‘বশীর আর আমিনার অব্যক্ত ভালোবাসা’
আজকে একটা গল্প বলতে চাই। অভিজাত পরিবারের এক যুবক বকুলের সাথে অতি সাধারণ পরিবারের যুবতী তুলুর অব্যক্ত ভালোবাসার গল্প।
বকুলের বাবা ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ। ৯ ভাইবোনের মধ্যে তিনি সপ্তম পুত্র ও কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন। বকুলের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট, বুধবার, ঢাকায়। পিতৃপরিচয়েই তিনি খ্যাতিমান হতে পারতেন অনায়াসে, কিন্তু তিনি হলেন দেশের একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী, কবি, শিক্ষক, লেখক, চলচ্চিত্রনির্মাতা, শিল্পনির্দেশক, সংগ্রাহক, গবেষক ও মুদ্রাবিশারদ। ১৯৪৯ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টসে (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট) দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে বকুল চারুকলায় শিক্ষা শুরু করেন এবং ১৯৫৪ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি শিল্পশিক্ষা শেষ করে প্রথম বিভাগে পাস করেন এবং ১৯৫৬ সালে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ইতালির ফ্লোরেন্সে যান।
তুলুর জন্ম ১৯৪০ সালের ৩০ মার্চ, কলকাতায়। মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলায় কাহেতারা গ্রামে পৈতৃক নিবাস। আট ভাইবোনের মধ্যে তিন পুত্র ও পাঁচ কন্যার মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। বাবা ছিলেন রেল কর্মকর্তা। তিনি ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম রেলওয়েতে যোগদান করেন। বাবার রেলওয়ের চাকরি সুবাদে তুলু চট্টগ্রামে ড. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৫২ সালে চট্টগ্রাম রেলওয়েতে কর্মরত অবস্থায় বাবার মৃত্যু হলে তুলুর মা নাবালিকা সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং গ্রিন রোডে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
বকুলের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী বন্ধুর গ্রিন রোডের বাসার উল্টো দিকের বাসায় তুলুর পরিবার বসবাস করতেন। তুলু অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। ফরসা টুকটুকে গায়ের রং, গোড়ালি পর্যন্ত লালচে লম্বা চুল, ধূসর সবুজ রংয়ের চোখের মণি দেখে এবং যখন বকুল জানতে পারলেন, তুলু বিক্রমপুরের মেয়ে, তখনই মনস্থির করলেন—তাকেই বিয়ে করবেন। কেননা, বকুল দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি' পড়ে বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। গ্রিন রোডের বাসায় উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ নিজে তুলুকে আশীর্বাদ করতে গিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালের ২৭ মে বকুল গাঁটছড়া বাঁধলেন সাধারণ পরিবারের তুলুর সঙ্গে। বকুলের হাত ধরে তুলু একান্নবর্তী অভিজাত পরিবারের ছোট বউ হয়ে আসলেন।
তুলু আর বকুলের দুজনের পারিবারিক অবস্থান উত্তর ও দক্ষিণ মেরু এবং মনের মেরুকরণেও একজন পূর্ব তো আরেকজন পশ্চিম। তারপরও দুজনের রসায়নে কোথায় যেন অব্যক্ত প্রেম, আবেগ, মমতা ছিল, যা তাদের একসাথে বেঁধে রেখেছিল ৫৫ বছর। কলকাতার শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা বকুল আর বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা তুলুর যুগলবন্দীতে একে অপরের প্রতি মমত্ববোধের অভাব ছিল না। এত সব বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব উজ্জ্বল এক নক্ষত্রসম বকুল ছিলেন একজন অব্যক্ত প্রেমিক, যে কিনা তুলুকে পরম মমতায় আগলে রেখেছিলেন। বকুল মনে করতেন, এটা যত না প্রেম, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্ববোধ। বকুল তুলুর জন্য বিয়ের রাতে বাসরঘরে পরার জন্য করাচির ভিক্টোরিয়া রোডের নাম করা দোকান ফ্যাশন আর্কাইদ থেকে ১০০ টাকা দিয়ে হাল্কা গোলাপি নাইটি কিনেছিলেন। তুলু কোনো দিন পরেননি। ১৯৬৮ সালে বকুল স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে (এখন বাংলাদেশ ব্যাংক) ১০০ ফুট লম্বা একটা ম্যুরাল চিত্র করেন এবং ৭০ হাজার টাকার মতো পান। তুলুকে নিয়ে গেলেন বায়তুল মোকাররমের পার্ল হাউসে। কিনে দিতে চাইলেন নবরত্ন পাথরে গড়া গয়নার সেট। সে সময় দাম ছিল আনুমানিক ১০ হাজার টাকা। তুলু এত দামি উপহার কিনতে কোনো আগ্রহ দেখালেন না। ১৯৭২ সালে বকুল প্যারিসে অবস্থানকালীন তুলু এবং দুই শিশুকন্যা রেখে জনতা ব্যাংকের ম্যুরাল করার জন্য লন্ডনে যান। পরিবারের কাছে প্যারিসে ফেরার আগে লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটের নামকরা ডিপার্টমেন্ট স্টোর 'জন লুইস' থেকে চারটা জাপানি সিফন শাড়ি কেনেন ১০ পাউন্ড দিয়ে এবং ইউরোপিয়ান মেয়েরা বিয়ের সময় যে সাদা গ্লাস নাইলন কাপড়ের গাউন পরে, সে কাপড়ই কিনেছিলেন ১০ পাউন্ড দিয়ে। তুলু বোধহয় জীবনে একবারই পরেছিলেন। এ জন্য বকুলের মনে বেশ দুঃখ ছিল। বকুল কল্পনার জগতে বাস করতেন। তার মনে হয়েছিল তুলু ফর্সা, তার সঙ্গে সাদা গ্লাস নাইলনের সাদা লেসের কাপড়ের শাড়িটা যদি পরতেন, তবে তাকে দেবী সরস্বতীর মতো লাগবে।
বকুল আর তুলুর বিয়ের ৩ মাস পরে বকুল করাচিতে যাওয়ার পর নবপরিণীতা তুলু তার স্বামীর বিরহে কাতর হয়ে হৃদয়ের কথা লিখছে ২৮ আগস্ট ১৯৬২ সালে...
'প্রিয় বকুল,
আমার ভালবাসা নিও। তোমাকে প্লেনে তুলে দিয়ে কেমন লেগেছে, তা হয়তো তোমার বুঝবার সাধ্যে নাই, বেশ আরামে আছ এখন তাইনা। তুমি যাওয়ার পর আমাকে মা আমাদের বাড়ীতে নিয়ে এসেছে। সেজ ভাই আমাকে তার ওখানে যাওয়ার জন্য খুব বলেছে। মা যেতে দিল না। আজকে আমাকে গেদু তোমাদের বাড়ীতে রেখে গেছে। টুকু আসতে পারেনি তবে শিলাকে মা আমার সাথে দিয়ে দিয়েছে।
বকুল, তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা তোমাদের বাড়ীতে এসে কেন যেন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারছিলাম না। অদ্ভুত একটা ব্যাথা বুকের মধ্যে করছিল। খালি মনে হলো এই সিঁড়ি দিয়ে কাল তোমাকে নামিয়ে এয়ারপোর্ট দিয়ে এসেছি। আর আজ আমি একা একা উঠছি। ঘরে ঢুকে চতুরদিকে তোমার ছড়ানো জামা কাপড় দেখে কেঁদে দিয়েছি। ঘরে এসে সত্যই বুঝতে পারলাম তুমি আমার কাছে নাই। তোমার ছবিকে নিয়ে তুমি অনেক দূরে আজ চলে গেছ। তোমাকে দিয়ে এসে আমাদের বাড়ীতে একটুও ঘুমাতে পারিনি বকুল তুমি বিশ্বাস কর। খালি মনে হয়েছে প্লেনে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। বাড়ীতে এক মিনিটও থাকতে ইচ্ছা করে নাই। আমার মনে হয়েছে আমার ঘরে গেলে বোধহয় তোমার জিনিষ দেখে ভাল লাগবে। কিন্তু এখানে এসে মনে হচ্ছে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘরে ঢুকতে পারছি না বকুল। বিছানার দিকে দেখছি আর মনে হচ্ছে কেন তোমাকে যেতে দিলাম। হয়তো আজকেও আমাকে জেগে জেগে কাটিয়ে দিতে হবে।
এখন রাত ১০টা বকুল ঘুম আসছে না, তাই তোমার কাছে বসে বসে চিঠি লিখছি আর তোমার কথা ভাবছি। দিনটা কোন রকমে কাটাতে পারবো, কিন্তু রাতটা আমার কাছে মরুভূমির মত অসহ্য। Horlicks-এর শিশিটা দেখছি আর কান্না পাচ্ছে। নিজেকে দেখো লক্ষ্মীটি। শরীরের যত্ন নিও। রোজ কিন্তু একটা করে চিঠি দিতে হবে। না হলে দেখো। বেশী খাটবে না। রাতে ছবি আঁকবে না। তাড়াতাড়ী ঘুমিয়ে পড়বে। খুব সাবধানে থাকবে। এখানে সকলে ভাল আছে। তুমি ভাল করে থেকো। চিঠি দিও।
তোমার তুলু'
করাচি থেকে বকুল তার নবপরিণীতা স্ত্রীর কাছে লিখছে ২৮ আগস্ট ১৯৬২ সালে—
'সুচরিতাসু তুলুমনি,
কাল ঢাকা সময় রাত দুটো পনেরোতে করাচীতে পৌঁছেছি। ঘরে ফিরতে ফিরতে তিনটে। এয়ার পোর্টে কিংবা এয়ার আপিসে আমার বন্ধুকে না পেয়ে সোজা তার বাসায় আসি। যা হোক ভাল ভাবে পৌঁছেছি। পথে কোন রকম কষ্ট হয়নি। অনেক দিন পর বেশ লাগছে। কেমন মনে হচ্ছে সব। নানা কথা মনে পড়ছে। কিছুখন বাদ চা খেয়ে বের হবো। কয়েকজন পরিচিত লোকের সংগে দেখা করতে হবে। ফিরবো দেড়টায়। কোন রকম চিন্তা করবে না, এবং মন খারাপ করবে না। তুমি মনে করে ওষুধগুলো খাবে। ভুলো না যেন। নিজের প্রতি যত্ন নিও। রাতে তোমার কথা বড্ড মনে হচ্ছিল। অনেকখন ঘুমাতেই পারিনি। তোমারও নিশ্চিয়ই এমন হয়েছে। তাই না! মা ও অন্যান্য সবাইকে সালাম।। তুমি আমার প্রীতি ও ভালবাসা নিও।
ইতি তোমার বকুল।'
জীবনের বর্ণময় যাত্রায় সুখ-দুঃখ, আনন্দ-উচ্ছ্বাস, উত্থান-পতন অসংখ্য হৃদয়ের কথা বকুল আর তুলু চিঠির মাধ্যমে তাদের বিবাহিত জীবনে আদান-প্রদান করেছেন। কর্মসংস্থান এবং চিত্র প্রদর্শনীর জন্য বকুলের জীবনের বেশ কয়েক বছর পাকিস্তানের লাহোরে কেটেছে। লাহোরে উচ্চবিত্তদের মধ্যে বকুল এবং তার চিত্রকর্মের বেশ সমাদর ছিল। বিয়ের পর ১৯৬২ সালে বকুল তুলুকে নিয়ে লাহোরে গিয়েছেন। সেখানে সমাজের উচ্চ শ্রেণির মহিলারা তাকে যেভাবে ঘিরে রেখেছিল, তাতে তুলু খুব বিব্রত হচ্ছিলেন। বকুলের চিত্র প্রদর্শনীতে তুলু খুব কম গিয়েছেন। তিনি নিভৃতচারিণী ছিলেন। বকুল তার কাজের জন্য পাকিস্তান ও ফ্রান্সে বেশ কিছু বছর কাটানোর পর ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুবাদে সপরিবারে চট্টগ্রামে থিতু হন। দুই কন্যা ও এক পুত্রসন্তানের বাবা ও মা হয়ে বকুল আর তুলু সুখে-দুঃখে, জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল। অভিজাত পরিবারের বকুলের আত্ম-অহমিকার কাছে তুলু খুব সাধারণ পরিবারের হলেও তার আত্মগরিমার জন্য বকুল সব সময় মাথা নুয়ে থাকত পরম স্নেহে। নির্লোভ, সুশৃঙ্খল আর সহজ-সরল মনের অধিকারিণী তুলুকে বকুল যতটুকু না ভালোবাসতেন, তার চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করতেন। বকুলের দুঃসময়ে সংসারের হাল ধরে তার পাশে এবং সাথে থেকে তুলু হয়ে উঠেছিলেন মহিমান্বিত এক নারী। অভিজাত পরিবারের বউ এবং নামকরা ব্যক্তির স্ত্রী হয়েও তার মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না। সেই জন্যই বকুল তার বোহেমিয়ান জীবনের লাগামটা ইচ্ছে করেই তুলুর হাতে দিয়ে রেখেছিল। অবশেষে ৩০ বছরের চট্টগ্রামের পাট চুকিয়ে ২০০৩ সালে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সাধারণ মধ্যবিত্তের সংসার যেমন চলে, তুলু আর বকুলের সংসারজীবনও তেমনই নিজস্ব গতিতে চলছিল। তাদের দুই কন্যা এবং একমাত্র পুত্র তারাও জীবনে প্রতিষ্ঠিত এবং নিজেদের সংসারে আবদ্ধ।
২০১৩ সাল থেকে বকুল আর তুলুর জীবন-আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা দিতে শুরু করে। বকুল ২০১৩ সালে ইউনাইটেড ও অ্যাপোলো হাসপাতালে ফুসফুসে কঠিন সংক্রমণ নিয়ে জীবনের অবশিষ্ট সময় চিকিৎসকের অধীনে চলে গেলেন। ২০১৪ সাল থেকে লাগাতার অসুস্থতার কারণে তুলু বারবার হাসপাতালে ভর্তি হতেন। কয়েক বছর ধরে তুলুর অসুস্থতাকালীন যন্ত্রণা বকুলকেও কষ্ট দিচ্ছিল। তুলু শয্যাশায়ী হওয়ার পর ৩ বছর বকুল রাত জেগে সেবা করে গেছেন। ঘুমের মধ্যেও জেগে থাকতেন কখন তুলু ডাকবে। শয্যাশায়ী তুলুর নৈমিত্তিক কর্মকাণ্ডে ছায়া হয়েছিলেন বকুল। তার অসুস্থতা মানসিক দিক দিয়ে তাকে একেবারে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল এবং পরিবারেও নেমে এসেছিল স্তব্ধতা। তুলু যখন দীর্ঘ অসুস্থতায় ভুগছিলেন, তুলু অন্তঃপ্রাণ শয্যাশায়ী স্ত্রীর সেবাযত্নে বকুলের যে কর্তব্যবোধ, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা ছিল, তা তার দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করছিল। তুলু ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারিতে ভর্তি হয়েছিলেন অ্যাপোলো হাসপাতালে। তখন থেকে মৃত্যুর পূর্বে মে মাসের ১৩ তারিখ পর্যন্ত নিয়মিতভাবে ডায়ালাইসিস করতে হতো। একবার বকুলের চোখের সামনে তুলুর ডায়ালাইসিস হচ্ছে। হঠাৎ তুলু বমি করা শুরু করল। চোখ স্থির হয়ে গেছে। বকুলের চোখ দিয়ে অঝরে পানি পড়ছে। বকুল ডাকছে—'তুলু, তুলু, তুলু!!!' নিয়মিত ডায়ালাইসিসের বাইরে তুলুকে মাসখানেক অ্যাপোলো হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। দীর্ঘ চার মাস (জানুয়ারি ২০১৭-মে ২০১৭) তুলু প্রচণ্ড রোগযন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে মনেরও শক্তি হারিয়ে ফেলছিল। এরই মধ্যে তাকে একবার সিসিইউ এবং আইসিইউতে নেওয়া হয়। ডায়ালাইসিস করার জন্য পালাক্রমে প্রথমে ডান পায়ে এবং পরে বাম পায়ে, তারপর গলায় ক্যাথেটার করা হয়। এত খোঁচাখুঁচি তুলুর শরীর আর সহ্য করতে পারছিল না। শেষের দিকে তেমন কথা বলতেন না। শুধু মাঝেমধ্যে বলতেন—ব্যথা। বকুল জিজ্ঞাসা করতেন, তুলু কোথায় কষ্ট হচ্ছে? তুলু কোনো উত্তর না দিয়ে আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে একেবারে চুপ করে থাকতেন। শেষের দিকে তুলুর শারীরিক যন্ত্রণা কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছিল না। বকুল ফেসবুকে লিখলেন, ২০ মে ২০১৭—'Shame on me!! As a self-centred life patner could not share the pain...'
সেই সময়টা বকুল তুলুকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়েনি। তিনিও হাসপাতালবাসী হয়েছিলেন। তিনি নিজেও ফুসফুসের কঠিন সংক্রমণ নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছিলেন। তার এবং তুলুর চিকিৎসার জন্য প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিলেন। বকুল তার সন্তানদের বলেছিলেন, কারও কাছে তোমরা হাত পাতবে না। আরও বলেছিলেন, প্রয়োজনে বাড়ি বিক্রি করে হলেও তোমাদের আম্মার চিকিৎসা চালিয়ে যাব। বকুল রাতের পর রাত জেগে তুলুর সেবা করে গেছেন। ১৩ মে সকালে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে (বর্তমান এভারকেয়ার হাসপাতাল) শেষবারের মতো ডায়ালাইসিসের সময় তুলু লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। সমস্ত শারীরিক কষ্টের ঊর্ধ্বে। বকুল আর তুলুর তিন সন্তান মানসিকভাবে তৈরি ছিল না তুলুর চলে যাওয়ার জন্য। কিছুদিন পরপর তুলুকে হাসপাতালে ভর্তি করানো ছিল বকুলের পরিবারের নিয়মিত কাজের মতো। বকুল, যুই, যুথী আর যামী মনে করেছিল, প্রতিবারের মতো চিকিৎসা শেষে এবারও তুলুকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসব। তুলু বাসায় এসেছিল ঠিকই, তবে নিষ্প্রাণ দেহ নিয়ে। তুলুর তাকে রেখে চলে যাওয়াটা মানসিকভাবে মানতে পারছিলেন না বকুল। তিনিসহ পরিবারের কেউই প্রস্তুত ছিল না তুলুর বিদায়ের জন্য।
তুলু মৃত্যুর কয়েক মাস আগে থেকে শুধু বকুলের নাম ধরে ডাকতেন, 'বকুল ও বকুল'। বকুল বলতেন, বলো কী বলবে। তুলু, তুমি ভালো আছ? তুলু বলতেন, ভালো আছি। বকুল বলতেন, আলহামদুলিল্লাহ। ৯ মে ২০১৭ আইসিইউতে তুলুর শেষ কথা ছিল, 'ও বকুল, বকুল'। বকুল যখন তুলুকে আইসিইউতে বললেন, 'তুলু, তুমি কেমন আছ? তুমি ভালো আছ?' তুলু কোনো উত্তর দেননি। তুলু তখন ঘুমের ঘোরে চলে গেছেন।
বকুল আর তুলুর একসাথে পথচলা শুরু হয়েছিল ২৭ মে, ১৯৬২। ১৩ মে ২০১৭, ৩০ বৈশাখ ১৪২৪, ১৬ শাবান ১৪৩৬, সকাল ৬টা ৫৫ মিনিটে বকুলের তুলু; যুই, যুথী আর যামীর আম্মা দুনিয়ার মোহ-মায়া ত্যাগ করে চিরবিদায় নিয়েছিলেন। ডাক্তারদের সব রকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে তুলু চিকিৎসাধীন অবস্থায় অ্যাপোলো হাসপাতাল, ঢাকায় চিরনিদ্রায় চলে গেলেন। বকুলের জীবনে নেমে আসে নিয়তির অমোঘ সত্য। তুলু যখন বিদায় নিয়ে অনন্তলোকে চলে গেলেন, বকুল নিথর হয়ে গিয়েছিল। তাদের বিয়ের ৫৫ বছর পূর্তির ১৪ দিন আগে তুলু বকুলের হাত ছেড়ে চলে গেল অনন্তলোকে। তাদের একসাথে পথ চলা শেষ হলো। কিন্তু থেকে গেল স্মৃতি! ১৯ মে ২০১৭ ফেসবুকে বকুল লিখল, 'Tulu, my wife left me physically on 13 May, 2017 but she is with me eternally...'
বকুল যখন তুলুর চলে যাওয়ার খবর পেল, ভেজা ভেজা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, 'তুলু, তুমি চলে যাও। আল্লাহ চাইলে দেখা হবে।'
বকুলের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছিল। ৭ মে ২০১৭ বকুল আর যামী অ্যাপোলো হাসপাতালের ফুড কোর্টের লিফটে দেড় ঘণ্টা আটকে ছিলেন। বকুলের অক্সিজেনের স্তরটা একেবারেই নেমে যায় এবং তার ফুসফুসেও পানি জমে যায় ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। ডাক্তার বকুলকে আইসিইউতে ভর্তি হতে বললেন।
২১ এপ্রিল, ২০১৯ বকুল লিখলেন, 'তুলু আজকে শবে বরাত। আল্লাহর কাছে দোয়া চাইলাম। ২০১৭ সালে এই শবে বরাতের রাতে তুমি অ্যাপোলো হাসপাতালের আইসিইউতে জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে লাইফ সাপোর্টে ছিলে। আমিও অসুস্থবোধ করায় রাতে ডাক্তার আমাকেও আইসিইউতে ভর্তির জন্য নির্দেশ দিলেন। তুমি ছিলে সার্জিক্যাল আইসিইউতে। আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল মেডিকেল আইসিইউতে। কিন্তু আমার পরিবারের আবেদনের কারণে আমাকেও সার্জিক্যাল আইসিইউতে তোমার পাশের বেডে রাখা হলো। সেটা ছিল ১১ তারিখ ২০১৭। শবে বরাতের রাত। কিন্তু ১২ তারিখ রাত ৯টায় হঠাৎ করে আমাকে কেবিনে শিফট করে দিল। সকাল বেলায় যুই আমাকে বলল, আম্মা যেতে পারছেন না। আপনি আম্মাকে মাফ করে দেন আর যাওয়ার অনুমতি দেন। তখন আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল তুলু, তোমাকে চির বিদায় দিতে। তখন সকাল ৮টা। কেবিন থেকে আমাকে যখন লিফটে করে সার্জিক্যাল আইসিইউতে নিয়ে গেল, দেখলাম তুমি নিথর শুয়ে আছো। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল তুমি আর নাই। আমার ধারণা ছিল তুমি হাসপাতাল আর বাড়ি এই দুইয়ের মধ্যে আসা যাওয়া করবে আর বেঁচে থাকবে। আজকে আবার সেই শবে বরাতের রাত। তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো। আল্লাহ তোমাকে রহম করুন।। আমিন।'
অ্যাপোলো হাসপাতালের আইসিইউতে ৯ মে ২০১৭, রাত থেকেই তুলু অচেতন ছিলেন। ১০ মে বিকাল ৪টার পরে লাইফ সাপোর্টে চলে গেলেন। বকুল যেটার ভয় পাচ্ছিল, সেটাই হলো। বকুল আইসিইউ ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলেন, লাইফ সাপোর্ট দিলে তুলু কি ফেরত আসবেন? ডাক্তার কিছুক্ষণ চুপ থেকে সরাসরি মাথা নেড়ে 'না' বললেন। বকুল তুলুকে লাইফ সাপোর্টে দেয়ার ব্যাপারে ঘোর বিরোধী ছিলেন। যখন জানলেন তুলু ফেরত আসবেন না, তখন সরাসরি না বলে দিলেন। কিন্তু তুলুর কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞ যখন বললেন, 'ম্যাডামের এখন যে শারীরিক অবস্থা, লাইফ সাপোর্টে না দিলে শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। বেঁচে থাকা পরের কথা, আর যদি শেষ সময় হয়ে থাকে, তাহলে ম্যাডামের মৃত্যুযন্ত্রণা কম হবে। কাজেই ম্যাডামকে লাইফ সাপোর্টে চলে যেতে হবে।'
বকুলসহ তিন সন্তানের পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। বকুল বুঝতে পারল, তার প্রিয়তমা স্ত্রী তুলু সব আশা, বকুলের কাছে ফেরত আসার প্রতীক্ষা, সব ছেড়ে নতুন ঠিকানায় চলে যাচ্ছেন। বকুল আর তুলুর বড় কন্যা যুই লাইফ সাপোর্ট দেয়ার পর সন্ধ্যায় মাকে আইসিইউতে দেখতে গেল। তুলু শুয়ে আছেন। যুই আম্মার কানের কাছে মুখ নিয়ে ডাকল—'আম্মা, আম্মা, আম্মা'। সাড়া দিলেন না। কত ডাকল। তুলু তাকালেন না। অনেক ডাকল, কিছুই বললেন না। কিছুই বলতে পারলেন না। লাইফ সাপোর্টের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। কিন্তু যুই যখন বলল—'আম্মা বাবাকে বলে দেন আমাকে যেন বিরক্ত না করে।'
অবিশ্বাস্যভাবে তুলুর ডান চোখটা একটু খুলে গেল। স্পষ্ট তুলুর সবুজ চোখের মণিটা দেখা গেল। সেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। হয়তো বকুলের কথা বলাতে তুলু অচেতন অবস্থাতেও আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন। যুই বকুলের নামে নালিশ করছে, তুলু হয়তো তা মেনে নিতে পারছেন না। চোখ বন্ধ করে ফেললেন। হয়তো জীবনসায়াহ্নে তুলু বলতে চেয়েছিলেন, সেই অব্যক্ত ভালোবাসার কথাটি—'বকুল, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমিও কি ভালোবাসতে!!!'
তুলুর চলে যাওয়ার পর বকুল ফেসবুকে তুলুকে ২৬ জুন ২০১৭ লিখলেন—
'তুলু আজকে ঈদ। এই প্রথম তোমাকে ছাড়া আমাদের বাসায় ঈদ। তাই তোমার নতুন বাসায় তোমাকে ঈদ মুবারক জানাতে আসলাম। বেঁচে আছি ঠিকই, বেঁচে থাকতে হচ্ছে বলে। তুলু তুমি ছাড়া বড় একা একা লাগে। জানি না তোমার সাথে আর কখনো দেখা হবে কিনা। তুলু তুমি ভাল থেকো। আসি।'
তুলুর অনন্তলোকে চলে যাওয়ার পর বকুল বলতেন, 'এখন আমার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আমার আর বাঁচার ইচ্ছা নাই। আমার যেসব গবেষণামূলক কাজ করার কথা, যেসব আঁকার কথা এসব করার স্পৃহা আর নেই!'
দীর্ঘ ৫৫ বছর একসাথে থাকা জীবনসঙ্গিনী চলে যাওয়ার পর থেকেই বকুলের মনটা কেমন এক শূন্যতায় ভরে যায়। তুলুর চলে যাওয়ার বেদনা তাঁকে নিস্পৃহ করে দিয়েছে। ছবি আঁকার স্পৃহা হারিয়ে ফেলেন। হয়তো ছবি আঁকতে গেলে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা মনে পড়ে যাবে। তাই হয়তো আঁকাআঁকি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। বকুলের স্বপ্ন ছিল, সময়কে অতিক্রম করে যাবে তার আঁকা চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে। যেসব চিন্তাভাবনা করেছিল, যা আঁকা হয়নি, যা লিখতে চেয়েছিল, গবেষণামূলক লেখা, যেগুলো করা হয়নি। তুলু ছিল বকুল আর তিন সন্তানের জীবনে এক অবিনশ্বর আলোকবর্তিকা। তাকে হারিয়ে সবার যেন পায়ের নিচের থেকে মাটি হারিয়ে গেল। নিজেকে এত অসহায় তারা আর কখনো মনে করেনি। রোজ ভোরবেলা বকুল তুলুকে দোয়া পড়াতেন। বলতেন, 'তুলু বলো, "লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহি, লা মানজায়া মিনাল্লাহি ইল্লা ইলাইহি।" কী হলো বলো।'
তার সংসারের জন্য তুলুর অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগ ছিল অতুলনীয়। তুলু নিজের প্রতি যত্ন নেয়ার চেয়ে স্বামী আর সন্তানদের যত্ন নিতেই বেশি উদ্গ্রীব থাকতেন। তুলুর কথা মনে করে তার অনুপস্থিতিতে এবং বিচ্ছেদে বকুলের চোখ পানিতে ছল ছল করে উঠত। বকুল ও তুলু একে অপরের ওপর খুবই নির্ভরশীল ছিলেন।
বকুল তার কর্মক্ষেত্রে অবদানের জন্য বহু জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছেন। মার্চ মাস বকুলের কাছে সব সময় আনন্দের মাস ছিল। তুলুর জন্মদিন আর ছোট মেয়ে যুথীর বিয়ের মাস। মার্চ মাস আরও আনন্দের হয়ে থাকবে বকুলের বহুপ্রত্যাশিত স্বাধীনতা পদক ২০১৯ প্রাপ্তির মাস হিসাবে।
বকুলের সাফল্যের পেছনে তুলুর অবদান ছিল অসামান্য। বকুলের বহুমাত্রিক প্রতিভা চারদিকে বিকীর্ণ হওয়ার পর যশ, খ্যাতি ও অর্থের পিছনে তাকে ছুটতে হয়নি। বরং যশ আর খ্যাতি তার কাছে ধরা দিয়েছে। বকুল যখনই কোনো ছবি আঁকতেন, প্রথমেই তুলুকে দেখাতেন এবং মতামত নিতেন। তুলুর মতামতকে বকুল খুবই মর্যাদা দিতেন। বকুলের সাফল্যের নেপথ্য কারিগরের তুলুর অবদান ছিল অসামান্য। বকুল যখনই কোনো পদক পেয়েছে, তুলুর গলায় পরিয়ে দিতেন। শুধু স্বাধীনতা স্বর্ণপদক পরাতে পারেননি। তুলু তখন অন্য জগতের বাসিন্দা। শায়িত বনানী কবরস্থানে। তবে তার ব্যতিক্রম হয়নি। বকুলের আঁকা তুলুর প্রতিকৃতিতে বকুল বহুপ্রত্যাশিত স্বাধীনতা স্বর্ণপদক ২০১৯ পরিয়ে দিয়েছিলেন। বকুল তুলুকে ২৯ মার্চ ২০১৯ ফেসবুকে লিখলেন—'তুলু যখনই কোনো পদক পেয়েছি সেটা ১৯৮০তে একুশে স্বর্ণপদক, ২০০৩ সুলতান স্বর্ণপদক, ২০০৭ কবি চন্দ্রাবতী স্বর্ণপদক, ২০০৯ অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, ২০১৬ আমিন জুয়েলার্স স্বর্ণপদক তোমার গলায় পরিয়ে দিয়েছি। আর যখনই সম্মাননা ক্রেস্ট পেয়েছি তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। তুমি বিস্ময়ে গ্রহণ করেছ এবং পরে তোমার চেহারায় চাপা আনন্দের আভা দেখেছি। আজকে তুমি নাই। আমার বহু প্রত্যাশিত স্বাধীনতা পদক ২০১৯ অবশেষে ৩৯ বছর পরে পেলাম। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তুমি বেঁচে থাকলে খুশী হতে। এই পদক আমার আঁকা তোমার পোর্ট্রেটে পরিয়ে দিলাম।'
বকুল যেন দিব্য চোখে দেখল, এটা তুলুর প্রতিকৃতি নয়, এ যেন ছবির কাচের ফ্রেমের ভেতর জীবন্ত তুলু আগের মতো স্মিত হেসে, ফরসা গালে লাল আভা ছড়িয়ে গলায় পরানো মেডেলটা উল্টেপাল্টে দেখে বকুলকে বললেন—'বকুল দেরিতে হলেও অবশেষে জীবিত অবস্থায় তোমার ইচ্ছা পূরণ হলো। আমি অনেক খুশি হয়েছি। তোমার এখানে এসে জিয়ারত করে আল্লাহর কাছে তোমার রুহের মাগফিরাত চাইলাম। আল্লাহ তোমাকে রহম করুন। আমিন।'
তুলু চলে যাবার পর বকুল খুব অস্থির আর মনমরা হয়ে থাকতেন। বকুল তার মনের যত কথা ফেসবুকে তুলুর কাছে লিখতেন। ফেসবুকে বকুল তুলুকে লিখলেন (১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯)—
'তুলু ২০১৭ মে ১৩ তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছো। আমি অনেক মাস কিছুতেই তোমার এ ভাবে হুট করে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছিলাম না। আমার মনে হতো এভাবে তুমি অ্যাপোলো হাসপাতাল ও শেলটেক মনিহারে আমাদের বাসায় আসা যাওয়া করবে। তুমি চলে যাওয়ার পরে আমার বিশ্বাস হয়নি আমার থেকে তুমি চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছো। যুই আমার এই অবস্থা দেখে বললো—বাবা আপনি নামাজ পড়েন। ছোটবেলা থেকে আমি আমার বাবুর (বাবা) সাথে নামাজ পড়তাম। তারপর স্কুল ও কলেজ জীবনে শুধু ফজর আর এশা ছাড়া নিয়মিত নামাজ পড়া হত না। মাঝে মাগরিব পড়তাম আর শুক্রবারে জুম্মা। ১৯৫৬ সালে বাবু আমাকে ইতালি পড়তে পাঠালেন। দেশে ফিরে এলাম ১৯৫৮ এর শেষে। বিদেশে থাকাকালীন সময় কোনদিন নামাজ পড়া হয়নি। দেশে ফিরে আসার পর কোন চাকরি হলো না বা দেয়া হবে না। তখন ইনস্টিটিউট এ চাকরি নির্ভর করতো প্রিন্সিপাল জয়নুল আবেদিনের উপর। যদিও আমি প্রথম শ্রেণি পেয়েছিলাম ও বিদেশে পড়াশোনা করেছিলাম। প্রথম ব্যাচের বিজন চৌধুরী ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল। তারপর নিতুন কুন্ডু, প্রানেশ মন্ডল এবং নাসির বিশ্বাস ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া সত্ত্বেও চাকরি পায়নি।
আমি চাকরি পাইনি বলে আমার জীবনটা বাঁচানোর জন্য হয়ে গেল যাযাবরের মত। কিছুদিন করাচি, লাহোর অথবা রাওয়ালপিন্ডি এভাবেই চললো ১৯৭০ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ আমাকে লাহোর নিয়ে যান চিত্র প্রদর্শনী করার জন্য ১৯৬৯ এর শেষে। সেখানে তিনি আর্ট কাউন্সিলে ছাত্র ছাত্রীদের ছবি আঁকা শেখাবার জন্য চাকরি দেন। আমি ১৯৬১ সালের শেষের দিকে হুট করে ঢাকা চলে আসি। ১৯৬২ সালে আমি বিয়ে করি। বিয়ের পরে মাঝে মধ্যে সকাল-সন্ধ্যা নামাজ পড়তাম। বাবু নামাজ পড়ার জন্য ডাকতেন। ১৯৬৯ এ বাবুর মৃত্যুর পরে নামাজ পড়া বলতে গেলে ছেড়ে দিয়েছিলাম।
'আমার স্ত্রী তুলু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। আমি পড়তাম না। আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পরে আমার মানসিক অশান্তি দেখে আমার মেয়ে যুই আমাকে নামাজ পড়তে বলে। আমি ২০১৭ ডিসেম্বর মাস থেকে নামাজ পড়া শুরু করলাম যা এখনো অব্যাহত আছে। আগে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তাম। আপাতত পড়ছি না। প্রতিদিন রাত ৩টায় যুই আমাকে ডেকে দেয়। আমি ফজর নামাজের আগ পর্যন্ত কোরআন পড়ি। ২০১৮ জানুয়ারী মাস এ পর্যন্ত প্রতি মাসে একবার করে কোরআন খতম করি। আজকেও কোরআন খতম করে বাবু, মা, আমার ভাইদের আর ভাবীদর রুহের উপর বকশিয়ে দিলাম। সেই সঙ্গে তুলুর নামেও বকশিয়ে দিলাম। ময়না (আমার সেজো ভাই যকীয়ুউল্লার ছেলে) আমার বদলী হজ্ব করে আজকে ফিরে এসেছে। ২০১৬ তে ময়না তুলুর বদলী হজ্ব করে দিয়েছিল। তুলু খুব খুশী হয়েছিল। আমি আল্লাহর কাছে নিয়ত করেছি ২০২০ সালে ওমরাহ করার জন্য। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার এই আশা পূরণ করবেন। আজকেও আগের দুই বারের মত তোমার কাছে এসে মোনাজাত করতে পারলাম না। গাড়িতে বসে তোমার জন্য আল্লাহর কাছে মোনাজাত করলাম আল্লাহ যেন তোমাকে রহম করুন। আমিন।'
বকুল চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছেন। মাঝেমধ্যে গ্যাপ দিয়েছেন। তারপর অনেক বছর বাদ দিয়ে আবার নামাজের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। রক্ষণশীল মুসলমান পরিবার হওয়াতে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা নিয়েই বকুলের জ্ঞানতাপস পিতা এবং তার ছয় পুত্র আর দুই কন্যা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। পিতা প্রতিদিন বেগম বাজারের বাসায় বকুলসহ যে কজন তার পুত্র থাকতেন, তাদের ঘরের দরজায় টোকা দিতেন আর নামাজ পড়ার জন্য তাগাদা দিতেন। একদিন বকুল হঠাৎ তার পিতাকে বললেন, 'নামাজ আপনার ভয়ে পড়ব, না আল্লাহর ভয়ে?' তারপর ইংরেজিতে বললেন, 'why only 5 times, why not 24 hours. Do not disturb me. I am trying 24 hours.' জ্ঞানতাপস অপলক দৃষ্টিতে তার পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কিছু না বলে হেঁটে চলে গেলেন। তিনি যত দিন বেঁচে ছিলেন, আর কোনো দিনও বকুলকে নামাজ পড়ার জন্য ডাকেননি। বকুল বলতেন, 'জীবনে যা কিছু করেছে, ভালোবেসে করেছে। সেটা ছবি আঁকা হোক, গল্প-কবিতা বা উপন্যাস লেখা, গবেষণা করা, স্টাম্প বা কাগজের টাকা, মুদ্রা জমানো, প্রেম ও ভালবাসা—সব সময় আনন্দ নিয়ে করেছি। আজকে কোরআন শরিফ পড়ছি, নামাজ পড়ছি, আনন্দ পাচ্ছি তাই!'
১৯৬২ মে ২৭, বিয়ে করার পরে বকুল তুলুর প্রথম স্কেচ করেছিলেন জুন মাসে ঢাকাতে। বিয়ের পরে বকুল যেসব পেইন্টিং করেছিলেন, তাই নিয়ে লাহোরে ১৯৬২ সালে নভেম্বর মাসে প্রথম প্রদর্শনী করেছিলেন। সেই ক্যাটালগের পেছনে তুলুর একটা স্কেচ ছিল। তা ছাড়া চট্টগ্রামে ১৯৭৪-৭৫ সালে চারটি, ১৯৮৮ সালে কলকাতায় বকুল তুলুর স্কেচ করার সময় তুলু সিটিং দিতেন। বকুল তুলুর খুব বেশি স্কেচ করতে পারেনি। তুলু পছন্দ করত না। তারপর তুলুর আর কোনো স্কেচ করেনি। অনেক বছর পরে তুলুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ১৩ মে ২০১৮ উপলক্ষে বকুল 'ঊীযরনরঃরড়হ ঐড়সধমব ঞড় গু খধফু' তুলুর প্রতি উৎসর্গ করলেন। বিভিন্ন সময় তুলুকে ড্রয়িং করা ১২টি স্কেচের সেরিগ্রাফি নিয়ে ৩০টি সেটের একটি ফলিও ছিল এই প্রদর্শনীতে। তুলু চলে যাবার পরে ৩০ মার্চ ২০১৮ তুলুর জন্মদিন স্মরণে বকুল তুলুর ছবি দেখে একটা স্কেচ করেছিলেন।
তুলু চলে যাওয়ার পর বকুল নিয়মিত প্রতি শুক্রবার এবং শুক্রবার ছাড়া যেকোনো পারিবারিক অনুষ্ঠান বা উৎসবে তুলুর সমাধির কাছে যেতেন এবং বলতেন, 'তুলু, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি।'
২০১৭-২০২০ বকুল তুলুর কাছে ফেসবুকে লাগাতার লিখে গেছেন। বাসায় ফিরে বকুল ফেসবুকে তার মনের যত কথা, তুলুর বিরহে তার একাকিত্ব, ভালো থাকা না থাকা সব ভাগ করে নিতেন। বনানী কবরস্থানে বড় কন্যাকে সাথে করে তুলুর কবর জিয়ারত করতে যেতেন। একদিন যুই তার বাবাকে বলল, আম্মার কবর শব্দটায় আমার আপত্তি আছে। বকুল বললেন, ঠিক আছে, তাহলে বলি তোর আম্মার সমাধি। তুলুর রুহের মাগফিরাত চেয়ে বকুল আর তার কন্যা মোনাজাত করত, আর ছবি তুলত। মাঝে মাঝে যুই বিরক্ত হয়ে বলত, 'বাবা, সব সময় ছবি তুলতে ভালো লাগে না।' বকুল বলতেন, 'আরে তুলে রাখ, আমি না থাকলে তোকে তো একা একা তোর আম্মার কাছে আসতে হবে, তখন আমার অভাব অনুভব করলে এই ছবিগুলো দেখবি।'
রাতে বাসায় খাওয়ার পর বকুল মেয়েকে বলতেন, আজকে তোর আম্মার সমাধিতে গেলাম, লিখাটা তো লিখতে হবে। তুই ফ্রি আছিস?
যুই বকুলকে মাঝে মাঝে বলত, 'বাবা, আপনি আমাকে ডিকটেশন দিচ্ছেন, আমি লিখে দিচ্ছি। আমি আর লিখতে পারব না। আপনি লিখতে পারেন না?' বকুল হাসত আর বলত টাইপ করতে গেলে অনেক ভুল হয়। তোর মতো তো পারি না।
যুই বলত, বাবা আপনি প্রতি শুক্রবার আম্মার সমাধি থেকে এসে আম্মার প্রতি আপনার ভালোবাসার অনুভূতির যে বহিঃপ্রকাশ, সেটা কি আম্মা দেখতে পায়? এই যে আমি আর আপনি প্রতি শুক্রবার আম্মার কাছে যাচ্ছি, রাতে আপনি আম্মাকে লিখে জানাচ্ছেন। অনেকেই বলে আম্মা তো মৃত। তাকে নিয়ে কেন নিয়ম করে লিখছেন।
বকুল চুপ করে থেকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলতেন—'তুইও তো লিখিস তোর আম্মাকে নিয়ে "হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শনিবার", তুই লিখিস কেন?'
মেয়ে বলত, আম্মা আছেন আমার আশেপাশে, তাই লিখি।
বকুল বলতেন, 'তুলু মানুষের কাছে মৃত হতে পারে, আমার কাছে নয়, ও আছে আমার আশেপাশে, তাই লিখি। তোর আম্মাকে নিয়ে তোর লিখা আর তুলুকে নিয়ে আমার লিখাগুলো বই আকারে বের করব।'
মেয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল, বাবা আপনার লিখা পড়বে, আমারটা কে পড়বে? বকুল বলেছিলেন, 'পড়বে। আমার পাবলিশার্সদের আমি বলব, ওরা ছাপবে কি না।'
৩০,মার্চ, ২০২০ বকুল ফেসবুকে তুলুকে লিখছে, 'Tulu on your birthday, I want you to know that you mean so much to me. I cherish every single moment spent with you...I'm grateful to Allah for blessing me with an adorable woman like you...Thank you for making life worthwhile...May Allah bless Tulu and grant her a place in Jannah...All my prayers are with her...2017.'
তাদের বিবাহবার্ষিকী ২৭ মে, ২০১৮ ফেসবুকে লিখলেন, 'তুলু আজকে আমাদের ৫৬তম বিবাহ বার্ষিকী। আমার হাতে ধরে পথ চলা শুরু করেছিলে ১৯৬২, ২৭ মে। আমাকে ছেড়ে চলে গেলে ২০১৭, ১৩ মে। ৫৫ বছর লম্বা সময়। অথচ মনে হচ্ছে এই তো সেদিন তুমি আর আমি পথ চলা শুরু করলাম। তিন সন্তানের জনক জননী, নানা নানি, দাদা দাদি হলাম। ২০১৭-২০১৮ তোমাকে ছাড়া আমাদের বিবাহ বার্ষিকীতে আমি একাই পথ চলছি। তুমি যেখানেই থাকো আল্লাহ যেন তোমাকে রহম করেন। আমীন।'
২৭ জুন ২০২০ বকুল ফেসবুকে তুলুকে লিখছে, 'তুলু ২০১৭, ১৩ মে এই পৃথিবী ছেড়ে, আমাদের ছেড়ে তুমি সে চিরকালের জন্য অন্য জগতে পাড়ি দেবে, তা আমি কল্পনা করতে পারিনি। আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল অ্যাপোলো হাসপাতাল আর আমাদের বাসা শেলটেক মনিহার অসুস্থতার কারণে আসা যাওয়া করবে। তুমি চিরকালের জন্য চলে যাওয়াতে আমার জীবনে একটা বিরাট ধাক্কা। এই অবস্থায় তোমার বড় মেয়ে যুই আমাকে বললো বাবা আম্মা চলে যাওয়াতে আপনার মনে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে এবং আপনার মনের শান্তির জন্য আপনি নামাজ পড়েন, কোরআন শরীফ পড়েন। ২০১৮ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি কোরআন শরীফ ১২ বার খতম করি। ২০১৯ সালে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে আমি শ্বাসকষ্টজনিত হার্ট ফেইলিউরের কারণে অ্যাপোলো হসপিটালে এডমিট হই। ফলে আমি অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বর ৩ মাস কোরআন শরীফ পড়তে পারিনি। ২০১৯ সালে আমি ৯ বার কোরআন শরীফ খতম করি। এবং ২০২০ এ জানুয়ারি-জুন পাঁচবার কোরআন শরীফ খতম করি। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে আমি প্রতিবার কোরআন শরীফ খতম করে তোমার, বাবু, মা, আমার ভাই-ভাবীদের নামে বকসিয়ে দেই। তুলু তুমি চলে যাবার পর তোমাকে খুব একটা স্বপ্নে দেখি না। আজকে বছরের মাথায় ২৭ জুন তোমাকে স্বপ্নে দেখি। আমি দেখলাম একটা বিরাট বাড়িতে আমি কার সঙ্গে দেখা করার জন্য গেছি। সেই বাড়িতে পিছন দিয়ে নদী গেছে। আমি বাসার কাজের লোকদের বলছি আমি যে এসেছি খবর দিয়েছেন। এমন সময় তুলু তুমি এসে উপস্থিত। তুমি অনেক স্বাস্থ্যবতী এবং সুন্দরী। আমি তোমার গালে চুমু খেলাম। আমি বললাম 'আরে তুলু তুমি হাঁটতে পারো' (তুলু বছরখানিক ধরে হাঁটতে পারতো না, হুইলচেয়ার ব্যবহার করতো, প্রায় শয্যাশায়ী ছিল)। আমার কথা শুনে তুলু হেসে উঠলো। তুলু আজকে আমাদের একমাত্র ছেলে যামীর জন্মদিন। (তুলু ২০১৭, ১৩ মে চলে যাবার দুই মাস পরে ২০১৭, ১৫ জুলাই যামী ওর স্ত্রী টিনা, দুই ছেলে রিহান আর রাইমকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক এ স্থায়ী হওয়ার জন্য চলে যায়)। তুলু আল্লাহ যেন তোমার সব গুণাহ মাফ করে দেন। তোমার সমাধিকে যেন বেহেশতের বাগান করে দেন। তোমাকে যেন জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। আমীন।'
তুলুর সমাধিতে বকুলের নিয়মিত যাওয়া বন্ধ হয়ে গেয়েছিল বেশ কিছু কারণবশত। সম্ভবত ফেব্রুয়ারি ২০২০ তুলুর সমাধির সামনে বকুল শেষবার গিয়েছিল। একে তো বকুলের শরীরে অনেক অক্সিজেন লাগছিল। একটু হাঁটলেই হাঁপিয়ে যেতেন। তখন আবার বনানী কবরস্থানের ভেতরে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছিল। বকুল গাড়িতে বসে তুলুর জন্য দোয়া করতেন এবং সমাধির সামনে যেতে পারছেন না বলে খুবই মন খারাপ করতেন। ১৭ জুলাই ২০২০, বকুল ফেসবুকে তুলুকে লিখছেন, 'তুলু আর কত দিন ঘরে থেকে তোমার জন্য দোআ করবো। তোমার সমাধিতে গিয়ে বসে থেকে দোআ করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু করোনা ভাইরাস এর জন্যে ৫ মাস ধরে গৃহবন্দী।'
৮ আগস্ট ২০২০, বকুলের জ্বর। ১৪ আগস্ট বাসা থেকে হাসপাতালের যাত্রা পথে বকুল সবার অজান্তে পরকালের চিরস্থায়ী জীবনের জন্য বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ১৪ আগস্ট ২০২০ রাত ৩টা ১৯, এভারকেয়ার হাসপাতাল আইসিইউতে বকুল চলে গেলেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়ে গেল। ১৭ আগস্ট ২০২০, ৮৮ বছর পুর্ণ করার ২ দিন আগে ১৫ আগস্ট ২০২০ সালে ৯টা ১০ মিনিটে তুলু চলে যাওয়ার ৩ বছর ৩ মাস পরে বকুল তিন সন্তানকে ছেড়ে অনন্তের পথে চলে গেলেন। একটা অব্যক্ত ভালোবাসার পরিসমাপ্তি ঘটল। তুলুর মতো বনানী কবরস্থানে বকুল চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন!!!
এই গল্পের যুবক বকুল আর যুবতী তুলু অন্য কেউ নয়। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং মরগুবা খাতুনের পুত্র এবং পুত্রবধূ। বকুল আর তুলুর দুই কন্যা যুই, যুথী এবং একমাত্র পুত্র যামীর বাবা মুর্তজা বশীর আর আম্মা আমিনা বশীর!!!
প্রতি বছর তুলুর মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে "আমিনা বশীর স্মৃতি ট্রাস্ট" বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির মাধ্যমে (1) Art of Myanmar, Indonesia, Malaysia, Thailand, Nepal and Sri Lanka, (2) History of Independent Sultans of Bangladesh, (3) Coins of Early Historical Bengal up to 1538 AD, (4) Coins of Rajas of Arakan (1571-1648 AD), (5) Contemporary World Cinema, (6) Modern English Literature: 'Angry Young Man', United Kingdom and 'Beat Generation', United States of America (USA) and (7) Bangladesh: Art and Society) বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করা হবে।
মুর্তজা বশীর বলেছিলেন:
ছোটবেলা থেকে পড়তাম, মানুষ মরণশীল। কিন্তু সেদিন মনে হলো ম্যান ইজ ইমমরটাল। আমাকে ইমমরটাল হতে হবে। এমন কিছু কাজ করতে হবে, যেন আমি মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকি, কিন্তু কীভাবে? সেই থেকেই ছবি আঁকা, লেখালেখি। সৃজনশীল কাজ দিয়ে মৃত্যুর পর বেঁচে থাকতে চাই। কখনো মনে হয় ছবি নয়, হয়তো বাংলার হাবসি সুলতান কিংবা পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরের টেরাকোটা নিয়ে আমার গবেষণাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। কে জানে? শুধু সময় বলে দেবে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর 'ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি' উপন্যাসে বলেছিলেন, মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু কখনোই হারবে না। কিন্তু আমি ঠিক এর উল্টোটাই বিশ্বাস করি, মানুষ হারতে পারে, কিন্তু ধ্বংস হবে না!!!
- লেখক: শিল্পী মুর্তজা বশীরের জ্যেষ্ঠ কন্যা