রূপকথার রাজকুমার হয়ে দলকে জেতালেন মিরাজ-আফিফ
রূপকথার রাজকুমাররা কেমন হয়? গল্পের বর্ণনা থেকে কল্পনায় আঁকা রাজকুমারদের অবয়ব যদি ঝাপসা হয়ে গিয়ে থাকে, তবে চোখ রাখুন বাংলাদেশ-আফগানিস্তানের মধ্যকার প্রথম ওয়ানডেতে। একজন নয়, দুই দুজন রাজকুমারের দেখা পেয়ে যাবেন। হ্যাঁ, ম্যাচের অবস্থা বিবেচনায় রাজ্যই জয় করেছেন আফিফ হোসেন ধ্রুব ও ম্যাচসেরা মেহেদী হাসান মিরাজ। ৪৫ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে মাঝ দরিয়ায় পড়ে যাওয়া দলকে পথ দেখিয়ে অসাধার জয় এনে দিয়েছেন এ দুজন।
আফিফ-মিরাজের রেকর্ড গড়া জুটিতে বুধবার চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে আফগানিস্তানকে ৪ উইকেটে হারিয়েছে বাংলাদেশ। টস জিতে আগে ব্যাটিং করা আফগানরা ৪৯.১ ওভারে ১০ উইকেটে ২১৫ রান তোলে। জবাবে দুঃস্বপ্নের শুরুর পরও আফিফ-মিরাজের অসাধারণ ব্যাটিংয়ে ৭ বল হাতে রেখে রোমাঞ্চকর জয় তুলে নেয় তামিম ইকবালের দল।
আফগান পেসার ফজলহক ফারুকীর তোপে ১৮ রানেই ৪ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। ৪৫ রানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরও ২টি উইকেটের পতন। একে একে ফিরেন যান লিটন কুমার দাস, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, অভিষিক্ত ইয়াসির আলী রাব্বি, সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এরপর এভাবে দলকে জেতানো কীভাবে সম্ভব হলো?
এটা সম্ভব হবে, তামিম তেমন আশা করেননি। ম্যাচের পর বাংলাদেশ অধিনায়ক বললেন, 'সত্যি বলতে, আমি একবারও ভাবিনি। আমি যদি এখন বলি আমি বিশ্বাস করেছিলাম, তাহলে মিথ্যা বলা হবে। ২১৬ রান তাড়া করতে নেমে ৪৫ রানে ৬ উইকেট হারানো, সত্যিই খুব কঠিন। আমি খুবই খুশি। শুধু দল জিতেছে বলেই খুশি নই, যেভাবে দুই তরুণ ক্রিকেটার খেলেছে, অবিশ্বাস্য। আমার কোনো শব্দ নেই তাদের ইনিংসের বর্ণণা করার। খুবই খুশি এবং গর্ব করছি।'
'সহজ ছিল না ওদের বিপক্ষে ব্যাটিং করা (রশিদ-নবী-মুজিব)। আমি সব সময়ই বলেছি তাদের দারুণ বোলিং আক্রমণ আছে। বিশেষ করে তাদের স্পিন আক্রমণ। কিন্তু তাদেরকে যেভাবে হ্যান্ডেল করেছে, দেখে অসাধারণ লেগেছে। আমি হৃদয় থেকে প্রার্থনা করছি এটাই তাদের শেষ নয়, এখান থেকেই তাদের যাত্রা শুরু হলো। আমাদের জন্য তাদের আরও ম্যাচ জিততে হবে। খুব খুশি তাদের নিয়ে।' যোগ করেন তামিম।
২১৬ রানের লক্ষ্য, বিশাল কোনো বাদা নয়। কিন্তু ফজলহকের তোপে পড়ে ১৮ রানের মধ্যেই লিটন, তামিম, মুশফিক ও ইয়াসির ফিরে যান। চাপ কাটিয়ে তোলার চেষ্টা করা সাকিব নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনেন। ১০ করা বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান আফগান স্পিনার মুজিব-উর-রহমানের ইনসাইড এজে বোল্ড হন। দলীয় ৪৫ রানে আফগান তারকা লেগ স্পিনার রশিদ খানের শিকারে পরিণত হন মাহমুদউল্লাহ।
খাদের কিনারে চলে যাওয়া দলকে টেনে তোলার কাজ কাঁধে তুলে নেন আফিফ ও মিরাজ। শুরুতে কাজ ছিল চাপ সামলে থিতু হওয়ার। দেখেশুনে ব্যাট চালিয়ে সেই কাজটি করে ফেলেন তরুণ এই দুই ব্যাটসম্যান। এরপর মন লাগান রান তোলার কাজে। রশিদ, নবী, মুজিবদের বিশ্বমানের স্পি সামলে দেলকে জয়ের পথে এগিয়ে নিয়ে থাকেন দুজন।
দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে দুজনই পূর্ণ করেন হাফ সেঞ্চুরি। তাদের ব্যাটে বাংলাদেশ তখন অনেকটা পথ এগিয়েছে, হারতে বসা ম্যাচে নতুন করে জয়ের স্বপ্ন বুনুছে ঘরের মাঠের দলটি। এই স্বপ্ন ফিঁকে হতে দেননি আফিফ-মিরাজ। সপ্তম উইকেটে ১৭৪ রানের বিশ্বরেকর্ড গড়া জুটিতে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছান তারা। আফিফ ১১৫ বলে ১১টি চার ও একটি ছক্কায় ৯৩ রানে ও ম্যাচসেরা মিরাজ ১২০ বলে ৯টি চারে ৮১ রানে অপরাজিত থাকেন।
এত কম রানে ৬ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ আগে কখনও ম্যাচ জেতেনি। আফিফ-মিরাজের অবিচ্ছিন্ন ১৭৪ রানের জুটি সপ্তম উইকেটে যেকোনো ইনিংসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ, আর রান তাড়ায় যা বিশ্বরেকর্ড। রেকর্ডটি ছিল ইংল্যান্ডের জস বাটলার ও ক্রিস ওকসের। ২০১৬ সালে নটিংহ্যামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৩৮ রান করেছিলেন তারা। আফিফ-মিরাজের ১৭৪ রানের জুটি ওয়ানডেতে যে কোনো ইনিংসে সপ্তম উইকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সপ্তম উইকেট জুটির রেকর্ডটি বাটলার-আদিল রশিদের দখলে। ২০১৫ সালে এজবাস্টনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৭৭ রানের জুটি গড়েন তারা।
এর আগে ব্যাটিং করা আফগানিস্তানকে অল্প রানেই আটকে রাখে বাংলাদেশ। অসাধারণ বোলিং করেন মুস্তাফিজুর রহমান, শরিফুল ইসলাম, মেহেদী হাসান মিরাজরা। এর মাঝেও দারুণ ইনিংস খেলেন নাজিবউল্লাহ জাদরান। ৮৪ বলে ৪টি চার ও ২টি ছক্কায় ৬৭ রান করেন তিনি। এ ছাড়া ইব্রাহিম জাদরান ১৮, রহমত শাহ ৩৪, অধিনায়ক হাসমতউল্লাহ শহিদী ২৮ ও মোহাম্মদ নবী ২০ রান করেন।
আগুন ঝরা বোলিং করা মুস্তাফিজ ৯.১ ওভারে ৩৫ রানে ৩টি উইকেট নেন। ২টি করে উইকেট নেন তাসকিন, সাকিব ও শরিফুল। একটি উইকেট নেন মাহমুদউল্লাহ। মিরাজ ১০ ওভার করলেও কোনো উইকেট পাননি। তবে রান আটকে রাখার কাজটি তিনি সবচেয়ে ভালোভাবে করেছেন। ডানহাতি এই স্পিনার সবচেয়ে কম ইকোনমিতে ৩ মেডেনসহ মাত্র ২৮ রান খরচা করেন। শরিফুলও কিপ্টে বোলিং করেন, ১০ ওভারে তার খরচা ৩৮ রান।