শামির আগুনে নিউজিল্যান্ডকে পুড়িয়ে ফাইনালে অপ্রতিরোধ্য ভারত
আগে ব্যাটিং করা ভারতের ইনিংসে থাকলো অনেক অর্জন, দাপুটে ব্যাটিংয়ে হলো বেশ কয়েকটি রেকর্ড। বিরাট কোহলি, শ্রেয়াস আইয়ার ছুঁলেন সেঞ্চুরি। ঝড়ো ব্যাটিংয়ে অবদান রাখলেন রোহিত শর্মা শুভমান গিল, লোকেশ রাহুলরাও। এদের ব্যাটে বিশাল সংগ্রহ গড়া ভারতের হয়ে বল হাতে আগুন ঝরালেন নায়ক মোহাম্মদ শামি। এর মাঝেই অবশ্য লড়লেন ড্যারিল মিচেল, কেন উইলিয়ামসন; কিন্তু নিউজিল্যান্ডের জন্য তা যথেষ্ট হলো না। গ্রুপ পর্বের সব ম্যাচ জেতা অপ্রতিরোধ্য ভারত দারুণ জয়ে উঠে গেল ফাইনালে।
বুধবার মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের প্রথম সেমি-ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে ৭০ রানে হারিয়েছে ভারত। ২০১১ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠলো তারা। এ নিয়ে চতুর্থবারের ফাইনালে উঠলো ভারত। আগের তিন ফাইনালের মধ্যে দুইবার চ্যাম্পিয়ন হয় এশিয়ার এই ক্রিকেট পরাশক্তি। নবমবারের মতো সেমি-ফাইনাল খেলা নিউজিল্যান্ড তিনটি আসরের মধ্যে এবারই প্রথম ফাইনালে উঠতে পারল না। আগের দুটি বিশ্বকাপেই ফাইনাল খেলেছে কিউইরা।
টস জিতে আগে ব্যাটিং করতে নেমে ৪ উইকেটে ৩৯৭ রানের বড় সংগ্রহ গড়ে ভারত। নিজেদের বিশ্বকাপ ইতিহাসে এটা ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ, এবারের আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ৫০তম সেঞ্চুরি করে শচিন টেল্ডুলকারকে ছাড়িয়ে রেকর্ড গড়েন কোহলি, শ্রেয়াস তুলে নেন টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। রোহিত, শুভমান, রাহুলরাও করেন দাপুটে ব্যাটিং।
জবাবে শুরুটা ভালো না হলেও বড় জুটি গড়েন অধিনায়ক উইলিয়ামসন ও মিচেল। সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে লড়াই করা মিচেল সেঞ্চুরিও তুলে নেন, উইলিয়ামসন করেন হাফ সেঞ্চুরি। এই দুজনকে ফিরিয়ে নিউজিল্যান্ডকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দেন ভারতের বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা বোলিং করা শামি। গ্লেন ফিলিপস চেষ্টা করলেও বেশি পথ এগোতে পারেননি। ৪৮.৫ ওভারে ৩২৭ রানে থামে কিউইদের ইনিংস।
বড় লক্ষ্য তাড়ায় নিউজিল্যান্ডকে শুরুতেই চেপে ধরেন শামি। ৩৯ রানের মধ্যেই ডেভন কনওয়ে ও রাচিন রবীন্দ্রকে ফিরিয়ে দেন ডানহাতি এই পেসার। এখান থেকে জুটি গড়ে দলকে অনেকটা পথ এগিয়ে নেন উইলিয়ামন ও মিচেল। তৃতীয় উইকেটে ১৪৯ বলে ১৮১ রান যোগ করেন এ দুজন। ৭৩ বলে ৮টি চার ও একটি ছক্কায় ৬৯ রান করা উইলিয়ামসনকে ফিরিয়ে এই জুটিও ভাঙেন শামি।
এরপর টম ল্যাথামকে ২ বলের বেশি টিকতে দেননি বল হাতে দুর্বার ছন্দে থাকা ভারতের এই পেসার। মিচেলের সঙ্গে ৭৫ রানের জুটি গড়েন ফিলিপস, তখনও আশায় ছিল কিউইরা। কিন্তু ৩৩ বলে ৪টি চার ও ২টি ছক্কায় ৪১ রান করা ফিলিপসকে ফিরিয়ে ভারতকে নিয়ন্ত্রণ এনে দেন জাসপ্রিত বুমরাহ। পরের উইকেটটি নেন কুলদীপ যাদব, তার শিকার মার্ক চাপম্যান।
বাকি থাকা ৪ উইকেটই নিজের করে নেন শামি। তার চতুর্থ শিকারে পরিণত হওয়ার আগে ১১৯ বলে ৯টি চার ও ৭টি ছক্কায় ১৩৪ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন মিচেল। পরের ২১ রানের মধ্যে বাকি তিনটি উইকেট তুলে নেন শামি। ৯.৫ ওভারে ৫৭ রানে ৭টি উইকেট নেন ম্যাচসেরা এই পেসার। বিশ্বকাপে ভারতীয় বোলারদের মধ্যে এটাই সেরা বোলিং, এটা তার ওয়ানডের ক্যারিয়ার সেরা বোলিংও। অবশ্য কেবল শামিরই নয়, ওয়ানডেতেই ভারতের সেরা বোলিং এটা। ৪ রানে ৬ উইকেট নেওয়া স্টুয়ার্ট বিনি এতোদিন রেকর্ডটি দখলে রেখেছিলেন। বিশ্বকাপে ভারতের পক্ষে সেরা বোলিং ছিল আশিষ নেহরার। ২০০৩ বিশ্বকাপে ডারবানে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০ ওভারে মাত্র ২৩ রানে ৬ উইকেট নেন তিনি।
শামির বোলিং ফিগারটি এবারের বিশ্বকাপের সেরা, সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের ইতিহাসের পঞ্চম সেরা বোলিং এটা। এবারের বিশ্বকাপে তিনবার ৫ উইকেট নিলেন শামি, বিশ্বকাপের এক আসরে যা রেকর্ড। বিশ্বকাপে মোট চার ৫ উইকেট পেয়েছেন তিনি, এটাও রেকর্ড। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩বার ৫ উইকেট পেয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার মিচেল স্টার্ক। চলতি বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচে ২৩ উইকেট নিয়েছেন শামি, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে ১৭ ম্যাচে ৫৪ উইকেট নিয়েছেন তিনি। যা ভারতের পক্ষে সর্বোচ্চ এবং বিশ্বকাপের ষষ্ঠ সর্বোচ্চ।
এর আগে ব্যাটিং করতে নামা ভারত উড়ন্ত সূচনা পায়। শুভমানকে এক পাশে রেখে খুনে ব্যাটিং করতে থাকেন অধিনায়ক রোহিত। ৮.২ ওভারে ৭১ রানের উদ্বোধনী জুটি পায় বিশ্বকাপের আয়োজকরা। এর মধ্যে ৪৭ রান করেন রোহিত। ডানহাতি এই ওপেনার ২৯ বলে ৪টি করে চার ও ছক্কায় ৪৭ রান করে আউট হন। টিম সাউদির বলে ছক্কা মারতে গিয়ে কেন উইলিয়ামসনের হাতে ধরা পড়েন তিনি।
শুভমানের সঙ্গে যোগ দিয়ে জুটি গড়ে তোলেন কোহলি। দ্বিতীয় উইকেটে ৯৩ রান যোগ করার পর চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন শুভমান। এরপর চলতে থাকে কোহলি ও শ্রেয়াসের ব্যাটিং শো। তৃতীয় উইকেটে ১৬৩ রানের জুটি গড়ার পথে ওয়ানডেতে ৫০তম সেঞ্চুরি তুলে নেন কোহলি। শচিনের ৪৯ সেঞ্চুরির ছাড়িয়ে রেকর্ডটি নিজের করে নিলেন তিনি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ৮০টি সেঞ্চুরির মালিক হলেন কোহলি, যা ক্রিকেট ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাস নতুন করে লেখার দিন আরও একটি রেকর্ডে শচিনকে ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। বিশ্বকাপের নির্দিষ্ট কোনো আসরে এতোদিন সর্বোচ্চ রানের মালিক ছিলেন শচিন। ২০০৩ বিশ্বকাপে ৬৭৩ রান করেন তিনি। আজকের সেঞ্চুরিতে বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে এক আসরে ৭০০ ছাড়িয়ে গেছেন কোহলি।
৮০ পেরিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ব্যাটিং করা কোহলি সেঞ্চুরির পর মারকুটে মেজাজে খেলতে থাকেন। যদিও আর বেশি পথ এগোতে পারেননি। ১১৩ বলে ৯টি চার ও ২টি ছক্কায় ১১৭ রানের রেকর্ড গড়া ইনিংস খেলে আউট হন তিনি। বিশ্বকাপে এটা তার পঞ্চম সেঞ্চুরি, নাম লিখিয়েছেন রিকি পন্টিং ও কুমার সাঙ্গাকারার পাশে। এবারের আসরে এখন পর্যন্ত ১০ ম্যাচে ৩টি সেঞ্চুরি ও ৫টি হাফ সেঞ্চুরিতে ৭১১ রান করেছেন কোহলি। বিশ্বকাপে ৩৬ ম্যাচে ৫ সেঞ্চুরি ও ১১ হাফ সেঞ্চুরিতে ১ হাজার ৭৪১ রানের মালিক তিনি, যা তৃতীয় সর্বোচ্চ।
কোহলির বিদায়ের পর আরও কিছুটা সময় ঝড়ো ব্যাটিং চালিয়ে যান শ্রেয়াস। ৬৭ বলে সেঞ্চুরি পূর্ণ করা ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান ৪৯তম ওভারে থামেন, খেলেন ৭০ বলে ৪টি চার ও ৮টি ছক্কায় ১০৫ রানের দাপুটে ইনিংস। ওয়ানডেতে এটা তার পঞ্চম সেঞ্চুরি, বিশ্বকাপের দ্বিতীয়। এবারই দুটি সেঞ্চুরি করলেন তিনি। শেষ দিকে নেমে ২০ বলে ৫টি চার ও ২টি ছক্কায় ৩৯ রানের ক্যামিও ইনিংস খেলেন রাহুল। নিউজিল্যান্ডের টিম সাউদি ৩টি ও ট্রেন্ট বোল্ট একটি উইকেট পান।