অধিনায়কদের অধিনায়ক: ক্লাইভ লয়েডে মুগ্ধ বুলবুল
১৪টি দ্বীপদেশ থেকে ক্রিকেটার তুলে এনে দল বানালেন। সেই দলটি টানা দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। টেস্টে তাদের রাজত্বকাল হলো আরও দীর্ঘ। ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত ফরম্যাটে দীর্ঘ ১৫ বছরে হার মানেনি স্যার ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কীভাবে পারলেন ক্লাইভ লয়েড! এটা ভেবে বিস্ময়ের কীনারা খুঁজে পান না আমিনুল ইসলাম বুলবুল।
ছোটবেলা থেকেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভক্ত বাংলাদেশের সাবেক এই অধিনায়ক। এর অন্যতম কারণ উইন্ডিজ কিংবদন্তি অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড। তাই বুলবুল যখন বাংলাদেশের অধিনায়কত্ব পেলেন, চেষ্টা করতেন ক্যারিবীয় কিংদন্তির মতো করে দলকে এক করে রাখতে। যদিও বুলবুলের অধিনায়কত্বের পর্বটি দীর্ঘ হয়নি। ১৬টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েই অধিনায়কত্ব ছাড়তে হয় তাকে।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বুলবুল যখন নেতৃত্ব দিতে শিখলেন, ঠিক তখনই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয় অধিনায়কত্ব থেকে। যদিও অনেকেরই মত, বড় মাপের অধিনায়ক হতে পারতেন তিনি।
বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করা বুলবুল এখন আইসিসির ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার। ক্রিকেটকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়ান তিনি। ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়ার এই দায়িত্ব পালনের সময় বেশ কয়েকবার ক্লাইভ লয়েডের সঙ্গে দেখা হয়েছে বুলবুলের।
দেখা হলেই বাংলাদেশের সাবেক এই অধিনায়ক জানতে চেষ্টা করেছেন ক্যাবিবীয় কিংবদন্তির ক্রিকেট দর্শন, কৌশলসহ নানা বিষয় নিয়ে। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নিয়মিত আয়োজন 'অধিনায়কদের অধিনায়ক' সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে সেসব নিয়ে কথা বলেছেন বুলবুল।
আমিনুল ইসলাম বুলবুল: সেরা অধিনায়ক বাছাই করা খুবই কঠিন একটা ব্যাপার। বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন অধিনায়কের নেতৃত্বে খেলেছি। আবার বিদেশে যখন ক্লাবে খেলেছি, সেখানেও কিছু অধিনায়কের নেতৃত্বে খেলেছি। ঘরোয়া ক্রিকেটেও বেশ কিছু অধিনায়ককে পেয়েছি। আমার কাছে মনে হয় অনেক ভালো ভালো অধিনায়কের নেতৃত্বে আমি খেলেছি।
বাংলাদেশের মধ্যে আমি সব সময়ই প্রশংসা করতাম লিপু (গাজী আশরাফ হোসেন লিপু) ভাইকে। লিপু ভাই খুবই ভালো গেম লিডার ছিলেন। তিনি খেলা খুবই ভালো বুঝতেন। খেলোয়াড়দের সাইকোলজি উনি খুবই ভালো বুঝতেন। আমাদের জেনারেশনে আমি নান্নু ভাই, আকরাম, দুর্জয়, লিপু ভাইয়ের নেতৃত্বে খেলেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে লিপু ভাই খুবই ইতিবাচক এবং থিংক ট্যাংকারের মতো ছিলেন।
লিপু ভাই যখন অধিনায়কত্ব করতেন, আমরা আইসিসি ট্রফিতে খেলতাম। অনেক দিন পর পর এশিয়া কাপের ম্যাচ খেলতাম। প্রথম এশিয়া কাপে উনি আমাদের অধিনায়ক ছিলেন। লিপু ভাই সব সময় আমার প্রতিপক্ষ অধিনায়ক ছিলেন। কারণ আমি সব সময় মোহামেডান আর লিপু ভাই আবাহনীতে ছিলেন। ওই সময় তাকে কৌশলগত দারুণ সব সিদ্ধান্ত নিতে দেখতাম। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে ব্যাপার থাকে, উনার মধ্যে এটা খুব বেশি ছিল।
জাতীয় দলে অধিনায়কত্ব করার সময় দলটাকে নিয়ে যেমন চিন্তা করতেন ঠিক প্রতিপক্ষ নিয়েও একইরকম চিন্তা করতেন। খেলোয়াড়দের সাথে একটা ভালো সম্পর্ক রাখার চিন্তা করতেন। তিনি বোর্ড, কোচ এবং খেলোয়াড়দের মাঝে সেতু হয়ে কাজ কাজ করতেন। এই ব্যাপারগুলো খুবই লাগতো। উনি চেষ্টা করতেন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে।
আইডলের কথা বলতে হলে আমাকে দেশের বাইরে যেতে হবে। এবং তিনি ক্লাইভ লয়েড। লয়েড যখন অধিনায়ক ছিলেন, তখন অবশ্য খেলা দেখার সুযোগ কম হতো। তবে ১৪টা দ্বীপকে সম্মিলিত করে একটা দল করা এবং সেই দলটাকে পরপর দুইবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করা, ১৫ বছরে কোনো টেস্ট সিরিজে না হারা, একের পর এক বিশ্বমানের খেলোয়াড় উপহার দেওয়া; এই বিষয়গুলো ক্লাইভ লয়েডের দিকে আমাকে বেশি আকর্ষিত করতো।
ক্লাইভ লয়েড আমার অধিনায়কত্বের আদর্শ ছিলেন। দেশের মধ্যে লিপু ভাই। পুরো বিশ্ব মিলিয়ে ক্লাইভ লয়েড। আমি উনার অনেক বড় ভক্ত। ক্লাইভ লয়েডের মধ্যে অধিনায়কত্বের একটা ব্যাপার ছিল, উনি খেলতেন এবং সবাইকে খেলাতেন। শুধু সামনে থেকে নেতৃত্বই দিতেন না, উদাহরণ তৈরি করতেন।
ভারতের বিপক্ষে উনারা কলকাতায় একটা টেস্ট খেলছিলেন, সেই ম্যাচের কথা বলি। মাইকেল হোল্ডিং, অ্যান্ডি রবার্টসের মতো বোলারদের নিয়ে জুটি গড়ে নিজে সেঞ্চুরি করলেন। আবার প্রথম বিশ্বকাপে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি করলেন। রূপকথার মতো একটা দল তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন।
দলটা এত বছর ভালো খেললো। আগেও বললাম ১৪টি দ্বীপকে এক করে সিলিন্ডার বানিয়ে বিস্ফোরণ করা, এটা ছিল অসাধারণ একটা ব্যাপার। বেশ কয়েকবার তার সাথে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। সম্প্রতি আমাদের বার্ষিক কনফারেন্সে তিনি এসেছিলেন। আমি তাকে দুটি প্রশ্ন করেছিলাম যে তোমরা ১৪ বছর কীভাবে অপরাজিত থাকলে, আর কীভাবে তুমি তোমার খেলার কৌশল এত ভালো করলে।
ও যেটা বলল, "তখনকার দিনে সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা ছিল, ফাস্ট বোলিংয়ে মানুষ সুইং ও বাউন্স খেলতে পারতো না। আমি দ্বীপে দ্বীপে ঘুরে ঘুরে ফাস্ট বোলার খুঁজে খুঁজে কৌশলতগভাবে আমি আমার দলকে শক্তিশালী করেছিলাম। আর আমি দলটাকে একটা সুতোয় গাঁথার চেষ্টা করেছি।" ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ক্লাইভ লয়েডের অবস্থানটা ছিল একজন বাবার মতো। একজন বাবা যেভাবে পুরো পরিবারের দায়িত্ব নেন, সেই রকম একটা দায়িত্ব নিয়ে ক্লাইভ লয়েড তার দলটাকে সাজিয়েছিলেন।
তার সাথে খেলার সুযোগ হয়নি। সেভাবে মেশার সুযোগ হয়নি। তবে আমি অধিনায়কত্ব পালনের সময় মানসিকভাবে একটা কল্পনা আঁকার করার চেষ্টা করতাম। যেহেতু আমি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভক্ত ছিলাম। তার প্রভাব আমার ওপর কাজ করতো। তার মতো করে দলটাকে সাজাতে চাইতাম বা এক করতে চাইতাম। তার যে ভূমিকা ছিল হয়তো আমি সেভাবে বাবা হতে পারিনি, তবে আমি দলে সবার ভালো বন্ধু ছিলাম।
তার বেশ কিছু ইনিংস আছে। তবে সেরার কথা বললে ভারতের বিপক্ষে কলকাতার সেই সেঞ্চুরির কথা বলব। আর প্রথম বিশ্বকাপের সেই অবিস্মরণীয় সেঞ্চুরি।
তার ব্যাকগ্রাউন্ড যদি দেখেন, তিনি নিজে তো খেলেছেনই, গর্ডন গ্রিনিস, ডেসমন্ড হেইন্স, ভিভ রিচার্ডসদের মতো খেলোয়াড় তৈরি করেছেন। আবার নিচে ম্যালকম মার্শাল, কোর্টনি ওয়ালশ, অ্যান্ডি রবার্টসের মতো খেলোয়াড় তৈরি করেছেন। তখনকার দিনে তো কোচ ছিল না। অধিনায়কই ছিলেন কোচ। এই যে গবেষণা বা বোঝাপড়া যে কোনটা তার শক্তিশালী দিক, কীভাবে আক্রমণ করা যাবে, তার এসব চিন্তাধারা আমার কাছে খুব ভালো লাগতো।
ওই সময় টেলিভিশনে খেলা দেখার সুযোগ কম পেতাম। ভারত থেকে একটা পত্রিকা বের হতো স্পোর্টস স্টার আর বাংলাদেশ খবরের কাগজে যা বের হতো, ওইগুলো পড়ে বা পত্র-পত্রিকা ঘাটাঘাটি করে জানতাম।
ওদের রুমমেট থাকতো, তখন তো সবাই সিংগেল রুম পেত না। গর্ডন গ্রিনিজ আর হেইন্স এক সাথে থাকতেন সব সময়। একজন ফাস্ট বোলার আরেকজন ফাস্ট বোলারের সাথে রুম ভাগাভাগি করতো। এই যে একটা সুতোয় গাঁথা, এটা ছিল উনার মধ্যে। যেমন একজন ব্যাটসম্যান যদি আরেকজন ব্যাটসম্যানের রুমমেট হয়, তখন তারা ব্যাটিং নিয়েই আলোচনা করবে। ব্যাটসম্যান-বোলার হলে তাদের আলোচনার সীমারেখা কমে আসবে, সেভাবে উন্নতি করতে পারবে না বা জেলিং হবে না।
পত্রিকা পড়ে যেটা ভালো লেগেছিল, ক্লাইভ লয়েড দলের মধ্যে একটা স্পিরিট তৈরি করেছিলেন। ব্যাটসম্যান-ব্যাটসম্যান, বোলার-বোলার, তাদের মধ্যে কুস্তি লাগাতো, কুইজ প্রতিযোগিতা করতো। এই যে টিম স্পিরিটটা তৈরি করেছিলেন ক্লাইভ লয়েড, সেটা অন্য কোনো দলে ছিল না। এ কারণেই তারা বিশ্বে ১৫ বছর অপরাজিত ছিল। পাশাপাশি দুটি বিশ্বকাপ জিতেছিল।
কীভাবে টিম স্পিরিট তৈরি করতে হয়, সেটা তিনি জানতেন এবং সম্মানটা কীভাবে আদায় করে নিতে হয়, সেটাও জানতেন। শুধু খেলোয়াড়দের কাছ থেকেই নয়, বোর্ড কর্মকর্তা, দেশের মানুষ এবং সারা বিশ্বে তিনি ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন শুধু একজন অধিনায়ক হিসেবে।
আবার আপনি যদি তার রেকর্ড দেখেন, খারাপ নয়। ৭ হাজার রান আছে, ৪০ এর ওপরে গড় আছে। কিন্তু সবাই জানে ক্লাইভ লয়েড অধিনায়ক। ইমরান খান অধিনায়ক। ইমরান খান বিশ্বমানের ফাস্ট বোলার ছিলেন। কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় তারা অধিনায়ক। এটা একটা বিরাট সাফল্য মনে হয় আমার কাছে।
ক্লাইভ লয়েড যে সময় অবসর নেন, তখন না নিয়ে আরও কিছুটা সময় খেলতে পারতেন। এটা দেখতে পারলে খুবই ভালো লাগতো। সে কিন্তু সফল দল গড়েই থামেননি, দুজন অধিনায়ক গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। একজন রিচি রিচার্ডসন আরেকজন ভিভ রিচার্ডস। যারা নাকি পরে আরও ১০ বছর শাসন করেছেন বিশ্ব ক্রিকেটে।