বাংলাদেশের মাটিতে হওয়া যে ঘটনায় শুরু শাস্ত্রী-গাঙ্গুলী দ্বন্দ্বের
২০০৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপের পর দুই টেস্ট ও তিন ওয়ানডের এক সিরিজ খেলতে শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলী ও অনিল কুম্বলের মতো মহাতারকাদের নিয়ে বাংলাদেশে পা রাখে ভারত।
তারকায় ঠাসা দলটি তরুণ বাংলাদেশের বিপক্ষে একটি বাদে সব ম্যাচ অনায়াসে জিতে নিলেও এই সিরিজে ঘটা এক অস্বাভাবিক ঘটনার দাগ আজও বয়ে বেড়াচ্ছে ভারত। সফর চলাকালে একদিন দলের সঙ্গে যোগ দিতে একটু দেরি করে ফেলা সৌরভ গাঙ্গুলীকে ফেলেই রওনা দিয়ে দেয় ভারতের টিম বাস। কে দিয়েছিলেন বাস ছাড়ার নির্দেশ?
আর কেউ না, দলের তৎকালীন ম্যানেজার রবি শাস্ত্রী।
২০০৭ সালের এই ক্ষুদ্র ঘটনা ভারত ক্রিকেটকে প্রভাবিত করে আসছে গত ১৪ বছর ধরে। কেননা, এই ঘটনাই যে জন্ম দিয়েছিল বর্তমানে ভারতীয় ক্রিকেট মহলের দুই রাঘব বোয়াল সৌরভ গাঙ্গুলী ও রবি শাস্ত্রীর মধ্যকার দীর্ঘ শত্রুতার।
সম্প্রতি জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর আবারও এই পুরনো দ্বন্দ্বের দিকে আলোকপাত করেছেন শাস্ত্রী।
সৌরভ ইন্টারভিউ বয়কট করায় খুবই অপমানিত বোধ করেছিলাম: শাস্ত্রী
২০১৪ সালে ইংল্যান্ড সফরে তুলোধুনো হওয়ার পর শাস্ত্রীকে জাতীয় দলের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয় বিসিসিআই। তার অধীনে টানা দুই আইসিসি টুর্নামেন্ট, ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ও ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলে ভারত।
ডানকান ফ্লেচার দায়িত্ব ছাড়ার পর সীমিত সময়ের জন্য কোচের ভূমিকাও পালন করেন শাস্ত্রী। ২০১৬ সালে বিসিসিআইয়ের সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে আসলে শাস্ত্রী আবার নিজেকেই প্রস্তাব করেন নতুন কোচ হিসেবে।
কিন্তু সৌরভ গাঙ্গুলী, শচীন টেন্ডুলকার ও ভিভিএস লক্ষ্মণের উপদেষ্টা কমিটি কোচের দায়িত্ব দেয় অনিল কুম্বলেকে। শাস্ত্রী কমিটির সামনে ইন্টারভিউ দিতে আসলে সেই ইন্টারভিউয়ে উপস্থিতই হননি সৌরভ।
শাস্ত্রীর দাবি, সৌরভকে একদম বাচ্চাকাল থেকে চিনেন তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটে যখন সবে আত্মপ্রকাশ করেছেন সৌরভ, তখন শাস্ত্রীর অধিনায়কত্বেই টাটা স্টিলের হয়ে খেলেছেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। গত নভেম্বরে রিপাবলিক টিভিতে অর্ণব গোস্বামীর অনুষ্ঠানে শাস্ত্রী বলেন, ছোটবেলা থেকে দেখে আসা সৌরভের এই আচরণে খুবই অপমানিত বোধ করেছিলেন তিনি।
ইন্টারভিউয়ে উপস্থিত না হওয়ার জন্য পরবর্তীতে কোনো কারণও জানাননি সৌরভ। পরিচালক ও কোচ হিসেবে দুই বছর সফলভাবে দায়িত্ব পালন করার পরও কেন শাস্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এ ব্যাপারেও কারণ দর্শায়নি বিসিসিআই।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শাস্ত্রী বলেন, "(২০১৪ সালে) আমাকে বলা হয়েছিল ধারাভাষ্যের কাজ ছেড়ে দিতে। ছেড়ে দিয়েছিলাম। আরও অনেক কিছু ছেড়ে ভারত দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। দলে আমার কাজ থেকে সবেই ফসল ফলা শুরু হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ কোনো কিছু না বলে আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কেউ আমাকে বলেনি কেন।"
কিন্তু এক মাসে শীত যায় না। কুম্বলে-কোহলি দ্বন্দ্বের কারণে নয় মাস পর আবার শাস্ত্রীর দ্বারস্থ হয় বিসিসিআই।
এ ব্যাপারে শাস্ত্রী বলেন, "নয় মাস পর আবার ডাকা হয় আমাকে। ওরা বলল, দলের ভিতর গোলমাল রয়েছে। শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। দল ছাড়ার সময় এখানে কোনো সমস্যা ছিল না। নয় মাসে সব বদলে গেছে? আরও অবাক হয়েছিলাম এটা ভেবে যে নয় মাস আগে যাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাকেই আবার দায়িত্ব দেওয়া হলো।"
ভোরে এমনিতেই আবোল-তাবোল বলেন শাস্ত্রী: সৌরভ
ভারতের কোচ হিসেবে শাস্ত্রীর দ্বিতীয় পর্বও শেষ হয়েছে সম্প্রতি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর স্বেচ্ছায় এই পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এই বর্ষীয়ান ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাক্ষাৎকারে শাস্ত্রী সরাসরি সৌরভের নাম বলেননি। তিনি বলেছেন, বোর্ডের অনেকেই তাঁকে কোচ হিসাবে চায়নি। এবং এই 'অনেকের' সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব যে এখনও অব্যাহত আছে, দিয়েছেন সেই ইঙ্গিতও।
দ্বিতীয় দফায় ভারতের দায়িত্ব নেওয়ার দুই বছরের মধ্যেই বিসিসিআই প্রধান হিসেবে অভিষেক ঘটে সৌরভের। শাস্ত্রীর সঙ্গে যে সৌরভের ব্যাটে-বলে হয়নি, সেটা দুই পক্ষের অভিব্যক্তিতেই স্পষ্ট। কোচ হিসেবে কখনোই শাস্ত্রীর সুনাম করেননি সৌরভ। শাস্ত্রীও সংগঠক সৌরভের কোনো সিদ্ধান্তেই সাধুবাদ জানাননি এখন পর্যন্ত। জানাবেনই বা কেন?
আবারও জাতীয় দল থেকে তার প্রস্থানের কারণ হয়তো এই সৌরভই। এ ব্যাপারে এখনও কোনো অভিযোগ করেননি শাস্ত্রী। তবে সম্প্রতি ব্যাকস্টেজ উইথ বোরিয়া নামের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে গাঙ্গুলী স্বীকার করেন, অনেকদিন ধরেই দ্রাবিড়কে রাজি করানোর পায়তারা করছিলেন তিনি। গাঙ্গুলী জানান, তিনি ও বিসিসিআই সেক্রেটারি, জয় শাহ অনেক আগেই পরবর্তী কোচ হিসেবে দ্রাবিড়কে ঠিক করে রেখেছিলেন।
অর্থাৎ, বর্তমান চুক্তি শেষে শাস্ত্রী স্বেচ্ছায় সরে না দাঁড়ালেও একই পথে হাঁটত বিসিসিআই। ২০১৬ সালের সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন বলেই হয়তো এবার নিজে থেকেই সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন শাস্ত্রী।
যেই ঘটনার মধ্য দিয়ে এই দীর্ঘ শত্রুতার সূত্রপাত হয়, সেই বাস-কাণ্ড নিয়ে শাস্ত্রী বলেছিলেন, "কেউ যদি দেরিতে আসে, তাহলে বাস ছেড়ে যাবে। কে দেরিতে এসেছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেদিন এমনটা সৌরভের সঙ্গে হয়েছিল।"
তবে এ শত্রুতা নিয়ে কখনোই মুখ খুলেননি সৌরভ। স্বীকার করা তো দূরের কথা, পুরো বাস-কাণ্ডের কথাই অস্বীকার করে আসছেন এই সাবেক অধিনায়ক।
শাস্ত্রী স্বীকার করে নেওয়ার পর একবার গাঙ্গুলীকে জিজ্ঞেস করা হয় ২০০৭ সালে বাস ছেড়ে যাওয়ার ঘটনা কতটুকু সত্য। বিসিসিআই প্রধান সরাসরি বলেন, এরকম কোনো কিছু কখনোই ঘটেনি। পাশাপাশি দাবি করেন, ভোরে এমনিতেই আবোল-তাবোল বলে থাকেন শাস্ত্রী। যে কারণে মর্নিং শোতে বলা শাস্ত্রীর স্বীকারোক্তিকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন তিনি।