‘বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে আমার এখনও আক্ষেপ হয়’
ডেভ হোয়াটমোর, নামটি শুনলেই বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তরা ফিরে অতীতে। নামটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য স্মৃতি, যার বেশিরভাগই আনন্দের। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অনেক প্রথমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ান এই ভদ্রলোকের নাম। ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতেছিল হোয়াটমোরের অধীনেই। বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব ছেড়ে ২০০৭ সালে চলে যান এই অজি। এখন আবার ফিরেছেন বিপিএলে ফরচুন বরিশালের হয়ে কাজ করতে।
দ্য ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকার ক্রিককিংডম একাডেমিতে বসে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে বিশেষ এক সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন হোয়াটমোর। এই একাডেমির কোচ হিসেবেও কাজ করছেন তিনি, উদীয়মান ক্রিকেটারদের দিকনির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপচারিতায় এই অস্ট্রেলিয়ান কোচ স্বীকার করেছেন, ২০০৭ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি নিয়ে এখনও আফসোস করেন তিনি।
এবারের বিপিএলে হোয়াটমোরে দল ফরচুন বরিশালের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সাত ম্যাচের মধ্যে চারটিতে হেরেছে দলটি। এর মধ্যে কিছু ম্যাচে ৫০/৫০ সুযোগ থেকেও হেরেছে তারা। বরিশালের সেসব ম্যাচ জয়ের সামর্থ্য ছিল বলেই মনে করেন হোয়াটমোর, 'এখন পর্যন্ত বেশ উপভোগ্য একটা টুর্নামেন্ট আমার জন্য। তবে আর কয়েকটা ম্যাচ জিততে পারলে ভালো লাগতো। আমরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী খেলতে পারিনি, আমাদের এখন টানা কয়েকটা ম্যাচ জিতে দেখতে হবে কোয়ালিফায়ারের জন্য আমরা কোথায় থাকি।'
শ্রীলঙ্কাতে জন্ম নেওয়া হোয়াটমোর উপমহাদেশের ক্রিকেট কোচিংয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন। শ্রীলঙ্কাকে ১৯৯৬ বিশ্বকাপ তো জিতিয়েছিনই, পাশাপাশি বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপালের জাতীয় দলের কোচও ছিলেন। আইপিএল এবং রঞ্জি ট্রফিতেও কাজ করেছেন হোয়াটমোর।
বাংলাদেশের কোচ হয়ে ২০০২ সালে আসেন হোয়াটমোর। তখনকার স্মৃতিচারণ করলেন তিনি, 'আমি যখন বাংলাদেশের কোচ হয়ে আসি, দলের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। অনেকেই হয়তো বলবে, আমার জন্য এটাই সেরা সুযোগ ছিল দলটিকে ভালো অবস্থানে পৌঁছে দেওয়ার।'
'আমরা উন্নতি ঠিকই করেছি। সাদা বলের ক্রিকেটে বেশি করেছি, তবে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সিরিজও জিতেছি তখন। তারা কিন্তু ওইসময় খুব একটা খারাপ দল ছিল না। কিন্তু সীমিত ওভারের ক্রিকেট কীভাবে খেলতে হয় সেটা শিখাতে পারাটাই আমার জন্য সবচেয়ে সুখকর ছিল।'
২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিজেদের ইতিহাসে প্রথম কোনো টেস্ট ম্যাচ জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। তবে এটি আসতে পারত আরও দুই বছর আগেই, ২০০৩ সালে শক্তিশালী পাকিস্তানের বিপক্ষে, তাদেরই মাটিতে। দুই আম্পায়ার অশোকা ডি সিলভা এবং রাসেল টিফিনের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের সঙ্গে ইনজামাম-উল-হকের অতিমানবীয় ইনিংসের সুবাদে যা আর হয়নি। সেসময় ডিআরএস থাকলে ফলাফল ভিন্ন হতো বলেই মত হোয়াটমোরের, 'ডিআরএস থাকলে আমরা হয়তো ম্যাচটা জিততাম। অশোকা ডি সিলভার থেকেও রাসেল নামের এক জিম্বাবুয়াইয়ান আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা হেরেছি। আমাদের বেশ কয়েকবার মনে হয়েছিল তার আঙ্গুল উঠতে যাচ্ছে, বিশেষ করে ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলা ইনজামামের বিরুদ্ধে। কিন্তু তা আর হয়নি। তবে বাংলাদেশের সবাই বুঝতে পেরেছিল, আমরা যা করছিলাম তা সঠিক উপায় ছিল।'
ক্রিকেটের বিভিন্ন পরিবর্তন নিয়েও কথা বলেছেন এই অস্ট্রেলিয়ান কোচ। বিশেষ করে বর্তমানে যেসব দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ হয়ে থাকে, সেগুলোর ভক্ত নন হোয়াটমোর, 'ক্রিকেট দুনিয়া পরিবর্তিত হচ্ছে, খেলোয়াড়রা এখন ছোট সংস্করণে খেলার দিকে মনোযোগী হচ্ছে। তাসকিন আহমেদের কথাই ধরুন, আমার মনে হয় চোটের কারণে লম্বা ফরম্যাটের খেলা তার জন্য কঠিন হবে। এছাড়াও ভালো আয়ের জন্য অন্য অনেক খেলোয়াড় ছোট সংস্করণের দিকে ঝুঁকছে।'
'দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ কোনোভাবেই সাহায্য করছে না। কিন্তু টেস্ট সিরিজ আয়োজন করে বোর্ডরাও টাকা তুলতে পারছে না। তবে খেলোয়াড়দের জায়গা থেকে চিন্তা করলে, বিজোড় সংখ্যার ম্যাচ মনস্তাত্ত্বিকভাবে সাহায্য করে। প্রথম ম্যাচ হারলেও সিরিজে ফিরে এসে জেতার সুযোগটা পাওয়া যায়।'
বাংলাদেশের ক্রিকেটে লম্বা সময়ের জন্য প্রভাব রেখে যাওয়া হোয়াটমোর এখনও এই দলের খেলা নিয়ে খোঁজখবর রাখেন তিনি। ঘরের মাঠে বাংলাদেশ বাড়তি সুবিধা নিলেও দেশের বাইরের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে যে সেটি পাওয়া যাবে না তা নিয়েও সতর্ক করেছেন হোয়াটমোর।
এরপরই ২০০৭ বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশের দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে নিজের আফসোসের কথা জানিয়েছেন হোয়াটমোর, 'পেছনে ফিরে তাকালে ২০০৭ সালে আমার চলে যাওয়াটা কিছুটা পোড়ায়। আমার স্ত্রীও বলেছে যে আমি হয়তো ভুল করছি। কিন্তু মানুষ অভিজ্ঞতা থেকেই শেখে, আমার জন্যেও এটি একটি সেরকম অভিজ্ঞতাই ছিল।'
এবারের আগে ২০১৬ সালে সর্বশেষ বরিশাল বুলসের কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন হোয়াটমোর। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রধান কোচ হিসেবে ফিরে আসার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি তিনি, 'আমার ভবিষ্যত যদি আমি বলতে পারতাম তাহলে খুবই ভালো হতো। আমি বেশ কয়েকটি জায়গায় কাজ করছি একসাথে। তবে এই মুহূর্তে আমি বাংলাদেশে আসতে চাইলে সেটি অন্যদের সঙ্গে অন্যায় হবে। এখানে দুর্দান্ত সব লোকেরা কাজ করছেন। কিন্তু যদি কখনও সুযোগ আসে তাহলে কেন নয়!'