মারা গেছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সাইদুর রহমান প্যাটেল
দীর্ঘ সময় ধরে অসুস্থ ছিলেন, ভুগছিলেন দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসারে। থাকতেন যুক্তরাষ্ট্রে, সেখানেই চিকিৎসা হচ্ছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সাইদুর রহমান প্যাটেলের। চিকিৎসা নেওয়ার ছবি প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে দোয়া চাইতেন তিনি। অবশেষে জীবনযুদ্ধে তার লড়াই থেমে গেল, যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি হাসপাতালে আজ বিকেলে মারা গেছেন সাইদুর রহমান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর।
১৯৭১ সালে ফুটবল দল গঠন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বড় অবদান রাখাদের মধ্যে অন্যতম সাইদুর রহমান। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা হায়দরাবাদ, জয়পুর, মুম্বাইসহ বিভিন্ন প্রদেশে ১৬টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে অভাবনীয় সাড়া পায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। দেশের পক্ষে জনমত গঠন করার পাশাপাশি ভারতের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ প্রবাসী সরকারের হাতে তুলে দিতে থাকেন ফুটবল যোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধাদের ফান্ডে ১৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকা জমা দেয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। এই দলটি সংগঠিত হয় সাইদুর রহমানের প্রচেষ্টায়, তিনি নিজেকে দলটির প্রতিষ্ঠাতা দাবি করতেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন নিয়ে সাইদুর রহমান বলেছিলেন, 'তখন মে মাস, আমরা কলকাতায় সুবোধ সাহার বাসায়। উনি ড্রইং রুম ছেড়ে দিলেন আমাদের জন্য। উনারা চার ভাই আমাদের সব কথা শুনলেন রাত একটা পর্যন্ত। এর মধ্যে লুৎফর রহমান বলে উঠলেন প্যাটেল কিন্তু পিডব্লিউডির খেলোয়াড়। তখন সুবোধ কাকার ছোট ভাই বললেন, "তুমি প্রথম বিভাগের ফুটবলার? কোনো চিন্তা নেই, তোমাকে আমি বেঙ্গল নর্থ রেলওয়ের (বিএনআর) চাকরি নিয়ে দিবো। এই ক্লাবটা অন্যতম সেরা একটা ক্লাব ছিল।" তখন আমি বলি আমি কাপুরুষের মতো জীবন বাঁচাতে আসিনি। সবাইকে রেখে এসেছি, দেশকে স্বাধীন করতে আমি যুদ্ধে চলে যাব।'
'ভোর বেলায় আমাদের বেড টি দিয়েছে, সুবোধ কাকারা নেমে এসেছে। আমরা চারজন বসা। মা-বাবা, ভাই-বোন সবাইকে রেখে আমরা চলে এসেছি, মনের মধ্যে সব সময় আতঙ্ক। এর মধ্যেই আমার মুখ দিয়ে যে কথাটা চলে আসে, সেটা আল্লাহ প্রদত্ত। আমি এখনও অবাক হই কীভাবে ওই কথাটা চলে আসে। আমি বললাম, আমি সুন্দর একটা চিন্তা করেছি। বললাম আমরা যদি একটা ফুটবল দল গঠন করতে পারি, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের তহবিল এবং জনমত আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা একটা ভূমিকা রাখতে পারব। আর আমাদের খেলোয়াড়রাও তো আমাদের সম্পদ। দল গঠন করতে পারলে তারাও চলে আসবে এখানে, নিরাপদও থাকবে। তারাও দেশের জন্য অবদান রাখতে পারবে, জীবনও রক্ষা পাবে।'
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন করা নিয়ে গর্ব থাকলেও আক্ষেপ ছিল সাইদুর রহমানের। টিবিএসকে তিনি বলেছিলেন, 'আমি এখনও স্বীকৃতি পাইনি। কী কারণে, তা নিয়ে আমি এখনও অন্ধকারে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করলে আল্লাহ তাআলা খুশি হন। সেখানে আমি একজন মানুষ। আমার কাজের স্বীকৃতিটা তো আমার পাওয়া উচিত ছিল। এ ব্যথা আমার থাকবেই। সালাউদ্দিন স্বাধীনতা পদক পেয়েছে। অমলেশ পেয়েছে স্বাধীনতা পদক। বিএনপির সময়ে পিন্টু ভাই পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক। প্রতাপ দাও সে সময় পেয়েছেন। কয়েকজন খেলোয়াড় পেল, অধিনায়ক পেল। আর আমি নিজে হাতে এতো বড় একটা কাজ করে স্বীকৃত নই, এমন কি দলটাও স্বীকৃত নয়।'
১৯৫১ সালের ৭ অক্টোবর ঢাকার কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদে জন্ম সাইদুর রহমানের। তবে বড় হয়েছেন গেন্ডারিয়াতে। ফুটবল খেলতেন, তরুণ বয়স থেকে সক্রিয় রাজনীতি করতেন। তবে ফুটবল ছিল ভালোবাসার জায়গা, তাই প্রিয় খেলাটির পেছনেই বেশি সময় যেতো তার। ঢাকার শীর্ষ ফুটবলে ইস্টএন্ডের হয়ে খেলেছেন তিনি। ১৯৬৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে সাইদুর রহমানের ঠিকানা হয় ফরাশগঞ্জে। দুই বছর পর প্রথম বিভাগে দল পিডব্লুডিতে খেলা শুরু করেন তিনি। সন্তানদের লেখাপড়ার কারণে ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান সাইদুর রহমান। ২০১৩ সালে ফেরেন, এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া আসার মধ্যে ছিলেন তিনি। গত জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চাইলেও চিকিৎসার কারণে তাকে দ্রুততার সঙ্গে ফিরে যেতে হয় যুক্তরাষ্ট্রে।