ছেলে ৭১ বলে ৪ রান, বাবা ১৩৭ বলে অপরাজিত ০
টেস্ট ক্রিকেটে উইকেটে থাকার পাশাপাশি রান তোলার দিকেও জোর দেওয়া হয়। তবে কিছু সময়ে টিকে থাকাই হয়ে ওঠে একমাত্র লক্ষ্য। যদিও বাজবল ক্রিকেট দিয়ে টেস্টে নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে ইংল্যান্ড। দীর্ঘতম ফরম্যাটেও মারকাটারি ব্যাটিং করতে দেখা যায় দেশটির ব্যাটসম্যানদের। সেই দেশেরই ক্লাব ক্রিকেটে দেখা গেল উল্টো চিত্র, যেন প্রতিযোগিতা হলো রান না করে যতো সময় টেকা যায়!
ডার্বিশায়ার ক্রিকেট লিগে ডিভিশন নাইনের একদিনের ম্যাচে যেমন ব্যাটিং দেখা গেছে, যা রীতিমতো বিস্ময় জাগানিয়া। মিকলওভার থার্ড ইলেভেনের বিপক্ষে ডার্লি অ্যাবি ক্রিকেট ক্লাব ফোর্থ ইলেভেনের ব্যাটসম্যানরা এমন ব্যাটিং করেছেন যে, ক্রিকেট দুনিয়াজুড়ে খবরে পরিণত হচ্ছেন তারা।
রান না করে উইকেটে টিকে থাকার এই আলোচিত ঘটনা মূলত দুজনকে ঘিরে, সম্পর্কে তারা আবার বাবা-ছেলে। একই দলের পক্ষে খেলতে নেমে জুটি গড়েন তারা, দুজনই দেখান অবিশ্বাস্য ধৈর্য্য। দুজন মিলে ২০৮ রান করে করেন মাত্র ৪ রান। এই ৪ রানই ছেলে থমাস বেস্টউইকের অবদান, তার খরচা ৭১ বল। বাবা ইয়ান বেস্টউইক আরও ধৈর্যশীল, ১৩৭ বল খেলেও শূন্য রানে অপরাজিত থাকেন এই ওপেনার।
যদিও ম্যাচের চিত্র শুরুতে এমন ছিল না। আগে খুনে ব্যাটিং করে মিকলওভার। দলটি ৪ উইকেটে মাত্র ৩৫ ওভারেই তোলে ২৭১ রান, এরপর তারা ইনিংস ঘোষণা করে। মিকলওভারের ওপেনার ম্যাক্স থমসন খেলেন বিস্ফোরক এক ইনিংস, ১২৮ বলে ১৭টি চার ও ১৪টি ছক্কায় করেন ১৮৬ রান। জবাবে ৮ রানের মধ্যেই ৩ উইকেট হারিয়ে বসে ডার্লি অ্যাবি ক্রিকেট ক্লাব।
এখান থেকে দিকহারা দলের হাল ধরেন ইয়ান ও থমাস। উইকেটে গিয়ে সহজেই থিতু হয়ে যান দুজন, তবে রান তোলার দিকে মন দেননি তারা। ওভারের পর ওভার চলে যেতে থাকে, রান নেন না এ দুজন। তাদের জুটিও ভাঙতে পারেন না প্রতিপক্ষ দলের বোলাররা। শেষ পর্যন্ত থমাসের বিদায়ে এই জুটি যখন ভাঙে, তার নামের পাশে তখন ৭১ বলে ৪ রান।
এক বল থেকেই এই রান তোলেন থমাস, অর্থাৎ চার মারেন তিনি। এর অর্থ, বাকি ৭০ বলে কোনো রান নেননি তিনি। জুটি ভাঙে, ছেলে বিদায় নেন; তবে বাবা থেকে যান অপরাজিত। উইকেটে আঠার মতো লেগে থাকা ৪৮ বছর বয়সী ইয়ান ১৩৭ বল খেলেও কোনো রান না করে মাঠ ছাড়েন। বাবা-ছেলের দৃঢ়তায় তাদের দল হার থেকে বেঁচে যায়।
ডার্লি অ্যাবি ক্রিকেট ক্লাব ৪৫ ওভারে ৪ উইকেটে তোলে ২১ রান, এরপর ম্যাচটি ড্র ঘোষণা করা হয়। তাদের ইনিংসে সর্বোচ্চ ৯ রান আসে অতিরিক্ত থেকে। ইয়ান-থমাসরা অবশ্য অদ্ভুত নিয়মের কারণে ম্যাচটি ড্র করতে পেরেছেন। একদিনের ম্যাচ হলেও পরে ব্যাটিং করা দল চাইলে ম্যাচ ড্র করতে পারে, ডার্বিশায়ার ক্রিকেট লিগে এমন নিয়ম আছে। এই নিয়ম ও নিজেদের ধৈর্য্যর জোরে হার থেকে বেঁচে যায় ইয়ান-থমাসদের দল।
ম্যাচের পর ইয়ান বলেন, 'একটা সময়ে রান না করতেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম আমি।' বিবিসি রেডিও ডার্বিকে তিনি জানান, জয়ের লক্ষ্য ছিল না তাদের। তরুণ ও অনভিজ্ঞ দল নিয়ে রান তাড়ার কথা না ভেবে উইকেটে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন তারা। শেষ পর্যন্ত ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সেই চ্যালেঞ্জ জয় করেছেন ইয়ান। এ কারণে ড্র করাতেই জয়ের আনন্দ পেয়েছেন তারা, দল মেতেছে উল্লাসে।
ইয়ান বলেন, 'আমাদের ড্রেসিং রুম উল্লাসে কাঁপছিল, উচ্ছ্বসিত ছিল সবাই। এই ম্যাচই তুলে ধরেছে, স্থানীয় ক্রিকেট কতোটা ভালো হতে পারে। বোলিংয়ের সময় তিন ঘণ্টা ধরে মাঠের সব প্রান্তে ছুটোছুটি করতে হয়েছে আমাদের। ইনিংস শেষে আমাদের ছেলেরা খুবই হতাশ ছিল। কিন্তু ম্যাচ শেষে মনে হয়েছে, আমরা কাপ জিতেছি বা এমন কিছু।'
এই ম্যাচের ঘটনা ক্রিকেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। ১২৮ বলে ১৮৬ রানের ইনিংস খেলার পরও কারও মুখে নেই থমসনের নাম। ছেলে থমাসকে নিয়েও তেমন আলোচনা নেই, সবটাজুড়ে কেবল ইয়ানই। এ নিয়ে তার ভাষ্য, 'তাকে (থমসন) নিয়ে কেউ কোনো কথাই বলছে না! আমারটা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, কাতার, সবখানে খবর হয়েছে। সারা দুনিয়া থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাচ্ছি আমি।'
১৩৭টি বল মোকাবেলা করেছেন ইয়ান, ছেলের সঙ্গে ম্যারাথান জুটির বাধার পথে দীর্ঘ সময় উইকেটে থাকতে হয় তাকে। কিন্তু এরপরও কোনো ক্লান্তি নেই তার। বরং ক্লান্তির প্রশ্নে অবাকই হন মাঝ বয়সী এই ক্রিকেটার। ক্লান্ত লাগছে কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে ইয়ান বলেন, 'মজা করছেন নাকি! আমি কিছুই করিনি, একটুও দৌড়াইনি।' বাবা-ছেলের জুটি থেকে আসা ৪ রান বাউন্ডারির, তারা দৌড়ে কোনো রান নেননি।