অপর্যাপ্ত ঘুম প্রভাব ফেলতে পারে আপনার হাঁটার ধরনে
আপনার যদি পর্যাপ্ত ঘুম না হয় (যেমনটি আজকাল অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই হচ্ছে), তাহলে আপনি নিশ্চয়ই আপনার শরীর ও মনের উপর এর প্রভাব সম্পর্কেও কমবেশি অবগত রয়েছেন। সারাদিনই আপনার ঘুম ঘুম ভাব থাকে, হাই ওঠে, মাথাব্যথা করে, এবং আপনি হয়তো খুব অল্পেই উদ্বিগ্ন, বিরক্ত বা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
এবার আপনি চাইলে সে তালিকায় বেসামাল হাঁটাকেও যোগ করতে পারেন। নতুন এক গবেষণায় এমনটিই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে আপনার দৈনিক চোখ বন্ধ রাখার ঘাটতির সঙ্গে আপনার চলনভঙ্গির সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ আপনার যদি ঘুম কম হয়, তাহলে তার ফলে প্রভাবিত হতে পারে আপনার দৃঢ়ভাবে হাঁটার ধরন, প্রতিবন্ধকতা এড়ানো এবং ভারসাম্য রক্ষার ক্ষমতা।
"ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, চলনভঙ্গি কোনো স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া নয়, এবং এটি ঘুমের অভাব দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে," জানান গবেষণা নিবন্ধটির অন্যতম লেখক হারমানো ক্রেবস। তিনি ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড স্কুল অব মেডিসিনের নিউরোলজির সংযুক্ত অধ্যাপক।
"প্রত্যেকের জন্য রাতে ঘুমের আদর্শ সময় হলো আট ঘণ্টা। কিন্তু যদি রাতে আমাদের ওই পরিমাণ ঘুম না হয়, তাহলে দিনের বেলা যতটা সম্ভব ঘুম পুষিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।"
এই গবেষণা নিবন্ধে চলনভঙ্গি পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া নয় বলে যে দাবি করা হয়েছে, সেটি বিজ্ঞানীদের জন্য একটি নতুন তথ্য। ইতঃপূর্বে তারা এর উল্টোটা ভাবতেন। তারা মনে করতেন, আমরা যেকোনো একদিকে তাকাই, আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবে, সামান্য অবধারণের সাহায্য নিয়ে, সেদিকে হাঁটতে শুরু করে দেয়।
কিন্তু এখন গবেষকরা প্রমাণ করে দিয়েছেন, ব্যাপারটি মোটেই তেমন নয়। আমাদের মস্তিষ্ক রাস্তায় চলার পথে দৃশ্যমান বা শ্রবণযোগ্য বিভিন্ন সঙ্কেত গ্রহণ করে, এবং সে অনুযায়ী আমাদের চলার গতি দ্রুত বা ধীর করে দেয়, ডানে-বামে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।
মস্তিষ্ক যেন চলার পথে এসব সঙ্কেত সঠিকভাবে গ্রহণ করতে থাকে, সেজন্য মস্তিষ্কের প্রয়োজন উপযুক্ত বিশ্রাম। সেই বিশ্রাম নিশ্চিত করতে প্রাপ্তবয়স্কদের রাতে অন্তত আট ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। এছাড়া স্কুলগামী শিশুদের প্রতি রাতে নয় থেকে ১২ ঘণ্টা এবং কিশোর বয়সীদের প্রতি রাতে আট ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। এমনটিই জানিয়েছে ইউএস সেন্টারস অন ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন।
সায়েন্টিফিক রিপোর্টসে প্রকাশিত নতুন গবেষণাটির মূল ফোকাস ছিল ব্রাজিলের ইউনিভার্সিটি অব সাও পাওলোর নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে ভোগা শিক্ষার্থীরা। ওই শিক্ষার্থীরা ১৪ দিন ধরে স্লিপ ট্র্যাকার পরে থাকেন, যেখানে তাদের দৈনিক ঘুম ও হাঁটার সময় রেকর্ড করা হয়। শেষমেশ দেখা যায়, ওই শিক্ষার্থীরা প্রতি রাতে গড়ে ছয় ঘণ্টা করে ঘুমান।
এরপর ওই নির্দিষ্ট শিক্ষার্থী গোষ্ঠীর অর্ধেক সদস্য একদিন সারারাত ঘুমান। পরদিন সকল শিক্ষার্থী একটি ট্রেডমিল টেস্ট দেন, যেখানে তাদের বলা হয় মেট্রোনোমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পা ফেলতে।
পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, যেসব শিক্ষার্থীরা রাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাতে পারেননি, তাদের হাঁটার ছন্দ অন্যদের (যারা সারারাত ঘুমিয়েছেন) চেয়ে অনেকটাই খারাপ। তারা ঠিকমতো পা মেলাতে পারছেন না, বিপ মিস করছেন, এবং সামগ্রিকভাবে বাজে পারফর্ম করছেন।
তবে মজার ব্যাপার হলো, যেসব শিক্ষার্থী সপ্তাহান্তে বেশি পরিমাণ ঘুমিয়ে তাদের সারা সপ্তাহের ঘুমের ঘাটতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তারা এই টেস্টে তুলনামূলক ভালো ফল করেছেন।
অবশ্য বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের কৌশল অনুসরণের পরামর্শ দেন না। কেননা একজন ব্যক্তির নিয়মিত ঘুমানো ও ঘুম থেকে ওঠার যে রুটিন, সেখানে যদি সপ্তাহের কোনো এক বা দুদিন ৯০ মিনিট পর্যন্ত হেরফের হয়, তাহলে ওই ব্যক্তির হার্ট অ্যাটাকসহ অন্যান্য হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
তবে যা-ই হোক, এই গবেষণাটি পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়, বিশেষত যারা এমন সব ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে যেখানে শিফট-ওয়ার্ক করতে হয়, কিংবা যেখানে বেসামাল চলনভঙ্গি বিপদজনক হতে পারে।
"ঘুমের ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হতে পারে," বলেন গবেষণা নিবন্ধটির প্রধান লেখক এবং ইউনিভার্সিটি অব সাও পাওলোর মেকাট্রোনিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, আর্তুরো ফর্নার-করডেরো।
"উদাহরণস্বরূপ, যারা নিয়মিত ঘুমের অভাবে ভোগে, যেমন শিফট-ওয়ার্কার, ক্লিনিকিয়ান, এবং কিছু সামরিক কর্মকর্তা, তাদের জন্য ঘুমের ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার অভ্যাস খুবই জরুরি হতে পারে নিজেদের চলনভঙ্গির উপর আরও ভালো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসার জন্য।"
এছাড়া নিজের ঘুমের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার আরও ভালো একটি কৌশল রয়েছে। সেটি হলো নিজের মস্তিষ্ককে প্রশিক্ষণ দেওয়া।
নিজের মস্তিষ্ককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে শরীরচর্চা। ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের মতে, এমনকি দিনে ১০ মিনিটও যদি হাঁটা, সাইকেল চালানো বা অন্যান্য অ্যারোবিক শরীরচর্চা করা হয়, তার মাধ্যমে "রাতের বেলা ঘুমের মানের ব্যাপক উন্নতি" আনা সম্ভব।
এছাড়া অন্যান্য কৌশলের মধ্যে রয়েছে :
- দুপুর তিনটার পর থেকে কফি থেকে দূরে থাকা;
- ঘুমাতে যাওয়ার আগে অ্যালকোহল পান পরিত্যাগ করা;
- বেডরুমে আরামদায়ক বিছানা-বালিশ রেখে এবং ঘরকে শীতল রেখে ঘুমের উপযোগী করে তোলা;
- বেডরুমে টিভি দেখা বা অন্য কোনো কাজ না করা, যাতে মস্তিষ্ক ভাবে যে বেডরুম নির্দিষ্টভাবে কেবলই ঘুমের জন্য;
- বেডরুম থেকে যাবতীয় উজ্জ্বল আলো সরানো, এমনকি স্মার্টফোন ও ল্যাপটপের নীল আলোও দূর করা;
- ঘুমের আগে উষ্ণ পানিতে গোসল করা বা শাওয়ার নেওয়া, বই পড়া, হালকা গান শোনা, মেডিটেশন করা কিংবা হাত-পা কয়েকবার প্রসারণ করা যেন মস্তিষ্ক ঘুমের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়;
- আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো একটি নিয়মিত ঘুমানো ও ঘুম থেকে ওঠার সূচী মেনে চলা, এমনকি সপ্তাহান্তেও।
এই ব্যাপারগুলো নিয়মিত মেনে চলুন। এর মাধ্যমে আপনার ঘুমের অভ্যাসে উন্নতি ঘটানো সম্ভব, এবং আপনার চলনভঙ্গিতেও উন্নতি আসবে।
- সূত্র: সিএনএন হেলথ