কী হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের
বিরুদ্ধ রেকর্ড নিয়ে পাকিস্তান সফরে গিয়ে বাজিমাত করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ঘরের মাঠের দলটিকে হোয়াইটওয়াশ করে তারা। যে দলের বিপক্ষে কখনও টেস্ট জয়-ই ছিল না, তাদের বিপক্ষে এমন সাফল্যে প্রত্যাশার বেলুন ফুলেফেঁপে ওঠে। কঠিন পথ জেনেও ভারত সফরে ভালো করার প্রত্যয়ের কথা জনান বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। কিন্তু বাস্তবতা বুঝতে সময় লাগেনি তাদের। টেস্ট সিরিজের মতো টি-টোয়েন্টিতেও হোয়াইটওয়াশ হয় বাংলাদেশ।
নিজেদের মাঠেও বদলায়নি ভাগ্য। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ শুরুর আগে ২-০ ব্যবধানে জেতার স্বপ্নের কথা জানানো হলেও বাস্তবতা ধরা দেয় 'নির্মম সত্য' হিসেবে। দুই-আড়াই দিনেই টেস্ট হেরে আবারও হোয়াইটয়াশ বাংলাদেশ। প্রিয় ফরম্যাট ওয়ানডেতেও দুর্দশা চলমান, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ হার। ভিন্ন ভিন্ন ফরম্যাটে টানা চারটি সিরিজ হারা বাংলাদেশ প্রতিটা ম্যাচেই আটকে ছিল ব্যাটিং ব্যর্থতার বৃত্তে। বোলিংয়েও আহামরি পারফরম্যান্স আসেনি।
ব্যাটিং ব্যর্থতার পাশাপাশি বাংলাদেশের হার মেনে নেওয়ার ধরনও প্রশ্নবিদ্ধ। অনেকেই তাই হিসাব মিলিয়েছেন পাকিস্তান সফরের। অমন পারফরম্যান্স করা দলটির হঠাৎ কী হলো? সাবেক ক্রিকেটার, কোচরা জানাচ্ছেন, কিছুই হয়নি বাংলাদেশ দলের, দলটি আদতে এমনই। শক্তি-সামর্থ্য বিবেচনায় এমন পারফরম্যান্সই করার কথা। মাঝে মাঝে দুই-একটি ম্যাচ জেতাটাই বাংলাদেশ দলের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। অন্য দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সামর্থ্য, দক্ষতার পার্থক্যের বিষয়টিও উল্লেখ করছেন তারা।
বাংলাদেশ দলের বর্তমান পারফরম্যান্স, কঠিন সময় পার করা, বাস্তবতার নিরিখে ফলাফল প্রত্যাশা করা, অন্যদের সঙ্গে দক্ষতা-সামর্থ্যের পার্থক্য, এখান থেকে উত্তরণের উপায়সহ আরও কিছু বিষয় নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় দলের দুই সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও খালেদ মাসুদ পাইলট এবং স্থানীয় প্রবীণ কোচ সারওয়ার ইমরান।
আমিনুল ইসলাম বুলবুল (সাবেক অধিনায়ক, বর্তমানে আইসিসির ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার)
কোথায় সমস্যা বাংলাদেশ দলের
আজ থেকে ১৫ বা ১৭ বছর আগের একটা গল্প বলি। তখন বিসিবিতে যারা ছিলেন, তারা বাংলাদেশের ক্রিকেট কৌশল নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। তখন আমি খবরের কাগজে একটা লেখা লিখেছিলাম। তাদের নাম ধরে বলেছিলাম, "আপনারা এখন এমন একটা কৌশল বা পরিকল্পনা বানান যে, আগামী পাঁচ বছর পরে আপনি অস্ট্রেলিয়া, ভারতের সাথে নিয়মিত খেলবেন নাকি আফগানিস্তান, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিয়মিত খেলবেন।" তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। এ কারণে আমরা এখনও জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তানের সাথেই খেলি বেশিরভাগ ম্যাচ।
এ কারণে আফগানিস্তানের কাছে সিরিজ হারের পরও আমাদের মনে হয় একটা শক্ত দলের কাছে সিরিজ হারলাম। আর নেপালের সাথে ২-১ রানে জিতে মনে হয় আমরা অনেক সাফল্য অর্জন করেছি। আমাদের পুরো ক্রিকেটের মান আমরা কোথায় নামিয়ে এনেছি! হ্যাঁ, আমরা হঠাৎ করে পাকিস্তানকে টেস্ট সিরিজে হারিয়েছে, নিউজিল্যান্ডকে টেস্টে হারিয়েছি। কিন্তু আমাদের নিয়মিত যে পারফরম্যান্স, সে অনুযায়ী আমরা তলানীতে পড়ে আছি। র্যাঙ্কিংও বলে আমরা শেষের দিকের দল। আফগানিস্তান সিরিজের কথা বললাম কারণ, আমি তখন স্বপ্ন দেখতে বলেছিলাম। স্বপ্ন দেখেননি তারা, এখন আফগানিস্তানের কাছে ২-১ ব্যবধানে হেরেও মনে হয় আমরা ভালো লড়াই করেছি। পুরনো একটা দলের জন্য এটা লজ্জার। টেস্ট ক্রিকেটে দুই যুগ পার হয়ে যাওয়ার পরও আমরা কোথায় পড়ে আছি!
দলের এমন অবস্থায় মনে হয় সামর্থ্যের ঘাটতি, দুই নম্বরে আমাদের স্বপ্নের পরিধি। এই দুটো মিলিয়ে আমরা এখানে পড়ে আছি। একটা ছেলে যখন অঙ্ক পরীক্ষা দিতে যায়, সে কিন্তু ফেইল করতে যায় না। যে শূন্য পায়, সেও কিন্তু পরীক্ষা দিতে যায়, পাশ করার আশায় যায়। সারা বছরে আপনি কী প্রস্তুতি নিয়েছেন, আপনার সামর্থ্য কতোটুকু, এটার প্রতিফলন ঘটবে আপনার মধ্যে কতোটুকু শক্তি আছে, সেটার ওপর। আপনি যদি কাল ভুটানের সাথে একটা সিরিজ খেলেন, আপনি জানেন একটু এফোর্ট দিলে জিতে যাবো।
তাই আপনার সামর্থ্য কী বা কতোটুকু, সেটা আপনার জানা উচিত। দলের সুনির্দিষ্ট দুর্বলতা নিয়ে আমি বলতে পারবো না। আমাদের মানসিক শক্তি, সক্ষমতা, প্রস্তুতি, যেখান থেকে খেলোয়াড় তৈরি হয়, সেই ঘরোয়া ক্রিকেট; কোন জায়গাটা ভালো যে আপনি আশা করবেন নিয়মিত জিতবেন। এতো পরিশ্রমী, ধারাবাহিক দল অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নিউজিল্যান্ড; সবাই কিন্তু কিছু কিছু ম্যাচ হারে। কিন্তু আমরা কিছু কিছু ম্যাচ জিতি। কেউ যখন খারাপ খেলে, তখন আমরা জিতি। আমরা কাউকে হারাই না, এটাই সত্যি। আপনি কাকে ডমিনেট করে হারান, কাকে হারিয়েছেন।
অন্য দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে দক্ষতা ও সামর্থ্যের পার্থক্য
আমাদের শক্তি বা সামর্থ্য সম্পর্কে আমরা নিজেরা পরিষ্কার নই। নিজেদের শক্তি পরখ করার জন্য যে বিশ্লেষণ দরকার হয়, সেই বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা আমাদের নেই বললেই চলে। এ ছাড়া একটা কৌশলগত নির্দেশনা লাগে, একটা লক্ষ্য লাগে যে এখানে আমি পৌঁছাবো। এখানে পৌঁছাতে আমার এই এই ব্যাপারগুলো করতে হবে বা এই এই জিনিস থাকতে হবে। আমরা তো এটাই জানি না। আমরা পাকিস্তান থেকে দেখছি, কিন্তু এর আগে বিশ্বকাপে কিন্তু আমরা ভালো খেলিনি। সামর্থ্যের আলোচনায় অন্যদের সঙ্গে তুলনা করলে আমরা জানি না আমরা কোথায় আছি। আমরা কী, এটা জানা খুব জরুরি। আমরা কী পারি, কী পারি না, এটা জানতে হবে। একটা দল বা সংগঠনের উন্নতির জন্য স্বাভাবিক হতে হয়। তারপরে আপনি উপরের দিকে যাবেন। কিন্তু আমরা স্বাভাবিক নই।
টেস্ট ক্রিকেটের ২৪ বছর
এগোলো কোথায়, আরও তো পেছালো। পেছালো বলতে বোঝাচ্ছি, আমরা নবীনতম দল আফগানিস্তানের কাছে সিরিজ হারি। ওদের সঙ্গে খেলতে ভয় পাই। আমার তো এতোকিছু বলার দরকার নেই। কারণ, পৃথিবী এখন চলে রং ও সংখ্যার ওপরে। কেউ ভালো করলে সবুজ রং হয়, কেউ খারাপ করলে লাল রং হয়। মাঝামাঝি করলে অ্যাম্বার রং থাকে। আমাদের যে র্যাঙ্কিং, সেটাই বলে দেয় আমরা লাল। আমরা ১২ দলের মধ্যে ৯-এ পড়ে আছি। সংখ্যাই বলে দিচ্ছে আমাদের অবস্থান কোথায়। হুমায়ূন আহমেদ একটা লেখা লিখেছিলেন, আমাদের স্মৃতি গোল্ডফিশের মতো, আমরা একটু পরে সব ভুলে যাই। নিজের সমালোচনা করা উচিত। আত্মসমালোচনা হওয়া উচিত।
আপনি যখন একটা দলে আটজন ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলবেন, মানে প্রথম সাত ব্যাটসম্যানের ওপর আপনার কোনো ভরসা নাই। আবার হাথুরুসিংহের আমল থেকে আপনি এমন বাজে উইকেট বানানো শুরু করেছেন যে, দেশের লোকেরাই ভাবে এটা বিদেশি উইকেট। আমাদের মনোভাবই নেতিবাচক। মাঝে যে সমস্যা হতো, অনেক হারতে হারতে একটা ম্যাচ জিতলে গর্ত থেকে একটা লোক বেরিয়ে এসে এমনভাবে দেখাতেন যে, সব ভালো হয়ে গেছে আমাদের।
আমরা পর্যালোচনাটা ঠিকভাবে করতে পারি না বা করি না। আমাদের সামর্থ্যটাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে যে ধরনের পরিকল্পনার দরকার হয়, সেটা আমরা কখনই করি না বা জানি না করতে। খনিতে মানুষ ডায়মন্ড, স্বর্ণ খুঁজতে যায়। বেড়াতে যায় না। কিন্তু আমরা বেড়াতে যাই, দেখতে যাই। আমরা জানিই না কোনটা স্বর্ণ আর কোনটা কী। ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে কথা বলা উচিত আমাদের। আমাদের খেলোয়াড়রা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে দলে জায়গা পোক্ত করে। কিন্তু এসএসসির আগে যে টেস্ট বা প্রি-টেস্ট দিতে হয়, এই চর্চা আমাদের দেশের ক্রিকেটে নেই। আমার খুব খারাপ লাগে এতো নেতিবাচক করা বলতে, কিন্তু সত্য তো সত্যই। এসব না বললে মিথ্যা বলা হবে।
উত্তরণের উপায়
পকেটে থাকা থাকলে দোকানে গিয়ে দামাদামি করা যায়। কিন্তু আমাদের তো পকেটে টাকাই নাই। খেলোয়াড় নাই আমাদের, কী খেলোয়াড় আছে! তিন ফরম্যাটে ২৫টা খেলোয়াড় দাঁড় করানো কঠিন আমাদের পক্ষে। অনেক কাজ বাকি আছে। দেশের ক্রিকেটের অবকাঠামো, মাঠ এসব নিয়ে কথা বলতে হবে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে দল অনুশীলন করেনি, খেলেছে। তো তাদের এসব ম্যাচ খেলার জন্য আরও খেলার ব্যবস্থা রাখতে হবে। মাঠ কোথায়, আমাদের টেস্ট ভেন্যু পড়ে থাকে সারা বছর, কেবল প্রথম শ্রেণি হয়। আমাদের জেলাগুলোতে লিগ হয় না ঠিক মতো। একই কথা বলতে কেমন যেন সয়ে গেছে সবকিছু। আমাদের বাচ্চাদের খেলতে হবে, প্রতিযোগিতা থাকতে হবে। তাহলে আস্তে আস্তে সব বদলাবে।
খালেদ মাসুদ পাইলট (সাবেক অধিনায়ক)
কী হয়েছে বাংলাদেশ দলের
আমার কাছে মনে হয়, প্রস্তুতির যে জায়গাগুলো আছে; আপনি সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলছেন। কেউ ১০ বছর, কেউ ১২ বছর; কেউ পাঁচ বছর, ছয় বছর ধরে খেলছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলার জন্য এতোদিনেও যদি আপনি নিজেকে তৈরি করতে না পারেন, তাহলে ব্যর্থতা কিন্তু আমার মনে হয় খেলোয়াড়দের। আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতির ব্যাপারটা হয়তো এতো শক্তিশালী না। আমাদের ঘরোয়া অবকাঠামো শক্ত নয়, এ জন্য সমস্যা থাকে।
কিন্তু শারজার ব্যাপারটা নিয়ে আমি বলব, আমাদের খেলোয়াড়দের মধ্যে নিবেদনের ঘাটতি আছে। মোহাম্মদ নবি উইকেটে আটকে থেকে দলের রান দুইশোর বেশিতে নিয়ে গেল। কিন্তু বাংলাদেশ ১২০ থেকে ১৪৩ রানের মধ্যে অলআউট। স্পিন ট্র্যাক-স্লো ট্র্যাক, শারজায় কদিন আগে মেয়েদেরও খেলা হলো। সেটা তো আমরা দেখেছি, মুখস্থ। ১২০ রানে যখন তিন উইকেট, তখন মাঝখান থেকে কেউ ৪০-৫০ রানের একটা ইনিংস খেলতে পারলেই হতো। তো সেইগুলা বেশ ঘাটতি। বাস্তবায়নেরর জায়গায় ঘাটতি আছে বলে মনে হয়।
মানসিক প্রস্তুতির ঘাটতি
আমাদের আসলে অনেক কিছুর ঘাটতি আছে। আমরা সব সময় ফল চাই। কিন্তু ফল তো আর রাতারাতি আসবে না। কিছু কিছু জায়গা আছে, শুধুমাত্র আমরা দলকে প্রতিনিধিত্ব করছি। কিন্তু একটা মিশন নিয়ে যাওয়া যে, আমি প্রত্যেকটা জায়গা থেকে মানসম্পন্ন জিনিস নিয়ে যাচ্ছি। তাহলে ফল আসবে। প্রস্তুতি হতে হবে অমন, মানসিকতা হতে হবে ওরকম। তো অনেক জায়গা, খেলোয়াড়দের নিবেদন থাকতে হবে। কোনো কারণে এসবের কোথাও ঘাটতি আছে। যার জন্য ফল করতে পারছে না। খেলোয়াড়দের মধ্যে আত্মবিশ্বাসও নাই। খেলোয়াড়দের মাঠের যে চিত্রটা দেখা যায়, ম্যাচ জেতার জন্য যে টিম বন্ডিং দরকার, সেটা নেই। নির্বাচক, কোচ, অধিনায়ক বদলে ফেলা, এগুলো কোনো বড় বিষয় না। পারফরম্যান্সের সাথে এসব খুব একটা যুক্ত না। আপনি কোচ পরিবর্তন করলেন, নতুন কোচ নিয়ে আসলেন। এসব করে খুব বেশি লাভ নেই। যতোক্ষণ না খেলোয়াড়রা যারা খেলবে, তাদের মানসিকতার পরিবর্তন হবে।
উত্তরণের উপায়
এটা রাতারাতি কী করে হবে? ঘুণে ধরা একটা কাঠ রাতারাতি কী করে ভালো করে ফেলবেন! আপনাকে চিন্তা করতে হবে, তিন মাস, ছয় মাসের মধ্যে আমি এই ব্যাপারটায় কারেকশন নিয়ে আসব, কোথায় কোথায় উন্নতি করতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করতে হবে যে, পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে আমি এই জিনিসগুলো উন্নত করব। তাহলে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু এই পরিবর্তনের হাওয়া আমি দেখতে পাচ্ছি না। পরিবর্তন বলতে সেই অর্থে আমি বড় কোনো পদক্ষেপ দেখছি না এখনও। আগে এনসিএল একটা নিয়মিত রুটিন ছিল, বিপিএল নিয়মিত রুটিন ছিল। অন্য লিগগুলোও তাই ছিল। কিন্তু শেষ তিন-চার মাসে আপনি নতুন কী পরিকল্পনা করলেন যে, যেটায় বদল আনবে, যেটা মানুষ দেখে বুঝতে পারবে। নতুন কিছুই দেখছি না।
দুই যুগে টেস্ট ক্রিকেট কতোটা এগোলো
খুব বেশি এগোয়নি। ২০০০ থেকে ২০০৮-০৯ সালের কথা যদি বলি, দেখা গেল আমরা তিন সিঁড়ি উঠেছি, এক সিঁড়ি নেমে গেছি। আবার হয়তো আরও এক সিঁড়ি উঠেছি, দুই সিঁড়ি নেমে গেছি। ২০০০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গ্রাফটা খুব উপরের দিকে না। আমাদের এক তলা থেকে দশ তলা পর্যন্ত যাওয়ার কথা; তিন তলায় আপনি উঠেছেন ঠিকই, কিন্তু নেমে গেছেন এক তলায়। তার মান দুই তলায়। এই করতে করতে আপনি আসলে সেই এক-দুই তলাতেই আছেন। ভারত-অস্ট্রেলিয়া-শ্রীলঙ্কায় যে ক্রিকেট সংস্কৃতি আছে, আমাদের তাদের কাছাকাছি যাওয়া উচিত ছিল। কারণ ক্রিকেটের জন্য বাংলাদেশ খুব উর্বর জায়গা। যেখানে ১৮ কোটি মানুষ ক্রিকেট পছন্দ করে।
সারওয়ার ইমরান (স্থানীয় কোচ, বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের প্রধান কোচ)
কী কারণে এমন অবস্থায় বাংলাদেশ দল
অনেকদিন পরপর আমরা দুই-একটা ম্যাচ জিতি, ওটা নিয়ে আমরা অনেক কিছু বলি। ওয়ানডেতে আমরা হয়তো একটা স্ট্যান্ডার্ডে আছি, যদিও আফগানিস্তানের কাছে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ হেরেছি। ওই ম্যাচগুলোও জেতার মতো ছিল, আমরা জিততে পারিনি। কিন্তু টেস্টে হঠাৎ করে দুটি ম্যাচ জিতেছে, এখানে আমি বলবো পাকিস্তানের পারফরম্যান্স মৌলিক ছিল। পাকিস্তানের কোনো বোলারই ছিল না। প্রথম টেস্টে নামিদামি বোলার ছিল, তারা কিছু করতে পারেনি।
দ্বিতীয় টেস্টে তাদের বোলিং ইফেক্টিভ ছিল না। আমাদের বোলিং তাদের চেয়ে অনেক ভালো ছিল। ওদের দলে তেমন কোনো স্পিনার ছিল না, ভালো স্পিনার ছিল না। এই সুবিধাগুলো আমরা নিতে পেরেছি। পাকিস্তান দলে অন্তর্কলহ ছিল, নতুন অধিনায়ক, টিম কম্বিনেশন ভালো ছিল না। আমরা সুযোগ সদ্ব্যবহার করেছি, আমরা খুবই ভালো বোলিং করেছি। তবে টেস্ট আমরা হারতে পারতাম মুশফিকের ওই ইনিংস কিংবা মিরাজ-লিটন অমন ব্যাটিং না করলে।
এসব দেখে আমি যতোটুকু বুঝি, আমরা মাঝেমাঝে ভালো খেলি। আর এটা নিয়েই আমরা মনে করি আমরা সবাইকে হারিয়ে দিবো। তবে চারদিন বা টেস্টে উন্নতি করতে হলে আমাদের ওই মানের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট শুরু করতে হবে। আমাদের যে এখনকার অবকাঠামো বা বিজ্ঞাপন, তা বিপিএল বা ওয়ানডে ক্রিকেটের ধারে কাছে না। যদিও আমরা বলি এটাই আমাদের এক নম্বর টুর্নামেন্ট, কিন্তু এখানে (বিপিএল) কেউ খেলতে চায় না। তারকা খেলোয়াড় কেউ খেলতে চায় না, না খেলার কারটা কী! নিশ্চয়ই কারণ আছে। আমাদের এই কারণ ঠিক করতে হবে।
আর ওয়ানডেতে একটা ট্যাগ লাগিয়েছি যে, আমরা ওয়ানডেতে ভালো। তখন তামিম, সাকিব, মাশরাফি, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ একসাথে খেলতো। এখন মাহমুদউল্লাহ ছাড়া কেউ নাই, লিটন দাসও নেই। আমাদের সেই রকম খেলোয়াড় তৈরি হয়নি। আমরা তাওহিদ হৃদয়ের ওপর মিডল অর্ডারে পুরোপুরি নির্ভর করি। কিন্তু এভাবে তো হবে না। যেসব খেলোয়াড় আসবে, জাতীয় দলে খেলার আগে তাদের যেন অভিজ্ঞতা থাকে। নতুন নতুন খেলোয়াড় আসে, ভালো খেলে, আবার হারিয়ে যায়। কারণ ঘরোয়া ক্রিকেটের স্ট্যান্ডার্ড ওই মানের না। এটার উন্নতি না হলে এভাবেই খেলতে হবে, হয়তো মাঝে মাঝে হঠাৎ দুই-একটা বড় দলের সাথে জিতবো, আর ওটা নিয়েই আমরা গর্ব করতে থাকবে, গল্প করতে থাকব চারদিকে, এভাবেই চলতে থাকবে।
অন্য দলের ক্রিকেটারদের সাথে দক্ষতা ও সামর্থ্যের পার্থক্য
অবশ্যই পার্থক্য আছে। আমাদের খেলোয়াড়রা ১৯-২০ বছর বয়সে দলে ঢুকে যায়। অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ডে ২৪-২৫ এর আগে দলে ঢোকাটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। ওখানে ওরা অনেক প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে, নিজেকে প্রমাণ করে। আমাদের এখানে হয়তো অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে ভালো খেলেছে, ঘরোয়া ক্রিকেটে দুই-একটা ম্যাচ ভালো খেলেছে, তাকে সুযোগ দিয়ে দাও। কেউ পারছে না, তার জায়গায় ওকে সুযোগ দিয়ে দাও। ঠিক আছে সুযোগ দিন, কিন্তু সীমাবদ্ধতাগুলো তো বিবেচনায় রাখতে হবে।
আমি কোন বোলিংয়ের বিপক্ষে এখানে রান করছি, এসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে দলের সাথে রান করছি, তারা দল হিসেবে কেমন, তাদের টিম স্পিরিট কেমন, ওই দল কয়টা ক্যাচ ছাড়ে এক ইনিংসে; এসব দেখতে হয়। ভালো বোলার, ভালো ফিল্ডিং, ভালো দলের বিপক্ষে রান করলে ভালো ব্যাটসম্যান আসবে। কিন্তু আমাদের এখানে হয়তো দলে দুই-একটা বোলার ভালো থাকে, বাকি দুই-তিন বোলার সেই মানের থাকে না। উইকেটও ব্যাটসম্যানকে ভালো করার ব্যাপারে সাহায্য করে না। এখানে অসমান বাউন্সের উইকেট হয়, লো উইকেট হয়, যা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমাদের সাহায্য করে না। এসব বিষয় নজরে রাখতে হবে।
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ২৪ বছরের মূল্যায়ন
আমি তেমন কোনো পার্থক্য দেখি না। তখন আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, হাবিবুল বাশাররা যেভাবে খেলতো; প্রথম ইনিংসে আমরা ৪০০ করেছিলাম। তো তারা যেভাবে খেলেছে, এখানকার মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ দেখি না। ওয়ানডেতে পার্থক্য আছে, টেস্টে পার্থক্য দেখি না। এটাই বলে দেয় আমাদের টেস্ট ক্রিকেট কতোটা এগিয়েছে।