'এটা বিশ্বাস করার মতো নয়'- পেলের ক্লাব সান্তোস যেভাবে অবনমিত হলো
১১১ বছরের দীর্ঘ সমৃদ্ধ ইতিহাস সান্তোসের, সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের একজন, ব্রাজিলের 'কালোমানিক' খ্যাত পেলে তার ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন এই ক্লাবে। একবিংশ শতাব্দীতে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের অন্যতম সেরা তারকা নেইমারেরও বেড়ে ওঠা এই সান্তোসেই। আরও ব্রাজিলিয়ান তারকা ফুটবলারের আঁতুড়ঘর এই ক্লাবটি।
নিজেদের ১১১ বছরের ইতিহাসে ২০২৩ সালেই প্রথমবারের মতো ব্রাজিলের শীর্ষ সারির লিগ থেকে অবনমিত হয়েছে সান্তোস। পেলে, নেইমারদের মতো তারকা-মহাতারকাদের যত্ন নেওয়া ক্লাবটি কীভাবে চূড়া থেকে পতিত হলো ভূমিতে?
ব্রাজিলে ফুটবল দ্বিতীয় ধর্মের মতোই, ক্লাবগুলোকে নিজেদের উপাসনালয় হিসেবেই দেখেন ব্রাজিলের ফুটবল সমর্থকরা। সান্তোসের সমর্থকরাও ব্যতিক্রম নন। এত ভালোবাসার ক্লাব যেদিন অবনমিত হলো সেদিন কান্না ধরে রাখতে পারেননি গ্যালারিতে উপস্থিত ভক্তরা, তবে সেই কান্নার সঙ্গে মেশানো ছিল ক্ষোভ আর হতাশাও।
গ্যালারিতে যারা ছিলেন তারা মাঠে বিভিন্ন জিনিস ছুঁড়ে মেরেছেন, পুলিশের সঙ্গেও সংঘর্ষ বেধেছে তাদের। সাও পাওলো জুড়ে অনেক যানবাহনে আগুনও দিয়েছেন ক্ষুব্ধ সান্তোস সমর্থকরা। সান্তোস কিংবদন্তি পেপে, যিনি পেলের সঙ্গে খেলেছেন, এই ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪০৩ গোল করেছেন। সেই পেপে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, যে ক্লাবের হয়ে তিনি ৭৪১ বার মাঠে নেমেছেন, তারা দ্বিতীয় স্তরে নেমে গেছে!
সান্তোসের অবনমন নিয়ে আবেগাপ্লুত পেপে বলেন, '৮৮ বছর বয়সে এসে আমার মনে অনেক ধরনের আবেগ কাজ করছে। ভালো-মন্দ উভয় ধরনের অনুভূতির মিশেল রয়েছে সেখানে। সন্দেহাতীতভাবেই এটি একটি দুঃখের মুহূর্ত, আমি ভাবিনি দল অবনমিত হয়ে যাবে, ভেবেছিলাম ফুটবল ঈশ্বর আমাদের সাথেই আছেন।'
মৌসুমের শেষ ম্যাচে সান্তোস মুখোমুখি হয়েছিল ফোর্তালেজা স্পোর্টিং ক্লাবের, যাদের অবস্থান ছিল পয়েন্ট টেবিলের মাঝের দিকে, সান্তোসের অবস্থান ছিল ১৫ তম, অবনমন থেকে দুই ধাপ ওপরে। শেষ ম্যাচের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ভাস্কো দা গামা, বাহিয়া এবং সান্তোসের মধ্যে যে কোনো এক দলের অবনমিত হওয়ার সুযোগ ছিল। যার মধ্যে তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল সান্তোস, মাত্র ১০% সম্ভাবনা ছিল তাদের অবনমিত হওয়ার।
কিন্তু ঘরের মাঠে সান্তোস ২-১ গোলে হেরে যায়, অন্যদিকে ভাস্কো দা গামা এবং বাহিয়া দুই দলই নিজেদের ম্যাচে জয়লাভ করে, যার ফলাফল হিসেবে সান্তোসই অবনমিত হয়। ব্রাজিলের ক্রীড়া সাংবাদিক এবং সান্তোস ভক্ত অ্যান্থনি ওয়েলস যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে এটি আসলেই ঘটেছে, 'আমার মনে হচ্ছে না এটা সত্যি। আমি দুঃস্বপ্ন দেখেছি, সকালে যখন ঘুম থেকে উঠলাম, আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে- আমি কী আসলেই এই দিন দেখছি? এটা কী সত্যিই ঘটেছে?'
অ্যান্থনি যোগ করেন, 'যে কোনো সান্তোস সমর্থকের জন্যই এটা হৃদয়বিদারক। কারণ আমরা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে অবনমন এড়াতে পারব।' গত বছর পেলের মৃত্যুর পর সান্তোসের এই অবনমন আরও বেশি পীড়াদায়ক বলে হতাশা ব্যক্ত করলেন অ্যান্থনি। অনেক সান্তোস সমর্থক তো এমনও বলেছেন, পেলে এই দিন দেখার জন্য বেঁচে নেই বলেই বরং ভালো হয়েছে, কারণ তিনি সেটার প্রাপ্য নন।
সান্তোসের এই দুর্দিন আসবে তা আগে থেকেই অনুমান করা যাচ্ছিল। ২০২১ এবং ২০২২ সালে পরপর দুইবার পয়েন্ট টেবিলের মাঝের দিকে থেকে শেষ করে তারা। কিন্তু ক্লাব কর্তৃপক্ষ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, এমন যেন তারা ঘুমের ঘোরে নিজেদের ভাগ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছিল। সান্তোসের সভাপতি আন্দ্রেস রুয়েদা ২০২১ সালে দায়িত্বে আসার পর থেকেই ক্লাবের সমর্থকদের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছেন, যদিও তার সময় শেষ, গত শনিবার মার্সেলো টেক্সেইরা আবারও ক্লাবের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
টেক্সেইরা সভাপতি হয়ে প্রথমের পেলের ১০ নাম্বার জার্সিকে অবসরে পাঠিয়েছেন, যতদিন সান্তোস আবারও প্রথম স্তরে ফিরতে পারবে ততদিন কেউ এই ক্লাবের ১০ নাম্বার জার্সি পড়তে পারবেন না। সান্তোসের প্রায় ১৪২ মিলিয়ন ডলার দেনা রয়েছে, নিম্নস্তরের লিগে খেলার কারণে যা আরও বাড়তে পারে বলেই ধারণা। নেইমার-রদ্রিগোর মতো তারকাদের জন্ম দেওয়া সান্তোস একাডেমিরও আর আগের সেই জৌলুস নেই। এখন আর তারকা ফুটবলার বের হয়ে আসেন না সেখান থেকে, যাদেরকে চড়া দামে ইউরোপে বিক্রি করে দেনা মেটানো সম্ভব হতো।
সান্তোসের মূল লক্ষ্য এখন সিরি বি থেকে সিরি আ'তে ফেরা। তবে রাতারাতি সেটি করাও কঠিন। যেসব ক্লাব নিচের স্তরে অবনমিত হয় তাদের শীর্ষ স্তরে ফিরতে কয়েক মৌসুম লেগে যাওয়ার নজিরও রয়েছে। তাই সান্তোসের সামনে এখন কঠিন এক পথ, নিজেদেরকে আবারও ওপরে টেনে তোলার চ্যালেঞ্জ সামনে।
সান্তোসের এই দুর্দশার কথা এক বাক্যে যেন বলে দিয়েছেন ব্রাজিলিয়ান ধারাভাষ্যকার জুকা কুফরি, '২০২৩ সালে ব্রাজিলের ফুটবলে সবচেয়ে বড় দাগ হয়ে থাকবে সান্তোসের অবনমিত হওয়া।' পেলে-নেইমারদের ক্লাব নিজেদের হারানো ঐতিহ্য ও গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারে কিনা, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।