‘তিন বেলা খেয়ে বেঁচে থাকাটাই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল’
লেখাপড়া এসএসসি পর্যন্ত। এরপর এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছুটে চলা। আর বইয়ের সাথে সখ্য হয়নি। সেই সিদ্দিকুর রহমানই বলে উঠলেন, 'ইউ মে নো, আই অ্যাম নট এডুকেটেড।' এভাবেই এখন ইংরেজিতে কথা বলেন দেশসেরা এই গলফার। বিদেশিদের বলা ইংলিশ দেখে এখন আর হা করে তাকিয়ে থাকেন না তিনি।
বল বয় সিদ্দিকুর অবশ্য একটা ইংরেজি শব্দও বুঝতেন না। সেই না বোঝার ব্যাপারটিই তার মধ্যে জেদ তৈরি করে। গলফ মাঠে নিজেকে সেরা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার পাশাপাশি অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলার ব্যাপারটিকেও স্বপ্নে পরিণত করে ফেলেন সিদ্দিকুর। অদম্য ইচ্ছা আর কঠোর পরিশ্রমে দুটি স্বপ্নই পূরণ হয়েছে তার।
ব্রুনাই ওপেনে সেরার মুকুট জেতা সিদ্দিকুর তিন বছর পর দিল্লিতে আরেকটি এশিয়ান ট্যুরে চ্যাম্পিয়ন হন। আর গলফ টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন মানেই কাড়িকাড়ি টাকা। দেশসেরা এই গলফারের এখন বাড়ি, গাড়ি সবই আছে, ঘুমান শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে।
সিদ্দিকুরের জীবনের গল্প শুনলে অবশ্য রূপকথার মতো মনে হতে পারে। ঠিকমতো তিন বেলা খাবার পাওয়াই যে মানুষটির কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, সেই মানুষটিই এখন বছরের বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে সময় কাটান, বিলাসবহুল হোটেলে করেন রাত্রিযাপন।
ছোট্ট বয়সে গলফ ক্লাবে বল বয়ের চাকরি নেওয়া, পরিবারের দিনাতিপাত, লেখাপড়া করতে না পারা, গলফ সামগ্রী ধার করে বাছাইপর্ব খেলা, দারিদ্রতার শেকল ভেঙে নিজেকে সেরা প্রমাণ করার গল্পসহ জীবনের কঠিন কঠিন বাঁক নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন সিদ্দিকুর।
টিবিএস: বন্দি অবস্থায় দীর্ঘদিন কেটে গেল। এখন কীভাবে সময় কাটছে?
সিদ্দিকুর রহমান: গত কয়েক মাসের মতো এখনও বাসাতেই সময় কাটছে। ফিটনেস ধরে রাখার চেষ্টা করছি। এ ছাড়া তো আসলে কিছু করার নেই।
টিবিএস: লম্বা সময় ধরে এই অবস্থা, বিরক্তি কাজ করে কিনা?
সিদ্দিকুর: কিছুটা বিরক্তি কাজ করে। কিন্তু সবচেয়ে বড় হচ্ছে বেঁচে থাকা। বিরক্ত হয়ে লাভ নেই। পুরো পৃথিবীজুড়ে একই অবস্থা। এখান থেকে আমরা যতটা নিরাপদে থাকতে পারি, সেটাই বড় ব্যাপার। আমরা অনেক হিসাব করি, এই ক্ষতি হচ্ছে, ওই ক্ষতি হচ্ছে; আসলে এ সবই মিথ্যা। আমার মনেহয় এই অবস্থা বুঝে এটাকে মেনে নেওয়া একটা ভালো সিদ্ধান্ত।
টিবিএস: ক্রিকেট, ফুটবল বা অন্যান্য খেলার খেলোয়াড়দের জন্য ফিটনেস বিশেষ গুরুত্বের। গলফ খেলোয়াড়দের জন্য ফিটনেস কতটা জরুরী?
সিদ্দিকুর: আসলে গলফের জন্য অতটা ফিটনেসের দরকার নেই। তবে একেবারে উচ্চ পর্যায়ে যেতে আপনাকে প্রতিটা বিষয়ই ভালোভাবে যত্ন নিতে হবে। গলফ শারীরিকের চেয়ে বেশি মানসিক খেলা।
টিবিএস: জাপান ও কোরিয়ায় আপনার দুটি টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার কথা। কিন্তু ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে যেতে পারছেন না। সর্বশেষ কী অবস্থা?
সিদ্দিকুর: বাংলাদেশিদের জন্য জাপান ও কোরিয়াতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আছে। যে কারণে আমার যাওয়ার ব্যাপারটা এখনও ঝুলে আছে। তবে টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার পথেই আছে। আবার টুর্নামেন্টে বাতিলও হয়ে যেতে পারে। যদিও সূচি অনুযায়ী টুর্নামেন্ট এখনও বাতিল হয়নি। যদি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়, তাহলে আমি যেতে পারব। এখানে ভিসার কোনো জটিলতা নেই।
টিবিএস: করোনাভাইরাসের প্রভাব সব খেলাতেই পড়েছে। অনেক টুর্নামেন্ট বাতিল হয়ে গেছে। ফুটবল ও ক্রিকেটসহ অন্যান্য খেলা ফিরলেও দর্শকবিহীন মাঠে খেলা হচ্ছে। গলফে কেমন প্রভাব পড়েছে বা ভবিষ্যতে কতটা পড়তে পারে?
সিদ্দিকুর: আমার মনে হয় গলফে অতটা প্রভাব ফেলেনি। কারণ আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ডে টুর্নামেন্ট চলছে দর্শকবিহীনভাবে। গলফে স্বাস্থ্যবিধি মানা খুব সহজ। আমরা যখন গলফ খেলি, কারও সাথে কেউ কথা বলি না, দূরত্বও থাকে অনেক। শুধু ক্লাব হাউজে আমরা একত্রিত হই। তো স্বাস্থ্যবিধি মেনে বড় টুর্নামেন্ট হচ্ছে। তবে কিছু সময়ের জন্য গলফও বন্ধ ছিল। আড়াই-তিন মাসের মতো বন্ধ ছিল।
টিবিএস: আপনার গলফে আসার গল্পটা ছোট করে যদি শোনাতেন…
সিদ্দিকুর: গলফে আমি কাজের সন্ধানে গিয়েছিলাম। কাজ করতাম আর ফাঁকে ফাঁকে খেলতাম। ১৯৯৯ সালে আমাকে একটা সুযোগ দেওয়া হয়। জাতীয় দলের খেলোয়াড় নির্বাচনের জন্য আমাদের জুনিয়রদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতায় দেয়। তো সেখানে আমি কোয়ালিফাই করি। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর আমি খুব এক্সাইটেড ছিলাম। ওই সময়টাকে মনে হয় আমি কাজে লাগাতে পেরেছি। ওটা আমার জন্য বড় সুযোগ ছিল। কারণ আমি একেবারেই নিম্নবিত্ত থেকে এসেছি। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াটা আমার জন্য গর্বের ছিল। তো এভাবেই গলফে আসা। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর আমি এটাকে পেশা হিসেবে নিয়ে নিই। এরপর পরিশ্রম করে আজ আমি এখানে।
টিবিএস: গলফার হবেন বলে গলফে কাজের সন্ধানে গিয়েছিলেন নাকি স্রেফ কাজের সন্ধানে গিয়েছিলেন?
সিদ্দিকুর: না, শুধু কাজের জন্য। আমরা পরিবার তো স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। তো পরিবারকে সাপোর্ট করা এবং পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য কাজের সন্ধানে গিয়েছিলাম।
টিবিএস: কাজ করতে করতে কখন মনে হলো যে আপনিও একজন গলফার হতে পারেন?
সিদ্দিকুর: আমি যখন ২০০১ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত অ্যামেচার ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হই, তারপর আমার মনে হয়েছে আমি পারব। তারপর থেকে আমার অনুশীলন, লক্ষ্য পরিবর্তন হয়ে যায়।
টিবিএস: আমরা জানি গলফ উচ্চবিত্তদের খেলা। সাধারণ মানুষজন এই খেলাটা খেলেন না। গলফের সামগ্রী, গলফ ক্লাবে তালিকাভুক্ত হতে বেশ টাকার দরকার। সব মিলিয়ে আমাদের দেশে গলফ খেলা বা গলফার হতে চাওয়া বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে কিনা?
সিদ্দিকুর: আমরা এক সময়ে এমনই ভাবতাম। তবে এটা আমাদের ভুল ধারণা। গলফ খেলা বা গলফে আসা এখন কোনো ব্যাপার না। কিন্তু একটা সময়ে এটা অনেক খরুচে ছিল। আমাদের দেশে গলফ এখন জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তার কারণে গলফের সামগ্রীর সহজলভ্যতা থেকে শুরু করে প্রচার, প্রসার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন যে কেউ চাইলেই গলফ খেলতে পারবে। এই প্রবেশাধিকার এখন সহজ হয়ে গিয়েছে। আগে এটা ছিল ধনী ব্যক্তিদের খেলা, বয়স্ক বা সৌখিনদের খেলা, এখন আর তেমন নেই।
এমনিও খেলতে পারে আবার পেশাদার হিসেবেও নিতে পারে। আমাদের দেশে গলফ ক্লাবগুলো ক্যান্টনমেন্ট ভিত্তিক। ১০-১৫ বছর আগে গলফ ক্লাবে প্রবেশাধিকার কঠিন ছিল। ক্যান্টনমেন্টে সাধারণ মানুষ ঢুকতে পারতো না। যারা গলফ ক্লাবের সদস্য ছিলেন, ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার জন্য তাদেরকে একটা গাড়ির স্টিকার দেওয়া হতো। বিত্তবানরাই শুধু প্রবেশাধিকার পেতেন। কিন্তু এখন সেটা নেই।
এমনকি অবহেলিতদের জন্য গলফ ফেডারেশন থেকে প্রশিক্ষণের ধারাবাহিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এখন প্রবেশাধিকার অনেক সহজ। গলফ খেলার সামগ্রীও তেমন ব্যাপার না। আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ গলফ কোর্সে ভর্তি হওয়া এখন কঠিন নয়। প্রতিটা গলফ কোর্সে অনুশীলনের ব্যবস্থা আছে। নূন্যতম একটা ফি দিয়ে যে কেউ দুই-এক ঘণ্টার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। এটা আর এখন কঠিন নয়।
টিবিএস: আপনি বলছিলেন ১০-১৫ বছর আগেও এমন অবস্থা ছিল না। আবার আপনি এসেছেনও নিম্নবিত্ত থেকে। এতো প্রতিকূলতার মাঝে গলফার হওয়ার সাহস পেয়েছেন কীভাবে?
সিদ্দিকুর: আমি যখন ২০০১ সালে চ্যাম্পিয়ন হই, তখন তো আমার হারানোর কিছু ছিল না। আমার তখন সাহস ছিল অন্যরকম। আমি যখন গলফে কাজ করতাম, তখন আমার আয় একেবারেই কম ছিল। মাসে আমার আয় ৪০০-৫০০ টাকা ছিল। কিন্তু জাতীয় দলের ঢোকার পর আমাকে একটা বেতন দেওয়া হতো, সেটা ছিল ৩ হাজার টাকা। আমার জন্য ওই টাকা অনেক বড় একটা পাওয়া ছিল। যে কারণে আমি অনেক অনুপ্রাণিত হই।
তখন আমার মনে হয়েছে আমি যদি এখানে আরেকটু ভালো করি, আমার আয় আরও বেড়ে যাবে। যদি আরও ভালো করতে পারি, আমি বিদেশে গিয়ে খেলতে পারব। কারণ তখন আমাদের কিছু খেলোয়াড় ছিল, তারা ভারতে গিয়ে খেলত। তাদের খেলা দেখেও আমি অনেকটা অনুপ্রাণিত হই। তারা বিদেশে গিয়ে খেলে, আমিও একদিন পারব; জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর এমন একটা মনোভাব তৈরি হয়। যে কারণে আমার লক্ষ্য ওদিকে চলে যায়।
টিবিএস: আপনি যেমন পরিবার থেকে উঠে এসেছেন, এমন পরিবারের কেউ গলফার হতে চাইলে উৎসাহিত করবেন?
সিদ্দিকুর: আমাদের দেশে যতো গলফার আছে এখন, এর মধ্যে ৯৮ শতাংশ অবহেলিত (সামজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত)। পেশাদার, জাতীয় দল, জুনিয়র বা শুরু করছে সবাই এমন খেলোয়াড়। আমাদের দেশের গলফের অবস্থা বিবেচনায় বিত্তবানদের সন্তানরা সেভাবে উৎসাহ পাচ্ছে না যে, গলফকে পেশা হিসেবে নেবে। তো আমাদের দেশের শতকরা ৯৮ ভাগ গলফার অন্যদের তুলনায় কম সুবিধাভোগী।
টিবিএস: কাজ রেখে যেদিন থেকে গলফার হিসেবে অনুশীলন শুরু করলেন, সেই দিনের অনুভূতি কেমন ছিল?
সিদ্দিকুর: এটা একটা অসাধারণ মুহূর্ত ছিল। যখন আমি ১৯৯৯ সালে জুনিয়র থেকে কোয়ালিফাই করি, প্রথম হই; এটার অন্যরকম একটা ভালো লাগা ছিল। দারুণ একটা অনুভূতি কাজ করছিল যে আমি বাংলাদেশের জাতীয় গলফ দলে ঢুকতে পেরেছি। এরপর আমাকে একটা গলফ সেট দেওয়া হলো, এটা একটা আনন্দের ব্যাপার। কারণ আমি যখন কোয়ালিফাইং খেলি, তখন আমার খেলার সামগ্রী ছিল না। আমাকে ধার করে কোয়ালিফাইং খেলতে হয়েছে। তো দারুণ একটা ব্যাপার ছিল যে দলে সুযোগ পেয়েছি এবং আমাকে একটা গলফ সেট দেওয়া হয়েছিল। আমাকে খেলার জন্য দেওয়া হয়েছিল। একটা সময়ে গিয়ে সেটা আমাকে ফেরত দিতে হয়েছিল।
টিবিএস: আপনার প্রথম টুর্নামেন্ট এবং সেই টুর্নামেন্টের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে যদি বলতেন…
সিদ্দিকুর: আমার প্রথম পেশাদার টুর্নামেন্ট ছিল কোয়ালিফাইং, সেটা ছিল ভারতে। বড় টুর্নামেন্টে খেলতে প্রথমে বাছাইপর্ব খেলে কোয়ালিফাই করে তারপর যেতে হয়। ২০০৭ সালে জুলাইতে আমি ভারতে কোয়ালিফাইং খেলতে চাই। আমি ২০০৮ এর জন্য কোয়ালিফাইড হই। ২০০-৩০০ গলফারের মধ্যে আমি ১৪ নম্বর হই। ওটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া ছিল যে আমি, ইন্ডিয়ান ট্যুরে সুযোগ পেয়েছি এবং সারা বছর খেলতে পারব।
টিবিএস: গলফার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
সিদ্দিকুর: কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়নি, সেটা বলুন। অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। এখানে আর্থিক চ্যালেঞ্জ ছিল। ইউ মে নো, আই অ্যাম নট এডুকেডেট (আপনারা জেনে থাকতে পারেন, আমি শিক্ষিত নই)। আমার কোনো সার্টিফিকেট নেই। তো বিদেশে ভ্রমণ করাটা চ্যালেঞ্জ ছিল। আমি একা, আমার কোনো পার্টনার ছিল না যে আমি কোনো সাহয্য নিবো। আমাকে একা ভ্রমণ করতে হতো। আমি প্রথম দিকে ভারতে যেতাম রাস্তাপথে। সেখানে গিয়ে হোটেল খোঁজা, বুকিং দেওয়া এসব চ্যালেঞ্জ ছিল। রাস্তাপথে গেলে দুই-তিনটি লাগেজ বহন করা; ওই স্ট্রাগলটা কেমন ছিল, কেউ না করলে বোঝানো যাবে না।
অন্যান্য স্পোর্টসে ম্যানেজার থাকে, টিম ম্যানেজমেন্ট থাকে, হোটেল বুকিং করা থাকে। সবই প্রস্তুত থাকে। এসব আমাদের কিছুই ছিল না। আর্থিক সঙ্কট, পাশাপাশি আমি সেভাবে কিছু বুঝতাম না। তো মাথায় চাপের বড় একটা বোঝা নিয়েই শুরু করতে হয়েছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে এশিয়ান ট্যুরে যখন আমি কোয়ালিফাই করি, ওটা ছিল আরেকটা চ্যালেঞ্জ। কারণ তখন আমাকে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়াতে গিয়ে খেলতে হতো।
ভারতের সঙ্গে আমাদের অনেক মিল, আমাদের প্রতিবেশি দেশ। হিন্দিও একটু বলতে পারি। ভারতের চেয়ে ওসব দেশে বেশি চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ এখনও আমরা মালয়েশিয়াতে যাবো, আমরা বাংলাদেশিরা ভাবতে পারি না। এশিয়ান ট্যুর ছিল একটা দেশ থেকে আরেকটা দেশ। সেখানে ভিসা প্রস্তুত করা, প্রতিটা দেশের আইন কানুন জানা, অনলাইনে হোটেল বুকিং দেওয়া, এয়ার টিকেট, সেখানকার ক্যারি অ্যারেঞ্জ করা; এসব চ্যালেঞ্জ খুব কঠিন ছিল।
টিবিএস: আপনি বললেন যে আপনি শিক্ষিত নন। কিন্তু এখন আপনি ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলেন। ভাষার এই উন্নতি করলেন কীভাবে?
সিদ্দিকুর রহমান: এটাও আমার একটা স্বপ্ন ছিল যে আমি ইংরেজিতে কথা বলব। কারণ আমি প্রাইমারিতে সব সময় ইংরেজিতে ফেইল করতাম। আমি গলফ ক্লাবে ছিলাম, বিদেশিদের দেখতাম। তারা অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলে যেতেন। আমি একটা শব্দও বুঝতাম না। অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলাটাও আমার কয়েকটা স্বপ্নের মধ্যে একটা। তো এরপর আমি ওই পরিবেশ পেয়েছি, ওই পর্যায়ের মানুষের সাথে চলেছি। তাদের কাছ থেকেও শিখেছি। এটা আমি আয়ত্ত করে নিয়েছি।
কোথাও কোর্স করিনি, নিজে নিজেই শিখেছি। বিদেশে গেলে আমার ভাষা কেউ বুঝবে না। সেখানে আমাকে ইংরেজিতেই কথা বলতে হবে। ভাঙাচোরা দুই-একটা বলতে বলতে আস্তে আস্তে হয়ে গেছে। গ্রামারও একটু অনুসরণ করতাম আগে থেকেই। তারপরও ওয়ার্ডগুলো শেখা যে কোনটার কী অর্থ জানতাম। শব্দ শিখে শিখে নিজে নিজে বাক্য তৈরি করতাম। কেউ একটা লাইন বললে শুনেই সেটা মুখস্থ করতাম। নিজে নিজেই কথা বলতাম বারবার। এভাবেই আসলে শেখা।
টিবিএস: আপনি একটু আগে বললেন সেভাবে আপনার লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। আসলে কতটুকু পড়েছেন?
সিদ্দিকুর: আমি এসএসসি পর্যন্ত পড়েছি। এরপর আর লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি আমার।
টিবিএস: ব্রুনাই ওপেনে যেতে চাই। ওই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর কেমন অনুভূতি কাজ করছিল?
সিদ্দিকুর: সম্ভবত ওই বছর আমার শেষ বছর হতো, যদি আমি ওই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন না হতাম। আমি এতটাই সমস্যায় পড়েছি ২০১০ সালে গিয়ে, মনে হচ্ছিল আমার শেষটা দেখতে পাচ্ছিলাম। তখন আমার কোনো পছন্দ ছিল না, করো নয়তো মরো। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি ব্রুনাই ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হই। ওই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আমার আত্মবিশ্বাসের পর্যায় পরিবর্তন হয়ে যায়।
তখন থেকে আমার আর্থিক কোনো সমস্যা সমস্যা ছিল না। আমি মন খুলে খেলতে পেরেছি। যে কারণে আমি এখনও খেলতে পারছি। আমার আর্থিক কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ব্রুনাই ওপেন থেকে আমি ৫৪ হাজার ডলার (প্রায় ৪৬ লাখ টাকা) পেয়েছিলাম। যা আমার জন্য বিরাট একটা ব্যাপার ছিল। ব্রুনাই ওপেনের পর আমাকে আর পেছন ফিরে দেখতে হয়নি। ব্রুনাই ওপেনকে আমি আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট বলব। এরপর আমি বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের টুর্নামেন্টে খেলেছি।
টিবিএস: কোন শিরোপা জিতে সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছেন?
সিদ্দিকুর: যদি আমি অ্যামেচার আর পেশাদার ধরি, তাহলে অবশ্যই ২০০১ সালে আমি যখন বাংলাদেশে প্রথম চ্যাম্পিয়ন হই ওইটা এবং ব্রুনাই ওপেন।
টিবিএস: এখন পর্যন্ত দেশি-বিদেশি কতগুলো টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন?
সিদ্দিকুর: ঠিক সংখ্যাটা বলতে পারছি না। তবে অ্যামেচার আর পেশাদার মিলিয়ে ২৫টির মতো। স্থানীয় টুর্নামেন্ট ৩০-৪০টার মতো হবে।
টিবিএস: এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্জন কোনটা মনে হয়?
সিদ্দিকুর: আমি অলিম্পিকে খেলেছি, এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। কারণ এটা একটা ইতিহাস হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে কেউ কখনও সরাসরি অলিম্পিকে সুযোগ পায়নি, আমিই প্রথম। আমিই প্রথম জাতীয় পতাকার বাহক ছিলাম। তো আমি গর্ববোধ করি যে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন একটা ইভেন্ট যোগ করেছি।
আবার আমি ব্রুনাই ওপেন জেতার পরের বছর থেকে কিন্তু বাংলাদেশে নিয়মিত গলফ টুর্নামেন্ট হচ্ছে। এশিয়ান ট্যুর, পুরো ইভেন্ট হচ্ছে। এটা অনেক বড় একটা ব্যাপার। আমাদের দেশে ২৫টি দেশ অংশ নেয়। এটা অনেক বড় অর্জন। আমরা জিতি বা না জিতি, এত বড় একটা ইভেন্ট করতে পারছি বাংলাদেশে, ২৫টি দেশ থেকে খেলোয়াড় আনতে পারছি, এটা আমাদের জন্য বড় অর্জন।
টিবিএস: আপনি গলফ বিশ্বকাপেও অংশ নিয়েছেন। বিশ্বকাপ নাকি অলিম্পিক, কোনটাকে এগিয়ে রাখবেন?
সিদ্দিকুর: গলফের বিশ্বকাপ কিন্তু ওই রকম জমজমাট কোনো আসর নয়। ক্রিকেট বা ফুটবলের মতো নয় আমাদের বিশ্বকাপ। কারণ আমাদের বিশ্বকাপ এক বছর পর পর হয়। এখানে মাত্র ৬০ জন খেলোয়াড় অংশ নেন। এটাকেও আমি ছোট করে দেখছি না। তবে অলিম্পিকের মতো নয়। এর বাইরে টানা চার বছর আমি পিজিএ ট্যুরে মেধা তালিকায় থেকে অংশ নিয়েছি। আমাদের দেশে গলফ সেভাবে জনপ্রিয় নয় বলে সেভাবে সবাই জানে না। পিজিএ ট্যুর কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার। চারটা পিজিএ ট্যুরে আমি খেলেছি এবং আমার ফলও অনেক ভালো ছিল।
টিবিএস: আমরা জানি গলফে অনেক টাকা। অর্থের ব্যাপারটি দেখেই গলফার হতে চেয়েছেন, নাকি গলফে কাজ করতে করতে এই খেলার প্রতি ভালোবাসা জন্মে যায়?
সিদ্দিকুর: আমি ছোটবেলা থেকে টাকার পেছনে দৌড়েছি। তবে ততোটুকুই দৌড়েছি, যতটুকু আমার দরকার। আর খেলাটা ছিল আমার জন্য পুরোপুরি ভালো লাগার। এখানে টাকা কতটা আসবে সেটা নিয়ে সেভাবে ভাবিনি। খেলাটা আমি ভালোবাসি, খেলাটা আমি খেলব। তবে দিনশেষে আর্থিক ব্যাপারটিও বিবেচনায় চলে আসে। যদিও আমার মধ্যে আর্থিক ব্যাপারটিতে আকৃষ্ট হওয়ার বিষয়টি অতটা ছিল না।
টিবিএস: গলফার হিসেবে শুরু করার আগে আপনি গলফে কাজ করতেন। ওই সময়টা আপনি বা আপনার পরিবারের জন্য কতটা কঠিন ছিল?
সিদ্দিকুর: আমার এই খেলার পেছনে আমার পরিবারের কোনো ইনভেস্ট লাগেনি। ইনভেস্ট বলতে স্কুল ফাঁকি দিয়ে গলফ খেলেছি খেলাটার প্রতি ভালোবাসার কারণে। এতে একটা দিক হয়েছে। আমার লেখাপড়া হয়নি, গলফ হয়েছে। আমার পরিবার থেকে সমর্থন ছিল। আমি খেলতাম, অনেক সময় ধরে অনুশীলন করতাম, পরিবারকে সেভাবে সাপোর্ট দিতে পারতাম না। তবে তারা কখনও মনোক্ষুন্ন হয়নি। তারা সব সময় আমাকে সমর্থন দিয়েছে। এ কারণে আমি আরও অনুপ্রাণিত হয়েছি।
টিবিএস: গলফে কাজ করার সময় লেখাপড়া করতেন?
সিদ্দিকুর: হ্যাঁ, করতাম। জাতীয় দলে ঢোকার পর ২০০০ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। এরআগে ৯৭, ৯৮ সালে আমি প্রচুর গলফ খেলেছি। তখন আমার উঠতি বয়স, খেলার অনেক বেশি সুযোগ ছিল। তখন অনেক অনুশীলন করতাম। এরপর জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ায় আমার জন্য অনেক সহজ হয়ে গেছে।
টিবিএস: গলফে আপনি কী কাজ করতেন?
সিদ্দিকুর: আমি মূলত বল বয় ছিলাম। আমাদের এখানে যেসব বিদেশিরা খেলেন, তাদের বল দেখে রাখতে হতো। দেখা গেল ২০০ গজ দূরে থাকতাম, সে বলটা মারতো। বলটা উড়িয়ে মারার পর আমরা বল দেখে রাখতাম। কারণ আমাদের গলফ ক্লাবে জঙ্গল আছে, পানি আছে। আবার কাক বল উড়িয়ে নিয়ে যেত। তো বলটা বাঁচাতে আমরা প্রতিটা গেস্টের সঙ্গে একজন করে বল বয় থাকতাম। বলটাকে বাঁচানোই ছিল আমার কাজ। আমি বল বয় ছিলাম।
টিবিএস: গলফার হিসেবে কী স্বপ্ন দেখেন? কোন স্বপ্নটা পূরণ হলে মনে হবে জীবনে আর পাওয়ার কিছু নেই?
সিদ্দিকুর: আপাতত ভাবনা পিজিএ ট্যুর নিয়ে। কবে যাবো এবং খেলতে পারব সেটা নিয়ে ভাবনা কাজ করে।
টিবিএস: গলফ টুর্নামেন্ট থেকে এখন পর্যন্ত কত প্রাইজমানি জিতেছেন?
সিদ্দিকুর: আসলে কম জিতিনি। তবে তার ৮০ ভাগই খরচ হয়ে গেছে। কতো জিতেছি, নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। আবার এটাও মনে রাখতে হবে, আমি যতটাই জিতি না কেন সেখান থেকে কর হিসেবে ২০ শতাংশ কাটা হয়। আমার সামগ্রী যে বহন করে তাকে দিতে হয় ১০ শতাংশ। আমার কোচকে দিতে হয়। এ ছাড়া ভ্রমণ, থাকা, খাওয়া মিলিয়ে বড় একটা পরিমাণে টাকা চলে যায়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে আজ পর্যন্ত আমি সেভাবে কোনো স্পন্সর পাইনি।
আমার বড় সাফল্যর পরও দেশ থেকে কোনো কোম্পানিকে পেলাম না স্পন্সরের জন্য। যদিও এ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে চাই না। আমি দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি, এটা আমার জন্য বড় পাওয়া। কিন্তু বিদেশিদের কী হয়, প্রতিটা খেলোয়াড়ের স্পন্সরশিপ থাকে। হোটেল, এয়ার টিকেট, কোচিং ফি এসব স্পন্সর হয়। যেটা আমি কখনই পাইনি। পেলেও সামান্য কিছু পেয়েছি। যেটা একটা-দুটি টুর্নামেন্টে কাজে লাগে। প্রতি বছর গলফ খেলতে গিয়ে আমার খরচই হয় এক কোটি টাকার মতো। আমার কোচ একদিনের জন্য ৫০ হাজার টাকা চার্জ করে। তার নাম পিটার, সে জার্মানির। তাহলে চিন্তা করেন, বছরে যদি তার কাছে দুই মাস কোচিং করি তাহলে কত টাকা খরচ (৩০ লাখ টাকা)।
আমি স্পন্সর পাই বা না পাই, কোচিং নিচ্ছি। কারণ আমার নেশা এবং পেশা হচ্ছে গলফ। আমি কত আয় করি, সেই হিসাব করে করে যদি করচ করি তাহলে বাংলাদেশের গন্ডি পেরোনো যাবে না। এসব আক্ষেপ থেকে যায়। তারপরও ঠিক আছে। আমি হিসাব করি আমার তো কিছুই ছিল না। এখন আমি সারা বছর বিদেশে ভ্রমণ করতে পারি, সারা বছর ভ্রমণ করে যদি আমার কোনো ডিপোজিট নাও থাকে, আমি কিছু মনে করব না। কারণ আমি সারা বছরে ৩০টা দেশ ঘুরেছি। ৩০টা সংস্কৃতি দেখেছি, ৩০ ধরনের খাবার খেয়েছি। তো আলহামদুলিল্লাহ, ঠিক আছে।
টিবিএস: এখন পর্যন্ত কোন টুর্নামেন্ট থেকে সবচেয়ে বেশি প্রাইজমানি জিতেছেন?
সিদ্দিকুর: এটা ছিল হিরো ইন্ডিয়া। হিরো ইন্ডিয়া থেকে আমি ২ লাখ ২৫ হাজার ডলার জিতি। এটা একটা টুর্নামেন্ট থেকে আমার জেতা প্রাইজমানি। তবে এসব টাকা থাকে না। আমি আগেই বললাম প্রতি বছর আমার খরচ এক কোটি টাকা। গত চার বছর আমি এক কোটি টাকার নিচে আয় করেছি। কিন্তু খরচটা আমাকে ঠিকই করতে হয়েছে।
টিবিএস: সবচেয়ে কম কতো প্রাইজমানি পেয়েছেন?
সিদ্দিকুর: এটা একেবারেই কম। এশিয়ান ট্যুর থেকে ৩০০ ডলারের মতো পেয়েছিলাম।
টিবিএস: আপনি দেশ সেরা গলফার হয়েও স্পন্সরের জন্য আফসোস করেন। অন্যদিকে ক্রিকেটারদের পেছনে স্পন্সররা দৌড়ায়। আপনি এক নম্বর হয়েও ক্রিকেটারদের মতো জনপ্রিয়তা নেই। এটা দেখে আফসোস হয় কিনা?
সিদ্দিকুর: আফসোস একটু আছে। কিন্তু ক্রিকেটের বয়স দেখুন, অনেক দিন ধরে খেলছি আমরা। আর গলফ সেখানে কতো বছর! আমার গলফের বয়স ধরলে ২০০৮ থেকে শুরু করতে হবে। পেশাদার হিসেবে চ্যাম্পিয়ন না হলে কিন্তু হাতেগোনা মানুষের বাইরে কেউ জানবে না। আমি ব্রুনাই ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ২০০ সাংবাদিক ছিল এয়ারপোর্টে। এটা অনেক বড় কভারেজ ছিল।
ওই প্রচারটা বাংলাদেশে একটা জাগরণ ফেলে দেয়। এরপর হিরো ইন্ডিয়াতে জেতার পর ভালো কভারেজ পেয়েছি। ভারতকে হারিয়ে আমরা কিছু জিতলে দেশে জোয়ার বয়ে যায়। সেখানে ব্রুনাই ওপেনে ২৫টি দেশ ছিল। শুধু ভারত নয়, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া কোন দেশ ছিল না! ২৫টি খেলোয়াড়দের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসা মজার কোনো বিষয় না।
টিবিএস: গলফ ক্যারিয়ারের আপনার সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা কোনটা?
সিদ্দিকুর: প্রথম দিকে যখন আমি এশিয়ান ট্যুরে যেতাম, খারাপ লাগতো। কারণ তৃতীয় বিশ্বে বাংলাদেশ নামে যে একটি দেশ, এটা অনেকে চিনতো না। বাংলাদেশ নামে একটা দেশ আছে আবার এই দেশের মানুষ গলফ খেলে, এটা ভেবে অনেকে অবাকই হতো। কিন্তু এখন আমি গর্ববোধ করি যে, শুধু বাংলাদেশ না, এই দেশের গলফার সিদ্দিক, এটাও জানে। এটা ভালো লাগে। আমি মনে করি এটা বড় একটা পরিবর্তন।
টিবিএস: গলফে আপনার আদর্শ খেলোয়াড় কে?
সিদ্দিকুর: দক্ষিণ আফ্রিকার একজন খেলোয়াড়। তার নাম আর্নি এলস, তাকে আমার ভালো লাগে। তাকে আমি অনুসরণ করি।
টিবিএস: যখন আপনি টুর্নামেন্ট খেলতে যান, বড় বড় গলফারদের সঙ্গে দেখা হয়। সুযোগ থাকলে তাদের কাছ থেকে কোন সব বিষয় শেখার চেষ্টা করেন?
সিদ্দিকুর: প্রথম আমি তাদের সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করি। তাদের কাছে সবকিছু তো আর প্রশ্ন করে শেখা যায় না। দেখেও আমরা শিখতে পারি। শুধু বড় খেলোয়াড় নয়, যেকোনো খেলোয়াড়ের সঙ্গে যখন খেলি, দেখি তার মধ্যে ভালো কী জিনিস আছে, যেটা আমি নিতে পারি। এভাবেই শেখার চেষ্টা করি।
টিবিএস: যাকে আগে টিভিতে দেখতেন, এমন কোন গলফারকে সামনে থেকে বিশ্বাস হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল স্বপ্ন?
সিদ্দিকুর: টাইগার উডস। তাকে তো আমরা ছোট বেলা থেকেই টিভিতে দেখে এসেছি। পিজিএ ট্যুরে তার সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। ২০১৩ সালে উডসের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। তো তার সাথে দেখা হওয়ার পর বিশ্বাস হচ্ছিল না।
টিবিএস: এখন পর্যন্ত আপনার জীবনের কঠিনতম সময় কোনটা এবং কেন?
সিদ্দিকুর: তিন বেলা খেয়ে বেঁচে থাকাটা যখন বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, সেটা ছিল সবচেয়ে কঠিন সময়। কারণ আমাদের পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশি ছিল। আমরা চার ভাই এবং বাবা-মা। এই ছয় জনের তিন বেলার খাওয়ার জন্য টানাটানি লেগে যেত। আমার বাবা নির্দিষ্ট কিছু করতেন না। যখন যে কাজ পেতেন, সেটা করতেন।
টিবিএস: এখন আপনি তারকা, তারকাখ্যাতি উপভোগ করেন কিনা?
সিদ্দিকুর: অবশ্যই, আমি গর্ববোধ করি। আমি এটা প্রায়ই বলি। এতো মানুষ আমাকে চেনে, এটা ভালো লাগে। আমাকে অনুপ্রাণিত করে আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার, আরও ভালো করার। মানুষে যে চেনে এবং বিশেষ একটা সম্মান দেয়, এটা টাকা দিয়ে কেনা যায় না। অনেকেরই তো টাকা আছে। হাজার হাজার কোটি টাকার মানুষ আছে। কিন্তু তাদেরকে আমরা কজন চিনি! তো মানুষ আমাকে চেনে, মিডিয়া পার্সন আমাকে চেনে, এটা আমাকে সত্যি অনুপ্রাণিত করে। এটা অনেক বড় পাওয়া।
টিবিএস: এখন যে জীবন-যাপন করছেন, এমন জীবনের স্বপ্ন কী কখনও দেখতেন?
সিদ্দিকুর: এই স্বপ্ন আমি কখনই দেখিনি। তবে যখন আমি পেশাদার হই, তখন আমার স্বপ্ন ছিল যে আমার বাড়িটা আমি এভাবে করব। ভালো একটা গাড়ি থাকবে। আল্লাহর রহমতে এখন আমার সবই হয়েছে। আমি জীবন খুবই উপভোগ করছি।
টিবিএস: সব খেলাই কঠিন, আমরা জানি। অন্যান্য খেলার তুলনায় গলফ কতটা কঠিন?
সিদ্দিকুর: আসলে কোনো কিছুই সহজ না, আবার কোনো কিছুই কঠিন না। আপনি যদি ওইভাবে কোনো কিছুকে লক্ষ্য করেন, সেটা পাওয়া সহজ। কিন্তু কোনো কিছুই সহজে পাওয়া যায় না।
টিবিএস: আপনার ক্যারিয়ারে বিশেষ কারও অবদান?
সিদ্দিকুর: বিশেষ কাউকে অবদান দিতে পারব না। তবে গলফ ফেডারেশন থেকে যে পদক্ষেপটা নিয়েছিল, সেটা পুরো বাংলাদেশের গলফের জন্য একটা শিফট ছিল। আমাদের অবহেলিতদের যে একটা সুযোগ দেওয়া, এটা বড় একটা পদক্ষেপ। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছি অভাব থেকে। পরিবারের অভাব আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে।
টিবিএস: কোন ট্রফি বা টুর্নামেন্ট জেতার স্বপ্ন দেখেন?
সিদ্দিকুর: পিজিএ ট্যুরের যে মেজর ৫টি টুর্নামেন্ট আছে, এর মধ্যে একটি জিততে চাই।
টিবিএস: গলফ নিয়ে বাংলাদেশে কিছু করার পরিকল্পনা আছে আপনার?
সিদ্দিকুর: যদি কিছু করতে পারি, অবশ্যই ভালো লাগবে। তবে নিজেরটা বলি, আমি যেভাবে গলফকে ভালোবাসি, শেষ দিন পর্যন্ত খেলে যেতে চাই। কারণ আমাদের কোনো বয়সের সীমা নেই। আমি একা আসলে গলফের জন্য কিছু করতে পারব না। আমি যদি ভালো কিছু অর্জন করতে পারি, সেটা অন্যান্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে। কাউকে শেখানো বা খেলোয়াড় তৈরির চেয়ে আমি যদি দারুণ কোনো অর্জন আনতে পারি দেশের জন্য, সেটা বেশি ভূমিকা রাখবে।
টিবিএস: বাংলাদেশে গলফের কতোটা ভবিষ্যৎ আছে?
সিদ্দিকুর: গলফের ভবিষ্যত আছে বলে আমার মনে হয়। কারণ আমরা বাংলাদেশিরা অনেক খাটতে পারি। আমাদের ছেলে মেয়েদের অনেক পটেনশিয়াল। আমাদের পরিবেশ হয়তো একটু খারাপ, আবার খারাপও বলব না। এই পরিবেশ থেকে যে বের হতে পারবে সে হবে সত্যিকারে হীরা। গলফের ভবিষ্যৎ ভালো। আমাদের ধারাবাহিকতা যতো উন্নত করা যাবে, ততো ভালো মানের গলফার পাওয়া সম্ভব। আমরা যারা গলফার হবো, তারা ইতোমধ্যে গলফে সম্পৃক্ত।
বাইরে থেকে গিয়ে পেশাদার হওয়া কঠিন। সে যদি পুরো জীবনকে গলফের পেছনে ব্যয় করে, সেটা ভিন্ন। আমরা যারা গলফে আছি, তারা পথেই আছি। এদের যদি সমর্থন বা পরিবেশটা দেওয়া যায় উন্নতমানের, তাহলে সম্ভব। কারণ আপনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলবেন, সেটা মাথায় রেখে এখানে যদি সেই পরিবেশ না থাকে, তাহলে মিলবে না। ওই পর্যায়ে যেতে এখানে সেই ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ, পরিবেশ, ভালো ভালো টুর্নামেন্ট, বিদেশে দল পাঠানো; এসব অনেক কিছু যুক্ত করা সম্ভব। আমাদের এসব ব্যবস্থা আছে, তবে সীমিত আকারে। ফেডারেশন যতটা পারছে, করছে। এখানে যতো সুবিধা যুক্ত করা হবে, ততো ভালো হবে।