিষয়ে ধারাবাহিকতা রক্ষা হলো; ব্যাটিং ব্যর্থতা। অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও চললো আসা-যাওয়ার মিছিল, পুরো ইনিংসজুড়ে বেজে গেল কেবলই ভাঙনের সুর। এ যাত্রায় আরও একটি হার, সেটাও র্যাঙ্কিং, শক্তিতে অনেক পিছিয়ে থাকা ডাচদের বিপক্ষে।
আনন্দ নগরী কলকাতায় বিশ্বকাপের দুঃখ মোচনের মিশনে নেমেছিল বাংলাদেশ, কিন্তু হতাশার পারফরম্যান্সে এখানে লেখা হলো সবচেয়ে বড় বিষাদের কাব্য। শনিবার ইডেন গার্ডেন্সে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৮৭ রানে হেরেছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে ছয় ম্যাচের টানা পাঁচটিতে হারলো সাকিব আল হাসানের দল। হারতে হারতে ক্লান্ত বাংলাদেশ পয়েন্ট টেবিলে এখন ৯ নম্বর দল। এই হারে বিশ্বকাপ থেকে কার্যত বিদায় হয়ে গেল বাংলাদেশের।
টস জিতে আগে ব্যাটিং করে সব কটি উইকেটে ২২৯ রান তোলে নেদারল্যান্ডস। আরও কম রানেই তাদেরকে গুটিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা জাগিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ক্যাচ মিস ও বাজে ফিল্ডিংয়ে সেটা সম্ভব হয়নি। বারবার দিক হারিয়েও স্কট এডওয়ার্ডস, ওয়েসলি বারেসি, সাইবার এঙ্গেলব্রেখট, লোগান ভ্যান বিকদের ব্যাটে ২০০ ছাড়ানো সংগ্রহ গড়ে যাচরা। জবাবে ডাচদের বোলিংয়ের বিপক্ষে অসহায় আত্মসমর্পণ করা বাংলাদেশের ইনিংস থেমে যায় ৪২.২ ওভারে ১৪২ রানেই।
যদিও ভালো শুরুর আভাসই মিলেছিল। কিন্তু সে পথে বেশি পথ এগোনো হয়নি বাংলাদেশের। দলীয় ১৯ রানে ওলট-পালট হয়ে যায় বাংলাদেশের ইনিংস। এক ওভারের ব্যবধানে ফিরে যান দুই ওপেনার লিটন কুমার দাস ও তানজিদ হাসান তামিম। চাপ কাটিয়ে তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন নাজমুল হোসেন শান্ত, অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান মুশফিকুর রহিমও। মেহেদী হাসান মিরাজ কেবল কিছুটা লড়াই করেন, এরপরও ৭০ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকে বাংলাদেশ।
এবারের বিশ্বকাপে দুটি হাফ সেঞ্চুরি করা লিটন আউট হন বাজেভাবে। রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে ডাচ অধিনায়ক ও উইকেটরক্ষক স্কট এডওয়ার্ডসের হাতে ধরা পড়েন ১২ বলে ৩ রান করা ডানহাতি এই ওপেনার। ১৬ বলে ১৫ রান করা তানজিদ তামিমও উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে থামেন।
শান্তরও আউটও চোখে লাগার মতো। অনেক বাইরের বলে ব্যাট চালিয়ে স্লিপে ধরা পড়েন ১৮ বলে ৯ রান করা বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। দলের দুঃসময়ে পারেননি সাকিবও। নিজের ব্যাটিং উন্নতি করতে দেশে গিয়ে অনুশীলন করে আসা অভিজ্ঞ এই অলরাউন্ডার লাফিয়ে ওঠা বলে ব্যাট চালিয়ে এডওয়ার্ডসের হাতে ধরা পড়েন।
ব্যতিক্রম ছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ, বিপর্যয়ের মাঝেও সাবলীল ব্যাটিং করে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ৪০ বলে ৫টি চার ও একটি ছক্কায় ৩৫ রান করে ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানও উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন। বাংলাদেশের আউট হওয়া প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যানের তিনজনই ধরা পড়েন এডওয়ার্ডসের হাতে। খাদের কিনারে থেকেও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও শেখ মেহেদি হাসানের ব্যাটে স্বপ্ন দেখছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ৩৮ রানেই ভাঙে এই জুটি।
রান আউট হওয়ার আগে ৩৮ বলে ১৭ রান করে শেখ মেহেদি। কিছুক্ষণ পর থামেন ২০ রান করা মাহমুদউল্লাহও। ব্যাটসম্যানদের তুলনায় তাসকিন, মুস্তাফিজরাই ভালো লড়াই করেন। তাসকিন ১১ ও মুস্তাফিজ ২০ রান করেন। এটা মুস্তাফিজের সেরা ইনিংস। ম্যাচসেরা পল ভ্যান মিকেরেন ২৩ রানে ৪টি উইকেট নেন। ২টি উইকেট নেন বাস ডে লেডে। একটি করে উইকেট পান আরিয়ান দত্ত, লোগান ভ্যান বিক ও কলিন অ্যাকারম্যান।
এর আগে বল হাতে বাংলাদেশের শুরুটা হয় দাপুটে। তিন ওভারের মধ্যেই ডাচদের দুই উইকেট তুলে নেন বাংলাদেশের দুই পেসার তাসকিন আহমেদ ও শরিফুল ইসলাম। দ্বিতীয় ওভারেই ডাচ ওপেনার বিক্রমজিৎ সিংকে ফিরিয়ে দেন চোট কাটিয়ে দলে ফেরা তাসকিন। ডানহাতি এই পেসারের পায়ের ওপর করা ডেলিভারি ফ্লিক করতে গিয়ে সাকিব আল হাসানের হাতে ধরা পড়েন বিক্রমজিৎ।
পরের ওভারেই তোপ দাগেন শরিফুল, তার শিকার ম্যাক্স ও'দাউদ। তার করা অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের বলে ব্যাট চালিয়ে উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন ডাচ এই ওপেনার। ৪ রানেই দুই উইকেট হারানো দলের হাল ধরেন ওয়েসলি বারেসি ও কলিন অ্যাকারম্যান। চাপ কাটিয়ে তৃতীয় উইকেটে ৫৯ রানের জুটি গড়েন তারা।
দুই ওভারের মধ্যে এ দুজনকে ফিরিয়ে ডাচদের আবারও চেপে ধরে বাংলাদেশ। ১৪তম ওভারে মুস্তাফিজুর রহমানের ফুল লেংথের ডেলিভারিতে শট খেলতে গিয়ে সাকিবের হাতে ধরা পড়েন ৪১ বলে ৮টি চারে ৪১ রান করা বারেসি। ১৫ রান করা অ্যাকারম্যানকে পরের ওভারে ফেরান সাকিব, এবার ক্যাচ নেন মুস্তাফিজ।
১৬তম ওভারেই এডওয়ার্ডসকে সাজঘরে ফিরিয়ে দিতে পারতো বাংলাদেশ। কিন্তু তিন বলের মধ্যে ডাচ অধিনায়কের তোলা দুটি ক্যাচ নিতে ব্যর্থ হন লিটন কুমার দাস ও মুশফিকুর রহিম। জীবন পেয়ে বাস ডে লেডের সঙ্গে জুটি বাধেন এডওয়ার্ডস, যোগ করেন ৪৪ রান। ১৭ রান করা ডে লেডেকে ফিরিয়ে এই জুটি ভাঙেন তাসকিন।
এরপর ইনিংসের সবচেয়ে বড় জুটিটি পায় নেদারল্যান্ডস। ষষ্ঠ উইকেটে ১০৫ বলে ৭৮ রান যোগ করেন এডওয়ার্ডস ও এঙ্গেলব্রেখট। ৮৯ বলে ৬টি চারে ইনিংস সেরা ৬৮ রান করা এডওয়ার্ডস মুস্তাফিজের শিকারে পরিণত হয়ে থামেন। কিছুক্ষণ পরই থামেন এঙ্গেলেব্রেখট, ৬১ বলে ৩টি চারে ৩৫ রান করেন তিনি। যদিও ২৮ রান করেই ফিরতে পারতেন এঙ্গেলব্রেখট, কিন্তু তার তোলা ক্যাচ ফেলেন দেন মিরাজ।
এরপরও শেষ ৫ ওভারে বলে ৪৪ রান তোলে নেদারল্যান্ডস। এটা সম্ভব হয় ভ্যান বিকের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে। ১৬ বলে ২টি চার ও একটি ছক্কায় ২৩ রান করেন তিনি। আরিয়ান দত্ত ৬ বলে ৯ রান করেন। শেখ মেহেদি হাসানের করা ইনিংসের শেষ ওভার থেকে ১৭ রান তোলে নেদারল্যান্ডস। দারুণ বোলিং করা মুস্তাফিজ ১০ ওভারে ৩৬ রানে ২টি উইকেট নেন। তাসকিন, শরিফুল ও শেখ মেহেদির শিকারও ২ উইকেট। তবে তাদের খরচা বেশি। সাকিব পান একটি উইকেট।