দক্ষিণ আফ্রিকায় স্বপ্নের জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ
দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্দেশে দেশ ছাড়ার আগে তামিম ইকবাল জানিয়েছিলেন, এবার জিততেই যাচ্ছেন তারা। অধিনায়কের সুরে সুর মিলিয়ে তাসকিন আহমেদ জানিয়েছিলেন, সেরাটা দিতে পারলে দক্ষিণ আফ্রিকাতেও জেতা সম্ভব। প্রথম ওয়ানডেতেই তাদের বলে যাওয়া কথা বাস্তবে রূপ নিল। দারুণ ব্যাটিংয়ে বিশাল সংগ্রহ গড়ে পরে বল হাতে ছড়ি ঘোরানো বাংলাদেশ তুলে নিলো স্বপ্নের এক জয়।
সেঞ্চুরিয়নের সুপারস্পোর্ট পার্কে শুক্রবার সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৩৮ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। ইতিহাস গড়া এই জয়ে দীর্ঘ ২০ বছরের অপেক্ষা শেষ হলো বাংলাদেশের। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দ্বিপক্ষীয় কোনো সিরিজে প্রথমবারের মতো তাদেরকে হারালো বাংলাদেশ। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে আগের ১৯ ম্যাচেই হেরেছিল বাংলাদেশ। কুড়িতে এসে প্রোটিয়াদের মাটিতে বিজয় নিশান গাড়লো বাংলাদেশ।
টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নামে বাংলাদেশ। অধিনায়ক তামিম ইকবাল ও লিটন কুমার দাসের দারুণ উদ্বোধনী জুটির পর ম্যাচসেরা সাকিব আল হাসান ও ইয়াসির আলীর রাব্বির ব্যাটিং মহড়া। শেষ দিকে অবদান রাখেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, আফিফ হোসেন ধ্রুব ও মেহেদী হাসান মিরাজ। তাতে ৭ উইকেটে ৩১৪ রানের বিশাল সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ। যা দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং তাদের মাটিতে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস বাংলাদেশের।
জবাবে বল হাতে শুরুটা করে দিলেন শরিফুল ইসলাম। এরপর তোপ তাগলেন তাসকিন আহমেদ। তবু লড়াই চালালেন প্রোটিয়া অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা। সবচেয়ে বড় ইনিংসটা খেললেন রাসি ফন ডার ডুসেন। ঝড়ো ব্যাটিংয়ে কম চোখ রাঙাননি ডেভিড মিলারও। এ দুজনকে ফিরিয়ে আসল কাজ সারেন তাসকিন ও মেহেদী হাসান মিরাজ। শেষ দিকে তাই কেশব মহারাজ ও লুঙ্গি এনগিডির ধুন্ধুমার ব্যাটিং কাজে আসেনি। তাসকিন-মিরাজের দারুণ বোলিংয়ে ৪৮.৫ ওভারে ২৭৬ রানে শেষ হয় স্বাগতিকদের ইনিংস।
বড় লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে শরিফুল ইসলাম, তানকিন আহমেদদের দারুণ বোলিংয়ের সামনে শুরুটা ভালো করতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। ইনিংসের চতুর্থ ওভারে প্রোটিয়া ওপেনার ইয়ানেমান মালানকে ফিরিয়ে দেন শরিফুল। চাপ কাটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন কাইল ভেরেইনা ও অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা।
মনে হচ্ছিল গুছিয়েই নিয়েছেন এ দুজন। কিন্তু নবম ওভারে জোড়া আঘাত হেরে স্বাগতিকদের পথ ভুলিয়ে দেন তাসকিন। দুই বলের ব্যবধানে কাইল ভেরেইনা ও এইডেন মার্করামকে ফিরিয়ে দেন বাংলাদেশের গতিময় এই পেসার। ৩৬ রানেই ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা।
এখান থেকে দলের হাল ধরেন বাভুমা ও রাসি ফন ডার ডুসেন। চাপ সামলে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন তারা। চতুর্থ উইকেটে ৮৫ রান যোগ করেন বাভুমা-ডুসেন। এই জুটিতে প্রোটিয়ারা যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে, তখনই আঘাত হানেন শরিফুল। বাংলাদেশের বাঁহাতি এই পেসারের একটি এক্সট্রা বাউন্সারে ব্যাট ছোঁয়াতে গিয়ে মুশফিকের হাতে ধরা পড়েন ৩১ রান করা বাভুমা।
অধিনায়ককে হারিয়েও বিপদে পড়তে হয়নি প্রোটিয়াদের। ডার ডুসেনের সঙ্গে যোগ জুটি বাধেন ডেভিড মিলার। অল্প সময়ের মধ্যেই উইকেটে নিজেকে মানিয়ে নেন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। পঞ্চম উইকেটে ৬৪ বলে ৭০ রানের জুটি গড়েন ডুসেন-মিলার। এই জুটিতে জয়ের আশাই করছিল প্রোটিয়ারা। এমন সময়ে আঘাত হানেন তাসকিন। নিজের শেষ ওভারে তার শিকার ডার ডুসেন। ফেরার আগে ৯৮ বলে ৯টি চার ও একটি চারে ৮৬ রান করেন তিনি।
কাজটা কঠিন হয়ে পড়ে মিলারের জন্য। আন্দিলে ফেলুকুয়াওয়োকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে চাইলেও তা হয়নি। ২ রান করেই মিরাজের শিকারে পরিণত হন ফেলুকুয়াওয়ো। এরপর মার্কো জ্যানসেন ও কাগিসো রাবাদাকেও দ্রুত তুলে নেন মিরাজ। এখানেই থামেননি বাংলাদেশের ডানহাতি এই স্পিনার। হুমকি হিসেবে থেকে যাওয়া মিলারকে ফিরিয়ে স্বস্তি ফেরান তিনি। ফেরার আগে ৫৭ বলে ৮টি চার ও ৩টি ছক্কায় ৭৯ রান করেন মিলার।
শেষের দিকে ঝড়ো ব্যাটিং করলেও বাংলাদেশকে ভয় দেখাতে পারেননি কেশব মহারাজ ও লুঙ্গি এনগিডি। মহারাজ ১৬ বলে ৩টি চার ও একটি ছক্কায় ২৩ রান করেন। এনগিডি ১০ বলে ২টি ছক্কায় ১৫ রানে অপরাজিত থাকেন। অসাধারণ বোলিং করা তাসকিন ১০ ওভারে ৩৬ রান খরচায় ৩টি উইকেট নেন। মিরাজ ৯ ওভারে ৬১ রানে নেন ৪ উইকেট। শরিফুল ২টি ও মাহমুদউল্লাহ একটি উইকেট পান। সাকিব ১০ ওভারে ৫৪ ও মুস্তাফিজ ১০ ওভারে ৫০ রান দিয়েও কোনো উইকেট পাননি।
এর আগে ব্যাটিং করা বাংলাদেশের শুরুটা দারুণ হয়। উদ্বোধনী জুটিতে ৯৫ রান যোগ করেন তামিম ইকবাল ও লিটন কুমর দাস। সাবধানী শুরুর পর ধীরে ধীরে রান তোলার গতি বাড়িয়ে নেন এ দুজন। দলীয় সংগ্রহ ১০০ ছোঁয়ার একটু আগে বিদায় নেন তামিম। ৬৭ বলে ৩টি চার ও একটি ছক্কায় ৪১ রান করে সাজঘরে ফেরেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক।
কিছুক্ষণ পর আউট হন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের পঞ্চম হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেওয়া লিটনও। ৬৭ বলে ৫টি চার ও একটি ছক্কায় ৫০ রান করেন তিনি। দ্রুত দুই উইকেট হারানোর চাপ কাটিয়ে উঠতে গিয়েও তারা পারেননি। মুশফিকুর রহিম স্লগ সুইপ খেলতে গিয়ে আকাশে বল তুলে দেন। সাকিব আল হাসানের সঙ্গে যোগ দেন ইয়াসির আলী রাব্বি।
এই জুটিতে ছন্দ পেয়ে যায় বাংলাদেশ। শুরু থেকেই মারকুটে মেজাজে থাকা সাকিব প্রোটিয়া বোলারদের ওপর দিয়ে ঝড় বইয়ে দিতে শুরু করেন। উইকেটে মানিয়ে নিয়ে রান তোলায় মন দেন রাব্বিও। এই জুটিতে ১১৫ রান পেয়ে যায় বাংলাদেশ। অসাধারণ সব শট খেলতে থাকা সাকিব ৬৪ বলে ৭টি চার ও ৩টি ছক্কায় ৭৭ রান করে আউট হন। ওয়ানডেতে এটা তার ৫০তম হাফ সেঞ্চুরি।
এরপর রাব্বিও বেশি সময় থাকতে পারেননি উইকেটে। ক্যারিয়ারের চতুর্থ ওয়ানডেতে নিজের প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পাওয়া ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান ৪৪ বলে ৪টি চার ও ২টি ছক্কায় ৫০ রান করেন আউট হন। এরপর মাহমুদউল্লাহ ১৭ বলে একটি করে চার ও ছক্কায় ১৭, আফিফ ১৩ বলে একটি করে চার ও ছক্কায় ১৭ রান করেন।
মেহেদী হাসান মিরাজ ১৩ বলে ২টি ছক্কায় ১৯ রানে অপরাজিত থাকেন, তাসকিন আহমেদ করেন ৫ বলে ৭ রান। দক্ষিণ আফ্রিকার কেশব মহারাজ ও মার্কো জ্যানসেন ২টি করে উইকেট নেন। একটি করে উইকেট পান লুঙ্গি এনগিডি, কাগিসো রাবাদা ও আন্দিলে ফেলুকুয়াওয়ো।