আদিওস, মায়েস্ত্রো!
কোনো কোনো লেখককে মনে হয় তাঁরা অমর, তাদের কখনও মৃত্যু হবে না। হাসান আজিজুল হক তেমনই একজন অমর লেখক। তিনি মারা গেছেন, এই খবর কর্ণকুহরে প্রবেশ করলেও, বিশ্বাসের পরিবর্তে তার বিপুল, অসামান্য সব গল্পরা হলাহল করে এসে দাঁড়িয়েছে। হাসান ভাই, শুনুন আপনার এই গল্পদের তো বিনাশ নেই। ঘোরলাগা পাঠকের কাছে যুগ যুগ ধরে আপনি বেঁচে থাকবেন, পঠিত হবেন। আপনার মৃত্যু নেই।
বাংলা সাহিত্যে বিরল এক লেখক আপনি। ভাবা যায়? আপনি হাতেগোণা মাত্র দুটো উপন্যাস লিখেছেন, (আগুনপাখি নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। এ উপন্যাসের জন্য ২০০৮ সালে কলকাতা থেকে আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। আর দ্বিতীয় উপন্যাস 'সাবিত্রী উপাখ্যান' ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়। 'শিউলি' নামে আরও একটি ছোট উপন্যাস লিখেছেন, কিন্তু আপনার জীবন উৎসর্গ ছিল ছোটগল্পের কাছে। কি অসামান্য সব ছোট গল্প। মনে পড়ে? আপনার ফেরা গল্পটার কথা। মুক্তিযুদ্ধের গল্প। আমি সদ্য ফিরেছি দেশে তখন। সিনেমা বানাব, কাহিনির খোঁজে নানা লেখকের বই পড়ছি, জগদীশ গুপ্ত, দীপেন, আবু ইসহাক, আল মাহমুদ এবং আমার অতি কাছের জন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন ভাইয়ের কুহক নিয়ে ছবি বানাব, তাঁকে বলেছিলাম। মৌখিক সম্মতিও ছিল। সময় নিয়ে করতে চেয়েছিলাম। আর হয়নি। ওই যাত্রাতেই আমি পাই আপনার ফেরা গল্পের সন্ধান। আপনাকে জানালাম, বললেন, 'বানাও হে'। কিন্তু স্ক্রিপ্ট করতে গিয়ে আঁতকে ওঠে পিছিয়ে এলাম। রাতের শহর, ফেরা পুরোই রাতের শহর, নানারকম অপার্থিব আলো-আঁধারি রূপকল্প-এই শহরকে ফোটাতে যে বিপুল আলোকসজ্জার প্রয়োজন পড়বে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তখন প্রায় অসম্ভব মনে হয়েছে আমার। তারপর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে আমাদের। সিনেমা হয়নি, কিন্তু মাঝে মাঝে আমাদের সাহিত্যের নানা বিষয়ে কথা হয়েছে। আপনি ঢাকায় না থেকেও ঢাকার সাহিত্যের সব কিছুতেই প্রবলভাবে বিরাজমান ছিলেন। আপনার পাঠক নিয়ে হতাশা ছিল। বিভিন্ন সময়ে বলেছেনও। কিন্তু আপনি তো লেখকদের লেখক। বাংলা ভাষায় সাহিত্য করতে এসে কোনো তরুণ বহু দিন পর্যন্ত হাসান আজিজুল হককে বাদ দিয়ে কি সাহিত্য করতে পারবে? মনে হয় না।
স্মৃতি হঠকারিতা না করলে, যদি ভুল না করে থাকি আপনার আত্মজৈবনিক লেখা উঁকি দিয়ে দিগন্তের এই অংশটার কথা বলি, মর্মন্তুদ দেশভাগের বর্ণনা। বাবাকে খুন করার জন্য এসেছে দঙ্গাকারীরা, আপনার বাবাকে কৌশলে বাইরে নিয়ে যাওযার মতলবে আপনাদেরই অতি পরিচিত, প্রায় পরিবারেরই একজন ননু কাকা ডাকছেন আপনার বাবাকে। একই সঙ্গে দাঙ্গা পরিস্থিতির একটা অসাধারণ বর্ণনা আছে এখানে- রাত একটু নিশুতি হয়েছে। আস্তানা থেকে যখন মোসলমানরা চিৎকার করে উঠছে, সেটা যেন আসছে অনেক দূর থেকে আর যখন হিন্দু-মুসলমানরা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠছে, মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙে পড়বে গায়ের মাথায়। হ্যাঁ, এবার শোনা যাচ্ছে দাশু মাস্টারের গলা… এই দাশুর কথাটা শোন তোরা, কী বলছে শোন…। আবার বিকট চিৎকার, শোরগোল।
এরপর আপনি বলছেন-
বিষ যখন গলা পর্যন্ত উঠে আসবে, হৈ দিয়ে আস্তানা থেকে ছুটে আসবে মোসলমানরা, দেয়ালের কোণ থেকে ধুলো উড়িয়ে বেরিয়ে আসবে হিন্দুরা, ধুলোতে আঁধার ঢুকবে, কেউ কাউকে দেখতে পাবে না, লাঠির ঘা পড়ছে মাথায়, টাঙির কোপ পড়ছে ঘাড়ে। মুণ্ডু কেটে পড়ার পর শব্দ নেই একটুও, মাথা ফাটার ভীষণ শব্দ আছে, রক্ত গড়িয়ে পড়ার শব্দ এতই কম যে শোনা যায় না, ধুলোতে ফেনার রঙ বুঝতে পারা যায় না-
এই রকম বর্ণনা আর কোথায় পাব? দেশ ভাগের শিকার আপনিও। বর্ধমানে জন্ম। কিন্তু উন্মূল উঠে এলেন পূর্ববাংলায়। অপনার কথার টানেও রাঢ় বাংলা ছিল। রাঢ় বাংলার জীবন-জীবিকার রূপকারও আপনি। আপনার লেখায় হুগলী নদীর পশ্চিমের- বীরভূম, মুর্শিদাবাদ; বাঁকুড়া, বর্ধমান ও মেদিনীপুর-এই অঞ্চলের ভাষার প্রভাব ছিল বিপুল।
মনে পড়ে? 'মন তার শঙ্খিনী' নামে একটা গল্প লিখেছিলেন। কি প্রবল প্রেমের গল্প। সঙ্গে আরো অনেক ছোট গল্পের নাম করা যায়। শুধু আমার অতি পছন্দের কটা গল্পগ্রন্থের নামই বলি আপনাকে, আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫)।
আপনি বাংলা ছোটগল্পের মায়েস্ত্রো! আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি। ভাবা যায়, একজন লেখক তার পুরো সাহিত্য জীবন পার করে গেলেন শুধু ছোট গল্প লিখে! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অসংখ্য গল্প লিখেছেন। শুরুতে আপনাকে তার সঙ্গে তুলনা করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু আপনি মানিক প্রভাবিত ছিলেন না। আপনি আপনার মতো। একথা দু'একটা সাক্ষাতকারেও বলিষ্ঠভাবে জানিয়েও গেছেন।
আপনি কথা বলতে পছন্দ করতেন। আড্ডায় মধ্যমণি ছিলেন বরাবর। আপনার কথা মুগ্ধ হয়ে শোনার লোকের অভাব ছিল না। একবার জাতীয় যাদুঘরে এক অনুষ্ঠানে মঞ্চে ছিলাম আপনার সঙ্গে, আরো ছিলেন তখনকার জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক- আরো কেউ ছিলেন কিনা আজ আর মনে নেই। আপনার কথা শোনার লোভে নিজে এবং অন্যরা বক্তৃতা দীর্ঘ করুক চাইনি। অপেক্ষার পর, সবার শেষে আপনি উঠলেন। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সবাই শুনল আপনার কথা। একটুও বাড়িয়ে বলা না।
বাংলা সাহিত্যের আপনি ছোটগল্পের অবিসংবাদিত মায়েস্ত্রো। আপনার প্রিয় গল্পকারদের একজন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। এক সাক্ষাতকারে এই গল্পকারকে নিয়ে বলা কথা মনে পড়ছে, আপনি বলেছিলেন:
হেমিংওয়ে আমার প্রিয় লেখকদের একজন। তাঁর লেখা প্রথম পড়েছি ১৯৫৮ সালে—আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস। তখন আমি গ্র্যাজুয়েশন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। অনেক দিন আগে এক দৈনিকে একটি গল্প অনুবাদ করেছিলাম 'ব্রিজের ধারে একটি বৃদ্ধ' নামে। মূল গল্পের নাম 'দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য ব্রিজ'। তাঁর বলার ভঙ্গি আকর্ষণীয় আমার কাছে। খটখট করে বলে যাওয়া—বিশেষণবর্জিত গদ্য—স্টেটমেন্টের মতো করে গদ্য লেখেন। বিশেষণ ব্যবহার করতেই চান না। এটা আমাকে টানে।
মৃত্যু, জরা প্রভৃতি হেমিংওয়ের লেখার বিষয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বব্যাপী সংঘটিত ধ্বংসলীলা তিনি দেখেছেন। ওই সময় ইউরোপ টুকরোটাকরা হয়ে গিয়েছিল। এসব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে মানবিক পতন দেখেছেন। দেখেছেন, মানুষের সুকুমারবৃত্তিগুলো প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তার প্রতীকী বর্ণনা ছিল এ রকম: মানুষের পুরুষত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, মানুষের মেরুদণ্ড থেকে শিশ্ন পর্যন্ত ভেঙে পড়েছে।
আপনার প্রিয় আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একটা ঘটনার কথা বলে আপনার সঙ্গে কথোপকথনের সমাপ্তি টানব। প্যারিসের রাস্তায় যুবা বয়সের গার্সিয়া মার্কেস। ভিড়ের মধ্যে তিনি আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে দেখতে পেলেন। ভিড়ের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছেন। মার্কেসের পক্ষে ভিড় ঠেলে প্রিয় লেখকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। তাই দূর থেকেই মার্কেস চিৎকার করে ডাকলেন:
ওলা মায়েস্ত্রো!
ভিড়ের মধ্যে কেউ ফিরে তাকাল না, শুধু হেমিংয়ে ফিরে তাকালেন। কারণ হেমিংওয়ে জানতেন এখানে মায়েস্ত্রো একজনই, সে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, আর কেউ নয়।
আর আমাদের ছোটগল্পের মায়েস্ত্রো আপনি।
আদিওস, মায়েস্ত্রো!