আত্মহত্যার সাহস না থাকায় খুনি ভাড়া করলেন ভারতীয় ব্যবসায়ী
আর্থিক সঙ্কটের চাপে ভারতের রাজধানী দিল্লির এক ব্যবসায়ী আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু, সাহস করতে না পেরে অবশেষে নিজের প্রাণসংহারে খুনি ভাড়া করেছেন। মৃত্যুর পর যেন তার পরিবার জীবনবীমার টাকা পায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে সেটাও অন্যতম কারণ।
৪০ বছরের ওই প্রয়াত ব্যবসায়ীর নাম গৌরব বানসাল। তিনি একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বা রেশনের দোকান চালিয়ে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতেন। কিন্তু, কোভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষিতে চলমান লকডাউনে তার ব্যবসায় ধ্বস নামে। চাপ ছিল আগে নেওয়া নানা ঋণ পরিশোধের। পরিবারের ব্যয় নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি।
ব্যবসা বাণিজ্যের এই বেহাল দশা গৌরবকে মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত করে। শেষ পর্যন্ত কোনো কূল-কিনারা না দেখে তিনি ৬ লাখ রুপির এক ব্যক্তিগত ঋণ নেন। ওই ঋণের কিছু নিজ পরিবারের জন্য রেখে বাকি টাকায় খুনি ভাড়া করে নিজেকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটেন।
আটপৌরে ব্যবসায়ী গৌরবের পরিচিত কোনও অপরাধী ছিল না। তাই খুনি খুঁজতে সামাজিক গণমাধ্যমের আশ্রয় নেন তিনি। সেখান থেকেই একজনকে ভাড়া করেন নিজেকে খুন করার জন্য। খবর অডিটি সেন্ট্রালের।
এরপর গত ১০ জুন দিল্লির উপকণ্ঠে অবস্থিত নাজাফগড় এলাকার একটি গাছ থেকে তার গলায় দড়ি দেওয়া লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা থাকায় তাৎক্ষনিকভাবে আত্মহত্যার সম্ভাবনা নাকচ করে পুলিশ একে একটি হত্যা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে।
আউটার দিল্লির ডেপুটি পুলিশ কমিশনার এ. কোয়ান বলেন, প্রথমে নিজেকে হত্যায় গৌরব একজন কিশোরকে ভাড়া করেছিলেন। নিহত ব্যবসায়ীর ফোনকলের রেকর্ড এবং তার সামাজিক গণমাধ্যমের গতিবিধি অনুসন্ধান করে পুলিশ ওই অল্পবয়স্ক কিশোরকে শনাক্ত করতে পড়েছে। গ্রেপ্তারের পর সে পুলিশি জেরার মুখে তার অপর সহযোগীদের নাম স্বীকার করে। এরা হলো; ১৮ বছরের ছাত্র সুরাজ, মনোজ নামের এক ২১ বছরের এক সবজি বিক্রেতা এবং ২৬ বছরের দর্জি সুমিত।
পরবর্তীতে তাদের সকলকেই গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশকে অপ্রাপ্তবয়স্ক ওই কিশোর আরও জানায়, গৌরব নিজে থেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিশোরটি আগে কখনোই এমন অপরাধ করেনি। কিন্তু গৌরব তাকে বারবার অনুরোধ করে্ন। টাকার প্রলোভন দেখান। নিজের দুর্দশার কথা তুলে ধরে বলে, এই অবস্থায় হত্যা করলে বরং তার প্রতি দয়া দেখানো হবে। কারণ, সে যদি খুন হয় তাহলে তার পরিবার জীবনবীমা কোম্পানি থেকে মোটা অংকের টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে। আত্মহত্যা করাটা তাই কোনো সমাধান নয়। খুন হওয়া ছাড়া কোনো উপায় খোলা নেই তার সামনে।
এমন অনুরোধের মুখে এক সময় কিশোরটি গৌরবকে হত্যায় রাজি হয়। এই জন্য সে একটি পিস্তল কেনার চেষ্টাও করে। কিন্তু, তার অল্প বয়স দেখে স্থানীয় অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসায়ী তার কাছে পিস্তল বিক্রি করতে রাজী হয়নি।
'তখন গৌরব বানসাল নিজেই কিছু রশি কিনে নিয়ে এসে তা দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে তাকে হত্যা করতে বলে। এইকাজে সহযোগিতার জন্য ওই কিশোর তার বন্ধু মনোজ কুমার যাদবকে পরিকল্পনায় জড়িত করে। সে আবার জড়িত করে সুরাজ এবং সুমিত কুমারকে। নিজেকে হত্যার জন্য মোট ৯০ হাজার রুপি দেয় গৌরব। ওই অর্থ সমানভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয় আলোচিত চার খুনি' বার্তা সংস্থা এএনআইকে এসব তথ্য জানান ডেপুটি পুলিশ কমিশনার এ. কোয়ান।
হত্যার জন্য নির্ধারিত দিন গৌরব নিজেই মোহন গার্ডেনে তার খুনিদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। এবং তাকে কোন জায়গায় গলায় দড়ির ফাঁসে ঝুলিয়ে হত্যা করতে হবে সেটিও দেখিয়ে দেন। হত্যার আগে গৌরব খুনিদের তার হাত শক্ত করে বেঁধে পরিচয়পত্রটি পকেটে রাখতে বলে্ন। মৃত্যুর পর লাশ শনাক্তে যেন কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্যেই এমন কথা বলেন তিনি। এমনকি নিজের ফোন নাম্বারে আসা ইনকামিং কল তার শ্যালকের নাম্বারে ডাইভার্ট করে দেন গৌরব।
পুলিশ গৌরবের মৃত্যুকে একটি 'রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড' হিসেবেই প্রথমে জানিয়েছিল। খুঁজে পাচ্ছিল না হত্যার মোটিভ। কিন্তু, কয়েকদিন আগে ইন্ডিয়া টিভির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই ঘটনার রহস্য উন্মোচন হয়। টিভি চ্যানেলটি জীবনবীমার টাকার জন্য নিজেকে হত্যার ওই 'জটিল' ষড়যন্ত্রের পর্দা ফাঁস করে দেয়। এরপরেই সহজ হয় পুলিশি অনুসন্ধান। সামাজিক গণমাধ্যমের সূত্র ধরে গ্রেপ্তার হয় ওই আলোচিত কিশোর ও তার সহযোগীরা।
পুলিশি অনুসন্ধানের ফলাফল জানার পর কিন্তু মানসিকভাবে খুবই কষ্টের সময় পার করছে গৌরবের পরিবার। পরিবারের কথা ভেবে নিজেকে খুন করানোর এই সত্য মেনে নিতে পারছেন না তারা ।
গৌরবের শ্যালক জানান, পুলিশ আমাদের অনেক কিছুই খুলে বলছেনা। যা বলছে তাও বিশ্বাস করা কঠিন। আমার বোনের স্বামী নাকি সামাজিক গণমাধ্যমে পরিচিত এক অল্পবয়স্ক কিশোরের সাহায্য নিয়ে খুন হয়েছেন, এমন দাবি করছে তারা।
তিনি আরও বলেন, মাত্র দুইদিন আগে তারা চার সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে তরা জানিয়েছে। কিন্তু, পুলিশ হত্যা পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানায়নি। খুন নিয়ে পুলিশের সত্যিকার ধারণা জানতে আমরা তাদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করব।
এই প্রেক্ষিতে পুলিশ জানিয়েছে, এখনও মামলার তদন্ত কাজ চলছে। খুনের আসল কারণ এটাই কিনা তা নিশ্চিত হতে তারা সম্ভাব্য অন্যান্য দিকও খতিয়ে দেখছেন।